পেন্সিলে লেখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-২)

অনেক বাবারা তাদের সন্তানের কাছে কোনো লিখা উইল আকারে রেখে গেলে তাদের লিখনির শুরুতে নানান নাটকীয় কথা লিখে থাকেন। যেমন, ‘ এই লিখাটি যখন তুমি পড়বে, হয়ত তখন আমি তোমার থেকে অ…নে…ক দূরে’- এই টাইপের।

আমি তোমার জন্য সেরকম কিছু লিখলাম না। তোমার দাদুর মাধ্যমে এতোদিন পরে তোমার কাছে এই ডায়েরীটা এই জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম, আজ তোমার বুঝবার ক্ষমতা যতটুকু হয়েছে, আরো আগে ততটুকু ছিল না। এই ডায়েরির গুরুত্ব আজ তোমার কাছে যতটুকু, আরো আগে তেমনটা থাকত না। বয়সের একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে তুমি পৌঁছার পরে যেন এটা তোমার হাতে আসে, আমি সেই ব্যবস্থাই করেছিলাম।

ব্যাপারটার ভিতরে একটু হয়ত নাটকীয়তার পরশ রয়েই গেল! তবে তা তো হতেই পারে, কারণ আমাদের জীবনটাই তো একটা নাট্যমঞ্চ। সেখানে আমরা সবাই এক একজন অভিনেতা।

আমার বাবু!

তোমার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, আমি কখন মারা যাব, সেটা তো আমার জানার কথা নয়। হ্যা, এটা একটা সার্বজনীন ব্যাপার। কেউ আগে থেকে জানতে পারে না। মানুষের জীবন বড্ড অনিশ্চিত। তাই আমি আমার হৃদয়ের অনুভূতিগুলো আগেই অক্ষরে রুপ দিয়ে রেখেছিলাম।

কোথা থেকে শুরু করবো?

অনেক ভাবলাম।

শেষে কোনো চিন্তা ভাবনা না করেই লিখা শুরু করলাম। লিখতে লিখতে কলম (আসলে হবে পেন্সিল) যেদিকে নিয়ে যায়! তারপরও চেষ্টা করছি একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ণ অনুসরণ করতে। লিখাগুলো তুমি একটানা না পড়ে ধীরে ধীরে পড়তে পার। আমার এই লিখায় আমার সমসাময়িক প্রেক্ষাপট উঠে আসবে… কিছু রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার নিরিখে টুকরো আলোচনা চলে আসতে পারে। তোমার এই বাবার অনেক না পাওয়ার বেদনা… কষ্টে নীল হতে হতে নীলাভ বর্ণ ধারণ করা আমার সেই সময়ের অনুভূতি জানতে পারবে। এসব কিছু মিলিয়ে তোমার চিরচেনা সেই বাবার সাথে সাথে নতুন এক অচেনা বাবাকেও তুমি পাবে আশাকরি।

আর একটা কথা, আমার এই লিখা সম্পুর্ণ আমার নিজস্ব অভিমত। তোমাকে যে এই মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হতে হবে, ঘুণাক্ষরেও সেটা তোমার হৃদয়ে স্থান দিবে না।

নিজে নিজের মত করে মানুষ হতে চেষ্টা কর।

যেহেতু এটি একটি ডায়েরি, তাই সেভাবেই দিনপঞ্জি আকারে লিখা উচিত ছিল। কিন্তু সেদিকে গেলাম না।

আমার জীবনের শিশুবেলার একেবারে প্রথম স্মৃতিটি কি ছিল? প্রতিটি মানূষ চোখ বুজে বা চোখ খোলা রেখে নিজ নিজ শৈশবের কথা চিন্তা করলে, একেবারে প্রথম কোন ঘটনাটি মনে পড়ে? তুমি নিজের প্রথম স্মৃতিটি এই মুহুর্তে চিন্তা করে দেখতে পারো।

কি? কোন স্মৃতিটি মনে পড়ল?

মিথিলা বাবু!

আমি তোমার পাশে না থেকেও এই লিখার দ্বারা সাথে রয়েছি। মন খারাপ কর না। এই পৃথিবীতে যতদিন থাকবে, আনন্দে থাকবার চেষ্টা করবে। জীবনটা একটা গতি। আনন্দ সেই গতিময়তা ধরে রাখার জ্বালানি।

যা বলছিলাম, প্রথম স্মৃতির ব্যাপারটিতে ছিলাম, তাই না বাবা?

শুনেছি এল এস ডি নামের এক ধরণের ড্রাগ নিলে নাকি মায়ের গর্ভের কথাও মনে পড়ে যায়। এ দেশে এই ড্রাগ পাওয়া গেলে আমি একটু নিয়ে আমার ব্রেইনের লুক্কায়িত ঝিল্লিগুলোতে পর্দার আড়ালে থেকে যাওয়া আমার মধুর শৈশবের সেই সব মাদকতাময় হারানো সময়কে দেখতে চাইতাম। তবে নিজের হারানো সময়কে পাবার জন্য এই জীবন ধবংসকারী মাদক গ্রহন করাটাও ঠিক নয়।

আমি চিন্তা করে দেখলাম, আমার একেবারে মনে পড়ে এমন প্রথম স্মৃতি কোনটি।

স্মৃতি মিনারে একেবারে চূড়ায় যেটি দৃশ্যমান, তা হল- আমি আমার নানাবাড়িতে নানার পাশে শুয়ে আছি। তখনো ফজরের আজান হয় নাই। পাশের রুমে তোমার দাদু মানে আমার আম্মা প্রসব বেদনায় ছটফট করছেন। তখন কি আম্মার এই যন্ত্রণার স্বরূপ অনুধাবন করতে পেরেছিলাম? অন্ধকার ঐ রুমটিতে আমার নানী, দাই মা ভানু এবং আরো কারা যেন ছিলেন। যন্ত্রনাকাতর আম্মার অনুভূতি শিশু এই আমার কাছে কেমন অপার্থিব লেগেছিল। কিছুক্ষণ পরে ফজরের আজান হয়ে গেল। সেই সাথে এক নবজাতকের চীৎকার নতুন এক মানবের এই পৃথিবীতে আগমনী বার্তা জানিয়ে দিলো। সেই শিশুটি হল তোমার মেজ চাচা।

আর একটি স্মৃতি মনে পড়ে।

আমি আমার নানা ভাইয়ের কোলে। খালের পাড়ে আমরা সবাই লঞ্চের অপেক্ষায় রয়েছি। আব্বা শহরে যাবেন। লঞ্চ এলো। আব্বা লঞ্চে উঠে গেছেন। আমি নানা ভাইয়ের কোলে বসে খুব কাঁদছি। কিন্তু আমাকে না নিয়েই শেষ পর্যন্ত লঞ্চটি চলে গেল। সাথে আব্বাও।

এতো গেল নানাবাড়ির স্মৃতি। এরকম আরো অনেক রয়েছে। সেগুলো যদি সব লিখতে যাই, তবে তো সাড়ে সাত শো পাতার এক বিশাল উপন্যাসই হয়ে যাবে। তাই সেদিকে গেলাম না। তবে এই স্মৃতি এবং শৈশব- এগুলো খুব যত্ন করে আমাদের মনের মণিকোঠায় অবস্থান করে। জীবনে চলার পথে আমাদেরকে বিভিন্ন বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তখন অবস্থার প্রেক্ষিতে আমরা প্রায়ই দিশেহারা হয়ে পড়ি। তখন এই সাময়িক বিবশ অবস্থা থেকে নিজেদেরকে রিফ্রেস করতে প্রয়োজন হয় কিছু নির্ভেজাল আনন্দময় স্মৃতি। আর শৈশবের থেকে মনকে সতেজ করার মত এত আনন্দঘন মুহুর্ত মনে হয় না জীবনের অন্য কোনো পর্যায়ে রয়েছে।

এই স্মৃতির কথাটা এজন্যই উল্লেখ করছি, তোমার জীবনেও চলার পথে অনেক ঘাত প্রতিঘাত আসবে… মন খারাপ হবে… তখন আমি হয়ত থাকব না। তাই এই সব বিব্রতকর মুহুর্তগুলোতে নিজেকে তোমার সেই শৈশবের স্মৃতিময় মুহুর্তে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। চিন্তার গভীর টানেল ধরে স্মৃতিদের শান্ত নির্জন এক জলাশয়ের পাশে নিজেকে কল্পনা করবে। সেখানে বাতাস শান্ত জলের উপরে মৃদু ঢেউয়ের সৃষ্টি করছে… সবুজ বনানীর পাশের এই জলাশয় তোমার ভালোলাগা স্মৃতিদের আঁধার। জীবনের ঐ সব রুক্ষ্ণ মুহুর্তগুলোতে তুমি সেই জলাশয়ে অবগাহন করে ভালোলাগাময় সময়কে তুলে আনবে। এতেই হৃদয়ের প্রশান্তি আসবে।

মিথিলা বাবু!

এই বাবা তোমার জন্য সবসময়েই পাশে আছে মনে করবে। জীবন চলার বন্ধুর পথে হোচট খেলেও বার বার উঠে দাঁড়াবে। থামবে না। চলাই জীবন… আর জীবনের জন্যই চলতে হয়।

(ক্রমশঃ)

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!