ভৌতিক গল্প…অতল অন্ধকার…

‘ তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, মাঝখানের স্মৃতিটা আপনি ভুলে গিয়েছিলেন?ওটা মানে অশরিরী জিনিসটা এসে আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাইছে যে আপনি ঠিক কি ভুলে গিয়েছেন?গল্পটা বেশ রোমাঞ্চকর।’ কফির মগে লম্বা চুমুক দিয়ে জানতে চাইলেন প্রফেসর বোস। ‘এটা গল্প নয় স্যার,এটা সত্য ঘটনা।’ বেশ জোর দিয়ে বললো তার সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকা লোকটা।তাকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিলো।

‘আরে বাবু,কোনো গল্পের ঘটনা যে সত্যি হতে পারেনা সেটা তো কেউ বলেনি তাইনা?সত্য হোক মিথ্যা হোক যাই হোক আপনাকে তো সেটা গল্পের মতোই বলতে হবে! নাকি?’আশ্বাসের স্বরে বললেন মিঃবোস। রফিক আর কথা বাড়ালো না,শেষ চুমুক কফিটা পান করে বলতে শুরু করলো, ‘ভৌমিক বাবু আমাকে কি বলেছিলেন আমার তা ষ্পষ্ট মনে পড়েনা,শুধু আবছা একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে,আমরা নীলাচল যাচ্ছি।গাড়িতে কৃষ্ণা চ্যাটার্জীর গাওয়া অতুলপ্রসাদের “মিছে তুই ভাবিস মন”, গানটা বাজছে,খাড়া একটা রাস্তা বেয়ে গাড়িটা উঠতে যাচ্ছে তখন…!তারপর কিছুক্ষন মাথাটা ফাঁকা।আবার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে,ভৌমিক বাবু স্টিয়ারিং হুইল ছেড়ে আমার হাত ধরে বলছেন,’আমার কথাটা তুমি রেখো রফিক,আমি জানি তুমি পারবে।’তারপর গাড়ি থেকে আমাকে ঠেলে ফেলে দেয়া পর্যন্ত…!…প্রচন্ড শব্দ…! আর কিছু মনে পড়েনা।
মাথায় যন্ত্রনা হয়। আমার জ্ঞান ফেরে সন্ধ্যায়, জানতে পারি তিনদিন আই সি ইউতে ছিলাম,কোমায়!যতোটুকু বললাম ঠিক ততোটুকুই মনে করতে পারছিলাম,এর বাইরে কিছু ভাবতে বা মনে করতে পারছিলাম না আমি।এই দুর্ঘটনা অথবা আমার ক্ষনস্থায়ী কোমা আমার শুধু একটুকরো স্মৃতিই কেনো কেড়ে নিল সেটা বুঝতে পারছিলাম না।তাছাড়া সবচে বড় যে ব্যাপার,আমার শরীরে কিছু যায়গায় ছিলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো আঘাত ছিলোনা শরীরে।তাহলে আমি কেনো কোমায় চলে গেলাম?

ডাক্তাররা বললেন,’দুর্ঘটনার আগে চেপে বসা প্রচন্ড মানসিক চাপ থেকে এটা হতে পারে,নিউরনের যে ভাগে এই স্মৃতিটা সংরক্ষিত আছে মস্তিস্ক সে যায়গাটা অবশ করে রেখে দিতে চাইছে,সে চায়না যে এই ভয়ানক স্মৃতি তার মনে পড়ুক।মানব মস্তিস্ক রহস্যময় বস্ত।সম্পূর্ন কিছু ছাপিয়ে এর নিজস্ব একটা স্বত্তা আছে।যা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে।’ আমার কেনো জানিনা খুব অস্বস্তি লাগছিলো,ভৌমিক সাহেব আমাকে কিসের কথা বলতে চাইছিলেন?উনি তো নিঃসঙ্গ চীরকুমার মানুষ, নির্বিরোধী।কি এমন হয়ে থাকতে পারে?
ক্লিনিক থেকে ছাড়া পাবার পর বাসায় ফিরলাম মাথায় ভোতা যন্ত্রনা নিয়ে।ঘনঘন টানে হঠাৎ করে কড়া সিগারেট টানলে মাথায় যেমন ঝিমঝিমে একটা ভাব আসে তেমন। বান্দরবন থেকে সিলেটে আসা লম্বা ভ্রমনের ক্লান্তি ছাপিয়ে ওই বাক্যটা বারবার ফিরে আসছিলো মাথার ভেতর,”আমার কথাটা তুমি রেখো রফিক…” কি এমন কথা? কি নিয়ে? চিন্তাটা দীর্ঘায়িত হয়না,মাথা ছিড়ে যেতে চায়।
সে রাতে এক গ্লাস গরম দুধ খেয়ে আমি ঘুমিয়ে পরি,সেই ঘুম যে ঘুমে চেতনারা স্বাধীন হয়ে ঘুরে বেড়ায়,কখনো কখনো চলে যায় মৃতদের জগতে। গভীর ঘুম। তখন আমি স্বপ্নটা দেখি, অন্ধকার,অনেক অনেক অন্ধকার,অদ্ভুত অন্ধকার,পৃথিবীর অন্ধকারের সাথে এর মিল নেই।একসময় আমি একটা আলোর বিন্দু দেখতে পাই,ক্ষুদ্র অথচ অনেক স্পষ্ট,এগিয়ে আসছে,ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে ঘুরতে ঘুরতে।একসময় বিশাল বিস্ফোরন, কিন্ত নিঃশব্দ, চারদিকে আলো,কুয়াশা ঢাকা আলো।তারপর আমি নিজেকে আমার রুমে আবিস্কার করি,জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি,লাল পর্দাটা দোলছে,টেবিলল্যাম্পটা ডিম করা, আমার ঘুমন্ত দেহটা খাটের উপর ঘুমুচ্ছে,নাইট গাউনটা ভিজে যাচ্ছে ঘামে,দ্রুত নিঃশ্বাসে উঠা নামা করছে বুক। হঠাৎ আমার জানালাটা ভরে উঠে আলোয়,অদ্ভুত তীব্র আলো ছড়িয়ে পড়ে ঘরে কিন্ত চোখ ধাঁধিয়ে যায়না।

ঠিক তখন আমি দেখতে পাই আকাশের পূর্ব কোনে একটা আবছা ছায়ামূর্তি, ধীরে ধীরে নেমে আসছে। একসময় তা সামনে এসে দাঁড়াতেই বুঝতে পারি ছায়ামূর্তিটা ভৌমিক বাবুর।অনেক বিমর্ষ, ক্লান্ত,বিদ্ধস্ত।শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি অথবা আমার শরীরের বাইরে থাকা চেতনা তখন ভয় পেয়ে যাই।একটা অস্থির অনুভুতি জাগে যা দীর্ঘস্থায়ী হয়না। নিজেকে আবিস্কার করি বিছানায়,ঘেমে নেয়ে একাকার,গলা শুকিয়ে কাঠ,দরজায় ধুপধাপ আওয়াজ আর মায়ের একটানা চিৎকার, এই রফিক দরজা খোল,দরজা খোল বাবা! আমি তরিঘরি করে দরজা খুলে দিই,মা জিজ্ঞেস করেন,’কি হয়েছে !চিৎকার করছিলি কেনো?’ আমি অবাক হলাম,আমি চিৎকার করছিলাম?
মাকে বললাম,’কিছু না মা।দুঃস্বপ্ন।তুমি ঘুমাওগে যাও।’ মাকে চিন্তিত দেখায়!মা বলেন,’আমি কি যেনো দেখলাম,একটা শব্দ শোনে আমার ঘুম ভাঙে। ঘুম ভেঙে দেখি তোর ঘরের ভেন্টিলেটর আর দরজার নিচ থেকে তীব্র আলো বেরিয়ে আসছে,তুই চিৎকার করছিস।আমি ভাবলাম আগুন টাগুন…আল্লাহ্‌ না করুক। আচ্ছা যাই হোক,আল্লাহ্‌ ‘র নাম নিয়ে ঘুমিয়ে পর বাবা।’
মা’র কথায় খটকা লাগে,স্বপ্নের সাথে কেমন যেনো মিলে যায় কথাগুলো।মাথার যন্ত্রনাটা প্রকট হয়ে ফিরে আসে।দরজা বন্ধ করে শুতে যাবো তখন শুনতে পাই শব্দটা! দক্ষিনের জানালা দিয়ে প্রচন্ড বাতাসের শো শো শব্দ,অথচ বাইরে বাতাস নেই।জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম,না বাতাস বইছে এমন কোনো শরীর জুড়ানো অনুভুতি নেই।বরং গোমট একটা ভাব ঘরজুড়ে।শুধু শব্দটা শোনা যাচ্ছে।

