গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেয়েরা কেন নিজেই নিজের ‘লাঠি’ হতে পারে না?
আজকাল চলার পথে কতবার যে পড়ে পড়ে উঠে চলতে হয়… চলার পথ যে কতটা বন্ধুর। আর পুরূষগুলো যদি কোনো ভাবে বুঝতে পারে এই মেয়ের বর্তমানে কোনো অবলম্বন নেই, তবেই ছোক ছোক করা শুরু করবে।
সে যে এক ডিভোর্সী যুবতী।
ওর মানুষটা ভালো-মন্দ যা ই ছিল একটা ‘লাঠি’ তো ছিল। সেই দিনগুলোতে এখনকার মত বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়নি। একটা অন্যরকম স্বাধীনতা ভোগ করে আসছিল।
কিন্তু মানুষটা যে কেন শেষ সময়ে ওরকম করল…।
কনার বড় বোন রুনা সেলাই মেশিনে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে এগুলোই ভাবছিল। পাশের রুমে মা থেকে থেকে যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে গিয়ে দেখে আসছে। এ রোগ আর সারবার নয়। ওদের সামর্থ অনুযায়ী ওরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। মাঝে মাঝে মা’র কষ্টটা দেখে মনে মনে চায় মা মরে যাক! এতো কষ্ট সহ্য করার থেকে একবারে মুক্তি পাওয়াই কি অনেক ভালো নয়? এটা ওর মনে যে ক’বার এসেছে, পরবর্তিতে লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক কেঁদেছে সে।
গরীব মানুষের কান্না ছাড়া আর কিই বা আছে?
আচ্ছা, বড় লোকেরা কি কাঁদে?
তাদের নিশ্চয়ই কান্নার মত কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। তবে সুখে কাঁদতে পারে।
নিজের উপরে এবার একটু রাগ হল রুনা।
এসব কি ভাবছে। কাজে মনঃযোগ দিতে পারছে না। অনেকগুলো অর্ডার রয়েছে। আজই ডেলিভারি দিতে হবে। হাত পা দুটোকেই আরো দ্রুত চালানো শুরু করল। তবে সেই সাথে মনটাও ভাবনার জগতে আবার কীভাবে যেন ঢুকে গেলো।
এই বিল্ডিঙের ব্যাচেলর ছেলেগুলো কনার চেয়ে কেন জানি ওকে দেখলেই বেশী কাছে ঘেষতে চায়। কনা একটু রাসভারী এবং সে নিজে স্বামীছাড়া একেলা মেয়ে বলেই কি? ছেলেগুলোকে রুনা কোনো দোষ দেয় না। ওদের তো বয়সই এগুলো করার। কিন্তু ওদের বাড়ীওয়ালা? সেও ওর এই অসহায় অবস্থার সুযোগটা কাজে লাগাতে চায়… এই বয়সেও মেয়ে দেখলে লোকটার মাথা খারাপ হয়ে যায়। এখানে এলেই ওকে মা মা করে… গায়ে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদের অজুহাতে ওর জঘন্য ইচ্ছেটা মনে মনে মিটাতে চায়… নারী দেহের স্পর্শ নিয়ে কামুকতার রাজ্যে বিচরণ করে।
একজন মেয়ের এজন্যই একজন পুরুষ মানুষ দরকার। সে থাকলে অন্যরা পিছন থেকে অশ্লীল মন্তব্য করতে সাহস পায় না… সাহায্যের নামে নির্জনে ডেটিং এর প্রস্তাব দিতেও পারে না। একজন পুরুষ ছাড়া এই সমাজে আজকাল মেয়েরা সত্যিই ‘একজন মেয়ে’ হয়ে যায়।
বাবার গলার আওয়াজে রুনার ঘোর ভাঙ্গে। বাসার সামনে এতোক্ষণ ওর মেয়ে দুটোকে নিয়ে ছিলেন। এখন ঘরে ঢুকছেন। ওদের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দেয় রুনা।
… …
বারান্দাটাই আজকাল নিজের রুমের মতো হয়ে গেছে সিদ্দিক সাহেবের কাছে।
এখানে বসলে চারদিকটা সহজেই দেখা যায়। ইদানিং একজন ‘দেখক’ হিসাবেই নিজের ভুমিকা পালন করছেন তিনি। দুই ছেলে আর ওদের মাকে নিয়ে তার যে জগতটা সেটাতে একসময় তার ভুমিকে মূখ্য থাকলেও এখন একজন নীরব দর্শক। যার অখন্ড অবসর… আর বেলাশেষের এই জীবনে তার বয়সী মানুষদের আসলে করার কিছুই থাকে না। এটাই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। প্রকৃতির অলিখিত বিধান। জীবন নামের রহস্যময় একটা ঘূর্ণিপাকে সাইক্লিক অর্ডারে ঘুরতে থাকাটাই তার প্রধান কাজ।
শরীরে রোগ-ব্যাধিও বাসা বেঁধেছে। ডায়াবেটিস ও হাই ব্লাড প্রেসার এগুলোকে তেমন পাত্তা না দিলেও কিছুদিন আগে একটা ছোটখাট হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেলো। সেটাই পরিবারের সবার দুশ্চিন্তার কারণ। তবে সেই ‘উপলক্ষ্যে’ তার প্রতি সবার যে একটা আলাদা ‘কেয়ার’ সেটাকেও তিনি খুব উপভোগ করছেন। সালেহা তো এখন আগের চেয়ে আরো বেশী হাঁকডাক শুরু করেছে। বিধিনিষেধের বেড়াটা আরো বেশী শক্ত করে তার উপর চাপিয়ে দিয়েছে। খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রেই এই নিয়ন্ত্রনটা বেশী দেখাচ্ছে সে আজকাল। তবে আজীবন ভালো ভালো খেয়ে দেয়ে অভ্যস্ত সিদ্দিক সাহেবের এই শরীরটা এখন নিয়মতান্ত্রিক জীবনকে মেনে নিতে পারছে না।
বড় ছেলে জাহাঙ্গীর আগে থেকেই বাবার খুব ন্যাওটা। মাকে না জানিয়ে চুপি চুপি বাবাকে সে মাসে মাসে ‘অতিরিক্ত’ কিছু টাকা দেয়। সেটা দিয়েই চলে তার এই ‘একেলা জীবনের রসনা বিলাস’। সকালে ও বিকেলে নিয়ম মাফিক হাঁটার সময়ে বাইরে বেড়িয়ে ‘মনে যা চায়’ সেগুলো তিনি খেয়েই চলেছেন… প্রতিদিনই। জানেন যে এগুলো তার জন্য বিষ। কিন্তু শিশুদের মতো যা ই দেখেন খেতে যে মন চায়!
আর মনের ইচ্ছের বাইরে আগেও কিছু করেননি… এখন কীভাবে সেটাকে নিষেধ করেন?
পেনশনের টাকাটা সংসারে দিয়ে দেন। গ্রামের বাড়ী থেকে চাল-ডাল এগুলো আসে। সেদিক থেকেও কিছুটা সাশ্রয় হয়।
জীবন তো এখন টাকার হিসেবে চলে।
টাকা নেই তো জীবনও নেই!
তবে কি তিনি মৃত?
হয়তো …
ছোট ছেলে বাবুলকে দেখতে পাচ্ছেন। গ্রামীন ব্যাংকের সামনের চা এর দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। ওর সাথের বন্ধুদেরকেও তিনি চিনেন। সবাই সেই ছেলেবেলা থেকেই এক সাথে বড় হয়েছে। বলতে গেলে ওনার চোখের সামনেই বড় হল। আজ ওরা যখন হোন্ডাতে চড়ে পাড়া মাতিয়ে বেড়ায়- দেখতে খুব ভালো লাগে সিদ্দিক সাহেবের। নিজের যৌবনের কথা মনে পড়ে যায়। চাকরি জীবনে নিজেও একজন তুখোড় বাইক চালক ছিলেন। সেদিনের সেই উদ্দামতার কথা মনে পড়ায় একটু হাসলেন। বিগত সোনালী দিনগুলোর নস্টালজিক মুহুর্তগুলো তাকে যেন হাওয়ায় উড়ে এসে সময়ের রথে চড়ে কানে কানে বলে গেলো, ‘ ‘কি বাবু মশায়? ভালো আছেন তো!’
আর বাসায় মন টিকল না। বিকেলের হাঁটার সময়ের এখনো ঢের বাকি। তবুও বের হবার উপক্রম করলেন। ভিতরে সালেহার রুমে একবার উঁকি দিয়ে ধীরে ধীরে দরোজা খুলে বের হলেন।
দরোজা খোলার শব্দে সালেহা বেগম বিছান থেকে উঠে এলেন।
আজ শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। এটা যে এখনো সুস্থ আছেন সেটাই আশচর্যের ব্যাপার! সংসারের ঘানি টেনে টেনে আজ তিনি বড় ক্লান্ত…
এখন একটু বিশ্রামের তার বড্ড প্রয়োজন।
কিন্তু চাইলেই কি সব প্রয়োজন মেটানো যায়?
বড় ছেলের বিয়েটা হয়ে গেলে নিজেকে শ্রান্তির কোলে তুলে দিতে পারতেন। কিন্তু ছেলে এখনই বিয়ে করতে চাইছে না। যখনই কথা তুলেছেন ভদ্রভাবে পাশ কাটিয়ে গেছে। বলেছে, ‘আরো একটু দেখি মা।‘
সে যে কি দেখতে চায় সেটাও তিনি বেশ বুঝেন। ছেলে যে সংসারের বর্তমান আর্থিক অসচ্ছলতাকে আরো একটু গুছিয়ে নিয়ে একটা স্থির পর্যায়ে সময়কে টেনে নিতে চাচ্ছে, বেশ উপলব্ধি করেন।
তারপরও… ঘরে একটা মেয়ের বড্ড অভাব বোধ করছেন আজকাল। এই বয়সে নাতীদের সাথে খুনসুটি করে করে আর নিজের ভিতরে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাওয়া স্নেহের ডালি পেতে ওদেরকে ‘মনে রাখার মত’ কিছু স্মরণীয় স্মৃতি দিতে কার না মন চায়।
সবই বোঝেন তিনি।
কিন্তু ভাগ্যের কাছে জিম্মি হয়ে কেবলই দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া করার কিছুই নেই।
সুখকে পিছু ধেয়ে আয়ত্ত করা যায় না।
তার চেয়ে সুখ নিজে এসে যতটুকু ধরা দেয় সেটুকুতেই অভ্যস্ত হওয়া ভালো।
তিনিও আজীবন সেটাই করে এসেছেন।
এই যে লোকটা সময়ের আগেই বাইরে হাঁটতে চলে গেলো… তিনি সবই দেখেছেন। তার রুমে উঁকি দেয়া… মাসে মাসে জাহাঙ্গীরের তাকে লুকিয়ে টাকা দেয়া… বাইরের হাবিজাবি খাওয়া- এসবই তিনি জানেন। তারপরও সেসব তিনি উপেক্ষা করে আসছেন। মানুষটা তার টাকা কত যায়গায় যে লুকিয়ে রাখে… সেগুলো আবার হারিয়েও ফেলে। তিনিই তার পকেটে আবার গুছিয়ে রেখে দেন… তবে সিদ্দিক সাহেব এসবের কিছুই টের পান না। যেমন টের পান না জাহাঙ্গীরের টাকার অতিরিক্ত আরো কিছু টাকাও তিনি সেই টাকার সাথে মিলিয়ে রেখে দেন।
ভালোবাসা তো দেখানোর কিছু নয়।
সেটা মনে মনে উপলব্ধির একটা ব্যাপার… একজন অপরকে না দেখিয়ে- কিছু পাওয়ার আশা না করেই ভালোবাসতে হয়। সেটাই আসল ভালোবাসা।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিদ্দিক সাহেবকে হেঁটে যেতে দেখেন সালেহা বেগম।
যে ভালোবাসা আজ থেকে ৩২ বছর আগে শুরু হয়েছিল তাদেরকে ঘিরে, সেটা আজও অমলিন রয়ে গেছে দেখে ভিতরে ভিতরে আনন্দ পান… গর্বও হয় একটু… ভালো লাগে! গালে গরম কিছু অনুভুতির সাথে সাথে দূরের সিদ্দিক সাহেব কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে যেতে থাকেন। পলক ফেলতেই ভালোবাসা নোনা জলের সাথে নিম্নগামী হয়ে সিদ্দিক সাহেবকে আবারও স্পষ্ট করে দিয়ে যায়!!
(ক্রমশঃ)
গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।