পরিবর্তন

লোকটির বয়স ষাটের কাছাকাছি। সুন্দর করে ছাঁটা মাথা ভরা সাদা চুল, উন্নত নাক, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ভরা কালো চোখ। দামি ধূসর রঙের স্যুটে তাকে বেশ মানিয়েছে। আমার সঙ্গে তার ব্যবধান অনেক। আমার বয়স তার চেয়ে অর্ধেকেরও কম। এলোমেলো ধূসর চুল, সাধারণ চেহারা। নাকের বিশেষ কোনো আকর্ষণ নেই। তবে আমার চোখে হাসির ঝিলিক আছে। পোশাক অতি সাধারণ—বোতাম খোলা সাদা শার্ট আর নীল রঙের জিন্স। আভিজাত্যের চিহ্ন না থাকলেও এই পোশাক আমার কাছে আরামদায়ক।

তাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে, আমরা দু’জন যুগ যুগ ধরে একে অপরের জানের দুশমন। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছি আমরা। আমাদের চারপাশে লোকটির সাতজন বডিগার্ড ঘিরে আছে। সুঠাম দেহের অধিকারী, বিশ্রী কালো পোশাক পরিহিত এই বডিগার্ডদের দু’জন তার পাশে, দু’জন আমার পাশে, আর তিনজন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। জানালার পাশের তিনজনের দু’জন করে ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সতর্ক পদক্ষেপে চলাফেরা করছে, তবে জানালাটা কখনো ফাঁকা থাকছে না—সবসময় একজন সেখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।

সবার হাতে গুলি ভরা বন্দুক। আমার পাশের একজনের বন্দুক আমার বুকের দিকে তাক করা। সে ট্রিগারে এমনভাবে আঙুল নাড়ছে, মনে হচ্ছে এখনই গুলি ছুড়বে। আমি একটি চেয়ারে বসা, হাত-পা চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা। আমার কাছে কোনো অস্ত্র নেই। ফোন করে কারও সাহায্য চাওয়ার সুযোগও নেই। ইতোমধ্যে তারা আমার দু’জন সহকর্মীকে হত্যা করেছে। আমি বিশ্বাস করছিলাম, আমি বিজয়ী হতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার সহকর্মীরা জীবন বাঁচানোর জন্য আত্মসমর্পণ করেছিল। অস্ত্র ফেলে দু’হাত উপরে তুলতেই তারা অন্যায়ভাবে তাদের হত্যা করেছে। কাপুরুষরা এমনই—দুর্বলের ওপর অত্যাচার করে আনন্দ পায়।

আমি এখন খুব কঠিন সময়ের মুখোমুখি। বৃদ্ধ লোকটির গর্জন শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। তার গর্জন বজ্রপাতের মতো কানে এসে আঘাত করলো:

“খবরদার! কোনো চালাকি করার চেষ্টা করো না। তুমি যদি স্বেচ্ছায় আমাদের পথ অনুসরণ না করো, কিভাবে তোমাকে বাধ্য করতে হয়, তা আমরা জানি। কোনো প্যাঁচ খেললে পরিণতি হবে খুব খারাপ। আমি আমার লোকদের আদেশ দেবো গুলি করে তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দিতে।”

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বন্দুকধারীদের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। তারা সবাই আমার মাথার দিকে বন্দুক তাক করলো। লোকটি মুচকি হেসে বলল,

“এই বাচ্চা ছেলে, ভয় পেয়ো না। এখনই তোমাকে হত্যা করার প্রয়োজন নেই। তোমাকে ছেড়ে দেবো, তবে তোমাকে অবশ্যই গোপন বিষয়গুলো বলতে হবে। আমরা জানি, তোমরা রূপ পরিবর্তন করতে পারো। আমাদের গোয়েন্দারা আমাকে জানিয়েছে, তোমরা সুযোগ পেলেই অন্য রূপ ধারণ করো। কিভাবে এটা করো, তা আমাদের জানাতে হবে। আমার সামনে তোমাকে নিজের রূপ পরিবর্তন করে দেখাতে হবে। দেখো, তোমার পেছনে খোলা মাঠ আছে। তুমি পালিয়ে যেতে পারো। আমাকে বলো, তুমি ঘোড়া, ব্যাঙ, না কি খরগোশ হয়ে পালাবে?”

আমি বুঝতে পারলাম, কোথাও একটা ভুল হয়েছে। তার গোয়েন্দারা ভুল তথ্য দিয়েছে। হয় তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য দিয়েছে, অথবা বন থেকে সাপ বা অন্য কোনো প্রাণী পালানোর শব্দ শুনে তারা মনে করেছে আমরা রূপ পরিবর্তন করে পালিয়েছি।

লোকটি হেসে উঠল, “সৌভাগ্যবশত, এবার আমরা সফল হয়েছি। তোমরা আমাদের ফাঁদে পড়েছো। আমরা জানি, কিভাবে তোমরা ফাঁদে পড়েছো। তবে এটুকু শিকার আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়।” সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

আমি পাথুরে পথে চলতে গিয়ে পা ফসকে ফাঁদে পড়েছি। তবে আমার বিশ্বাস ছিল, কেউ না কেউ আমাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসবে। আমার জন্য পাতা ফাঁদ আসলে লোকটির জন্যও ফাঁদে পরিণত হয়েছে। অবশেষে তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলো।

লোকটি গর্জে উঠল, “অনেক হয়েছে! আমাদের জন্য এটাই যথেষ্ট। কিভাবে তুমি তোমার রূপ পরিবর্তন করো? কী সেই চালাকি?”

আমি চুপ করে থাকলাম। সে আমার হাতে থাকা আংটিটির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই আংটিটি কি আমি পরতে পারি?”

তার পোষা গুন্ডারা আমাকে আঘাত করে, জোর করে তা ছিনিয়ে নিল। তারা লোকটির মতোই রুক্ষ আচরণ করল। আংটিটি তার হাতে তুলে দিল। লোকটি তা গভীরভাবে পরীক্ষা করল। প্লাটিনামের ওপর বসানো বড় রুবিটা রহস্যময় মনে হলো তার কাছে।

“এই বাচ্চা ছেলে, বলো, এটা কিভাবে কাজ করে? কিভাবে এটা ব্যবহার করতে হয়?”

সে রুবিটি নিয়ে খেলতে লাগল, আর আমি তার সঙ্গে খেলা শুরু করলাম। হঠাৎ সে চিৎকার করে বলল, “তুমি নিজেকে খুব চালাক ভাবছো, তাই না? আমি আর তোমার সাথে খেলতে চাই না!”

কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি নিজেকে একটা মাছি ভাবতে শুরু করলাম। আমার বাঁধন আলগা হয়ে গেল। আমি তখন মাছি, আর আমার আশেপাশের ৩০ ফুট আমার রাজত্ব।

তার লোকেরা আমাকে ধাওয়া করল, কিন্তু আমি তখন বিশাল এক বাবুন হয়ে গিয়েছি। এক লাফে লোকটির পায়ে দাঁত বসিয়ে দিলাম। গুন্ডারা কিছু করার আগেই আমি তাকে খতম করলাম। সে যখন রুবি নিয়ে খেলছিল, আমি তখন খেলছিলাম তার সঙ্গে। তারপর আমি নেকড়ে হয়ে শত্রুদের গলায় থাবা বসালাম। কিন্তু দরজার দিক থেকে আরও শত্রু আসতে দেখে আমি বিশাল হাতি হয়ে গেলাম, জানালা ভেঙে রাস্তায় লাফিয়ে পড়লাম। আমার পায়ের নিচে কতজন মারা গেল, তা জানি না।

চারদিক থেকে চাপ বাড়তে থাকল। আমি কাক হয়ে উড়লাম, কিন্তু এক ঝাঁক কাক আমার পেছনে ধাওয়া করল। আমি আতঙ্কিত বিড়াল হয়ে শহরের গলিতে নামলাম, তাতেও স্বস্তি পেলাম না। অবশেষে নিজেকে কুকুর করে গলিপথে গেলাম।

এভাবেই আমি বারবার রূপ পরিবর্তন করছি, একের পর এক অন্যায় প্রত্যক্ষ করছি। এখন আমি আগুন-চোখের এক পাখি, একা উড়ে বেড়াই। অন্যায় দেখি, ঘৃণার আগুন চোখে রাখি।

 

অভ্যাস

কবরস্থানের রহস্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *