অন্ধ অনুকরণ

বাড়ীর চারপাশে যা কিছু আছে তাই নিয়ে গড়ে ওঠে পরিবেশ। পরিবেশ ভাল থাকলে মানুষও ভাল থাকে, আবার পরিবেশ মন্দ থাকলে মানুষও মন্দ হয়ে পড়ে। পরিবেশ খারাপ হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে সবাই যা বলে বা করে, কোনরকম ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই তা করা বা অন্ধ অনুকরণ করা। কিন্তু ইসলাম ধর্মে অন্ধ অনুকরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যে কাজই করো না কেন, তা আল্লাহ সন্তুষ্টির জন্য কর। কাজটি করার আগে ভেবেচিন্তে দেখতে হবে যে, এ কাজটি আল্লাহপাক পছন্দ করবেন কিনা?

তবে যদি দেখা যায়, আপনি যে পরিবেশে বসবাস করছেন সেখানকার সবাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করছে, তাহলে সবার সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করতে অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি পরিবেশ এমন হয় যে, ইসলামী নিয়ম-কানুনের বিপরীতে সবাই কাজ করছে, সেক্ষেত্রে সবার সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করলে নিজেও গোনাহর পথে চলে যাবে। কারণ ইসলামে একথা বলা হয়নি যে, বেশীর ভাগ লোক যা করছে তুমিও তা কর। বরং বলা হয়েছে, যে কাজটি সঠিক সেটা কর, এমনকি যদি তুমি এ পথে একা হয়ে যাও তবুও সেটাই কর।

এ প্রসঙ্গে নবী বংশের মহাপুরুষ ইমাম মুসা কাযেম (আঃ) তাঁর শিষ্য হিশামকে বলেছেন, “হে হিশাম, যদি তোমার হাতে আখরোট থাকে আর মানুষেরা বলে যে, এটা মুক্তা- তাতে তোমার কোন লাভ নেই। কারণ তুমি জান যে, এটা মুক্তা নয়। আবার যদি তোমার হাতে মুক্তা থাকে এবং লোকেরা বলে যে, এটা আখরোট তাহলেও তোমার কোন ক্ষতি নেই, কারণ তুমি জান যে, এটা মুক্তা।”

একই বিষয়ে হযরত লোকমান (আঃ) তার পুত্রকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “মানুষকে খুশী করার জন্য কোন কাজ করো না বা তাদের প্রশংসা শুনে বেশী খুশী হয়ো না। কারণ তাদের জন্য যত বেশী কর না কেন, তারা আসলে খুশী হবে না।”

হযরত লোকমান (আঃ) তার এ প্রসঙ্গে তাঁর ছেলেকে একটি মজার গল্পও শোনান। রংধনুর আসরে আমরা সেই গল্পটিসহ অন্ধ অনুকরণ সম্পর্কে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছি।

একবার এক চাষী তার গাধাটা বিক্রি করার জন্য তার ছেলেকে নিয়ে বাজারে যাচ্ছিল। কিছুদূর যাবার পর তারা দেখতে পেল কতগুলো ছেলে রাস্তার পাশে খেলাধুলা করছে। এ দু’জনকে দেখে ছেলেদের একজন বলল: “আরে আরে দেখেছিস-ওরা কি বোকা! এদের কেউ না কেউ অনায়াসে গাধায় চড়ে যেতে পারে, তা না করে দুইজনই গাধার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। এমন আজব লোক জীবনেও দেখি নাই।”

ছেলেটির এই ব্যঙ্গোক্তি শুনে কৃষক ছেলেকে গাধার পিঠে চড়িয়ে নিজে তাদের পিছে হেঁটে যেতে লাগলেন। কিছুদূর যাবার পর দেখা গেল কয়েকজন বৃদ্ধ পথের ধারে বসে গল্প করছে। তাদের একজন কৃষক ও তার ছেলেকে দেখিয়ে অন্য বৃদ্ধদের বলল: “দেখেছিস, দেখেছিস তোরা ছোকরার কান্ড! বাপ যাচ্ছে পায়ে হেঁটে আর ছেলে যাচ্ছে গাধায় চড়ে। এ যুগের ছেলেরা তারা গুরুজনদের কবে সম্মান দিতে শিখবে- কে জানে?”

বৃদ্ধদের এসব কথা শুনে ছেলেটি বিষম লজ্জা পেয়ে গাধা থেকে নিচে নেমে এলো এবং পিতাকে অনুরোধ করলো গাধার ওপর চড়তে। এরপর কৃষক গাধার পিঠে এবং তার পুত্র গাধার পেছনে পেছনে চলতে লাগলো। কিছুদূর যাবার পর সামনে পড়লো কয়েকজন স্ত্রীলোক। গাধার উপর পিতা এবং পেছনে পুত্রকে হেঁটে আসতে দেখে তাদের একজন বলে উঠলো: “দেখেছিস, মিনসের কি আক্কেল, নিজে আরামে গাধার পিঠে চড়ে যাচ্ছে আর ছেলেটাকে নিয়ে যাচ্ছে হাঁটিয়ে। লোকটা দয়ামায়া কিছুই নাই নাকি!”

মহিলাদের কথা শুনে কৃষক খুবই লজ্জা পেল। নিজেকে সে অপরাধী মনে করলো। লোকদের কোন কথা আর যেন শুনতে না হয় সেজন্য সে নিজ পুত্রকেও গাধার পিঠে বসালো। বাপ-বেটা দুজনেই গাধার পিঠে চড়ে কিছুদূর যাবার পর তাদের সামনে পড়লো আরও কিছু লোক। তাদের একজন কৃষককে লক্ষ্য করে বলল: “লোক: এই যে ভাই, এই গাধাটা কি তোমার?” কৃষক: “কেন? এটা তো আমারই গাধা।” লোক: “দেখে তো মনে হয় না যে, এটা তোমার গাধা।” কৃষক: “কেন, কি হয়েছে?” লোক: “কি হয়েছে জানো না? নিজের গাধা হলে তুমি কি পারতে এর উপর তোমরা দুজন লোক চড়ে যেতে? শোন মিয়া, তুমি এই অবলা প্রাণীটিকে যে কষ্ট দিয়েছো, তাতে তোমাদের উচিত এখন একে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া।”

লোকটার কথা শুনে বাপবেটা দুজনই গাধা থেকে নিচে নেমে আসলো। তারপর একটা দড়ি নিয়ে গাধার পা বেঁধে পায়ের ভিতর বাঁশ ঢুকিয়ে গাধাকে কাঁধে করে নিয়ে চললো। বাজারের কাছে ছিল একটা খাল। খালের উপর ছিল একটা পুল। বাপ-বেটা গাধা কাঁধে নিয়ে ঐ পুলের উপর উঠার পর বাজারের বহু লোক এই কাণ্ড দেখে হাসি-ঠাট্টা আর হৈ হট্টগোল শুরু করে দিল। লোকজনের শোরগোল শু গাধাটা ভয় পেয়ে পা ছুড়তে লাগলো। এক সময় পায়ের দড়ি ছিড়ে গাধাটা পানিতে পড়ে গেল।

গাধা খালে পড়ে যাওয়ায় কৃষক কিছুক্ষণ বোবার মত দাঁড়িয়ে থাকলো। নিজেকে সামলে নেবার পর সে তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো: “যে যা বলেছে তাই শুনে আমি তাকে সন্তুষ্ট করেতে গেছি। কিন্তু কাউকে তো সন্তুষ্ট করতে পারলামই না, মাঝখান থেকে আমার গাধাটা গেল।”

গল্পটি থেকে আমরা একটি বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি আর তা হলো সব মানুষের মন জয় করা কিংবা তাদেরকে খুশী রাখা সত্যিই অসম্ভব। হযরত লোকমান হাকীম তার ছেলেকে গল্পটির মাধ্যমে একথাই বুঝাতে চেয়েছেন।

কুৎসিত যুবক: হুরদের কাড়াকাড়ি

সেদিন বিকালের ট্রেনেই আমরা ঢাকায় রওনা দিলাম ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *