এটি একটি সত্য ঘটনা

আমি সৌরভ, ময়মনসিংহের একটি প্রত্যন্ত অঞ্ছলে আমার নানার বাড়ি।
আজ আপনাদের যেই ঘটনাটির কথা বলবো তা ঘটেছিল আমার উপস্থিতিতে।
পরিবারের সবাই ঢাকায় সেটেল্ড বলে গ্রামের বাড়িতে তেমন একটা যাওয়া হয় না। আর যদিও যাই তবে থাকা হয় না।
সেবার পুজার ছুটিতে অনেক আয়োজন করে নানার বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছিলাম সবাই। তখন বর্ষাকাল ছিল।
জানি না কেন কিন্তু ময়মনসিংহ মনে হয় বৃষ্টি কিছুটা কম হয়। তবে মাটি মারাত্মক পিচ্ছিল।
সেই মাটিতে একবার আছার খাওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলেন, হয়েছিলো আমার। আসছি সেই প্রসঙ্গে।
আমার নানারা জমিদার বংশের লোক। এলাকায় ভালো প্রতিপত্তি আছে। ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পরপরই চারপাশ থেকে অনেকেই গাড়ি আঁকড়ে ধরল।
তাদের মাঝে কাউকেই আমি চিনি না। তবে এর মাঝেও একজন লোককে বিশেষ ভাবে নজরে পড়লো। কেন পড়লো জানি না।
তবে লোকটি অন্য সবাইকে দেখা বাদ দিয়ে এক নজরে আমাকেই দেখছিল। হয়তো এই কারনে।
যাই হোক, সেদিন রাতে আমারা সবাই খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি। রাতে প্রবল নিম্নচাপে আমার ঘুম ভাঙ্গে।
একে তো নতুন পরিবেশ তার উপর টয়লেট বাসা থেকে অনেকটা দূরে। তাই আমার এক মামাত ভাইকে জাগালাম।
আমি সেই রাতে তার সাথেই ঘুমিয়েছিলাম। আমার মামাত ভাই ভীষণ ঘুম কাতুরে। অনেক ডাকাডাকির পর সাড়া দিল।
তাকে নিয়ে চললাম টয়লেটের দিকে। ঘরের বাইরে বের হতেই এক পলশা ধমকা বাতাস পুরো শরীর কাঁপিয়ে দিল।
একটানা ঝি ঝি পোকার ডাক। বৃষ্টির দিন বলে ব্যাঙের কোলাহল শুনতে পাচ্ছিলাম। এর মাঝে দূরে কিছু একটা চিৎকার করে উঠলো।
হয়তো শিয়াল হবে। ঠিক জানি না। গাঁ ছমছমে পরিবেশ। নিজের প্রশংসা করছি না, কিন্তু আমার এইসব ব্যাপারে ভয় বরাবরই একটু কম।
একটা চারজার বাতি হাতে নিয়ে ছুট লাগালাম টয়লেটের দিকে। কাজ শেষ করে বের হতে নিবো, এমন সময় ঠিক পাশের ঝোপেই কি যেনও নড়ে উঠলো।
মাথা ঠিক রাখলাম। আলো মেরে দেখার চেষ্টা করলাম কিসের শব্দ। কিন্তু কিছুই চোখে পড়লো না।
টয়লেট থেকে বের হতে যাবো এমন সময় আবার শব্দটা হল। এবার আর জোড়ে। কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। নিশি রাতে একা পেলে মানুষকেও নাকি শিয়ালের দল আক্রমন করে।
আসলেই যদি শিয়াল হয় তাহলে খারাপ কিছু ঘটতে পারে। বড় করে একটা দম নিলাম। তারপর টয়লেট থেকে বের হয়েই দে ছুট।
ঠিক এরপরেই আমার সাথে যা ঘটলো তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
পেছন থেকে কে যেনও বলে উঠলো, “ভয় পাইস না। তরে কিছু করমু না। তুই আমার বংশের বাতি।” পাই করে ঘুরে গেলাম। মনের সমস্ত শক্তি এক করে আলো ফেললাম সেখানে যেখান থেকে আওয়াজটা এসেছে।
কিন্তু কিছুই নজরে পড়লো না। আগেই বলেছি, আমার এইসব ব্যাপারে ডর ভয় কম। তাই আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে লাগলাম চারপাশ।
হয়তো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম তাই মনে হল কিছু যেনও একটা দেখতে পেলাম। একটা আবছা ছায়া। ঠিক যেনও বাতাসে ভর করে ভেসে চলেছে।
পাগলের মত চিৎকার করে উঠলাম, “কে? কে ওখানে? ঐ কে?” পাঠক, আমি তখন হয়তো ভয়ে গুলিয়ে ফেলেছিলাম, তাই উল্টাপাল্টা দেখেছি।
এমনকি পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার নিজের কাছেই তা মনে হয়। আমি ঘটনাটা চেপে যাই। কারো সাথে শেয়ার করি না।
সেই সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় একদল ভিক্ষুককে দাওাত করে খাওয়ানো হয়।
খাওয়ানোর ভার পড়ে আমার সকল মামাত ভাই এবং তাদের বন্ধুদের উপর।
অনেকটা কৌতূহলের বসে আমিও তাদের সাথে যোগ দেই। সবার পাতে ডাল বেড়ে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপর।
লক্ষ্য করলাম, একজন ভিক্ষুক তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে বসেছে।
আমি ডালের বাটি হাতে নিয়ে উনার দিকে আগালাম। ঠিক যেই মুহূর্তে লোকটি চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল, সাথে সাথে আমার যেনও অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো।
সেই লোকটা! যে কিনা আমি যেদিন গ্রামের বাড়িতে আসি সেদিন গাড়িতে আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। মানুষ জনের উপস্থিতিতে সাহস হারালাম না।
এগিয়ে গেলাম যেমন কিছুই হয়নি এমন মনে করে। ডাল লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতে লোকটি কোনও উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
বলল, “কাল রাতে কি বেশি দরাইছিলি?” কথাগুলো কানে ঢোকা মাত্র আমি চমকে উঠলাম। এতটাই চমকে গেলাম যে হাত থেকে ডালের বাটি পড়ে গেলো।
মাটিতে পড়ে ধুপ করে আওয়াজ হওয়া মাত্রই আমার এক মামাত ভাই ছুটে এলো। জিজ্ঞেস করলো এখানে কি করছি।
আমি ঘুরে ওকে বলতে লাগলাম যে ডাল দেয়ার জন্য এসেছিলাম, একজন লোক একা বসে আছে, তাই তার ডাল লাগবে কিনা অথবা অন্য কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম।
সে আমার পিছনে উকি দিয়ে বলল, কোন লোক? চূড়ান্ত বিস্ময়ে আমি আমার পিছনে ঘুরে তাকালাম। ফাঁকা।
সেখানে কোনও লোক তো দূরের কথা এমনকি কোন কিছুই নেই। অথচ আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম যে লোকটি হাতে ভাতের পেয়ালা নিয়ে ভাত খাচ্ছিল।
কিছু বুঝে পেলাম না। সে রাতে আমি ভয়ঙ্কর কিছু দুঃস্বপ্ন দেখলাম। তার মাঝে একটা ছিল, যে গভীর কোনও পুকুরে আমি ডুবে যাচ্ছি।
আমি এমনিতেই খুব ভালো সাঁতারু। কিন্তু এরপরেও ডুবে যাচ্ছি।
পাশ থেকে ঐ আগুন্তক লোকটা সমানে চিৎকার করছে আর বলছে, “আমাকে ধর! আমাকে ধর! আমাকে ধরলে ডুববি না।
আমাকে ধর!” দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। আমার পাশে আমার এক মামাত ভাই ঘুমিয়ে কাঁদা।
আমার সাড়া গাঁ বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছিল। স্বপ্নের রেশ তখনো চোখে মুখে। ভয় না, এ যেনও এক অজানা আতঙ্ক।
যার সাথে আমার আগে কখনো পরিচয় ঘটেনি। কলপাড়ে যাওয়ার সাহস হল না। দরজা খুলে মুখে প্নি ছিটিয়ে রুমে ঢুকলাম।
বাটি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মাঝেই গভীর ঘুমে হারিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে আমি আমার সব মামাত ভাইকে গতরাতের কথা বলি।
ওরা শুনে কিছুটা অবাক হয়। পুকুরটার বর্ণনা দিতেই একজন চিন্তিত মুখে বলে উঠে সেই পুকুরটা সে চিনে। শুধু সেই না। দেখলাম বাকি সবাই চিনে।
আমাদের নানার বাড়ি থেকে প্রায় ৪ কি মি দূরে একটা ভাঙ্গা বাড়িতে ঐ পুকুরটা। কেউ নাকি দিনের বেলায়ও যায় না। পুকুর ভর্তি মাছ।
মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে কিছু মানুষ এসে পুকুরে জাল মারে। ট্রাক ভর্তি করে মাছ নিয়ে যায়। আমি বায়না ধরলাম যে, সেই পুকুরে আমাকে নিয়ে যেতেই হবে।
কিছুতেই তাদের রাজি করান গেলো না। সকলের একি কথা। সেখানে আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না। পাছে কিছু হয়।
আমি হাল ছারার পাত্র নই। শেষ মেশ ঠিকই রাজি করালাম। ঠিক হল আমি, সায়েম, আর রিপন যাবো পরদিন বিকেল বেলা।
খাওয়াদাওয়ার পর মোটর সাইকেল নিয়ে বের হলাম তিনজন মিলে। আম্মুকে বলা হল, বাজারে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে। আম্মু আপত্তি করলেন না।
বাইক চালাচ্ছিল সায়েম। বাইক তো নয়, যেনও রকেট চালাচ্ছিল। ম
মুহূর্তের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। একটা ইট বিছানো রাস্তা দেখা গেলো। মেইন রোড থেকে বাড়ির দিকে গিয়েছে।
সায়েম বলল, এতটুকু রাস্তা পায়ে হেঁটে যাবার জন্য। বাইকের মায়া তার প্রচুর। ইট বিছানো রাস্তায় ঝাকি লাগলে বাইকের ক্ষতি হবে।
এটা চায় না সে। তিন ভাই মিলে বাইক স্ট্যান্ড করে রওনা হলাম। বাড়িটা বহুদিন কেউ ব্যাবহার করে না দেখলেই বুঝা যায়।
জংলায় পরিণত হয়েছে সামনের উঠানটা। বাড়িটা ঘুরে কিছুদূর এগুলেই সেই পুকুর। আশ্চর্য হলাম। হুবুহু সেই পুকুর।
আমি সেই পুকুরটা সেদিনই প্রথম দেখলাম। তাহলে? তাহলে ,এটা আমার স্বপ্নে এলো কি করে? বিমুরের মত এগিয়ে গেলাম পুকুরের পার ধরে।
পেছন থেকে সায়েম আর রিপন ডাকতে লাগলো। ভয় পাচ্ছিলো দুজনই। আমি তখন হিতাহিত জ্ঞানশুন্য।
নিজেও বলতে পারব না কখন একবারে পুকুরের পানির কাছাকাছি চলে গিয়েছি।
একটু ঝুকে পানি ধরার লোভ সামলাতে পারলাম না। পানি ঠাণ্ডা। ভয়ানক ঠাণ্ডা। সাতারে এক্সপার্ট হবার কারনে অনেক পুকুরেই আমি সাতার কেটেছি।
কিন্তু এতো ঠাণ্ডা পানি কোনোদিন পাইনি। আরেকটু ঝুকে আবার ধরতে গেলাম। ঠিক তখনই ঘটলো ঘটনা।
পুকুরের শেষ সিঁড়িতে ছিলাম আমি। একটা ক্ষয়ে যাওয়া ইটের উপর দাঁড়িয়ে। ঝোঁকার সময় মনে হয় পা পড়লো প্সহের কাদামাটিতে।
পিচ্ছিল মাটিতে পা দিয়েই ধরাম করে আছড়ে পড়লাম। একবারে পুকুরের পানিতে।
মাথায় প্রচণ্ড বাড়ি লাগলো। কিছুক্ষণ চোখে আঁধার দেখলাম।
এর মাঝেই খানিকটা পথ পেরিয়ে পুকুরের আর গভীরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কিছুতেই এগুতে পারছি না।
সেদিন ভয়ে নাকি ঠাণ্ডায় জানি না, কিন্তু সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারছিলাম না। আর কিছুদূর যাওয়ার পর হাল ছেড়ে দিলাম।
এদিকে সায়েম আর রিপন পাড়ে এসে চিৎকার করছে। নামতে সাহস করছে না কেউ।
পড়ে শুনেছিলাম, এই পুকুরে নাকি প্রায়ই মাছ চুরি করতে এসে কয়েকজন মারা যায়।
অনেক ভালো সাঁতারুও নাকি মারা গেছে। আমাকে বাঁচানোর জন্য কোত্থেকে যেনও একটা বড় লাঠি নিয়ে এলো সায়েম।
চিৎকার করে বলতে লাগলো লাঠিটা আঁকড়ে ধরার জন্য। আমি প্রানপন চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারছিলাম না।
এক পর্যায়ে নাকে মুখে পানি ঢুকতে শুরু করে। একনাগাড়ে আল্লাহকে ডাকছি।
এমন সময় মনে হল পেছন থেকে কে যেনও আমাকে ধাক্কা দিল। পিঠে কারো হাতের ছোঁওয়া অনুভব করলাম।
এরপর আবার! আমি কিছুটা এগিয়ে গেলাম পারের দিকে। আবার ধাক্কা! এবারে প্রায় অনেক জোড়ে।
আমি সায়েমদের ফেলান লাঠিটা হাতের নাগালে পেলাম। প্রানপ্রনে আঁকড়ে ধরে রাখলাম।
ওরা যখন আমাকে পানি থেকে উপরে তুলে তখন আমি অজ্ঞান ছিলাম। সেই রাতে আমার নানা বাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে যায়।
শহর থেকে ডাক্তার নিয়ে আসা হয়। রাত ১১ টার দিকে আমার জ্ঞান ফিরে। আমি নাকি জ্ঞানে ফিরার পর প্রথম কথাটা বলেছিলাম, কলপাড়ে দেখ।
জলদি কলপাড়ে যাও কেউ! সেইদিন কলপাড়ে আমার এক মামাত বোনকে সাপে কাটে।
সবাই যখন আমাকে নিয়ে আতঙ্কিত তখন সে গিয়েছিলো থালা বাসন মাজার জন্য।
আমার কথা শুনে কয়েকজন গিয়ে তাকে সেখানে অজ্ঞান অবস্থায় পায়। পরে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
বেঁচে যায় সে! আমি সেদিন বাড়ির সবার উপস্থিতিতে খুলে বলি কি হয়েছিলো। একদম প্রথম থেকে শেষ অবদি।
আমার কথা শুনে গ্রামের কিছু বৃদ্ধকে ডেকে আনা হয়। আমার নানু আগেই বলেছিলেন, আমি যেই লোকটিকে দেখেছি তিনি আমার নানার ছোট কাকা।
আমার নানাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। গ্রামের কিছু প্রবীণ বৃদ্ধকে বর্ণনা করা হলে তারাও সায় দেয় কথাটায়।
আমি ঠিক মানতে পারিনি ব্যাখ্যাটি। তবে এছাড়া আমার আর কোনও উপায়ও ছিল না। কি জানি, হয়তো মৃত্যুর ওপারেও কোনও দুনিয়া আছে।
সেখান থেকে আমাদের পরিচিতরা এসে আমাদের সাহায্য করে যায়। হয়তো!

চাবুক

এস.এম.এস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *