শিয়াল আর বেজির লড়াই

পাহাড়ে ওঠা কঠিন কাজ। কিন্তু সে কাজটাই করার পণ করেছে শিয়াল পণ্ডিত। তার বুদ্ধির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লেও শক্তির নাম চারদিকে ছড়ায়নি। সেটাই চাই তার। বন্ধু সজারু তাকে বার বার বোঝালেও সে মানতে নারাজ। বেজির চেয়ে সে আগে উঠবেই। বেজির চরম শত্রু সাপও তাকে আশ্বাস দিয়েছে, লাগলে তাকে সর-সর করে টেনে তুলবে উপরে। সাধ্য কী বেজি তাকে পরাস্ত করে! খুব সকালে যাত্রা শুরু করেছে দু’জনে। আম্পায়ারিংয়ে আছে কুকুর। শিয়ালের খুবই আপত্তি ছিল এতে। কিন্তু বেজি যখন বলল, কুকুর তো আমারও শত্রু, তোমারও শত্রুÑ নিরপেক্ষ তো একেই বলে; তখন আর পণ্ডিতের মুখে কথা জোগালো না। হুইসেল বাজানো হলো কুকুরের তীব্র হুঙ্কারের মাধ্যমে। পথের বাঁকে বাঁকে দাঁড়ানো একেকটি কুকুর সেই ডাক রিলে করে পৌঁছালো পর্বতশৃঙ্গে দাঁড়ানো ভল্লুকের কাছে। ভল্লুকের বিচারপতি হওয়া নিয়েও আপত্তি ছিল শিয়ালের। বাঘ হলো তার মামা। সে হবে বিচারক। কিন্তু সবাই বললো, অন্য কথা। তাদের মতে, সমতলে বাঘ রাজা হলেও পাহাড়ের ক্ষমতা ভল্লুকের। আর পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা বাঘের পক্ষে যখন তখন সম্ভব নয়। সময়ও নেই তার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানতে হয়েছে শিয়ালের। সূর্য ওঠার এখনো অনেক দেরি।
এই ঝাপসা অন্ধকারই দরকার তার। যদিও তার পা লম্বা, ছুটতেও পারে খুব, তবুও শিয়ালের বুকের ভেতর পরাজয়ের ভয় রয়েই গেছে। সেই যে অতীতকালে একবার কচ্ছপের সাথে পাল্লাপাল্লিতে হেরে গিয়েছিল চতুর খরগোশ, সে গল্প কে-না জানে। শিয়াল হয়তো পথে ঘুমিয়ে পড়বে না, তাই বলে বেজিকে অবহেলাও করা যায় না। তারও তো বন্ধুর সংখ্যা কম নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা, কুকুরকে সে যতটা ভয় পায়, বেজি ততটা পায় না। আর সাপের এক নম্বর শত্রু হলেও বেজির চলাফেরা সাপের মতোই দ্রুত। পথ খুবই দুর্গম। বিশেষত, খানাখন্দের জায়গাটা তার মোটেই ভালো লাগে না। পণ্ডিতের পোশাকও নষ্ট হয় সেখানে। কাঁটা-ঝোপের এলাকাও তার পসন্দ নয়। কিন্তু বেজি সে এলাকায় খুবই স্বচ্ছন্দ। এই দুটো বিপদের পরও আছে ছোট নালাটা। যদি ঢল আসে, পার হওয়া খুবই সমস্যা। চশমায় পানি লাগলে পাড়টাও ঠিকমত দেখা যায় না। কিন্তু বেজির এ সমস্যা নেই। কিভাবে যেন পুঁচকেটা ঠিকই পার হয়ে যায়। ছুটতে ছুটতেই প্ল্যানটা ফাইনাল করে শিয়াল। পথের দুই গোপন-গর্তে আরো দুটো শিয়ালকে লুকিয়ে রেখেছে সে। তারই মতো দেখতে তারা। গোপনে ‘রানার’ বদল হবে। তারপর ‘বিজয়ী’কে নিয়ে যেই উল্লাস শুরু করবে তার বন্ধুরা, ফাঁকে ঢুকে আবার জায়গা নেবে সে। এভাবেই হারাবে সে বেজিকে। তিনটে আনকোরা শিয়ালের সাথে পাল্লা দিয়ে কি ছোট্ট বেজি পারবে? কক্ষণো না। হাসতে হাসতেই প্রথম গর্তে ঢুকল সে। দ্বিতীয় শিয়াল তৈরিই ছিল। পণ্ডিত ঢুকতে না ঢুকতেই সে লাফ দিয়ে বাইরে বের হয়ে ছুটল। পিছু পিছু আসা দাঁড়কাক এমনিতেই চোখে দেখে কম। শিয়ালদের কারসাজির কিছুই সে টের পেল না। ভাল মানুষের মতো দ্বিতীয় শিয়ালটারকে ট্র্যাক করে উড়তে লাগল সে। বেজি প্রাণপণ দৌড়েও একটুর জন্য হেরে গেল।
মুখের মেকাপ ঠিক রাখার জন্য শেষের শিয়ালটাকে আস্তে ছুটতে হচ্ছিলো। বেজি প্রায় ধরেই ফেলেছিল তাকে। ছোট সব পশু তাকে জোর উৎসাহ দিলেও মুরগি, কবুতর আর শালিকরা চুপ রইল। বেজি তাদের বিষণœ মুখ দেখতে যেয়ে আরেকটু পিছিয়ে পড়ল। সেই সুযোগে শেষ লাফটা দিয়ে শিয়াল চূড়ায় লাফিয়ে পড়ল। পড়বি তো পড় মালির ঘরেÑ একেবারে ভল্লুকের কোলের মধ্যে। ভল্লুক ফিসফিস করে বলল, ভাগ্যিস, আজ আমি বিচারক। নইলে তোর মতো শয়তানের ঘাড়টা এক্ষুনি মটকে দিতাম। ভয়ে শিয়ালের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। অনেক কষ্টে সে বন্ধুদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। হুক্কা-হুয়া-হুররে; হুররে-হুররে। সবাই তাকে নিয়ে নাচ শুরু করে দিলো। সে-কি নাচ, স্যারসদের বার্ষিক নৃত্যানুষ্ঠানকেও হার মানিয়ে দিলো তারা। উদ্দাম নাচের মধ্যেই পণ্ডিত এসে হাজির। চোরা চোখে চারপাশটা দেখে নিয়ে চুপিচুপি সে ভিড়ে গেল স্বজাতির দলে। তারপর দুই রানারের পকেটে পাঁচশো টাকার দুটো করে নোট গুঁজে দিয়ে দাঁড়াল বিজয়মঞ্চে। ভল্লুক তার গলায় মেডেল ঝুলিয়ে দেবার সময় গরগর করে বলল, কি-রে শয়তান, তোর চেহারা এত পাল্টায় কেন? ভয় পাচ্ছিল আমাকে? ভয় পাবার কিছু নেই। বিচারক হবার অনেক অসুবিধা। আজ তোর ঘাড় মটকাবার সুযোগ নেই। যা, ভাগ্ এবার। শিয়াল সত্যি সত্যি ভয় পেল। তবে কি ভল্লুক টের পেয়ে গেছে সব? পাহাড়ে তো ওরই রাজত্ব। কী করি এখন? শিয়াল গেল সজারুর কাছে। ভাই সজারু, কেমন হলো রেসটা? ভারী চমৎকার। আচ্ছা দৌড়ে জিতেছো তুমি। বহুত খুব। তুমি খুশি হয়েছ? মিষ্টি মুখে জানতে চায় শিয়াল। খুবই খুশি হয়েছি। আমার বন্ধু জিতেছে, আর আমি খুশি হবো না? এরপর শিয়াল গেল সাপের কাছে। কিন্তু সাপ তাকে অভিনন্দন না জানিয়ে উল্টো জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আমার দুটো গর্ত তুমি ভাড়া নিয়েছিলে কেন? বিশেষভাবে, আজ রাতের জন্য? শিয়ালের বুক কেঁপে উঠল ভয়ে। সাপকে সে এমনিতেই এড়িয়ে চলে, কারণ সত্য উচ্চারণে সে কাউকে ছাড় দেয় না।
উচিত কথা তো বলেই, দরকার হলে লড়াই করতেও পিছপা হয় না। বেজির শত্রু বলে সে তার পক্ষ নিলেও, এখনকার ভাবসাব ভালো ঠেকছে না। শিয়াল কোন মতে পাশ কাটাবার জন্য বলল, আমার দুই জ্ঞাতি-ভাই রেস দেখতে এসেছিল তো, তাদের বিশ্রামের জন্যই নিয়েছিলাম, ভাই। হুম। আমি আবার দুই ছেলেকে পাঠিয়েছি গর্তগুলো দেখতে। কারণ চিরশত্রু ঈগল আমাকে খবর পাঠিয়েছে, এর মধ্যে কী নাকি একটা চালাকি আছে। না-না, কী যে বলে ঈগলÑ। বলতে বলতে থেমে গেল শিয়াল। ঈগল পর্বতের রাজা আর তার চোখও দূরবীনের মতো শক্তিশালী। বুঝে ফেলল নাকি তার জারিজুড়ি? না-হে পণ্ডিত, ঈগল আর যাই বলুক, মিথ্যে বলে না। আমার সঙ্গে তার যুগান্তরের লড়াই চললেও, তার কথাকে আমি মূল্য দেই। আসুক ছেলেরা। শুনি ওদের কথাবার্তা। তারপর তোমাকে ডাকব। হাতে প্রাণ নিয়ে পালাল শিয়াল। সাপের বাচ্চা দুটোকে ঠেকাতেই হবে। ওদের জিভে ধার খুব বেশি। যেকোনো গন্ধ ওরা টের পায়। বাপকে ওরা ঠিকই জানাবে যে কে কে ছিল গর্ত দুটোয়। ভল্লুকেরও সন্দেহ হয়েছে। সুতরাং উপায় নেই। মরতে হবে সাপের বাচ্চা দুটোকে। খুবই কৌশলে কাজ সারল শিয়াল পণ্ডিত। পেঁচাকে বলল যে, এইমাত্র শুনলামÑ পাশের লাল-পাহাড় থেকে দুটো সাপ এসেছে। তাদের উদ্দেশ্য : পেঁচার বংশ ধ্বংস করা। সাথে আমাদেরও মারবে মনে হচ্ছে। একটা কিছু কর, পেঁচা-মশাই। অনেক আগে, কালো-পেঁচার বাবা মারা গেছে দুর্ঘটনায়। লাল পাহাড়ে। সবার ধারণা, ওখানকার কেউটেদের জন্যই ঘটেছিল দুর্ঘটনা। কেউ নিজ চোখে দেখেনি ঘটনাটা, তবে বিশ্বাস করেছিল। কারণ সেখানে উপস্থিত ছিল শিয়াল পণ্ডিতের বাবা প্রবীণ মাস্টার। নিজে সে উপস্থিত ছিল লাল পাহাড়ে। আসলে, ঘটনা ছিল অন্য রকম। লাল পাহাড়ের ওপর দিয়ে দেশরক্ষী-সেনারা বিদ্যুতের লাইন টানছিল। অচেনা সেই তারের ওপর বসে পড়ায় বুড়ো পেঁচার শরীরে আগুন ধরে যায়। লাল পাহাড়ের রাজা শ্বেতভল্লুক বদনাম এড়াবার জন্য প্রবীণ-মাস্টারকে ডেকে নগদ দুশো টাকা, তিনটি মুরগি আর ছ’টা কবুতর উপহার দিয়ে বলেছিল : আমার সম্মান রক্ষার জন্য যা করবার করুন, প্রবীণ-মাস্টার। আমার ছেলেরা আপনাকে চিরদিন এ জন্য ‘স্যার’ বলে ডাকবে। কালো পেঁচাও বিশ্বাস করেছিল বুড়ো শিয়ালের বর্ণনা। সেই থেকে তার ভয়ঙ্কর রাগ কেউটেদের ওপর। বাবার হত্যাকারীরা আবার এসেছে যখন, ভাবল সে, এবার প্রতিশোধটা নিয়েই ফেলি। শিয়াল পণ্ডিতের বাড়ানো হাত ঠেলে সরিয়ে দিলো সে। টাকা লাগবে না পণ্ডিত। বাবার হত্যাকারীদের আমি বিনে পয়সাতেই নিকেষ করব। আমাকে শুধু ওদের খোঁজটা দেখিয়ে দাও। তিন বন্ধুকে নিয়ে ছোঁ মারল কালো পেঁচা। বাচ্চা দুটো, এমনকি লুকোবারও সময় পেল না। মুহূর্তের মধ্যেই পেঁচাদের পেটে চলে গেল তারা।
শিয়াল পণ্ডিত গোঁফে তা দিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর বেজিকে বলে : বুঝলে ভাই, এমন প্রতিযোগিতা না করাই উত্তম। ভাই-ভাই মিলে মিশে থাকাই ভালো, তাই না? বেজি সন্দেহের চোখে তাকিয়ে উত্তর দেয়, আমারও তাই মনে হয়, পণ্ডিত। কারণ দুটো নালা পার হতে তোমার দু’বার ভেজার কথা। কিন্তু ভল্লুক বলেছে, তুমি যখন তার গায়ে লাফ দিয়ে পড়েছিলে, তোমার গা ছিল শুকনো। শুনে শিয়ালের থরহরি কম্প শুরু হয়। ভল্লুককে সে এমনিতেই যমের মতো ডরায়। বাঘ মামা না থাকলে পাহাড়ের রাজা সে। স্বয়ং রাজার মনে সন্দেহ দেখা দিলে তো সর্বনাশ! সেই সর্বনাশটাই শেষ পর্যন্ত ঘটলো। ঈগল, শালিক আর ভোরের কাক সাক্ষ্য দিলো যে পাহাড়ের উল্টোপথ দিয়ে তারা শিয়াল পণ্ডিতকে উঠতে দেখেছে। একই ব্যক্তি এক-সময়ে দু’-জায়গায় থাকে কী করে? তদন্ত কমিটি করল ভল্লুক। সাপকে দেয়া হলো মূল দায়িত্ব। পণ্ডিতের তো মহামরণ! সাপ তো ঠিকই সত্য বের করে ফেলবে। পদক যায় যাক, ও নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু দুই ছেলের খুনের ঘটনা যদি ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে তো শাস্তি হবে কুকুর-দণ্ড। সেই ভয়ঙ্কর শাস্তি মানে তো তার নধর দেহটা কুকুরের ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাওয়া। হ্যাঁ-ভাগ্য, সামান্য এক রেসে একটু এদিক-ওদিক হবার এই বিচার? কিন্তু কালো পেঁচার অন্ধ প্রতিশোধ-স্পৃহা আর গোয়ার্তুমির কারণে বেঁচে গেল শিয়াল। জোচ্চুরির জন্য তার ‘মেডেল’ কেড়ে নেয়া হলো, আর মিথ্যাচারের দণ্ড হিসেবে নির্বাসন দেয়া হলো পাহাড় থেকে সমতলে। জরিমানা দিতে না পারায় তার চশমাও কেড়ে নেয়া হলো। কষ্টের মাঝেও শিয়াল ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানায় এ জন্য যে, সাপ কখনো জানতে পারেনি তার দুই ছেলের নির্মম পরিণতির কথা। জানলে, তাকে আর জানে বাঁচতে হতো না। বোকা পেঁচার সাথে তার বন্ধুত্ব এখনো অটুট আছে। মাঝে মাঝে যখন কৃষকের মুরগির খামারে হামলা চালায় সে, পেঁচাই তাকে সাহায্য করে। বাদ সাধে শুধু বেজি। পাহাড়ের দৌড়ে পরাজিত হয়ে সেও স্বেচ্ছায় নেমে এসেছে সমতলে। কারণ শিয়ালের জোচ্চুরির কথা শুনে সে শপথ করেছিল : শিয়ালকে সে জীবনভরই দেখে নেবে। শত চেষ্টা করেও ডিম আর মুরগির বাচ্চা শিকারে বেজিকে হারাতে পারেনি শিয়াল পণ্ডিত। যদিও সে এর জন্য দোষ দেয় তার চশমা না-থাকাকেই। —বুলবুল সরওয়ার..

সত্যের মতো বদমাশ

রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *