প্যারানরমাল

আপনারা প্যারানরমালে বিশ্বাস করেন? আমি করি। আমি কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না, কিন্তু দেখার বাইরেও যে প্যারালাল আরেকটা জগত আছে, মানুষের জীবনের ওপর অদৃশ্য কিছু প্রভাবক আছে তা মানি।
এই প্রবল বিশ্বাসের কারনেই মনে হয় মাঝে মধ্যে অদ্ভুত কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়। মামার মৃত্যু নিয়েও হয়েছে।
চোখের সামনে খুব কাছের কারও ক্যানসারে মৃত্যু আমি দেখিনি। মামাকেই প্রথম দেখলাম।
আক্ষরিকভাবে একদম আমাদের চোখের সামনে মামা মারা গেল। মামার অবস্থা খুব দ্রুত খারাপ হচ্ছিলো, কিন্তু মারা যাচ্ছে এটা আমি মে মাসের শুরুর দিকেও কেউ বললে বিশ্বাস করতাম না।
আমার একটা প্রবল দুরাশা ছিল মামা সেরে উঠবে, আবার সুস্থ হবে, বিশ্বাসের কারণ যাই হোক না কেন।
কিন্তু ঠিক ঐ সময়টাতে আমি একরাতে একটা স্বপ্ন দেখলাম যে মামা বেঁচে নেই।
স্বপ্নে কি দেখেছিলাম ঘুম থেকে উঠে আমার কিচ্ছু মনে পড়ছিল না, শুধু এটা মনে ছিল যে স্বপ্নের থিমটা হচ্ছে মামা আর নেই।
অনেকে বলবে ওরকম সময়ে অমন স্বপ্ন দেখা খুবই স্বাভাবিক; নিতান্তই কাকতালীয় ঘটনা। ঠিক, আমিও তা মানি।
কিন্তু এখানে পার্থক্য হচ্ছে নানার মৃত্যুর সময় থেকে এখন পর্যন্ত আমি যখনই কারো মৃত্যু নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, সেটা সত্যি হয়েছে।
এবং এর সবগুলাই ছিল কাছের মানুষদের নিয়ে, আমার প্রিয় মানুষদের নিয়ে। যাই হোক, ঘুম থেকে উঠে মনটা খুব বেশি খারাপ হয়ে গেল।
আমি ওই প্রথম বুঝে গেলাম মামা আর বাঁচবে না। সময় হয়ে গেছে। এখানে একটা কথা বলে নেই।
আমি গত বছর মাঝামাঝি সময়েই আরেকটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, মামা খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে।
এটার কথা আমার মনে পড়েছে গত ২০ মে (মামার মৃত্যুদিন) এর পরে।
এটার কথা এর আগে হয় মনে পড়েনি, বা পড়লেও রিলেট করতে পারিনি। যাই হোক, তৃতীয় ঘটনাটা ঘটলো মামা মারা যাবার ঠিক সপ্তাহ খানেক আগে। এবারও স্বপ্ন।
এবার পরিষ্কার দেখলাম মামা মারা গেছে।
মামার দেহ মগবাজারে নানার বাসার দোতলায় ডাইনিং রুমের মেঝেতে রাখা, নানি মামার পায়ের কাছে একটা চেয়ারে বসা, আর নানা তার পুরানো ঘরে বিছানার ওপর জায়নামাজে চোখ বন্ধ করে বসে আছে; বেঁচে থাকতে ঠিক যেভাবে বসে থেকে নামাজ পড়তো! স্বপ্নের মধ্যেই আমার মনে হচ্ছিলো নানা যেন তার প্রিয় ছেলের জন্য দোয়া করতে ওপার থেকে চলে এসেছে।
এবং এখন সে তার ছোট ছেলেকে নিরাপদে নিয়ে চলে যাবে। যে রাতে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মামা আইসিইউ তে গেল সেদিন না কি মামার খুব ডেলিরিয়াম হচ্ছিলো।
পায়ের কাছে মামা নানার ছবি দেখেছিলো; মামিকে বলেছিলো “আব্বাকে দেখছি পায়ের কাছে। আব্বার ছবি। সরায় রাখো। আমার পায়ে লাগবে।“ আমার স্বপ্নের সাথে মামার ডেলিরিয়ামের ধরনটা একটু বেশি কাকতালীয় হয়ে গেল না? এবার শেষ ঘটনা।
১৮ মে আমি অফিস থেকে ফেরার পথে স্কয়ারে গেলাম। ১৪০৭ এ গিয়ে দেখি রুমে পুশা-শামা (মামার দুই ভাতিজি, আমার বড়-মামাতো বোনেরা), মামি, নানি, মামার বড়ছেলে, এরা আছে।
