
পেছনের বেঞ্চে এক কোনে বসে ছেলেটি।টিচারদের চোখে পড়ে না। পড়বেই বা কিভাবে? অ্যাট্রাকটিভ, শাইনিং, হ্যান্ডসাম কিছুই না। একটুখানি চেহারা। কালো কুচকুচে গায়ের রঙ। সাড়ে চারফুট লম্বা হলেও হতে পারে। শুকনো চুল কোঁকড়ানো ঢেউ খেলানো। অবিন্যস্ত চিরুনির আঁচড়।কিন্তু মুখশ্রীটা ভারি মিষ্টি।আমি ওকে কোনোদিন ক্লাসে বিরক্ত করতে দেখিনি। একে তো গ্রামের স্কুল। তায় আবার ঘরের মাপে সিটসংখ্যা অনুপাতে ছাত্রসংখ্যা প্রায় দেড়গুন। হবেই তো।সরকার নতুন স্কুল খুলছে না। টাকা নেই তাই। শিক্ষকের সংখ্যাও ছাত্র অনুপাতে বাড়ছে না।
ছাত্র সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছে। কোষাগার সামাল দিতে তাই এক অভিনব উপায় আবিষ্কার হয়েছে। শিক্ষকপ্রতি ছাত্রসংখা ৪০ এর জায়গায় ৮০ করে দেওয়া হলো। ঘর বেঞ্চি সব একই রইলো। বেঞ্চপ্রতি ছা্ত্রসংখ্যা ৫ এর জায়গায় ৬ বা ৭ হলো। বাদবাকি মেঝেতে ঠাঁই পেলো। সরকার বললো ‘ফ্রি এডুকেশন’ দেওয়া হচ্ছে। বারো ক্লাস পর্যন্ত। ওদিকে ‘স্কুল কমিটিগুলো’ ‘ডোনেশন’ আদায় করছে বছরে পাঁচশো ছয়শো হাজার টাকা। সরকারি ‘ফি’ ঊণসত্তর টাকা আলাদা। সরকার ৫-৬ ক্লাস পর্যন্ত ‘বিনামূল্যে বই’ দেয়। পূজোর আগে স্কুলে বই আসে না। অগত্যা আগের বছরের পড়ুয়ারা প্রমোশনের আগে পুরণো বই ফেরত দিলে নবাগতরা ভাগ করে নেয়। অনেকের বেশ কিছু পৃষ্ঠা ছাড়াই বই পড়তে হয়।বছরের প্রায় মাঝামাঝি নতুন বই পাওয়া যায়। এতোসব কথা বলছি কারণ ক্লাস নাইনে পড়া বর্তু এভাবেই পরপর চারটে ক্লাস পেরিয়ে এসে শেষ বেঞ্চের কোনে জায়গা করে নিয়েছে। অন্যসব পড়ুয়ারা মোটামুটি পরিচ্ছন্ন ইউনিফরমে আসে। তবে গ্রামীন স্কুলে সব পড়ুয়ার সে সঙ্গতি নেই।বর্তু মুণ্ডা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমি শহর থেকে আসাযাওয়া করি। ক্লাসে নিয়মমতো পড়িয়ে চলে আসি। আবার অতো পড়ুয়ার ভীড়ে প্রশ্নোত্তর করার সময়ও হয় না।
পিরিয়ড মাত্র ৪০ মিনিটের। তবুও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে যাচাই করে নিই পড়ুয়াদের অগ্রগতি। এ কারণেই প্রশ্ন করেছিলাম গাছে ফুল ফোটে কেন আর কিভাবে? অন্যেরা চোখ চাওয়াচাওয়ি করে বা চুপ করে থাকে মাথা নিচু করে। শেষ বেঞ্চে কোণায় বসা ছাত্রটি হাত তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘স্যর, ফ্লোরিজেন হরমোন সক্রিয় হলেই ফুল ফোটে। এরপর আনুসঙ্গিক প্রসঙ্গগুলি খুব সহজ কথায় গুছিয়ে বলে। আলোর ‘ফোটন’ কণার উপস্থিতি, ফুলের বর্ণ আর গন্ধের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি সবই ছেলেটি জেনে নিয়েছে। সেদিন থেকে ব্যাকবেঞ্চার ছেলেটি আমার নজরে পড়েছে। ওকে ডেকে আনি। কি নাম তোমার? স্যর, বর্তু মুণ্ডা। আমি একটু অবাক হই। এসব তো ছোটনাগপুর অঞ্চলে আদিবাসীদের পদবী। বুঝলাম ও সাঁওতাল উপজাতির। ওর শারীরিক গঠন ও মুখশ্রী আমার অনুমান সত্য প্রমান করে। ছেলেটি অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি মাথা উঁচু করে টানটান হয়ে দাঁড়াতে আদেশ করলাম। প্যান্টে গোঁজা জামায় বোতাম নেই। সাদা জামা অপরিষ্কার। সামান্য ছেঁড়া। ওর ওই একটাই জামাপ্যান্ট অর্থাৎ ‘স্কুলড্রেস’। ক্লাস মনিটরকে ডেকে নির্দেশ দিই আজ থেকে বর্তু ফার্ষ্টবেঞ্চে বসবে। মনটা একদিকে বিষণ্ণ অন্যদিকে খুশি। বিষণ্ণতার কারণ মেধাবী ছাত্রটির চরম দারিদ্র্যের প্রকাশ। খুশির কারণ অমন ছাত্রকে খুঁজে পাওয়া অনেক পড়ুয়ার ভীড়ে। মনে পড়লো আমার এক ছাত্রের কথা। ওর বাচ্চা মেয়েটিকে মাত্র ছ-মাস বয়স থেকেই বিশেষ ব্র্যাণ্ডের ‘শিওর ড্রিংক্স’ খাওয়াচ্ছে মেধা বাড়াবার আশায়। এখন আড়াই বছর বয়েস। শরীরের ওজন বয়স অনুপাতে কম। সাধারণ খাবার ভাত-ডাল-মাছ-দুধ পছন্দ নয়। এবার খুব নামজাদা এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। ওর মা গাড়ি করে নিয়ে যায় নিয়ে আসে। আশা করছে মেয়ে বড়ো হলে ‘বড়ো কিছু’ হবে। বেচারা বর্তুর ময়লা ছেঁড়া জামা পরে ‘বড়ো কিছু’ হবার কোনো আশা নেই।
পরদিন অফ্ পিরিয়ডে বর্তুকে ডেকে পাঠাই। সামনে দাঁড়িয়ে থাকে মাথাটা নিচু করে। হাত দুটো জোড় করে। আদেশের সুরে বলি ‘হাত নামা। সোজা হয়ে দাঁড়া’। আদেশমতো হাত নামায়। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে ইতস্ততঃ করে। ওদের পরিবারে ও-ই হলো প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। সোজা হয়ে দাঁড়াবার আধিকার কোনোদিন পায় নি ওর বাপ-ঠাকুর্দারা। ও-ও তাই। ভালো করে নজর করি। প্যান্টটা পালটেছে। জামাটা কেচে নিয়েছে। ছেঁড়াটা মেরামত হয় নি। জামার বোতামও লাগানো হয় নি। কারণটা জিজ্ঞেস করি। উত্তর : মা বলেছে সময় পেলে লাগিয়ে দেবে। কটা স্কুলড্রেস আছে? উত্তর : একটাই স্যর। আর প্রশ্ন করিনি। রবিবার সকালে বাড়িতে দেখা করতে বলি। ও ক্লাসে ফিরে যায়। ওদের হাজিরা খাতাটা মিলিয়ে দেখি। প্রতিদিন হাজির। দু-চারদিন বাদে। দুঃখ হচ্ছিলো এটা ভেবে ছেলেটাকে আগে কেন ‘আবিষ্কার’ করতে পারি নি। নেহাত ছেলেটি আমার প্রশ্নের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পেরেছিলো তাই ওকে ডেকে নিয়েছি। ওর জন্য ‘কিছু’ করা দরকার। রবিবার সকালে বর্তু দেখা করতে এলো। বাজারের দিকে যাবার জন্য দরজা খুলেই দেখি বর্তু গেটের মুখে মাথা নিচু করে চুপচাপ দঁড়িয়ে। কিরে?কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছিস এখানে? আধাঘন্টা স্যর।
