অন্যায় বিচারের পরিণতি

কোন সমাজ ও দেশের মানুষ তখনই ভাল থাকতে পারে যখন সেখানে ন্যায় বিচার থাকে। ন্যায়বিচার ছাড়া জীবনের কোনো অবস্থাতেই শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। ন্যায়বিচার শব্দটির আরবি প্রতিশব্দ আদল। যার বাংলা অর্থ¬ সোজা করা, সমতা রক্ষা করা, কম-বেশি না করা, ইনসাফ করা, ভারসাম্য রক্ষা করা ইত্যাদি। ইসলামী আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচার ছাড়া যেমন ইসলামী আইন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তেমনি ইসলামী আইন ছাড়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাও প্রায় অসম্ভব। আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজিদে বলেছেন, ”আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্টই নির্দেশনাদি দিয়ে পাঠিয়েছি এবং তাঁদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব মানদণ্ড তথা ইসলামী আদালত, যেন লোকেরা ইনসাফ ও সুবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।” পবিত্র কোরআনের এ ঘোষণার আলোকে আমরা বলতে পারি সমাজ, রাষ্ট্র সর্বস্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা এবং অগ্রগতি খুঁজে পেতে হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী আইনের গুরুত্ব অপরিসীম। ন্যায় বিচার না করার পরিণতি সম্পর্কে মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী তার বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবীতে চমৎকার একটি গল্প লিখেছেন। গল্পটিসহ একটি অনুষ্ঠান প্রচার করেছি রংধনু আসরে।

একবার এক হাড্ডিসার বৃদ্ধ গেল ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য । বৃদ্ধটি কংকালসার হওয়া ছাড়াও ছিল চরম ক্ষুধার্ত। ক্ষুধার জ্বালায় তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। বৃদ্ধকে দেখে ডাক্তারের বুঝতে বাকী রইল না যে, এই বৃদ্ধ বেচারার জীবন প্রায় শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। ডাক্তারের খুব মায়া হলো বৃদ্ধের জন্য। তাই বৃদ্ধ যাতে কষ্ট না পায় সেদিকে খেয়াল রেখে বললেন, ডাক্তার : তোমার যা অবস্থা-তাতে রোগ নিরাময়ের কোন সহজ পথ নেই। এর জন্য তেমন কোন ওষুধও দেখছি না। তবে তোমাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি । পরামর্শটি হলো, তোমার ভাল ভাল খাবার খেতে হবে এবং মন যা চায় তাই করতে হবে। বৃদ্ধ : আপনি ঠিকই বলেছেন ডাক্তার সাব। তবে আমার মন যা চায় তাতো খেতে পারি না অর্থাৎ আমার কাছে কোন টাকা-পয়সা নেই যে কিনে খাবো।

ডাক্তার : এটা তো সমস্যারই কথা- তবে যা নেই তা নিয়ে মন খারাপ করে লাভ কি ? যা আছে তাই মন খুশী করে খাও এবং যা করতে মনটা ইচ্ছে করে তাই করো। সুন্দর সুন্দর কল্পনা করেও কিন্তু মন ভাল রাখা যায়। বৃদ্ধ : মাশাল্লাহ। খুব ভাল ডাক্তার আপনি। একদম আমার মনের কথাই বলেছেন। জীবনে কখনো আমার মনের ইচ্ছে পূরণ হয়নি। তাই সুন্দর সুন্দর কল্পনা করাই ভালো। ডাক্তার: ঠিকাছে এখন যাও-মন যেখানে চায় সেখানে ঘুরে বেড়াও। আশাকরি তোমার মনের আশা পূরণ হবে। বৃদ্ধ : ডাক্তার সাব-আমার মন চাচ্ছে ঐ সবুজ বনের পাশে যে পানির নহর আছে তার পাশে গিয়ে বসে পানির ছলছল দৃশ্য দেখি। ডাক্তার : খুব ভাল কথা। যাও-সেখানেই যাও। খোদা হাফেজ

ডাক্তারের কথা বৃদ্ধের বেশ ভালই লাগলো। মনটা খুশীতে নেচে উঠলো। সে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল পানির নহরের কাছে। কলকল রবে পানি বয়ে চলেছে। বৃদ্ধটি নিবিষ্ট মনে পানির স্রোত ও গতিবিধি দেখতে দেখতে হঠাৎ তার নজর পড়লো নহরের পাড়ে বসা এক দরবেশের ওপর। বৃদ্ধ দরবেশকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো। এক সময় তার দৃষ্টি পড়লো সরবেশের বিশাল ঘাড়ের ওপর। এরকম মোটাসোটা ঘাড় দেখে বুড়োর হাত ইসপিস করতে লাগলো জোরসে কষে একটা থাপ্পর দেয়ার জন্য। দরবেশের ঘাড়ে

থাপ্পর বসালে এর যে কি আওয়াজ হবে সে কল্পনা পেয়ে বসলো বৃদ্ধকে। তবে তার জানা ছিল না-বেহুদা কাউকে থাপ্পর দেয়া যায় না। তার মনে পড়লো ডাক্তারের কথা। ডাক্তার তাকে বলেছিলেন, তার রোগের একমাত্র ওষুধই হলো মনে যা আসে তাই করা। ব্যস আর যায় কোথায় ! বৃদ্ধ হাতের আস্তিন গুটিয়ে হাত তুললো আসমানের দিকে। এরপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরবেশের ঘাড়ে মারলো কষে এক থাপ্পর। তড়াক করে বিরাট এক আওয়াজ হলো। সাথে সাথে খিলখিল করে সে হাসতে শুরু করলো।

থাপ্পর খেয়ে বেখেয়াল অবস্থায় দরবেশে বেচারা পড়ে যাচ্ছিলো পানিতে। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা তিনি পেছনে তাকালেন। দরবেশ বৃদ্ধকে পাল্টা থাপ্পর মারতে গিয়েও থেমে গেলেন। তার মনে হলো, বৃদ্ধকে একটা থাপ্পর মারলে সে নির্ঘাত মারা পড়বে। তাই শক্ত করে বৃদ্ধে হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন দরবেশ : এই বুড়ো, তোর ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে যে, অনর্থক আমাকে মারলি ? আবার নিলর্জের মত হাসছিস কেন ? পাগল হয়েছিস নাকি ? বৃদ্ধ : জানিনে কেন এ কাজ করেছি। শুধু মনটা চাইলো আর ডাক্তারও বলেছিল-মনে যা আসবে তাই যেনো করি। কিন্তু হাসছি এজন্য যে, চমৎকার আওয়াজ হয়েছে। বুঝতে পারলাম না, এ আওয়াজ আমার হাতের না তোমার ঘাড়ের ? দরবেশ : বুঝতে পারছিস না ? আয় তোকে বুঝাই।

একথা বলেই দরবেশ বৃদ্ধকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে চললেন কাজীর বাড়ী। কাজীকে সব কথা খুলে বলে উপযুক্ত বিচার চাইলেন। কাজী বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখে বললেন, তার উপর কেসাস অর্থাৎ থাপ্পরের বদলা থাপ্পর দেয়া সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়ে দরবেশকে তিনি বললেন,

কাজী : বন্ধু আমার, দেখতেই পাচ্ছেন লোকটিকে একটা থাপ্পর মারলে ওতেই সে মারা পড়বে। তখন তাকে হত্যার দায় আপনাকেই বহন করতে হবে। তার চেয়ে ওকে মাফ করে দিন। ক্ষমা করার ভেতরও একটা আনন্দ আছে।

দরবেশ : ক্ষমা ? কিসের ক্ষমা ? কাকে ক্ষমা করবো ? মানুষ যখন জানবে যে, এ ধরনের অন্যায় কাজের কোন বিচার হয়নি তখন শহরে অন্যায়-অবিচার ছড়িয়ে পড়বে। কেউ কাউকে মানবে না। কাজীকেও পাত্তা দেবে না। এটা একটা অন্যায় হুকুম। সব খারাপ কাজেরই শাস্তি হওয়া উচিত। আমি তাকে ক্ষমা করবো না, ত্রিশ বছর গেলেও না। কাজী : আহ-হা, আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, লোকটা হাড্ডিসার ও মৃত্যুমুখে পতিত। তার ওপর থেকে অভিযোগ উঠিয়ে নিন না !

দরবেশ এরপরও যখন বৃদ্ধকে মাফ করে দিতে রাজি হলো না তখন কাজী সাহেব বৃদ্ধের দিকে তাকালেন। বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন : কাজী : সকালে কি খেয়েছো ? বৃদ্ধ : কিছুই খাইনি।

এবার কাজী দরবেশের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাজী : দেখতেই তো পাচ্ছেন লোকটি অভুক্ত। আপনাকে না হয় একটা থাপ্পরই মেরেছো । এতে আপনার তো কিছু কমে যায়নি। আচ্ছা, আপনার কাছে কত টাকা আছে ? দরবেশ : ছয় টাকা। কিন্তু টাকার প্রশ্ন আসছে কেন ? কাজী : না- বলছিলাম কি, এ ছয় টাকা থেকে তিনটি টাকা বৃদ্ধকে দিয়ে দিন। বেচারা রুটি কিনে খাবে। দরবেশ : আজব বিচার তো ! মারও খেলাম আবার টাকাও দেবো ? এটা অন্যায়, এটা জুলুম। আমি মানি না এ বিচার।

এরপর শুরু হলো কাজী আর দরবেশের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক । এদিকে বৃদ্ধ ভাবতে লাগলো, থাপ্পর দিলে তাহলে টাকা পাওয়া যায়! আর এক থাপ্পরের দাম তিন টাকা ! এসময় তার চোখ পড়লো কাজীর ঘাড়ের ওপর। আবার রঙিন কল্পনা তাকে পেয়ে বসলো। তার হাত উঠে গেল শুন্যে। সবাইকে চমকে দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে মেরে বসলো কাজীর ঘাড়ে।

এরপর বললো, বৃদ্ধ : এবার দুজনেই তিন টাকা করে দিন, তাহলে ছয় টাকা দিয়ে ভাল কিছু কিনে খাওয়া যাবে। থাপ্পর খেয়ে লজ্জা আর অপমানে কাজীর মাথা নিচু হয়ে গেলো। কিন্তু দরবেশ ভীষণ খুশী হলেন। পকেট থেকে ছয় টাকা বের করে এনে কাজীকে উদ্দেশ্য করে বললেন দরবেশ : এই নিন, তিন টাকা আমার থাপ্পরের দাম আর তিন টাকা আপনার থাপ্পরের দাম। তবে আপনার থাপ্পরের দাম আরও বেশী হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আফসোস, আমার হাতে আর কোন টাকা নাই। নতুবা পুরো দামই দিতাম।

দরবেশের কথা শুনে কাজী আর কোন কথাই বলতে পারলো না। অন্যায় বিচার করতে গিয়ে তার যে শিক্ষা হলো, তা ভেবে সে খুবই লজ্জা পেল। “

অন্যায় বিচার কিংবা ইসলামের আলোকে বিচার না করার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনেও ব্যাপক হুঁশিয়ারী দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর বিধান দ্বারা ফয়সালা করে না তারা জালেম, ফাসেক ও কাফের। আল্লাহ মূলত বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই তাঁর দেয়া বিধানের মাধ্যমে বিচার করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।

আকাশকুসুম কল্পনা

মিতব্যয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *