
মাছ ধরতে গিয়ে মেছো ভূতটা দেখে নদীর ওপারে কে যেনো গোসল করছে। এই ভর সন্ধ্যে বেলায় কে গোসল করে? খুব জানতে ইচ্ছে করে তার। ঘোমটা টেনে টপাটপ ডুব দিয়েই চলেছে নারী মূর্তিটি। মেছো ভূত হাওয়ার বেগে নদীর ওপারে চলে যায়। এমন খাস সন্ধ্যেতে ভয় দেখানোর যে কি মজা! ঝপ করে নদীতে পড়ে সে। চারিদিকে পানি উথলে ওঠে। অনেক্ষণ ডুবে থাকে। তারপর উঠেই ঝপাঝপ ডুব লাগায়। ওমা, অবাক কাণ্ড! মেয়েটি তো ডুব থামায় না। টুপ টুপ করে দিয়েই চলেছে।
মানুষ হলে তো এতক্ষণে ভিরমি খেয়ে বাবাগো মাগো বলে ছুটে পালাত। তবে কে ওটা? মানুষ নয় নাকি? এবার চোখ জ্বেলে ভালো করে তাকিয়ে দেখে সে। আরে বাবা, এতো দেখছি সদ্য মরে পেত্নি হয়েছে। শোক এখনো সামলে উঠতে পারেনি। তাই অমন ডুবে মরছে। ডাঙায় উঠে পড়ে মেছো। ‘এঁই যেঁ নঁবাঁব জাঁদি, অঁতো ডুঁবে কিঁ আঁর হঁবে? উঁঠে এঁসো, ব্যাঁমোঁয় ধঁরবেঁ যেঁ।’ নাকি সুরের কথা শুনে ডুব থামাল পেত্নিটি। আগুন চোখে তাকাল মেছোর দিকে। ‘বঁলি মুঁখ পোঁড়া মিঁনসে, সেঁই কঁখন থেঁকে জ্বাঁলাচ্ছিঁস, দেঁবো নাঁকি চোঁখ গেঁলে? মঁরেও তোঁ দেঁখি শাঁন্তি নেঁই। সঁব জাঁয়গাঁয় ইঁভ টিঁজিং। পাঁলা এঁখান থেঁকে, নঁইলে….’ কথা শেষ হলো না। তার আগে নিজেই বাতাসে মিলিয়ে গেল পেত্নিটি।
মেছো হা করে চেয়ে রইল। আরেব্বাস, কেবল মরে এ লোকে নাম ভিড়িয়েছে, তার এতো শক্তি হয় কি করে? সব জায়গায় দুনম্বরি। বেঁচে থাকতেও নারীদের দাপট, মরেও। ভূতেশ্বর নিশ্চয়ই পেত্নিটার রূপে মজে তাকে এতো তাড়াতাড়ি অত ক্ষমতা দিয়েছে। সাত পাঁচ ভেবে মাছ ধরায় মন দেয় মেছো। বেশ মাছ ধরছিল সে, হঠাৎ দেখে বেশ খানিকটা দূরে কে যেনো ছিপ দিয়ে মাছ ধরছে। খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ে তার। মওকা মিলেছে ভয় দেখানোর, সেদিকে এগিয়ে যায় সে। কাছে গিয়ে লোকটির ঘাড়ে হাত রেখে বসে মেছো। ‘কেঁমঁন মাঁছ হঁচ্ছে মেঁসো?’ কোনো ভাবান্তর নেই। মানুষ হলে তো ভয়েই মরে যেতো এতক্ষণে। এতো দেখি নির্বিকার বসে মাছ ধরেই চলেছে। ‘বঁলি ওঁ মেঁসো…’ কথা গলায় আটকে যায় তার। কে যেনো তার ঘাড় ধরেছে শক্ত করে। দুটো রাম ঝাঁকি দিয়ে নদীর মাঝখানে ছুড়ে ফেলে। পানিতে পড়তে পড়তে মেছো শুনতে পায়। ‘হাঁভাঁতে মিঁনশেঁ, মঁরার আঁর যাঁয়গাঁ পাঁয় নাঁ। জ্বাঁলিয়ে মাঁরল।’ দুদিনেই চারিদিকে শোরগোল পড়ে গেল। ভয়ংকরতম সুন্দরী এক পেত্নি চারিদিকে ঝড় তুলেছে।
ছেলে বুড়ো সবাই তার হাতে অপদস্থ হচ্ছে। আবার তাকে দেখে কয়েকজনের কঙ্কাল থেকে শুকনো হৃদপিণ্ড বেরিয়ে আসার জোগাড় হচ্ছে। ভালবাসা নিবেদনের আগেই আবার ছ্যাকা থেকে হচ্ছে তাদের। মহা ফ্যাসাদে পড়েছে ভূতকূলের ভূতেরা। কে এই সুন্দরী? তাকে তো এ তল্লাটে আগে কখনো দেখা যায়নি। কোথা থেকে এলো, কেনই বা এলো তাই নিয়ে বটতলার ভূতের ফিসফিসানি সকাল-দুপুর-সন্ধ্যের বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগলো। সেদিন মাঝ রাতে ভূতের বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরছিল। পথে কে যেনো কাঁদছে শুনে এগিয়ে গেলো তারা। একটা অগভীর ডোবা থেকে ভেসে আসছিলো ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার শব্দ। ডোবাটার দিকে যেতে নিষেধ আছে। মুরুব্বি ভূতেরা বাচ্চাদের সবসময় নিষেধ করে ওদিকটাতে যেতে। আজকে কান্নার শব্দ শুনে নিষেধের কথা ভূলে গেল তারা। দল বেঁধে এগিয়ে গেল। বাচ্চা ভূতগুলো বেশ কিছুক্ষণ খুঁজে তারপর কান্নার উৎস খুঁজে পেলো। একটা খুব সুন্দরী দেখতে পেত্নি কাঁদছে। কালো কাপড়ে মোড়ানো কি যেনো একটা আছে তার সামনে। সেটাকে ধরে কাঁদছে পেত্নিটি। বাচ্চা ভূতগুলো তার কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিতেই কান্না থেমে গেল। তারপর কালো কাপড়টির মধ্য থেকে ঝপ করে বেরিয়ে এলো গুচ্ছ গুচ্ছ প্রজাপতি।
বাচ্চাগুলো খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল। অনেকদিন কেটে গেল অচেনা পেত্নিটিকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। তার পরিচয়টাও পেল না কেউ। দুয়েকজন সাহস করে গিয়েছিল জিজ্ঞেস করতে। প্রত্যেককেই হেনস্তা হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। কয়েকদিন পরে একটা হুতুম পেঁচা এসে খবর দিল, সেই পেত্নি এখন ভূতেশ্বরের দরবারে চাকরি পেয়েছে। ভুতেদের ক্ষমতা কমানো-বাড়ানোর দায়িত্ব এখন তার হাতে। সে নাকি নিজের চোখে দেখে এসেছে। তবে কে সে, কি তার পরিচয় সেটা পরে জানাবে বলে হুশ করে উড়ে গেল পেঁচাটি। এ প্যাঁচাটিকেও আগে কেউ দেখেনি এখানকার ভূতেরা।