বর্তুর সলজ্জ সংক্ষিপ্ত জবাব। ওকে ডেকে ড্রইংরুমে নিয়ে যাই। বসতে বলি। ও হাঁ করে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে। সোফায় বসতে ইতস্ততঃ করছে। ধমক খেয়ে গুটিয়ে বসে থাকে এককোনে। আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে বলি। বড়ো বেদনাময় বড়োবড়ো দুটি চোখ। প্রশ্ন করে জানতে পারি অন্য ছেলেরা ওকে ফার্সটবেঞ্চে বসতে দেয় না। কারণ ও নাকি সেদিন আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে ঠিক কাজ করে নি। জেনে নিই তাদের নাম। ওরা সম্পন্ন ঘরের ছেলে। ব্যবসায়ী। পড়ালেখায় মন নেই। পরিবারের ব্যবসা দেখা মূল উদ্দেশ্য। তাই মাধ্যমিকটা পাশ হলেই চলবে। কেউ কেউ আমার পাড়াতেই থাকে। পরদিন ক্লাস মনিটরকে ডেকে ধমকে দিয়ে ঐসব ছেলেকে নজরে রাখতে বলি।
প্রতিদিন রিপোর্ট করতে হবে ওকে। কাজ হয় তাতে। মনে হলো বর্তুকে জেরা করে ওর হাল-হকিকৎ জেনে নেওয়া দরকার। ওর বাবার নাম পেশা ইত্যাদি খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে ওকে সপ্রতিভ করে তোলার চেষ্টা করি। যা জানা গেল তা হলো ওর ‘বাড়ি’ স্কুল থেকে মাইল দুই দূরে একটা নামকরা ইঁটভাটা। ওদের নয়। ওর বাবা-মা ওই ইঁটভাটায় মজুরের কাজ করে। খুব ছোটবেলায় ওকে কোলে নিয়ে ওর বাবা-মা ছোটনাগপুর থেকে এখানে চলে আসে। খেয়েপরে বাঁচবার তাগিদে। ও শুনেছে এখানকার একজন মজুর-সাপ্লাই এর দালাল ওদের ৪৫ জনের এক দলকে এখানে কাজের জন্য নিয়ে আসে। ওর নাকি একটা দিদিছিলো। জঙ্গলে বাবা-মার সঙ্গে শালপাতা তুলছিলো। ডাইনির যাদুতে মারা গেছে। বুঝলাম অশিক্ষা আর অন্ধ কুসংস্কার থেকে ছেলেটা অন্তত মুক্তি পেয়েছে স্কুলে পড়বার সুযোগ পেয়ে। আসলে অপুষ্টি আর রোগভোগ যে কারণ হতে পারে তা ওরা জানে না। আমার মনে পড়ে যায় গিরিডির উশ্রী ফলস্ দেখতে গিয়ে অন্তত ১৫-১৬ জনের বাচ্চা বুড়োর দল আমাদের গাড়িটা ঘিরে হাত ধরে টানছিলো ‘গাইড’ হতে চেয়ে। অর্ধনগ্ন করুণ মুখগুলি আমাকে খুব বিচলিত করে তুলেছিলো। আমরা এক একজন এক একটা ‘গাইড’ সঙ্গে নিয়ে উশ্রীর শ্রী দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আর ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম গরীব অভুক্ত মানুষগুলির প্রতি সরকারের বিশ্রী অবহেলা দেখে।
প্রত্যেকে দু-পাঁচ টাকা হাতে পেয়ে খুশির হাসি হাসছিলো। একজন বয়স্ক মানুষ আমার ‘গাইড’ হয়েছিলো। ব্যাপারটা কিছুই না। আমরা ঘুরেফিরে দেখছিলাম। ছবি তুলছিলাম। ওরা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছিলো। বয়স্ক লোকটি আমাদের খুশি করতে একটা ঝুঁকে পরা তেঁতুলগাছের ডাল ধরে তরতর করে উঠে গেলো। ছবি তুলিয়ে নেমে এলো। ওকে দু-টাকা বকশিশ দিতে বহুৎ খুশির কথা জানালো। আমাদের গাড়ি বেরিয়ে গেলো। ওরা অন্য গাড়ির আশায় অপেক্ষা করছিলো নিশ্চয়। বর্তু একটু করে বলে। আমি শুনে যাই। খুব কম কথা বলে ছেলেটি। থাকে ইঁটভাটায় মজুরদের জন্য তৈরি আলগা ইঁট সাজিয়ে গড়া সারসার চালাঘরের নিচে। ছ-ফুটের বেশি উঁচু নয়। প্রাগৈতিহাসিক বন্য মানুষদের মতো গুহা আর কি। খুব সকালে উঠে পড়ে। বই নিয়ে বসে। সকলে পান্তাভাত বা বাসি রুটি খেয়ে নেয়। বাবা-মা কাজে বেরিয়ে যায়। বর্তু সওয়া দশটা নাগাদ স্কুলের দিকে পা বাড়ায়। ২ মাইল পথ হেঁটেই যাওয়াআসা করে। বাস বা ভ্যানরিকসা চড়ে না। পয়সা নেই তাই।বর্তু আরো জানালো ছুটির দিনে বাড়তি আয়ের জন্য মা-বাবার সঙ্গে কাজে হাত লাগায়। আমি সব শুনে বাড়ি ফেরার জন্য বাসভাড়া দিতে যাই। সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মৃদু ধমকে কাজ হলো। পরদিন বিকেলে দেখা করতে বললাম। ও বেরিয়ে গেলো। গিরিডির দেখা সেই করুণদৃষ্টি ‘গাইড’দের কথা মনে করিয়ে দিয়ে গেলো। ওদের ‘এন্টারটেনমেন্ট’ বলে কিছু নেই। শুধু বাঁচার জন্য খাওয়া আর খাওয়ার জন্য ঘাড় নুয়ে পরিশ্রম করা। এভাবেই জীবনের প্রভাত শুরু আর জীবনের সূর্যাস্তও একইভাবে।
পরিবর্তন সমাজবিকাশের প্রধান শর্ত। ওদের আদিবাসী সমাজে পরিবর্তন বলে কোনো শব্দ নেই। ছিটকে বেরিয়ে আসে দু একটা ভাগ্যবান। সমগ্র ভারতবর্ষ ঢুঁরে ওদের গুনে বের করা যায়। তাই বর্তু আমার একটা ‘এক্সপেরিমেন্ট’এর বস্তু বলা যায়। পরদিন যথারীতি গেটের মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বর্তু। ডেকে বসালাম। ওকে দু-সেট স্কুলড্রেস আর একজোড়া কেডস হাতে তুলে দিয়ে বলে দিলাম কাল থেকে ওগুলো পরে স্কুলে আসতে। বর্তু নিঃশব্দে ওগুলো তুলে নেয়। যাবার সময় আমাকে ওদের ‘বাড়ি’ যেতে আমন্ত্রণ জানালো। পরের রবিবার। সকাল দশটা নাগাদ পা বাড়াই ‘বর্তুদের’ ইঁটভাটার উদ্দেশে। বর্তু ঐ ইঁটভাটাকে ওর ‘বাড়ি’ মনে করে। ওখানে থেকেই ও বাঁচার লড়াই লড়ছে। আর আমি ঠিক করেছি ওকে লড়াইতে জিততে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাবো। আমাকে দেখতে পেয়েই বর্তু ছুটে আসে। পায়ে হাত দিতে যায়। ধরে ফেলি। ওর দুটো হাত কনুই পর্যন্ত চটচটে কাদামাখা। জিজ্ঞেস করি কাদা ঘাঁটছিস, পড়াশোনা করিস না? ওর সংক্ষিপ্ত উত্তর : স্যর, ছাচবাক্সে ভরার আগে কাদা মেখে নরম করে নিতে হয়। চল তো। দেখি তোর কাজ। আমার নির্দেশে ইঁটভাটার ঝিলের ধারে নিয়ে গেলো আমাকে।সার দিয়ে মজুরেরা কাদা চটকে চটকে কাঠের বাক্সে ভরে চেপে চেপে নরম চৌকোণা ইঁটগুলো বের করে এনে সারি দিয়ে রোদে দিচ্ছে। শুকনো ইঁটগুলো অন্য মজুরেরা বিশাল কুয়োর মতো চুল্লীতে সাজিয়ে রাখছে। ভরাট হলে হাজার হাজার ইঁট আগুনে পুড়ে লাল হবে। ঠাণ্ডা হবার পর ওগুলো পাঁজা করে সাজিয়ে রাখবে। লরিগুলো এসে ইঁট ভরে নিয়ে চলে যাচ্ছে। চারিদিক ধুলো আর ধোঁয়ায় ভরা। বর্তু ছুটে গিয়েএকটা পায়াভাঙা টুল এনে আমাকে বসতে দিলো। দূরে আঙুল তুলে দেখায়। ‘আমার বাবা-মা’। ওরা একই কাজ করে যাচ্ছে মাথা নামিয়ে। বর্তু একদৌড়ে ওদের ডেকে আনে। আমাকে দেখিয়ে বলে ‘আমাদের স্যর’। ওরা কাদামাটি মাখা হাত জোড় করে হেসে নমস্তে জানালো। দেহাতি হিন্দি আর বাঙলা মিশিয়ে বললো‘মাস্টরসাব আইয়ে। হমার গরিবখানায় একটু বোসবেন’। বলে হাসলো। হাসিটা ঠিক হাসি নয়। দীনতায় ভরা। পিছু পিছু এগুই ওদের ‘বাড়ি’ দেখতে। অসম্ভব ব্যাপার! এতো ছোট অন্ধকার খুপরি গুহায় মানুষ থাকতে পারে? আরো দেখা বাকি ছিলো। খুপরির শেষ মাথায় একজোড়া ছাগল কাঁঠালপাতা চিবুচ্ছে আরামে। বাইরে কয়েকটা মুরগির বাচ্চা মাএর পিছু পিছু খুঁটেখুঁটে খাচ্ছে। বর্তুর বাবা বর্তুকে সামনের দোকান থেকে মাস্টারবাবুর সম্মানে চা আনতে পাঠায়। আমি আঁতকে উঠে বাধা দিই। সরল মানুষগুলো কারণটা বুঝতে না পেরে একটু বিষণ্ন হয়। আস্তানার বাইরে একটা কালিমাখা গর্ত। ওদের চুলা। বুঝি ওদের আমাদের মতো রান্নাঘর নেই। বর্তুর দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা আগেই শুনেছি। ওর মা হাতজোড় করে মিনতি করে : মাস্টরবাবু, বর্তুর বহুৎ নসীব আপনার দয়া পেয়েছে। কৃপা করে যদি ওকে এই বহুৎ মেহনতি জীবন থেকে মুক্তির পথ বাতলে দেন। ওর মাএর কুণ্ঠাভরাআর্তি আমাকে বিচলিত করে তোলে। বলে এলাম ওর জন্য যতোটুকো করা সম্ভব তা অবশ্যই করবো। আজ যাই। ওরা আমাকে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়। ওর মা বলছিলো বর্তু ওদের তুলনায় বেশি ইট তৈরি করতে পারে। কিন্তু পড়ালেখায় সময় দেবার জন্য শুধুমাত্র ছুটির দিনেই ও ‘কাজে’ হাত লাগায়।বাড়ি ফিরে এলাম। সারাদিন বর্তুদের অসম্ভব অসম জীবনযুদ্ধ আমার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। বর্তুর জীবনের মোড় ঘোরাতেই হবে।
ওটা আমার চ্যালেঞ্জ। ‘মানবসম্পদ’ শব্দটা কথার কথা হিসাবে না দেখে বর্তুর মেধাকে কাজে লাগাতেই হবে। এজন্য পরদিন থেকেই আমার বাড়িতে ওর অনুশীলন শুরু হলো। বইপত্র, পোশাক, যাতায়াত এমনকি খাবার ব্যবস্থাও আমার দায়িত্ব। আমার যা করতে হতো তা হলো ওকে পাঠ্যবই ছাড়াও অতিরিক্ত অনুশীলন করানো। বর্তুর ঝটপট সবকিছু আয়ত্ব করার সহজাত গুণ ছিলো। তাই অনায়াসে ক্লাসের সব ছেলেকে পিছিয়ে ফেলে টিচারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ও টেস্টের পর ফাইনাল পর্যন্ত আমার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করবে ওর বাবা মাকে জানিয়ে রাখি। ততোদিন ওর মজুরের কাজ বন্ধ থাকে। ওর বাবা আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। কৃতজ্ঞতায় সম্ভবত। ওর মাএর হাতে কিছু টাকা দিয়ে এলাম। বর্তু মন দিয়ে পড়ছে ওর ওর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে। আমি আমার ঘরে বসে ভাবছি ওর কথা। রবিঠাকুরের ‘সহজপাঠ’এ লেখা দুটি লাইন ঃ ‘কাল ছিলো ডাল খালি\আজ ফুলে যায় ভরে। বল দেখি তুই মালি\হয় সে কেমন করে’। মালি বলতে না পারলেও বর্তু পেরেছিলো। আর তাই তো বর্তু আমার চোখে পড়ে যায়। ওর মেধার প্রকাশ ঘটাবে ওর পরীক্ষার ফলে। আমি নিশ্চিত। ছেলেটা ছাগল-মুরগির সঙ্গে অন্ধকার বদ্ধ খুপরিতে চাটাই পেতে পড়াশোনা করে। ওটা ওর ‘বিছানা’ কাম ‘ড্রয়িংরুম’। ওর ভাগ্য নির্ধারিত স্থান। ডাল-রুটি-পান্তা ওর ভাগ্যনির্ধারিত আহার আর কাদার তালথেকে ইঁট বের করে আনা ওর ভাগ্যনির্ধারিত ‘কাজ’। বর্তুকে লড়তে হবে সেইসব পড়ুয়াদের সঙ্গে যারা প্রতি বিষয়ে একাধিক ‘মাস্টার রাখে’। যারা সেরা স্কুলে পড়ে। ঠাণ্ডাঘরে হালকা মিউসিক টিউনে মন দিয়ে অঙ্ক কষে। ব্রেকফাস্ট শুরু করে দুধেভেজানো ফ্লেক্স দিয়ে আরডিনার শেষ হয় মেধাবর্ধক ‘হেল্থড্রিংস’ দিয়ে। এমন প্রতিযোগিতায় ‘বর্তুরা’ সমানে-সমান লড়বে ভেবে জেদ চেপে বসে আমার। ওকে অন্ধকার থেকে বের করে আনতেই হবে। বর্তু আমাদের অবাক করে দিয়েছে ওর মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টে। লাখো পড়ুয়ার মধ্যে বর্তু ফোর্থপ্লেস পেয়েছে। মিডিয়া ইন্টরভিউ দিয়েছে। ওকে টিভি পর্দায় দেখেছে সবাই। শর্টফিগার কালো বড়োবড়ো চোখ মেলে সপ্রতিভ জবাব দিয়ে যাচ্ছে। আমার বড়িতে ওর বাবা-মাকে ডেকে দেখাই। ওরা জড়োসড়ো হয়ে সব দেখে। আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে। ‘মাস্টারসাব, আপনার কৃপা কোনোদিন ভুলতে পারবো না’। বর্তু আর ‘পিছিয়ে পড়া’ বর্গের মতো নেই।
মাথা উঁচু করে চলতে শিখেছে। ওর পড়াশোনা দেখভালের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়েছি। দীর্ঘ চেষ্টার বলে বর্তু মুণ্ডা একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়র। দিল্লিতে কাজ করে। আমি অবসর নিয়েছি। বর্তু আমাকে ওর নয়দায় কেনা ফ্ল্যাট দেখিয়ে এনেছে। ওর স্ত্রী বাঙালি। দিল্লিতে শিক্ষকতা করে। বাবা—মাকে ইঁটভাটা থেকে মুক্ত করে নিজের কাছে রেখেছে। গতবছর সিমলা যাবার পথে বর্তুর ওখানে ঘুরে যাই। ওর ছোট্ট বাচ্চাটা ওর মতো বড়বড়ো চোখ মেলে আমার কোলে লাফিয়ে পরে। বর্তুর বাবা-মা সজল অথচ হাসিমুখে আমার হাতদুটো চেপে ধরেঅব্যক্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আমার চেষ্টা সার্থক হয়েছে। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি। উশ্রী ফলসে দেখা করুণ মুখগুলো চোখেরপর্দায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। বর্তুদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বেড়িয়ে পড়ি আমার গন্তব্যপথে।