আটপৌঢ়ে গল্প – পর্ব ১

বিষন্নতা যদি একটি রোগ হয় তবে সে একজন রোগী।
তবে এর জন্য সে কোনো ডাক্তারের কাছে যায় না।
তবে কি সে একজন ডাক্তার?
নাহ!
তার খালু একজন ‘ডাক্তার কদম আলী-ডিগ্রী নাই’ টাইপের ডাক্তার। যে কোনো সমস্যায় তিনি নিজে আগ বাড়িয়ে এইটা ওইটা প্রেসক্রাইব করেন। জ্বরে প্যারাসিটামল বা নাপা এক্সট্রা, বমি বন্ধে এবোমিন কিংবা লুজ মোশনে ফ্লাজিল… এসবতো কমন ঔষধ। যে কেউই দিতে পারে। রিটায়ার্ড শুল্ক অফিসের কেরাণী জনাব আব্দুল খালেকের দিন এখন কাটে সবাইকে তার ‘অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাপ্ত’ ডাক্তারি বিদ্যা দিয়ে বিব্রত করার মধ্য দিয়ে।

অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাপ্ত কথাটি মনে আসাতে বাবুলের অন্য একটি কথা মনে পড়ে যায়।
‘স্বপ্নে পাওয়া মহৌষধ’- এরকম পেপারে অনেক বিজ্ঞাপন সে দেখেছে। তবে ওর বাসার কাছেই যে এমন একজন স্বাপ্নিক-বাবা এসে যাবেন সেটা কখনোই ভাবেনি। তার কাছে গেলে সকল রোগের দ্রুত নিরাময়। আর যেন তেন রোগ নয়। সবই সেই বেশ দামী দামী রোগ। একেবারে জটিল ও পুরাতন আমাশয় থেকে শুরু করে একেবারে ক্যান্সার পর্যন্ত আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। বাসার সামনে সেই সকাল থেকেই বিশাল লাইন লেগে যায়। একেবারে মধ্যরাত পর্যন্ত তার বিস্তৃতি। সবাই ‘ওনাকে’ বাবা ডাকে। তিনি নাকি ছোট খাট অসুখ তার দৃষ্টি দিয়েই সারিয়ে তোলেন। তবে বাবুল একদিন জাষ্ট কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে ‘বাবা’র সামনে গেলো। সকল আখড়ার মত এর ঘরটাও একই রকম। ভিতরে কয়েকজন মুরীদ নিয়ে বাবা একটা আলীশান সোফায় বসে আছেন। আসলে এরা এদেরকে সাধারণ পাবলিকের সামনে এমন জাঁকজমক পুর্ণভাবে প্রকাশ করে থাকে যে, তার সাথে অন্যদের ভিতরে আপনাতেই একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। যে জন্য ওদের ভিতরের অন্তঃসারশূন্যতাকে সবাই সহজে অনুভব করতে পারে না।

বাবুল এরকম অনেক ভন্ড বাবা’দেরকে দেখেছে। এদের কয়েক ধরণের টেকনিকের সাথে সে অভ্যস্ত। প্রথমতঃ হয় এরা সিল্কের খুব দামী ও রংচকচকে পোশাক পড়বে, না হয় উর্ধাঙ্গ একেবারে নগ্ন রাখবে। শীতের রাতেও এদের খালি গায়ে বসে থাকতে কোনোরূপ অসুবিধা হয় না। কারণ পেটে আসল জিনিস পড়ে- আর অভ্যাসের একটা প্রভাব তো রয়েছেই।

দ্বিতীয়ত এরা মানুষ বুঝে সবার সাথে এমন এমন কিছু আচমকা টোটকা কথা বার্তা বলে থাকে যে, বিপদ্গ্রস্ত মানুষ সহজেই টাসকি খেয়ে যায়। কারণ যারাই আসে, তারা যে কোনো বিপদে পরিত্রাণের আশায়ই এসে থাকে।

বারান্দায় বসে দূরের ভীড়ের দিকে তাকিয়ে আনমনে এসবই ভাবছিল বাবুল। আরো কতক্ষণ ভাবতো কে জানে। এখন বসে বসে এইসব ভাবতে ওর অনেক ভালো লাগে। কিন্তু মা এসে সব ভন্ডুল করে দিলেন।

: কিরে, এভাবে গ্যাট হয়ে বসে থাকবি?

: তো কি করবো?

: কি করবি মানে? তোর না আজ শফিকের কাছে যাবার কথা… কোথায় যেন কার সাথে দেখা করতে নিয়ে যাবে তোকে…

: তোমাকে অনেকবার বলেছি মা, আর যেখানেই যেতে বল আমাকে শফিক ভাইয়ের কাছে যেতে বলবে না।

: কেন? সে কি করেছে শুনি?

: ও তুমি বুঝবে না…

: আমার বোঝাও লাগবে না। এভাবে বসে বসে আর কতকাল ভাইয়ের কামাই এর অন্ন ধ্বংস করবি? ছেলেটা দিনরাত খেটে খেটে মরছে… আর উনি নবাবের মত ঘরে বসে বসে… এ্যাই, তুই বলতো আমাকে, কি করতে চাস তুই?

: আমি কিছুই করতে চাই না!

: তাতো চাইবিই না। তোর সাথের ছেলেরা সবাই কিছু না কিছু করছে। নাহিদকে সেদিন দেখলাম কি জানি একটা ইন্সিউরেন্সে চাকরি করছে… কিছু না পারিস ওরকম কিছু একটা কর না।

: তোমার প্রতিদিন এই ঘ্যান ঘ্যান আর ভালো লাগে না মা। আমি যদি ইন্সিউরেন্সের দালাল হই, তুমি নিজেই তো একটা পলিসি করবে না… কি করবে?

মা ও ছেলে দীর্ঘক্ষণ চোখে চোখে তাকিয়ে থাকে। শেষে মা-ই চোখ নামিয়ে নেয়। সেই ছেলেবেলায় ছেলেকে ইচ্ছে করে জিতিয়ে দিতে গিয়ে তখনো চোখ নামিয়ে নিতেন।

আর এখন!

এখন ছেলের বড় বেলায় নামিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

ছেলে এখন বড় হয়ে গেছে… ভাবনা চিন্তায়- দেহ মনে… সব দিক দিয়েই। কোনো কথা না বলে রণে ভঙ্গ দিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে যান। দিনের অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে… চকিতে ভাবলেন, জীবনেরও কি?

ভ্রু কুঁচকে বাবুল রাস্তায় নেমে এলো। মেইন গেইট পার হয়ে একবার তিনতলার পশ্চিম পাশের বারান্দার দিকে তাকিয়ে বাবাকে বসা দেখতে পেল। ওকে দেখে শিশুর মত হাসিতে উদ্ভাসিত হলেন। সেই সৌম্য মুর্তিকে দেখে বাবুলের বুকের ভিতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। এই লোকের জন্য ওর কত কিছু করতে ইচ্ছে করে… কিন্তু কিছুই করতে না পারার অক্ষমতা ওকে হিংস্র শ্বাপদের মত ভিতরে ভিতরে একটা জানোয়ারে পরিণত করতে চায়। তবে ঐ যে… বারান্দায় বসা ওর জনকের শান্ত-সৌম্য মুর্তিটা ওকে একেবারে ঠান্ডা করে দেয়। মাথা নীচু করে গলির মোড়টার দিকে আগাতে থাকে… যেখানে ওর মতো এরকম ভিতরে জানোয়ার কিন্তু বাইরে নির্জীব মানুষ- সেরকম ক’জন বন্ধু রয়েছে। অলস আড্ডায় সময়ের কাটা নিজেদের আয়ত্তে রয়েছে মনে করে আত্মতৃপ্তিতে মগ্ন! দূর থেকে বাবুলকে দেখে দু’একজন হাত উঠিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল। ব্যস! ঐটুকুই। এরপরে আবার চায়ের দোকানটাকে পুরুষালী হাসিতে মাতিয়ে রাখল। ঠোঁটের কোণে অকারণেই হাসির একটা রেখা ফুটে উঠল বাবুলের।

প্রতিদিনই বন্ধুদের কাছে আসতেই এরকম হয়। কিন্তু নিজেকে তো আর আয়নায় দেখা যায় না!

তাই হাসিটা আর ওর নজরে পড়ে না। তবে এখানে এলেই মনের ভিতরেও কেন জানি অদ্ভুদ এক আনন্দ জাগে… কি এক অজানা শিহরণে বুকটা ধুকপুক করে… গলার কাছে কি যেন একটা দলা হয়ে জমে যেতে চায়। ইচ্ছেকৃত গলা খাকারি দিতে হয়… বারবার…

হামিদের চায়ের দোকানের বিপরীতেই ব্রাকের শাখা অফিস।

বারবার সেখানেই মন এবং চোখ-দুটোই চলে যায়।

মুখে বসন্তের দাগওয়ালা সেই মেয়েটি যে এখানেই চাকরি করে। তাইতো বাবুলের এখান থেকে নড়তেই ইচ্ছে করে না। বন্ধুরাও সেটা জানে। এজন্য নখরামি করে মটর বাইকে করে ওকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চায়। তবে সেও এমন ভাব দেখায় যে ‘ কে থাকতে চায় এখানে?’… বন্ধুরাও চোখ মটকে হাসে… মনের শুদ্ধতা ঝরে পড়া হাসিতে ওদের সাথে বাবুলও যোগ দেয়। তবে সে বুঝতে পারে না যে, ব্রাকের মাঠকর্মী সেই মুখে বসন্তের দাগওয়ালা কণা নামের মেয়েটির জন্যই ওর মনের ভিতরের জেগে উঠা আনন্দ ও শিহরণ! যা প্রতিটি মুহুর্তেই ওর সঙ্গী হয়… অবচেতন মনে ওর আনন্দ-মধুর জীবনকে একটা নির্দিষ্ট গতিতে সচল রাখতে সাহায্য করে।

জীবনটা তো আর সব দিন একই ভাবে যায় না… যাবে ও না।
(ক্রমশঃ)

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!