গল্প, কিন্তু গল্প নয় – ২য় পর্ব

আজিজ বলেন, দেখ সামাদ বিষয়টা আমার জানা ছিলনা। যা হোক জানলাম এবং এটার বিহিত করতে হবে। আমরা চেয়ারম্যানের কাছে যাব। এরপর মিটিং-এ আলোচনা যা হল, তা সংক্ষিপ্ত। মূল জিনিসটা আবার স্মরন করিয়ে দিলেন আজিজ এভাবে, আমরা আর চেয়ারম্যান, মেম্বারদের কোন অন্যায় কাজ মেনে নেবনা। প্রতিবাদ করব এবং প্রতিবাদ করে উক্ত অন্যায় কাজটি ন্যায়ভাবে করতে বাধ্য করব। যতক্ষন অন্যায়টি সংশোধন না হয় , ততক্ষন প্রতিবাদ করা বন্দ করা যাবেনা। শেষে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে জানতে চেয়ারম্যানের কাছে সকালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সভা শেষ হয়।
সব শুনে চেয়ারম্যান বলেন, সবাইকে তিনি তুমি-ই বলেন, দেখ বাবারা, এটা এমপি সাহেব বলতে পারবেন। আমি কিছু জানিনা। পারলে এমপি সাহেবের কাছে তোমরা যাও। ব্যাপারটিতে আমিও খুব বিরক্ত।
এমপি সাহেবের বাসার বিরাট বৈঠকখানা। এখানেই মিটিং হবে তাঁর সাথে। এসেছেন আজিজ, সামাদসহ আরো ৩/৪ জন গ্রামবাসী। আগে থেকেই সময় নেয়া ছিল তাঁদের। এমপি সাহেবের দুইজন সঙ্গী বসে আছেন, যারা থাকেন বিপদে-আপদে সবসময় তাঁর সাথে।
কিছুক্ষন পর এলেন তিনি, যার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন সবাই। তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, সামাদ কথাটা পাড়তেই। বললেন, পেয়েছ কি তোমরা, তোমাদের কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে আমার কাজের? প্রতিষ্ঠান নাই তো কি হয়েছে! হবে। আমার ক্ষমতা যে কি এবং কোথায়, তা তোমরা গ্রামের মানূষ কি বুঝবা? এক ফুতকারে মিলিয়ে দিব সব। যাও, কথা আর না বাড়িয়ে এখনই চলে যাও এখান থেকে। হুংকার ছাড়েন তিনি।
শান্ত কন্ঠে এবং হাসিমুখে বলে উঠেন আজিজ, জানেন, হাসিমুখ না করলে এখন কথাই বলতে পারবেননা তিনি এমপি সাহেবের হুংকারের কারনে। বলেন, দেখেন স্যার, আপনার কাছে আমরা এসেছিলাম বিষয়টা জানতে, আসলে। তাঁর উত্তেজনা প্রশমন করতে হবে আগে। নতুবা কথাই বলা যাবেনা আর।
আসলে জনগনের জন্য এই বরাদ্দগুলি আসে এবং আপনিও জনগনের ভোটেই নির্বাচিত হয়েছেন। তাই আপনার ভাব-মূর্র্তির ক্ষতি হবেনা কি, যদি জনগনের কাজে তা না লাগে?
কিছুটা শান্ত হওয়ার ধারায় ফিরে এলেন এমপি। বললেন, আমিতো বললাম, যেসমস্ত সংগঠনের কথা বলা হচ্ছে, সেসমস্ত সংগঠনের অস্তিত্ব না থাকলে ঐ সংগঠন তৈরী করা হবে এবং টাকাও খরচ করা হবে।
কিন্তু ছয়মাস আগে টাকা উত্তোলন করা হলেও এখনও কিছুই করা হয়নি , বলেন আজিজ।
সঙ্গীদের দিকে ইংগিত করে এমপি বলেন, কি ব্যাপার! তাঁরা আমতা আমতা করতে থাকলে এমপি আবার বলেন, আমিতো বললাম সব করা হবে, যান, এখন আমার অনেক কাজ আছে, আর বিরক্ত করবেননা। যান।
আমরা আপনাকে আরো একমাস সময় দিলাম এমপি সাহেব। এই এক মাসের মধ্যে আপনাকে এই টাকা খরচের বিষয়ে কি করা হল, তা বলতে হবে। আজিজ বলেন উত্তেজিত কন্ঠে।
না হলে! না হলে কি করবেন আপনি? উত্তেজিত কন্ঠ শোনা গেল এমপির।
তা হলে বলি, স্পষ্ট কন্ঠে বলেন আজিজ, ভেবেছিলাম আপনি সন্মানিত লোক, আপনাকে এভাবে কথা বলতে হবেনা। যা হোক, উক্ত সময়ের মধ্যে এবিষয়ে ব্যাবস্থা গ্রহন না করলে ইউনিয়নব্যপী এমন বিক্ষোভ সৃষ্টি করা হবে যে, আপনি হিসাব দিতে বাধ্য হবেন। বলে প্রস্থান করতে উদ্যত হলেন তাঁরা।
সঙ্গীরা ততক্ষনে উঠে দাড়িয়েছে। এমপি সাহেবের দিকে তাঁদের চোখ, নির্দ্দেশের অপেক্ষায়। কিন্তু না, কিছুই বললেননা তিনি। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছেন তিনি নিজেও।
আজিজ সামাদকে ওয়ার্ড কমিটিগুলি সম্পন্ন করার তাগিদ দিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন, কিছুসময় একা থেকে ভাবা দরকার তাঁর।
নিজের স্কুল থেকেই শুরু করা দরকার তাঁর, এখান থেকেই তাকে শুরু করতে হবে।
দিন দুয়েক পর স্কুল ছুটির পর স্কুলের বিরাট হলরুমে জমায়েত হয়েছে স্কুলের উচ্চ শ্রেনীর ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে পাশের কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের প্রিয় এই শিক্ষক কি বলেন, তা শোনার জন্য তারা বসেছে অনেক আগ্রহ নিয়ে। জানে তারা, এমনি এমনি ডাকেননি তাদের এই স্যার।
দেরী না করে আজিজ এলেন। জানেন, স্কুল ছুটির পর কিছু শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে শিক্ষার্থীরা। কোন ভূমিকা না করে বলতে শুরু করলেন তিনি।
আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা, তোমাদের একমাত্র কাজ শিক্ষা গ্রহন তবে তোমাদের বাসায় যদি কোন চুরিদারি, আরো পরিষ্কারভাবে বললে, তোমাদের পাওনা টাকা যদি তোমদের না পাওয়ার মত কোন ঘটনা ঘটে, তখন তোমরা নিশ্চয় চুপ করে থাকবেনা। জানি , অধিকাংশই তোমরা দরিদ্র ঘরের সন্তান। এই এলাকার উন্নয়নের জন্য, তোমাদের বাবারা-মায়েরা কাজ করবেন তার জন্য সরকার কিছু অনুদান দিয়ে থাকে। সেই অনুদান যদি কেউ তোমাদেরকে না দিয়ে নিজেরা হজম করে নেয়, তবে তোমাদের কোন দায়িত্ব থাকে কি-না সেটা উদ্ধারের?