মামা যেন একটু অস্থির, একটু পর পর রুমের এক কোন থেকে আরেক কোনের দিকে তাকাচ্ছে।
আর নিঃশব্দে কি যেন একটা বিড়বিড় করে বলছে। প্রথমে ডেলিরিয়াম মনে হয়েছিলো।
পরে ভালো করে খেয়াল করে দেখি পুরোপুরি সচেতন, ঘোরের কোন চিহ্নও নেই; আমার তখন মনে হল মামা কোন দোয়া/সুরা পড়ছে।
খানিকক্ষণ পরে মামিকে কি যেন একটা বলার চেষ্টা করলো ফিসফিস করে, কিন্তু মামি বুঝতে পারলো না দেখে ঐ অবস্থাতেই একটা নিরুপায় করুন হাসি দিয়ে হাল ছেড়ে দিলো।
শ্বাসকষ্ট ছিলো। আমি আর থাকতে পারলাম না। উঠে পড়লাম।
বেডের হাতলে রাখা মামার হাতের ওপর হাত বুলিয়ে দেয়াতে আমার দিকে তাকাল।
কিছু বোঝার আগেই আমার মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল, “মামা, গেলাম। আবার পরে আসবো। খোদা হাফেজ।” মামা ঘাড় ঘুরিয়ে হাত নেড়ে বিদায় দিলো।
কথা বলার চেষ্টা করে নি। মামার সাথে ঐটাই আমার শেষ কথা, বেঁচে থাকা অবস্থায় শেষ দেখা। এর ঘণ্টা দুয়েক পরেই প্রথম কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। দেন আইসিইউ।
এখানে বলি, কারো কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় আমার মুদ্রাদোষ হচ্ছে সবসময় “ওকে তাহলে, দেখা হবে” বলে কথা শেষ করা। একদম সবসময়! “খোদা হাফেজ” আমি খুব রেয়ারলি বলি।
বিদায় নিয়ে বের হবার পরে আমার মনে হল “পরে আসবো” কথাটা কেন বললাম? একটু চিন্তা নিয়েই বাসায় ফিরলাম।
বাসায় ফিরে শাওয়ার নিয়ে ঠান্ডা হচ্ছি, একটু পরেই নানির ফোন।
কান্নাজড়ানো কণ্ঠ ভেসে আসলো, “রাতুল, তোর মামা আর নাই! শীগগির আয়!” আমি আম্মাকে নিয়ে সাথে সাথে আবার স্কয়ারের দিকে রওনা দিলাম, ঐ রাতেই। অর্থাৎ মামাকে যা বলে বিদায় নিয়েছিলাম।
এবার শুধু পার্থক্যটা ছিল, মামা আর পৃথিবীতে নেই এটা জেনে। কিন্তু শেষ ঘটনাটা এটা না।
শেষ ঘটনাটা কি ছিলো সেটা এবার বলবো। মামা আইসিইউ তে যায় ১৮ মে রাতে। সারারাত আমরা অনেক মানুষ জেগে/হাফ জেগে আইসিইউ করিডরের সামনে কাটালাম।
এটা জানা হয়ে গিয়েছিলো মামার বাঁচার আর কোন আশা নেই। ১৯ তারিখ দিনের বেলা ডিসিশন হল বড়মামা এসে (২১ তারিখে) যদি ভেন্টিলেশন খুলে নেয়ার ডিসিশন নিতে হয়, নিবে।
সে কথামত সবাই ধরে নিল ২১ মে সকাল পর্যন্ত মামা ভেন্টিলেশন মেশিন দিয়ে হলেও বেঁচে আছে।
তাই সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম ১৯ তারিখ রাতে ইমেডিয়েট ফ্যামিলি ছাড়া হাসপাতালে আর কারো থাকার দরকার নেই। থাকবে শুধু মামি, মামির ভাবি, আর আমার আম্মার মামাতো বোন চুমকি খালা।
আমার নিজেরও থাকার কথা ছিল না। রাত ১২টা বাজে বাজে এমন সময় মনে হল থেকেই যাই। অ্যাট লিস্ট একজন পুরুষ আত্মীয় রাতে থাকুক।
আমি জানতাম না একটু পরে আম্মার মামাত ভাই রাজিব মামাও আসবে।
আমি হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে হাল্কা ডিনার নিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরের রিসেপশনের সামনে থাকা অনেকগুলা সোফার একটাতে আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
