
‘সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা’—এ প্রবাদটি আমরা সবাই জানি। কেবল প্রবাদে নয়, পবিত্র কোরআন ও হাদিসেও সততার ওপর বিশেষ গুরুত্ব এবং সত্যবাদিদের পুরষ্কার দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।” অন্যদিকে নবী কারীম (স.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য নিয়ে যায় জান্নাতের দিকে।’
ইরানের বিখ্যাত কবি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী তাঁর মসনবী গ্রন্থে সততার পুরস্কার সম্পর্কে একটি চমৎকার গল্প লিখেছেন। রংধনু আসরে আমরা সেই গল্পটি প্রচার করেছি।
অনেকদিন আগের কথা। এক ধনী লোক বাজার থেকে জামাল ও কামাল নামে দু’জন গোলাম কিনে আনালো। জামাল দেখতে ছিল বেশ ফর্সা, চালাক-চতুর ও চটপটে। অন্যদিকে কামাল ছিল খাটো, কালো এবং কিছুটা দুর্বল। এজন্য জামালের দাম দেয়া হলো দেড়শ’ দিরহাম এবং কামালের দাম একশ’ দিরহাম।
গোলামদের বাড়ি আনার পর মনিব নতুন গোলামদের স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার এবং কাজ-কর্ম সম্পর্কে পরীক্ষা নিতে চাইলেন। প্রথমে তিনি কামালকে ডাকলেন। তার কাছে জানতে চাইলেন:
মনিব: শুনেছি তোরা দু’জন একই বাড়িতে কাজ করতিস। তো সেখানে এমন কি করেছিলি যার জন্য মনিব তোদের বিক্রি করে দিল?
কামাল: আমি সঠিক কারণ জানি না। কারণ মনিবেরা তাদের গোপন কথা আমাদের কথা বলেন না। হয়তো আমাদের চেয়ে আরো ভাল গোলাম পেয়েছেন অথবা তার গোলামের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে-তাই বিক্রি করে দিয়েছে।
মনিব: ওখানে তোদের জীবন কেমন কেটেছে? মনিবের ওপর রাজি ছিলিতো?
কামাল: মানুষ পুরোপুরি মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত রাজি হতে পারে না। কিন্তু তবু কাজ করে গেছি, বলতে পারেন-অন্যদের মতোই জীবন কেটেছে।
মনিব এবার কামালের কাছে জামালের স্বভাব চরিত্র কেমন, তার কি কি দোষ আছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলেন। জবাবে কামাল বললো:
কামাল: আমি তো তার মধ্যে তেমন কোন দোষত্রুটি দেখিনি। সে তো বেশ সুন্দর চেহারার যুবক, আদব-কায়দাও জানে বেশ। আমার ধারণা তার ভেতর এমন কিছু গুণ আছে যে কারণে তার দামও বেশি।
মনিব: বেশ ভাল কথা। এবার বল দেখি, এখানে আসতে পেরে তুই কি সন্তুষ্ট হয়েছিস?
কামাল: আমি এখানে নতুন এসেছি। তাই জানিনে, এখানে ভালো আছি না আগের জায়গায় ভাল ছিলাম। কিছু দিন গেলেই আমি যেমন আপনাকে চিনতে পারবো তেমনি আপনিও আমাকে চিনতে পারবেন। এখন এ বিষয়ে কিছুই বলা যাবে না।
কামালের ভদ্রতা, সত্যবাদিতা ও সোজাসাপটা কথায় মনিব মনে মনে বেশ খুশি হলেন।
এ সময় জামাল গোসল সেরে জামা-কাপড় বদলিয়ে মনিবের সামনে হাজির হলো। জামাল আসার পর মুনিব কামালকে বিশ্রাম করার নির্দেশ দিলেন। কামাল চলে গেলে মুনিব জামালকে পরীক্ষা করা শুরু করলেন। কামালকে যেসব প্রশ্ন করেছিলেন জামালকেও সেসব প্রশ্নই করলেন। মুনিব বললেন:
মনিব: শুনেছি তোরা দু’জন একই বাড়িতে কাজ করতিস। তো সেখানে এমন কি করেছিলি যার জন্য মনিব তোদের বিক্রি করে দিল?
জামাল: আপনি ঠিক শুনেছেন। তবে আমার কোন দোষ ছিল না। এই কামালটাই যত দোষের মূল। সে প্রথম থেকেই ছিল ভীষণ অলস। এছাড়া, মুখের ওপর কথা বলার বদ-অভ্যাগ আছে তার। এ কারণেই মুনিব আমাদের বিক্রি করে দিল।
মনিব: ওখানে তোরা মালিকের ওপর রাজি ছিলি তো?
জামাল: কিসের রাজি? ওখানে কুকুরের মতো শুধু খেটে মরতাম।
এরপরও মনিব খালি দোষ ধরতো। কামালতো কয়েকবার বলেই ফেললো, চল মনিবের টাকা-কড়ি নিয়ে কেটে পড়ি। কিন্তু আমি বলেছি-না, এটা অন্যায়। অবশ্য শেষতক মনিবই বেইনসাফি করলো, আমাদের বিক্রি করে দিলো।
এরপর মালিক জামালের ব্যাপারে কামাল যেসব প্রশংসা করেছে সে কথা বলতে চাইলেন। কিন্তু স্পষ্টভাবে না বলে জামালের মনোভাব জানার চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন-
মনিব: কামাল তোর সম্পর্কে আমার কাছে বেশ কিছু কথা বলেছে-তা কি সত্য?
জামাল: না না, মোটেও সত্য না। আল্লাহর কসম সে মিথ্যা বলেছে। আসলে সে সব সময় আমার দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ায়। ওর চেহারা যেমন কুৎসিত মনটাও তেমন কুৎসিত। ওর কথা কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না।
মনিব: ঠিকাছে। এবার বল, এখানে এসে খুশী হয়েছিস কিনা?
জামাল: কি যে বলেন মালিক! আমি এখানে এসে খুব খুশি হয়েছি। কোথায় আপনি আর কোথায় আগের মালিক? আমি তো সব সময় স্বপ্নে আপনার চেহারাই দেখতাম। আজ এখানে আসতে পেরে এত খুশি হয়েছি যে, তা বলে বুঝাতে পারবো না।
মনিব: ঠিকাছে, ঠিকাছে। আমার যা জানার ছিলো জেনে নিলাম। এবার কামালকে ডেকে নিয়ে আয়, তোদের দু’জনের সাথে জরুরি আলাপ আছে।
জামাল চলে গেল কামালকে ডেকে আনতে। এই ফাঁকে মনিব দু’জনের আচার-আচরণ, কথাবার্তা ও স্বভাব-চরিত্রের তুলনা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর জামাল-কামাল এক সাথে মালিকের ঘরে প্রবেশ করলো। মালিক দু’জনকে লক্ষ্য করে বললেন-
মনিব: আমি তোদের দু’জনকেই পরীক্ষা করেছি। কামাল দেখতে কালো হলেও ওর মনটা ভাল। ওর মধ্যে আমি কোন দোষ-ত্রুটি পাইনি। কিন্তু জামাল, তোর চেহারা সুন্দর হলেও স্বভাব-চরিত্র ভাল নয়। তাই আমি তাকে বিশ্বাস করেছি। এবং এখন থেকে তুই কামালের অধীনে কাজ করবি। আর শোন, তোষামোদ ও অযথা প্রশংসা না করে কিভাবে ঠিকমতো কাজ করতে হয় তার শিক্ষা কামালের কাছ থেকে নিবি। মোট কথা কামাল যা বলে তাই মেনে নিবি-বুঝলি?
মনিবের কথা শেষে হবার পর জামাল-কামাল দু’জনেই বাগানে পানি দেয়ার কাজে গেলে গেল। কিন্তু ঘন্টাখানেক কাজ করার পর জামাল বসে পড়লো নালার পাশে। কামালকে উদ্দেশ্য করে সে বলল-
জামাল: আর পারছি নারে, খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এ কাজ আমার দ্বারা সম্ভব নয়। মনে হয় খুব খারাপ মালিকের হাতে পড়েছি। তারচেয়ে চল্-এমনভাবে কাজ করি যাতে মালিক অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের বিক্রি করে দেয়।
কামাল: ও রকম চিন্তা করবি না। আমিই না হয় বেশি কাজ করবো। তারপরও মনিবের বদনাম করার দরকার নেই। তাছাড়া এখান থেকে চলে গেলেই যে ভাল কারো হাতে পড়বো তার নিশ্চয়তা কি?
জামাল: এখন তো খুব ভাল মানুষ হয়ে গেছিস। কিন্তু মনিবের সাথে যখন একা ছিলি তখনতো আমার সম্পর্কে আগেবাজে বলেছিস। তোর কথা বিশ্বাস করেইতো মালিক তোকে নেতা বানিয়ে দিয়েছেন।
জামালের কথা শুনে কামাল খানিকটা অবাক হলো! এরপর সে জানালো, মনিবের কাছে তার সম্পর্কে খারাপ কিছুই বলেনি। বরং তার প্রশংসা করেছে। পরে জামালের কাছে সে জানতে চাইলো- মনিবের সাথে তার কি কথা হয়েছে।
কামালের কথা শুনে জামাল বুঝতে পারলো যে, দু’জনের কাছে মনিব একই ধরনের প্রশ্ন করেছিল এবং কামাল তার সম্পর্কে খারাপ কিছু বলেনি। এরপর জামাল তার ভুল বুঝতে পেরে লজ্জায় একেবারে মাথা নিচু করে ফেলল। তারপর আমতা আমতা করে বললো-
জামাল: ‘মনিব যখন আমাকে বললেন যে, তুই তার কাছে আমার বদনাম করেছিস তখন আমি মনিবের কথা বিশ্বাস করে ফেলি এবং নিজেকে ভাল আর তোকে খারাপ প্রমাণের চেষ্টা করি। এখন বুঝতে পারছি যে, মনিব আসলে আমাদের পরীক্ষা করে দেখেছেন। আর সে পরীক্ষায় তুই পাস করেছিস। আমি মেনে নিচ্ছি, তুই-ই বড় তুই-ই মহৎ।’
এ ঘটনার পর জামাল ও কামাল মিলেমিশে কাজ করতে লাগলো। কিন্তু কিছুদিন পর মনিব দুই গোলামকে বিক্রি করতে বাজারে পাঠালেন। সুদর্শন জামালকে দুইশ’ দিরহামে বিক্রি করা গেলেও কামালের জন্য ভাল কোন গ্রাহক পাওয়া গেল না।
মনিব আসলে কামালকে বিক্রি করতেও চাননি। তিনি তাকে মুক্ত করে দিয়ে নিজ সন্তান হিসেবে গ্রহণ করলেন।