থাকে স্যার, থাকে স্যার। সমস্বরে শোনা যায়।
আবারো বলি পড়াশোনা করাই তোমাদের প্রথম কাজ; তবে দেশের তথা এই ইউনিয়নের মানুষ হিসেবে ইউনিয়নে অন্যায়-অবিচার কিছু হলে সেগুলো রুখাও তোমাদের কর্তব্যের বাইরের কোন বিষয় নয়। তোমরা কেউ কেউ হয়তো জেনে থাকবে, এ-বিষয়ে মাননীয় এমপির সাথে আমাদের কয়েকজনের কথা কাটা-কাটি হয়েছে গম-চাল-টাকার হিসাব চাওয়ায়। আমাদের কথা, আমরা কাউকে আমাদের প্রাপ্য সম্পদ লুটপাট করতে দিবনা। আমরা এমপি সাহেবকে মাস সময় দিয়েছি; এর মধ্যে তিনি যেসমস্ত অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দিয়েছেন, যেগুলির তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে, সেগুলির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিবেন। হয় তিনি সেই প্রতিষ্ঠানগুলি বানিয়ে বরাদ্দ মোতাবেক অর্থ খরচ করবেন অথবা টাকাগুলি অতি দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিবেন। মোট কথা, প্রান্তিক দরিদ্রদের নামে যে টাকাগুলি সরকার প্রদান করে, তা কাউকে আমরা মেরে খেতে দিবনা। তোমাদের এসব বলা হল এজন্য যে, আমাদের একার পক্ষে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহন করা যদি সম্ভব না হয়, তবে তোমরা এগিয়ে আসবে। এটা তোমাদেরই কাজ এবং প্রয়োজনে তোমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।
তোমরা জানো, আমাদের রাজনীতি করার কোন ইচ্ছা নাই এবং হবেওনা। তবে ন্যায়ের পথে এই ইউনিয়ন যাতে সবসময় থাকে, সেবিষয়ে আমরা সবসময় সজাগ থাকবো এবং তাতেও যদি কাজ না হয়, তবে আমরা কর্তৃপক্ষকে চাপ প্রয়োগ করে তা করতে বাধ্য করবো। আগামী এক মাস এই ঘটনার প্রতিবাদস্বরূপ প্রতি শুক্রবার বৈকাল ৪ ঘটিকা থেকে ৬ ঘটিকা পর্যন্ত এই কলেজমাঠে আমরা বসে থাকবো। তোমাদের যাদের পড়াশোনা অথবা অন্য কোন কাজ থাকবে, তারা এসোনা। তোমরা তোমাদের পড়াশোনা অক্ষুন্ন রাখবে, কারন এটাই তোমাদেরকে আলোকিত করার একমাত্র পথ এবং এটা হেলায় হারালে অথবা এতে অলসতা করলে জীবনে পস্তাতে হবে মনে রাখবা। আপাততঃ আর কোন কথা নাই, ধন্যবাদ।
চার সপ্তাহের শেষ সপ্তাহ আজ। গত তিন সপ্তাহের চেয়ে আজকের জমায়েত অনেক বেশী ঘন। কেমন যেন একটা গুমোট ভাব দেখা যায় সারা মাঠময়। আগের জমায়েতগুলিতেও ছাত্র-শিক্ষক, বিভিন্ন, বিশেষতঃ ছোট ব্যবসায়ীদের, এমনকি পাশের ইউনিয়নেরও অনেক মানুষ এসেছিলেন। ধীরে ধীরে এই জমায়েত সমৃদ্ধ হয়েছে। কথাবার্তাও কেউ কেউ বলেছেন। তবে কিছু বলেননি আজিজ। ঠিক চারটায় এসেছেন তিনি। ওয়ার্ড কমিটিগুলির সাথে মতবিনিময় করেছেন আর সমাবেশ দেখেছেন। একমাস শেষ হয়ে যাচ্ছে। আজ তিনি বলবেন এবং নতুন কর্মসূচী দিবেন। সামাদের বক্তব্য শেষ হতে চলেছে। ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি, এমন সময় মাঠের দুই প্রান্ত থেকে হইচই শুরু হচ্ছে। কারা যেন ধর ধর করতে করতে মঞ্চের দিকে ধাবিত হয়ে আসছে।
এমন সময় সামাদকে সরিয়ে মাইক নিলেন তিনি এবং বললেন, ভাইসব আপনারা ভয় পাবেননা। আমি জানি এরা কারা অর্থাৎ যারা গম-চাল-টাকা লুটের হিসাব দিতে চায়না, হামলা তারাই করছে। ভাইসব, আপনারা হতভম্ব হবেননা, মেরুদন্ড খাড়া করে থাকুন; কিচ্ছু হবেনা। ওদের ভয় আছে, ওরা—(ক্রমশ) .Smile.

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!