গল্পের তৃতীয় পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রতিদিন একই রুটীন।
কনার কাছে জীবনটা অসহ্য ঠেকছে। সেই কাকডাকা ভোরে উঠে কল চেপে পানি তোলা। প্রাতঃক্রিয়া সেরে নাস্তা তৈরী করা। মোটে চারটা চুলা। সেখানে ১০ রুমের মানুষ রান্না করে। চুলার দখল পেতে এজন্য এতো ভোরে উঠতে হয়। ছোট দুই রুমের বাসায় ওরা পাঁচজন মানুষ গাদাগাদি করে থাকে। এক রুম বাবা মা’র জন্য… বাকীটাতে বড় বোন ও তার ছোট দুই মেয়ে এবং সে নিজে। পশুর মত বসবাস এবং বেঁচে থাকাটা এজন্যই অসহ্য লাগে ইদানিং। স্যাতস্যাতে পরিবেশে ছারপোকার বসতি গড়ে উঠেছে। লম্বা ‘এল’ শেপের ভাড়া বাসাটার এক অংশ গার্মেন্টসে চাকুরিজীবিদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। এই রুমগুলো ব্যাচেলরদের জন্য। সেগুলো এক রুমের… বাহিরে টয়লেট ও গোসলখানা। তবে দুই রুমের কথিত ‘ফ্ল্যাট’ এর ভিতরেই ‘এটাচড বাথরুম-টয়লেট। এরকম ‘ফ্ল্যাট’ রয়েছে ৪টি। আর বাকী ৬টি ব্যাচেলরদের জন্য। সেখানে এক এক রুমে চারজনের বেশী করে থাকছে। গিদার মুন্সীর এরকম আরো দু’টো বাড়ি রয়েছে।
একই প্যাটার্ণের।
এভাবে বানালেই নাকি ভাড়া বেশী উঠে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল বাসা কখনো খালি থাকে না। গিদার নামের মতোই তার আচরণ ও চলাফেরা। এজন্যই তাকে মানুষ এই নামেই ডাকে। আসল নাম শমসের আলী। তবে ডাকতে ডাকতে এখন ‘গিদার মুন্সী’ই হয়ে গেছে। মুন্সী ওদের কোনো পারিবারিক উপাধি নয় কিংবা সে যে খুব পরহেজগার তাও নয়। মাথায় সবসময় একটা টুপি থাকেই। এজন্য মুন্সী উপাধি। আর নোংরা থাকার কারণে ‘গিদার’ নামকরণ। ওনার নামের মতোই কনাদের ভাড়া বাসাটার পরিবেশ ও নোংরা। মেইন রাস্তা থেকে অনেকটা নীচুতে হওয়াতে কিছুটা যায়গা সারা বছরই প্যাকে ভর্তি থাকে। আর অধিবাসিদের পালিত হাঁস-মুরগীর মলে পুতি-দুর্গন্ধময় এলাকাটা।
ব্যাংকের জানালা দিয়ে মোড়ের চা এর দোকানের দিকে তাকিয়ে আনমনে এসব ভাবছিল কনা। সেখানে কয়েকজন যুবক আড্ডা দিচ্ছিল। ওদের সবাইকে না চিনলেও একজনকে বেশ ভালোভাবেই চিনে সে। বছরখানিক হল ওকে দূর থেকে দেখে শুধু। বাসা থেকে অফিসে যাওয়া-আসার পথে ওর পিছু নিলেও আজ পর্যন্ত কখনো খারাপ-ভালো কোনো মন্তব্য করেনি। তবে পুরুষ মানুষের চোখের দৃষ্টি কনা ভালোই চিনে… বোঝে। বাবুল নামের ছেলেটির দৃষ্টিতে ওর প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা সে দেখতে পেলেও সে নিজে থেকে কিছু বলে না… সাড়া দেয় না। ছেলেটি একবার বেনামে একটি চিঠি দিয়েছিল। সেটা আজও সে সযত্নে রেখে দিয়েছে। তবে আজকাল কেউ কাউকে চিঠি দেয় না। এজন্য বেশ অবাক হয়েছিল। এখন তো ফেসবুকে রোমান্স চলে… না হলে মোবাইলে ঘন্টার পর ঘন্টা অলস প্রেমালাপ। এদিক দিয়ে বাবুল অনেক ব্যাকডেটেড।
এই নিয়ে আজ দু’বার বাবুলের সাথে চোখাচুখি হয়ে গেলো।
এভাবেই কাটছে সময়।
একজন নীরব প্রেমিকের এই উৎকন্ঠাটুকু কেন জানি আজকাল কনার অসহ্যকর জীবনের ক্ষণগুলোতে একটু হলেও আনন্দ দিয়ে যায়। তবে মেয়ে বলে সে উপযাজক হয়ে তো আর বলতে পারে না যে ‘ তোমায় ভালোবাসি’।
এছাড়াও ওর আরো সমস্যা রয়ে গেছে। বাসায় অসুস্থ মা… ডিভোর্সী বোন… অক্ষম বাবা। এতোগুলো মানুষের জন্য খাবারের জোগাড় করতে হয় ওকে। বড় বোন অবশ্য বাসায় বসে কিছু সেলাইয়ের কাজ করে। আশেপাশের মহিলারা অর্ডার দেয়। যা আয় হয় তাতে করে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামে সেও কিছুটা অবদান রাখে। তবে সেটা একেবারে অকিঞ্চিত।
এই অবস্থায় কীভাবে কনা কাউকে বলে, ‘চলো, ঘর বাঁধি!’
আর যাকে বলবে সেও তো কিছুই করে না।
শুধু ভালোবাসা দিয়ে তো আর জীবন চলে না…
আর কনা চলে গেলে বাবা মা- বোন আর তার দুটি বাচ্চাকে কে দেখবে?
সাইড ব্যাগটি কাঁধে নিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে বের হয়। ফিল্ডে যেতে হবে। এটাই তো ওর কাজ। দোকানের সামনে আসতেই উচ্ছল ছেলেগুলো কেন জানি এক মুহুর্ত থেমে যায়। কনার কাছে মনে হল চারিদিকে সব মুহুর্তের জন্য থমকে গেল। সময়ও যেন স্থির… বাবুলের বন্ধুদের চোখে ভাষা খেলা করে… সবাই বাবুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর যাকে নিয়ে তাদের এই খেলা, সে যেন পাথরের ভাস্কর্য! মাথা নিচু করে নিজের পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে আছে।
স্লো মোশন ছবির মতো কনা বাবুলকে পাশ কাটিয়ে যায়।
তবুও একজন প্রেমিক কেন জানি তার ভালোলাগার মানুষটির দিকে তাকাতে পারে না। কত কথা জমা রয়েছে তার বুকে! দিনে দিনে এই না বলা কথাগুলো ওকে আরো ম্রিয়মান করে তোলে।
কনার খুব খারাপ লাগে।
সে আরো দু’কদম গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
এবারে পিছনে ফিরে হেঁটে আসে।
বাবুলের সামনে এসে বলে, ‘এই যে শুনুন।‘
তবুও যুবকটি মাথা নিচু করে থাকে। ওর বন্ধুরা ওকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিতেই সে মাথা উপরে তোলে।
এবং আশ্চর্য হয়ে ওর স্বপ্নের মানবীকে ওর সামনে দাঁড়ানো দেখতে পায়!
একটা আদিগন্ত ভালোবাসা বাবুলের চোখ হয়ে কনার চোখের ভিতর দিয়ে ওদের দুজনের হৃদয়কে স্পর্শ করে… সে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
: ‘আমাকে বলছেন?’
: হ্যা… আমার সাথে একটু হাঁটবেন? – কথাগুলো বলতে কনার খুব যেন কষ্ট হচ্ছিল। তবে ওর ভিতরে কি যেন একটা বাড়াবাড়ি রকমের অজানা ব্যাথা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। তাই একটা ঘোরের ভিতর থেকে সে বলে যাচ্ছে।
ওর সামনের বিমুঢ় যুবকটিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে পা বাড়ায়। কি এক অমোঘ আকর্ষণে যুবকটিও ওর পিছনে হাঁটতে থাকে।
চায়ের দোকানে বসা যুবকটির বন্ধুরা হা করে এই অদ্ভুদ দৃশ্যটি দেখে। কিছুদূর গিয়ে যুবক ও যুবতি পাশাপাশি হয়ে যায়। যেন ওরা কতদিনের চেনা!
একসময় সবার চোখের সামনে দিয়ে গলির মোড় ঘুরে ওরা অদৃশ্য হয়ে যায়।
এভাবেই একটা সম্পর্ক তৈরী হয় বাবুল ও কনার ভিতর… সেখানে কোনো পুর্বাভাষ ছিল না…
ভালবাসাই স্বর্গ থেকে এসে দু’টি হৃদয়ে নিজের থেকেই বাসা বাঁধল।
(ক্রমশঃ)
গল্পের তৃতীয় পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।