‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই
আজি তাই, শ্যামলে শ্যামল তুমি
নীলিমায় নীল’
একজন মানুষের প্রতি ভালবাসা যে কতটা প্রবল,
কতটা আবেগী হতে পারে তা হয়তো এই
পংক্তিগুলোর মাধ্যমে বোঝানো সম্ভব না।
কিন্তু পৃথিবীতে আমাদের নিয়ত জীবন চলার
পথে আমরা চারপাশের মানুষগুলোর
সাথে যে আত্তার বাধনে জড়িয়ে যাই সেই অদৃশ্য
সুতোর বাঁধন ছেড়ার ক্ষমতা মৃত্যুর’ও নেই।
আমার বাসা আজিমপুর এলাকায়। আজিমপুর
গোরস্থান আমার বাসা থেকে খুব বেশী দূরে নয়।
হেটে গেলে দশ কি বড়জোর পনের মিনিট লাগে।
আমি ইদানীং প্রায় প্রতিদিনই সেখানে যাই।
কোন এক অজানা কারণে সন্ধ্যার পর প্রায় এক-
দেড় ঘন্টা আমি সেখানে থাকি, হেটে বেড়াই
পুরো কবরস্থান জুড়ে। সেখানে হাটি,
মনে মনে তেলাওয়াত করি, বেরিয়ে আসার সময়
কখনও দাদা আবার কখনও দাদীর কবরের
সামনে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করি।
এ লেখার শুরুতে উল্লেখ করা চারটি লাইন
আমি দেখেছি এক কবর ফলকে। প্রথম দেখায়
একটু
আশ্চর্য হয়েছি। এরকম কবিতা বা গানের লাইন
সধারণত চোখে পড়ে না। সেখানে থাকে দরূদ
শরীফ বা কোরআনের কিছু আয়াত। কিন্তু
আনকমন
এই লেখাটিই মৃতের প্রতি আপনজনের মায়ার
সত্যিকারের প্রতিফলন।
কবরস্থানটি বিশাল। নিউপল্টনের প্রান্ত
হতে শুরু করে নিউমার্কেটের আরেক প্রান্ত
পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। বিশাল আয়তনের এই
জায়গাটিতে আশ্চর্য রকমের এক
নিরবতা থাকে সব সময়। আমি যখন গেট
দিয়ে ঢুকে কয়েক পা সামনে এগোই হঠাৎ করেই
যেন পেছনের কোলাহলগুলো থেমে যায়। যত
বেশী সামনে যাই তত বেশী নির্জনতা যেন
গ্রাস করে। ফ্লুরোসেন্ট লাইটের সাদা আলোয়
চারপাশের সবুজের মাঝে কালচে একটা ভাব
থাকে। প্রচন্ড গরমের মাঝেও
সেখানে থাকে একটা হিমশীতল প্রশান্তির
বাতাস। শেষ শীতের দিকে হেটে যাবার সময়
নাম না জানা এক ফুলের অদ্ভুত সুন্দর
গন্ধে আমি মাঝে মাঝে থমকে দাড়াতাম।
হতে পারে সেটা সন্ধ্যামালতীর ঘ্রাণ। কিন্তু
সেই জায়গাটায় আর সেটা পেতাম না। মনে হত
যেন এই ঘ্রাণটা অচেনা কোন স্থান
থেকে এসে পুরো কবরস্থান
জুড়ে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে।
কবরস্থানের ভেতর ঢুকে কিছুদূর এগুলেই
বা দিকে কবি সুফিয়া কামালের কবর। এরপর
রয়েছে স্থপতি হামিদুর রহমানের কবর। তারপর
কয়েকজন ভাষা শহীদের কবর। তার পাশে আমার
দাদীর কবর।
এগুলো পেছনে ফেলে আমি হাটতে থাকি সামনের
দিকে। একে একে দেখি পীরজী হুজুর আর বায়তুল
মোকারমের খতিব আল্লামা উবায়দুল হকের
কবর।
কবরস্থানের ভেতর খুব বেশীজনকে দেখা যায় না।
ব্যস্তদিনের সমস্ত কাজের ফাকে মৃত
আপনজনের
প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের সময় কই! সবাই
তো আর আমার মত বেকার না।
দু’একজনকে দেখি কখনও মোনাজাতরত
অবস্থায়,
কখনও বা দেখি আঝোর ধারায় কাঁদতে। শুধুমাত্র
একজনকে নিয়মিতভাবে এখানে এসে কোরআন
তিলাওয়াত করতে দেখি। যখন কোন লাশ দাফন
করতে নিয়ে আসা হয় তখন আবার একসাথে বেশ
কিছু মানুষের সমাগম হয়। এখানেও এক ধরণের
শ্রেণী বৈষম্য থাকে। অভিজাত সমাজের কেউ
মারা গেলে বা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত কেউ
মারা গেলে সেই লাশ দাফনে আসে অনেকজন।
সেই মৃত ব্যক্তির খুব কাছের কিছু মানুষ
ছাড়া বাকি সবার মাঝে থাকে ঔদ্ধত্যভাব।
গায়ে দামী পাঞ্জাবী আর কড়া পারফিউমের
সুবাশ। কিন্তু সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষ
হিসেবে যারা পরিচিত তারা মারা গেলেও কেন
যেন আমাদের কাছে নিচু শ্রেণীর মানুষই
থেকে যায়। সেই নিচু শ্রেণীর লাশটির
সাথে থাকে চার কি পাঁচ জনের শোকাত
আপনজন। থাকে দু’একজন মহিলা। ভয়ার্ত
প্রাণে তারা মেনে চলে গোরখোদকের নির্দেশ।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি দাফনের
সব আনুষ্ঠানিকতা। লাশ কবরে শোয়ানো, গিট
খুলে দেয়া, মুখ পশ্চিম দিকে ফেরানো, চাটাই
দেয়া, গুনে গুনে বাশের বেড়া দেয়া- এসব
দেখতে দেখতে মুখস্থ হয়ে গেলেও প্রতিবারই
অন্যরকম লাগে। আমাকেও একদিন এভাবেই শেষ
বিদায় জানানো হবে- ভাবতেই প্রাণে শিহরণ
জাগে। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ মাটি চাপা পড়ে যায়
সাড়ে তিন হাতের অন্তিম আশ্রয়স্থলটুকু।
হাতে তুলে নেই মাটির ঢেলা। এরপর শামিল হই
মোনাজাতে। মৃত ব্যক্তিটি আমার কেউ না,
আমি তাকে জীবনেও দেখিনি, কিন্তু
মোনাজাতের সময় স্রষ্টার প্রতি ইমামের করুণ
আকুতিতে তার আত্তার মাগফিরাতের জন্য
আমার চোখও মাঝে মাঝে ভিজে যায়। আর
আপনজনেরা তো হু হু করে কাদতে থাকেন। এসব
কারণেই হয়তোবা আমাদের পরিচয়
আমরা ‘মানুষ’।
সৃষ্টিকর্তা আমাদের হৃদয় দিয়েছেন যার জাগতিক
অস্তিত্ব নেই কিন্তু আবেদন আছে।
ধীরে ধীরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।
একে একে সবাই যেতে থেকে। সবারই যে কাজের
তাড়া আছে। কিন্তু আমি একা সেখানে ঠায়
দাঁড়িয়ে থাকি। না, না, ভুল বললাম। শত শহস্র
ঘুমন্ত আত্বার ভীড়ে সেখানে আমি নিশ্চয়ই
একা থাকি না।
কবরস্থানের ভেতর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায়
জানাজার ঘরটি পেরিয়ে একটু
সামনে এগোলে ডান দিকে চার সারির
পুরো জায়গাটা জুড়ে ছোট বাচ্চাদের কবর।
আজিমপুর গোরস্থানের এত্ত বড় জায়গাটার
সবচেয়ে করুণতম স্থান বোধহয় এটাই। এক-দেড়
হাতের কবরের
আকৃতি দেখে ভেতরে শুয়ে থাকা ছোট দেহটার
কথা মনে হতেই কেমন যেন
একটা অনুভুতি জাগে তা লিখে বোঝানোর
ক্ষমতা আমার নেই। নিজেকে ভীষন অসহায়
মনে হতে থাকে।
এই তো জীবন আমাদের। জ়ীবদ্দশায়
জ়ীবনটাকে সাজাতে চেষ্টার কোন অন্ত নেই।
নিভৃত রজনীতে দেখা স্বপ্নটাকে পূরণ
করতে প্রাতঃরাশের টেবিলে বসে সারাদিনার
ছক কাটি। আর কর্মক্লান্ত দিনের প্রতিটি ক্ষণ
কাটে কখনও অর্জনের আনন্দে আবার কখনও
বা না পাবার হতাশায়। এমনিভাবে হঠাৎ একদিন
জীবনগাড়ি এসে দাঁড়ায় এমন এক
স্টপেজে যেখানে থাকে না জীবন সাজানোর
তাড়া, থাকে না ক্লান্ত দিনের ব্যস্ততা।
আমরা পৌছে যাই চিরমুক্তির দেশে।
সবচেয়ে অন্য রকম লাগে লোডশেডিংয়ের সময়।
সব বাতি নিভে যায়, থেকে শুধু চাঁদের আলো।
চাঁদের আলোর প্রকটতা আমি অন্য কোথাও
এমন
দেখিনি যেটা দেখেছি কবরস্থানে। পুরো অন্য
রকম একটা পরিবেশ। পৃথিবীর কোন পরিবাশের
সাথে যেটার তুলনা চলে না। মায়াভরা স্বর্গীয়
একটা ভাব। এমনি একটা পরিবেশ পেয়েছে বলেই
হয়তো মানুষগুলো ঘুমিয়ে আছে যুগের পর যুগ।
স্বর্গ
থেকে আসা হিমশীতল হাওয়া আর
ছুটে চলা অচেনা কোন ঘ্রাণের মোহ
কাটিয়ে সেই ঘুম কোনদিন’ই ভাঙ্গানো সম্ভব
না।
প্রতিদিন বাড়ি ফিরে আসার পর নিজের
মাঝে কেমন যেন একটা পরিবর্তন টের পাই। কেন
যেন নিত্যদিনের ছুটে চলা, মারামারি,
হানাহানির প্রতি বিতৃষ্ণা জাগে।
মনটা কিছুক্ষণের জন্য হলেও হালকা হয়ে যায়।
এই
অনুভবটা বুঝি সবার মাঝেই প্রয়োজন।
আমি নিশ্চিত, কেউ যদি এই হৃদয়াবেগ নিয়ে দিন
শুরু করতে পারে তবে সে অফিসে যেয়ে অনৈতিক
পথে পা বাড়াবে না, ব্যবসা করতে যেয়ে কেউ
প্রতারণার আশ্রয় নিবে না।
আমরা কেউই অনন্তকালের জন্য
পৃথিবীতে আসিনি। লক্ষ টাকার
গাড়ি বা কোটি টাকার ফ্লাট কোনটাই শেষ
বিদায়ের দিনে আমাদের সাথে যাবে না। সেই
অন্তিম দিনে আমাদের সান্তনা হবে শুধুমাত্র
মানুষের ভালবাসা। আমি যখন কবরে শুয়ে দেখব
আমার প্রস্থানে কাদছে আপনজন, আমার হঠাৎ
তৈরী করা শূন্যস্থান ভরে যাচ্ছে চেনা-
অচেনা সব মানুষের অশ্রুজলে- কেবলমাত্র
তখনি এ পৃথিবীতে আমার ভ্রমনটাকে সার্থক
মনে হবে।
আমরা কি পারি না জীবনটাকে সার্থক করতে?
হয়তোবা হ্যাঁ, হয়তোবা…….
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।