 

আর তখনই দেখলাম, আমার বিছানার উপর ভৌমিক বাবুর রক্তাক্ত লাশ।চোখগুলো আধখোলা হয়ে যেনো আমার দিকেই চেয়ে আছে।বাঁ হাতটা বাহুর নিচ থেকে ছিলে খাটের তলায় এসে গড়াগড়ি দিচ্ছে,পেটের দিক থেকে কিছুটা মাংস নেই,ওখান থেকে নাড়িভুঁড়ির আদলগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো,নাকটা থেতলে গেছে,চুয়ে চুয়ে রক্ত পরছে কানের পাশ থেকে।মুহূর্তের মধ্যে আমার ঘরটা রক্তে সয়লাব হয়ে গেলো।আমি আতংকে অস্থির হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম,ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো কিন্ত অনুভব করলাম মাথার সেই ভোঁতা যন্ত্রনাটা আর নেই।কিন্ত বুকের পাশে হৃদপিন্ডের কাছাকাছি প্রচন্ড ব্যাথা।
আমি বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখলাম ভৌমিক বাবুর লাশটা নড়ে উঠছে,আমি চিৎকার দিতে চাইলাম,ইচ্ছে হলো চিৎকার দিয়ে মাকে ডাকি,মা মা গো আমায় বাঁচাও মা! গলা দিয়ে হালকা বাতাস বের হয়ে এলেও শব্দ হলোনা। ভৌমিক বাবুর লাশটা তখন উঠে বসে পেট থেকে খসে পড়া ভুঁড়িগুলো আবার ভেতরে ঠেসে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো,’বড় যন্ত্রনা রফিক,খুব যন্ত্রনা,তুমি আমার কথাটা রাখো,তুমি পারবে…” ভৌমিক বাবু তার হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেন,আঙুলগুলো মাংসহীন কংকাল।

চোখগুলো বাইরে এসে দুলছে,কোটরে অজস্র পোকা কিলবিল করছে। আমি শেষবার “মা”বলে চিৎকার দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম।সম্ভবত হার্ট এটাক।আমি আমার মৃতদেহটাকে জানালার পাশে দেয়াল ঘেষে পড়ে থাকতে দেখলাম।নিজের প্রতি আমার খুব মায়া হলো” এতোক্ষন মাথা নিচু করে বলে যাচ্ছিলো লোকটা,মিঃবোস অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি মৃত?আপনার প্রলাপ সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে’ আর তখনি মাথা তুলে সরাসরি মিঃ বোসের দিকে তাকালো লোকটা, কোটরে চোখ নেই,অতল অন্ধকারের মতো শুন্যতা। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।যে হাসির অর্থ অন্ধকার,মিথ্যা,মৃত্যু অথবা শুধুই ভয়।

কে, ওখানে.?

এক রাতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *