মেকুর-২য় পর্ব

আমাকে শেষ পর্যন্ত আমার ফ্যামিলি (এক মেয়ে ও বউ) নিয়ে গ্রামে চলে যেতে হলো। এটা পুরাপুরি গ্রাম ও না, শহর ও না। একটা উপজেলা যেখানে বিদ্যুত-গ্যাস থাকলে ও সাপ্লাই পানি নাই। তবে চট্টগ্রামে আগ্রাবাদের তুলনায় এটা অজ পাড়া গা ই। সেখানে অনেক জায়গা নিয়ে একটা সেমি পাকা টিনশেড বাড়ীতে আমি উঠে এলাম।
আমার শ্বশুরের আশ্রয়ে আমি আছি।
মাকে হারিয়েছি চীরতরে।
ভাইয়েরা ও আমার উপর রাগ। আমার বউ এর পরিবার ও আমার পরিবারের ভিতর কোথাও থেকে কিছু সুতা আলগা হয়ে গেছে। সম্পর্কের সুর কেটে গেছে। কেউ কাউকে টলারেট করছে না। আর এই দুই পরিবারের ভিতরে আমার অবস্থা যেন দুই নৌকায় পা দিয়ে থাকা এক সতর্ক শয়তান।
আমি কোন কাজ করতে চাই না। আমার কোনো কিছু ভালো লাগে না। কিন্তু আমার সংসার চালাতে তো হবে। জব থাকা অবস্থায় আম্মা নিজের পছন্দ করা মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। আহা! কত সুন্দর ই না ছিল সেই দিন গুলো [ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম]!
এর পরের ঘটনা তো সব আগের পাতায় লিখেছি।
আম্মা মারা যাবার পরে প্রথম কিছু দিন গুম হয়ে ছিলাম। তবে শোকের তীব্রতা টের পেলাম আমার বড় মেয়ে মারা যাবার পরে। প্রায় ৬ মাস পাগলের মত ঘুরলাম। সবাই আমাকে এই সময়টা ছাড় দিয়েছিল।
পর পর দুইটা ধাক্কা সামলানো আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হতে থাকে। কিন্তু মাথায় মনে হয় কিছুটা গন্ডগোল হয়ে গিয়েছিল যা আর ভালো হল না। চাকরি টা চলে গেল। ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। আমার বউ এর বাবা এর পরে আরো এক জায়গায় আমার জন্য জবের ব্যাবস্থা করলেন। কিন্তু সেখানে তিন দিনের দিন রাগ করে বের হয়ে এলাম। আর গেলাম না। এ জন্য আমার শ্বশুর আমার সাথে অনেকদিন কথা বলেন নাই। তবে তিনি বিভিন্ন ভাবে আমাকে একটা ভালো পজিশনে আনার জন্য তার যথসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। তবে আমি নিজেকে যেন ধ্বংস করার তালে ছিলাম। আমার সরকারী চাকুরির বয়স ছিল। কিন্তু আমাকে বিসিএস বা অন্যান্য পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে বললে ও আমি মাসুদ রানা বা ওয়েস্টার্ণ পড়ে পড়ে প্রস্তুতি নিতাম। আমাকে পড়িক্ষার হলের গেটে ধুকিয়ে দিয়ে আসা হত। আমি পিছনের গেট দিয়ে বের হয়ে এসে বটতলি স্টেশনে এসে গুজাইয়ার সাথে বসে কল্কি টানতাম। মোটকথা আমি একেবারে শেষ হয়ে যেতে চেয়েছিলাম।
এইজন্য আমাকে আমার পরিবার সহ এই উপজেলায় নির্বাসনে পাঠানো হল।
মেকুরের বনবাস।
প্রায় এক বিঘার মত সম্পদ পানির দামে আমার শ্বশুর কিনেছিলেন অনেক আগে। সেখানে তিনটি পরিবার থাকতে পারে মত করে টিনশেড ঘর করা হয়েছিলো। তবে আরাম ছিলো। গ্যাস-কারেন্ট ও মটর বসিয়ে ট্যাঙ্কিতে পানি তোলার ব্যবস্থা ছিল। আমি প্রথম এসে তো কাউওকে চিনি না।যারা এলাকার ছেলেপেলে, সবাই আমার থেকে অনেক ছোট। বেশীরভাগ ই সারাদিন টোটো করে ঘুরে-নেশা করে আর চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়। আমার মনের ভিতরের শয়তানটা হেসে উঠল।
যাক! এতদিন পরে নিজেকে শেষ করে দেবার একটা স্থান পাওয়া গেলো। আমি অল্প দিনের ভিতরে জুনিতর সেই ছেলেদের ভিতর মিশে গেলাম। আমার শ্বশুর ছিলেন এই এলাকায় প্রভাবশালী। আর দুনিয়া টাকা আর প্রভাবের গোলাম। আমি সবার ভিতরে বেশ খানিকটা প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করলাম।
আমার সারাদিন কোন কাজ ছিলো না। পঢ়া জায়গাটা বাউন্ডারি অয়াল করা ছিলো। প্রায় ৮ ফুট উঁচু সেই বাউন্ডারির ভিতরে আমি এক শাহেনশাহ’র মত জীবনযাপন করা শুরু করলাম। আমার কোন অপুর্ণতা আমার বউ এর বাবা রাখেন নাই। তিনি তার এই মেয়েকে অনেক ভালো বাসতেন। আর আমি তার এই ভালবাসার দুর্বলতাকে কাজে লাগালাম। বাড়ীর ভিতরে তিনি ৪০ ধরনের হার্বাল গাছ লাগিয়েছিলেন। আমি তাদের সংখ্যা আরো একটি বৃদ্ধি করেছিলাম। সেতা ছিলো গাঁজা গাছ। এই বাউন্ডারির ভিতরে আমি না চাইলে পুলিশ ও ঢুকতে পারত না।
প্রথমে আমার শ্বশুর আমাকে ভিতরে বিভিন্ন শাক শব্জীর চাষ করতে বললেন। আমি ও কামলা দিয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ খালি জায়গায় শাক-শব্জির চাষ করালাম। কিন্তু একদিন একজন কামলাকে তখন ৯০-১০০ টাকা দেয়া লাগত। আর শাঁক বিক্রি করে ১০ টাকা পেতে ও কষ্ট হয়ে যেতো। আর এ গুলো কে বিক্রি করবে? আমার পক্ষে কি সম্ভব? যে ব্যাটাকে দিয়ে চাষ করাতাম, সেই ই শেষে নিজের বাসার জন্য প্রায় বিনামুল্যে কিনে নিয়ে যেতো। এভাবে একের পর এক প্রজেক্ট হাতে নিলাম। পেঁপে বাগান, হালুয়া ঘাট থেকে হাইব্রিড ডাটার বীজ এনে চাষ করা, কিংবা গোলাপ ফুলের চাষ- আরো কত কি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব ই লস প্রজেক্ট।
আমার শ্বশুর হতাশ।
আমি আরো আনন্দিত।
এর পরে তিনি আমাকে তিনটা মুরগী কিনে দিলেন। একটা মোরগ। বাকী দুইটা তার দুই বউ। চিন্তা করতে পারো, একটা মোরগের দুইটা বউ, আর আমার মোটে একটা? শেষ পর্যন্ত একটা মোরগ ও আমাকে ছাড়িয়ে গেলো?
প্রতি দিন সকালে রশি দিয়ে বাধা মোরগ ও মুরগী আমি ছেড়ে দেই। আনার বিকালে ওদেরকে আশে পাশের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসি। আসলে আমি কিছু ই করি না। আমার বিচ্ছু বাহিনী সব করে। ওদের নিয়ে সারা দিন গ্রামের এখানে সেখানে বসে গাঁজা টানি। শুধু খাবার সময় হলে বাসায় এসে খেয়ে নি। আমার বউ আমাকে কিছু বলে না। মাসে মাসে ঘর ভাড়া পাই। তার সাথে আমার শ্বশুর টাকা পাঠায়। আমার ভালঈ চলে যাচ্ছিলো।
আসলে আমাকে তিনটা মুরগী এই জন্য কিনে দেয়া হয়েছিলো যেন ওগুলোর পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে এই বোহেমিয়ান জীবন ছেড়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করি। তবে আমি সব কিছু বুঝে ফেলেছিলাম।
কিছু ই করলাম না।
আমাকে আমার শ্বশুর বলতেন যে, পথে বের হলে সব সময় একটা পলিথিন পকেটে রাখবা। পথে যদি গোবর ও পাও তবে তা ঐ পলিথিনে ভরে বাসায় নিয়ে আসবা। একটা গাছের গোড়ায় দিলে ও তো কাজে লাগবে।
অসাধারন! কি আইডিয়া!
আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম রাস্তায় পড়ে থাকা কাচা গোবর আমি মানুষের সামনে দিয়ে উঠিয়ে পলিথিনে ভরে পকেটে রাখছি। আর সবাই অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। তবে তাদের চোখে মুগ্ধতার পরিবর্তে সেখানে রয়েছে ভয় মেশানো বিস্ময়, যা পাগলদের দেখলে আসে।
একদিন একটা মুরগী কারা যেনো ধরে নিয়ে গেলো। আমার বিচ্ছু বাহিনীর ই কাজ হবে। আর মোরগটাকে বিক্রি করে গাজার পুরিয়া কিনে ‘পার্টি’ দিলাম এক পুকুর পারে। আমি অবিবেচক নই। বাকী মুরগীটা আমার বউকে নিয়ে মজা করে খেলাম। আমার এই প্রজেক্ট ও লসে পরিণত হল।
আমার মেয়েকে উপজেলার সব থেকে ভালো একটি কেজি স্কুলে ভর্তি করানো হল। আমার বউ প্রতিদিন বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে যায়।আমার জন্য সব কিছু করে। ভাড়াটিয়াদের সুযোগ-সুবিধার খোজ নেয়। ওর নিজের একটা সার্কেল গড়ে উঠলো বিভিন্ন স্টুডেন্টদের মায়েদের সাথে। তবে তারা জানত না, যে আমি ওর হ্যাজবেন্ড। আমাকে তারা দেখত রাস্তা-ঘাটে বখাটে ছেলেদের সাথে- চা এর দোকানে- নেশায় চুড়। কখনো বা মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে অকথ্য ভাষায় কাউকে গালিগালাজ করা অবস্থায়। আমি আমার বউ কে একটু ও বুঝার চেষ্টা করতাম না। ও যেন আমার ভোগের সামগ্রী ছিলো। আর ছিল আমার তাকা যোগানোর উৎস।
আমার জন্য ওর সামাজে মুখ দেখানো ই এক পর্যায়ে দায় হয়ে যায়। তবে আমার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ আসে নাই ওর কাছে। আমাকে ও অনেক বুঝাল। আমি বুঝতে চাইলাম না। শেষে একদিন ওর বাবা এসে আমাকে বললেন যে, এভাবে আর চলে না। তুমি তোমার রাস্তা দেখ। আমার বউ মাথা নীচু করে সমস্ত সময় বসে ছিল। আর আমি ছিলাম তখনো উন্নত মম শির। এক সতর্ক শয়তান।
আমার বাচ্চাকে শেষবারের মত আমার কোলে দেওয়া হলো।
একটু আদর করার জন্য।
কিন্তু কিভাবে আদর করে তা ও ভুলে গেছিলাম।
আমার হৃদয়ের গহীনে কোথাও থেকে কেমন অন্য এক সুর বাজছে টের পেলাম। আমার বাচ্চা আমার কোলে। কেমন দেবশিশুর মত লাগছে আজ!
ওহ! আজ এই শেষবেলায় সব এমন কেন মনে হচ্ছে?
আমি কি ভুল করেছি? তবে তা শোধরানোর মত সময় আর নেই।
আমার হৃদয় প্রচন্ড শব্দে আন্দোলিত হচ্ছিল। আমি আমার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে। কেউ যেনো নিয়ে যেতে না পারে।
কিন্তু ভুল যা হবার অনেক আগেই হয়ে গেছে।
আমার শ্বশুরের প্রভাবের কাছে আমি হেরে গেলাম। আমি তবু ও অপেক্ষা করছিলাম আমার বউ হয়ত…
আমি অপেক্ষা করছিলাম ও একটু আমার দিকে তাকাক…
যেভাবে এতোগুলো বছর আমাকে সহ্য করেছে- সুযোগ দিয়েছে; আর একটি বার আমাকে দিক।
কিন্তু সে আর আমার দিকে ফিরলো ই না। আমার পৃথিবী-আমার সন্তানকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হলো। ও বুঝতে ও পারলো না, ওর বাবাকে হারাতে চলেছে।
আমি নির্বাক হয়ে এক অভিমানে আমার নিজের সংসার থেকে বের হয়ে গেলাম।
পিছন থেকে কেউ আমাকে ডাকলো না।
আমি ও সামনের পানে এগিয়ে চললাম।
তখন কিন্তু আমি আর সতর্ক শয়তান ছিলাম না।
বিশ্বাস কর, আমি ঐ মুহুর্তে একজন সত্যিকার মানুষে রুপান্তরিত হয়েছিলাম। কিন্তু জানোয়ারের খেতাব কি আর এক মুহুর্তের মানুষের পরিচয়ে দূর করা যায়!
আমার হৃদয় ভেঙে চুড়ে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিলো।
পিছনের পথ বন্ধ।
সামনের পথের দিশা নাই।
আমার সব থেকে প্রিয় দুজন কে হারানোর পরে আমি কি হারালাম তা টের পেলাম। তবে এই উপলব্ধি আমার কোনো কাজে আসলো না।
আলো থেকে অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এক মুহুর্তের আলো আমাকে আলোকিতো করে আবার এক নিরংকুশ অন্ধকারে টেনে নিয়ে গেলো।
[আমার বউ আমার মেয়েকে নিয়ে কানাডায় চলে যায়।তার বাবা সব ব্যবস্থা করেন। সেখানে এক ডাক্তারের সাথে ওর বিয়ে হয়। আমার মেয়ে এখন তাকে ই বাবা জানে। এটা আমার অনুমান। কারন আমার সাথে আর ওদের দেখা হয় নাই। কে যেন বলেছিলো- ‘তোমার কোনো প্রিয়জন যদি তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যায়, তিন বা চার বছর পর্যন্ত তুমি তার চেহারা চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাবে। আজ ৭ বছর পার হয়ে গেছে। আমি আমার বউ ও মেয়েকে স্পষ্ট চোখ খোলা এবং বন্ধ- এ দু অবস্থায় ই দেখতে পাই। এর কারন হয়ত আমি একজন MECUR তাই। তবে কোনো এক সুন্দর সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি মনের ভুলে ডাক দেই-
‘বউ, আমার চা দাও।‘ কিংবা কোনো এক চাদনী রাতে একাকী মনের ভুলে আমার বঊকে ডাকি-
‘কই, এদিকে আসো। দেখ কি সুন্দর…’
কিন্তু আমার ডাকে কেউ সাড়া দেয় না।সে তো তখন কানাডায় অন্য কোনো সাথীকে নিয়ে চাদ দেখছে।
আচ্ছা, ওখানে ও কি চাদ একই রকম?
আমি আর আমার ছায়া- দুজনে এক হয়ে যেতে চেষ্টা করি। কিন্তু রেললাইনের মত আমার ছায়া কেবলি আমার থেকে সমান দুরত্তে অবস্থান করে। পাশাপাশি- কিন্তু কখনো এক হবে না।
ধরা দিতে চায় না।
অভিমানী ছায়া!

সময় সময়ের ভিতর থেকে প্রচন্ড এক দুঃসময় বয়ে এনেছে আমার জন্য।
আমি দেহমনে তীব্র এক যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার হৃদয়ের ক্ষত যা প্রতিটি ক্ষণে কেবলি আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে… প্রলম্বিত এক যাতনার ব্যবচ্ছেদে আমি বোবা অনুভূতিতে বিলীন হচ্ছি।

আমার মেয়ের কথা মনে পড়ে… বউয়ের মুখটা চোখে ভাসে। চলার পথে ছোট মেয়ের হাত ধরে কোনো গৃহবধুর হাসিমুখ আমাকে পাগল করে দেয়। ওদের নিরন্তর বয়ে চলা এই সুখ আমার সহ্য হয় না। ইচ্ছে করে এক লহমায় ওদের হাসি হাসি মুখগুলো বেদনায় ভারাক্রান্ত করে দেই। কোথা থেকে এক নরপশু আমার ভিতরে জেগে উঠে সবকিছু লন্ড ভন্ড করে দিয়ে যেতে চায়।

তারপরও আমি বেঁচে থাকি। তিনবেলা খাবারের খোঁজে চিন্তা-ফিকির করি। পকেটে কোনো টাকাই থাকেনা। তারপরও দিব্যি কিভাবে যেন বেশ চলছি। আসলে মানুষের উপরে বিগত বছরগুলোতে নির্ভর করে চলতে চলতে, এক অভ্যাসগত চারিত্রিক গুনাবলীতে আচ্ছন্ন এই আমি নিজেকে অন্যের ভিতরেই কেবলি খুঁজে চলেছিলাম।

দিনের বেলা বঙ্গবন্ধু হলের পরিচিত রুমটিতে অলস সময় কাটাই। কিংবা ছাদের উপরে নির্জনে একা একা থাকি। এই সময়টিতেই অনেক এলোমেলো ভাবনা আমার মনে দোলা দিয়ে যেতে থাকে।

এই যে আমার বর্নাঢ্য মানবজীবন (আমি দ্বিধাগ্রস্ত আমার এই জীবনকে মানব জীবন বলা চলে কিনা? তাও আবার বর্নাঢ্য!!), একে আমি কিভাবে দেখছি? নিজেকেই প্রশ্ন করি। আর উত্তর খুঁজে বেড়াই নিজের মনে মনে।

জীবন আমার কাছে ‘এয়াজ বদলের’ মত মনে হয়। শব্দটা ‘ওয়াজ বদল’ ও হতে পারে। একের জমি অন্য একজনের নামে হস্তান্তর বা বদল করাতে এটা বুঝানো হয়। যেমন আমাদের সমাজের কাঠামোটাকে যদি দেখি, এখানে বিভিন্ন প্রকার পেশাজীবি এবং বিভিন্ন গোত্রতে বসবাস করছে।
একদিন হুট করে জীবনটাকে বদল করে দেখলে কেমন হয়?
তবে জীবন বদল করাটা খুব সহজ নয়। এর জন্য বিশেষ কিছু দরকার হয় না, শুধু লাইফ ইভেন্ট গুলো চেইঞ্জ করলেই হয়।

জীবন বদলের ভাবনায় তাড়িত হয়ে আমি চিন্তা করলাম, আমি যদি গাড়ীর হেল্পার হতাম কেমন হতো ? যেই ভাবা সেই কাজ। পরিচিত একজনকে ধরে বললাম, ‘ভাই বিপদে আছি, আপনার ষ্ট্যান্ডের একটা গাড়ীর হেল্পারের কাজ যোগাড় করে দিন না।‘

বেচারা আকাশ থেকে পড়লেও আমার চাপাচাপিতে রাজি হয়ে গেল। টঙ্গী থেকে তখন গাজীপুর গামী রাইডার চলতো। হয়ে গেলাম হেল্পার। প্রথম দিন ভাড়া নেওয়াটা একটু কষ্টকর হলেও পরে ঠিক হয়ে গেল। একসপ্তাহে পরিবর্তন হয়ে গেল। ‘আমার বন্ধু, আমার লাইফ ষ্টাইল, রাস্তার পাশে বাথরুম সারা থেকে শুরু করে বন্ধুদের সাথে গাঁজার মত ভয়ঙ্কর জিনিসে টান দেওয়া, বালতিতে করে পানি এনে গাড়ি পরিষ্কার করা, কিভাবে টাকা মারতে হয়, এ সব কিছু শিখলাম।
সব শেষে যা পেলাম তা হল, এই পেশায় ভালমানুষীর কোন মূল্য নেই।

স্বাধ নিলাম অনেক কিছুর। রাতের অপ্সরীরা কি করে, কারা কোন ধান্ধায় ঘুরে এগুলো জানলাম। তবে এখানে শিখলাম আরেক জিনিস।
বেশির ভাগ হেল্পাররাই ড্রাইভারের গোলাম।
বেশির ভাগ হেল্পাররা জানে না আগামীকাল বলে কিছু আছে।
এ লাইনে টাকা ধার চাইলে পাওয়া যায়।
একদিন বসা থাকলেও খাবার মিলে।
এতো গেলো একজন হেল্পারের জীবনে এসে নিজেকে চেনা।

কিন্তু আমি… আমার অবস্থানে এসে নিজেকে দেখতে চাইলাম।
সবার মাঝে একটা মিল আছে আর সেটা হলো সবাই তাদের পিতামাতাকে ভীষণ ভালবাসে, পারলে কলিজা বিক্রি করে দেয় ওদের জন্য।

এরপর এক এক করে হয়েছি খেয়া ঘাটের মাঝি, ভবঘুরে, জেলখানার কয়েদী পর্যন্ত (আমাকে ক্যাম্পাস থেকে ৫৪ ধারায় একবার চালান করে দিয়েছিল)।
জীবনটা সব জায়গাতেই রং হীন পেলাম।
তবে ভবঘুরে বেকার জীবনটাই হচ্ছে এর মধ্যে সবচেয়ে কষ্টের। সব দিক থেকে এরা ভিক্ষুকদের চেয়েও নীচু লেভেলের।

একবার ভাবনা হলো মাঝ রাতে একা নৌকায় মদ খেতে কেমন লাগবে? খুব রিস্কি ব্যাপার। নিজে নৌকা বাইতে জানতাম। তো শীতলক্ষা নদীর মাঝখানে গিয়ে রাতভর চিৎ হয়ে শুয়ে চাঁদ দেখলাম।
ভয়ঙ্কর ভাবনা ছিল সেটা। তবে ওভাবেও জীবনকে বর্ণহীন পেলাম।

আর একদিন ভাবনা হল, রাতের বেলায় গরুর গাড়িতে কেউ বাড়ি ফিরবে-এই ভাবনাটা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। সেটাও পুরোন করেছি গাজীপুর মাওনাতে।

খালি পায়ে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ানো বা লুঙ্গী পড়ে ভার্সিটির অনুষ্ঠানে যোগদানের মত ভয়ঙ্কর ব্যাপারটাও করে ফেলেছি একবার।

একবার এক বিচ্ছুকে নিয়ে গেলাম বাগেরহাট। উদ্দ্যেশ্য ছিল দুজনে মিলে এলাকায় ফেরী করবো লেইস ফিতা। পথে নদী পড়ল… নদী পার হলাম, মাঝি টাকা চাইলো, বললাম আমরা থানার লোক।ব্যাটা ভাবলো আমরা পুলিশ, দ্বিতীয়বার আর চাইলো না
সাথের বিচ্ছু বলল, ‘আপনি মিথ্যা বললেন কেন?
আমি বললাম মিথ্যা বললাম কই, আমি বা তুমি কোন না কোন থানার লোকই তো, তাই না, সেটাই তো বললাম।
মাঝে মাঝে আমার মাথায় শয়তানে টোকা দেয়, তখন অনেক মজার কাজ করে ফেলি।

একবার ফার্ম গেইট গেলাম বাসে অলস ঘুরতে ঘুরতে।
অনেক টাইম হাতে, ভাবলাম ফুটপাত থেকে কয়টা টি-শার্ট কিনি, দেখি এরা কিভাবে কি করে। পরে দুইটা টি শার্ট কিনলাম ৩০ টাকায়। আর কথায় কথায় সেই বিক্রেতা আমাকে দুপুরের খাবার খাওয়ালো এবং বাসায় আসার জন্য গাড়ী ভাড়াটাও দিয়ে দিল।

একটা ঠান্ডা প্রতিশোধের কথা মনে পড়ল। আমার এক জুনিয়র ফ্রেন্ড সদ্য প্রেমে ছ্যাকা খাইছে এক মেয়ের কাছ থেকে । অনেক টাকা ফাও হারাইছে। সে কেইসটা আমাকে ডিল করতে দিল, ব্যাস হয়ে গেল কাজ শুরু।

প্রথমে বন্ধুত্ব করলাম। তারপর মাঝে মাঝে সময় দেয়া।এরপর ফাইনাল রাউন্ড। রাতের বেলা ঘুম ভাঙ্গলে বিশেষ করে রাত ২ টার দিকে ফোন দিতাম। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে দিতাম। তারপর ২ মিনিট ফাও আলাপ সেরে ফোন রেখে দিতাম।
একসময় দেখলাম তার রূপ যৌবনে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। তিন মাস এভাবে চলার পর সে একদিন আমাকে ডেকে ক্ষমা চাইল। আমি এবার তার হাতটা ঐ জুনিয়র বন্ধুর হাতে বেঁধে দিয়ে ভাগলপুর চলে এলাম।

এবার আমাকে খুব খারাপ একজন মানুষ লাগছে, তাই না ? আসলেই আমি নিজে প্রচন্ড রকম খারাপ একজন ব্যাক্তি। না হলে আমার সকল প্রিয়জনেরা এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যায়?

আমি আমার জীবনটাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছি…
একটা আলোয় ভরা অন্যটা অন্ধকার।
কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি, এই যে বিভিন্ন চরিত্রে আমি নিজে কে দেখলাম। এ সব কিছু মিলিয়ে আমি আসলে কে?
আসলে কে আমি?
নিজের মনই আমাকে উত্তর দিয়ে দিলো।
আমি আসলে সময়ের স্ফটিক।
আমি একধারে বিচ্ছিন্ন একটা সময় , মানব জনম খুব সাধন করে হয়। এ জন্ম কোনভাবে বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। অন্যকে সম্মান করার জন্য, অন্যকে ভালবাসার জন্য এ জনম। পৃথিবীর রহস্য নয়, নিজের রহস্য জানার জন্য নিজেকেই সাধন করে যেতে হবে।
আর এটা করার অন্যতম শর্ত হলো, সবার আগে মানুষ সত্য বিষয়টি মনে আনতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার কাছে পৃথিবী নিরাপদ নয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি মানুষ নই। আমি যেদিন ১০০% মানুষ হবো, সেদিন পৃথিবী আমার গোলামী করবে, আমি তার বাদশাহ হবো।

আমি কি বাদশাহ হতে পেরেছি? কিংবা মানুষ?
কিভাবে বুঝব আমি মানুষ হতে যাচ্ছি ? আমি আংশিক হয়েছিলাম- এখন আবার পতন হচ্ছে।
তবে এটাকে রোধ করার পথও রয়েছে। আর তা বেশ কঠিন কাজ, যাকে বলে নির্বান লাভ করা। যুগে যুগে সকল মহাসাধকগণ এটা করতে পেরেছিলেন। আমি এ পথে কাউকে ডাকি না। একজন মেকুর কখনো কাউকে ডাকবে না। মেকুরকে দেখে অন্যরা স্বেচ্ছায় চলে আসবে। কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডাকলে তাতে বর্তমান সমাজের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। মানুষ হিসেবে যা যা করার তা আগে যদি শেষ করতে পারি- দেখা যাবে নিজেকে সে একাই টেনে নিয়ে যাবে।

আমি যদি ধর্মের দিকে তাকাই, আমি হয়ত অনেক কিছুই পালন করি না। তবে ধর্ম পালন করেও অনেকে ধর্মের জন্য কিছুই করতে পারে না। সেটাও কি ঠিক?
… …
বঙ্গবন্ধু হলের ছাদের উপরে বসে বসে এইসব এলোমেলো ভাবনায় বিলীন হচ্ছিলাম। একটা ভূবন চিলের চীৎকারে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, চিলটি ক্রমাগত নির্দিষ্ট কিছু যায়গা জুড়ে পাক খাচ্ছে। হয়তো কোনো শিকারের সন্ধান পেয়েছে। এখন আক্রমনের পায়তাড়া করছে। আকাশের নীলের ভিতরে সৌন্দর্যের চেয়ে আমি বেদনাকে অনুভব করলাম বেশী! নিজেকে ঐ চিলের শিকার মনে হল। আমার হৃদয়ের বেদনাগুলো আমার মাথার উপরের নিঃসীম নভোতে পুঞ্জীভূত মেঘ হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। আর আমি এক শিকার হয়ে মুহুর্তে শেষ হয়ে যাবার জন্য আনন্দে চোখ বন্ধ করলাম।

আহ! যদি এই মুহুর্তেই শেষ হয়ে যেতে পারতাম!!

(ক্রমশঃ)

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!