তখন রাত প্রায় পৌনে একটা। জানিও না কখন রাজিব মামা এসে উপরে গিয়ে মামিদের আইসিইউ-এর দরজার সামনে থেকে ডানদিকে একটু ভিতরে একটা প্যাসেজের কোনায় শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছে।
ওখান থেকে আইসিইউ দেখা যায় না, আইসিইউ থেকে নার্স এসে রোগীর অ্যাটেনডেন্টকে খুঁজলে কাউকে দেখতে পাবে না।
ভোর ঠিক সাড়ে চারটার দিকে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। জেগে দেখি আমি ঠাণ্ডায় কাঁপছি।
জ্বর, কাশি, সর্দি, কিচ্ছু না; কিন্তু দাঁতকপাটি লেগে যাচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো শরীরের সব রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে, এত ঠাণ্ডা! নরমালি আমার এত ঠাণ্ডা লাগে না।
তাকিয়ে দেখি আশে পাশে অনেক মানুষ আমার মতই ওখানে থাকা সোফাগুলায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে।
আমি ছাড়া কারো মধ্যে ঠান্ডাজনিত বিন্দুমাত্র অস্বস্তির ভাব নেই। এখানে আরেকটা কথা বলি, আমি এভারেজের চেয়ে বেশি ঘামি, যত ঠান্ডাই হোক; এসির মধ্যে আমার কখোনও তেমন প্রব্লেম হয় না।
যাই হোক, ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আমি রিসেপশন করিডর থেকে লিফটের উইং-এ আসলাম। ঠাণ্ডা কমে গেল।
পিছনে তাকিয়ে দেখি রাজিব মামাও ঘুম ভেঙ্গে উঠে এগিয়ে আসছে। লিফটে উঠে দুইজনে লেভেল ফোরে আইসিইউ-তে চলে আসলাম।
এসে দেখি গোটা করিডরে মাত্র একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন (মামিরা তো আগেই বলেছি একটু ভিতরের দিকে ছিল)! এছাড়া গোটা ফ্লোরে আইসিইউ-র সামনে একটা মানুষ নেই।
অথচ আগের দিনেই দেখেছিলাম আমরা ছাড়াও অন্যান্য রোগীর বেশ কিছু আত্মীয়-স্বজনেরা আছে।
যাই হোক, আগে থেকে এনে রাখা একটা কম্বলে নিজেদের ঢেকে আমি আর রাজিব মামা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আবার ঘুমিয়ে গেলাম। ঠিক আধা ঘণ্টা পরে (ভোর পাঁচটা) আমার ঘুম আবার ভেঙ্গে গেল।
দেখি আইসিইউ থেকে একজন মেল নার্স বের হয়ে আসছে।
বের হয়ে বলল “বেড#১৩ এর কে আছেন?” আমার মাথার মধ্যে কেউ যেন বলে দিলো, মামার বেড নম্বরই ১৩! আমি ধড়মড় করে উঠে রাজিব মামাকে বললাম “মামিকে ডাকেন।
বলেন ভিতর থেকে ডাকতে আসছে!” আমার ভুল হয়নি।
রাজিব মামা মামিকে ডাক দেয়াতে মামি জেগে উঠে তাড়াহুড়া করে ভিতরে গেল। স্বাতী মামি উঠে দোয়া দরূদ পড়ছে। কিন্তু ততক্ষণে মামা নেই।
মামি একটু পরে বাইরে এসে দেয়াল ধরে তার সদ্যমৃত স্বামীর জন্য কেঁদে উঠলো।
পরে ডাক্তারের মুখে শুনেছিলাম মামার দ্বিতীয় অ্যারেস্টটা হয় ভোর ৪ টায়, আর শেষবারটা হয় ভোর সাড়ে ৪টায়, মানে গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকা অবস্থায় ঠিক যখন প্রবল ঠাণ্ডায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
এখন আমার কথা হচ্ছে; ডাক্তারের সময় অনুযায়ি মামাকে যখন প্রোনাউন্স করা হলো (ভোর ৫টা ৫ মিনিট), তখন করিডরে আমি আর রাজিব মামা ছাড়া আমাদের আর কেউ ছিল না।
আমরা ঐ সময় ওখানে না থাকলে মামার মৃত্যুর পরে নার্স এসে কাউকে পেতো না।
মামি উঠে নিজে থেকে পরের বার মামার অবস্থা চেক অন করতে না যাওয়া পর্যন্ত মামার দেহকে ঐ অবস্থাতেই বেডে শুয়ে থাকতে হত, কতক্ষণের জন্য কে জানে?
ঠিক সেকেন্ড অ্যাটাকের সময়েই আমার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া, হঠাৎ চরম ঠান্ডার প্রভাবে আইসিইউ-র ফ্লোরে সময়মত চলে আসা, আবার মামার মৃত্যুর পর নার্স ডাক দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আমার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া,
এগুলা শুনতে যতই সহজ আর কাকতালীয় হোক, আমার কাছে এত সহজ না। মামা যতদিন বেঁচে ছিল, প্রয়োজনে/বিপদে-আপদে আমার জানাত,
বন্ধুবান্ধবের সাথে সাথে আমাকেও ইনফরম করে রাখতো। অনেকে বলতে পারেন আমি পাগলের প্রলাপ বকছি, ইম্যাজিনিং থিংগস, বা কল্পনার যোগফল মেলাচ্ছি; কিন্তু আমি নিশ্চিত,
মামা ঐ ভোররাতে চলে যাবার আগে এসে কোন এক উপায়ে তার সেই চিরপরিচিত ভঙ্গিতে আমাকে বলেছে, “উপরে আয়। আমি চলে যাচ্ছি।
তোরা এই সময়টা আমার কাছাকাছি থাক।” আর সেজন্যই ঘুম ভেঙ্গে ঠিক সময় ঠিক জায়গামত থাকা হয়েছিলো আমাদের।
আমি মামাকে এর পরে আর স্বপ্নে দেখিনি। এখন পর্যন্ত না। মামার বন্ধুবান্ধব, নানি, মামি, কলিগরা হয়তো দেখেছে, কিন্তু আমি না।
তবে আমি জানি আমি দেখবো। আজ হোক, কাল হোক, দুই মাস পরেই হোক, মামা আমাকে দেখা দিবেই। দেখা দিয়ে জানাবে সে এখন কেমন আছে।
মারা যাওয়ার পরে মামার চেহারায় একটা প্রশান্তির চাপ ছিল, হাসিহাসি মুখটা আবার ফিরে এসেছিল।
শুধুমাত্র চুলহীন মাথা, আর ঠোঁটে একটা জ্বরঠোসা ছাড়া ফেটাল রোগটার কোন প্রভাব মুখে ছিল না।
বরং মনে হচ্ছিলো মামা যেন অবশেষে পরম শান্তিতে ঘুমানোর সুযোগ পেল, যার জন্য অপেক্ষাটা ছিল বহুদিনের।
প্রতিদিনই মামার কথা আমার মনে পড়ে; মনে পড়ে হাজারটা স্মৃতি, হাসি, কান্না, আনন্দের ছোট ছোট অজস্র টুকরাগুলার কথা। কম তো না, ৩৩ বছরের পরিচয়!
কিছু সম্পর্ক মৃত্যুর সাথে শেষ হয়ে যায় না, জন্মান্তরে এগুলার রেশ রয়ে যায়। আর একারনেই আমি জানি মামাকে আমি দেখবো, খুব শিগগিরই দেখবো। আমার সাথে দেখা না করে কি ছোটমামা পারে?

অতৃপ্ত আত্মার কাণ্ড!

শ্মশানঘাট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *