
‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ কিংবা ‘লোভের ফল ভাল নয়’-এই প্রবাদ দু’টি সবাই জানে। এ প্রবাদ দু’টি মধ্যেই লোভের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। তারপরও অনেক মানুষ লোভ-লালসার কাছে নিজেকে বন্দি করে ফেলে। লোভী ব্যক্তি সমাজের জন্য দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলেই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা লোভ থেকে বিরত থাকো, কারণ তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনেকেই লোভের কারণে ধ্বংস হয়েছে।”
অন্যদিকে আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, “লোভ পরিহার কর। কেননা লোভী ব্যক্তি অপমানের হাতে বন্দী। তার এ বন্দীদশা কখনও শেষ হবে না।” তিনি আরো বলেন, “লোভ আত্মাকে অপবিত্র করে, ধর্মকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে এবং যৌবনকে ধ্বংস করে।”
লোভের কুফল সম্পর্কে আমরা ইরানের মরমী কবি শেখ ফরিদউদ্দিন আত্তারের লেখা একটি গল্প প্রচার করেছি।
এক পিঁপড়া একটি গমের দানা মুখে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিল। পথিমধ্যে একটি উঁচু পাথরের কাছে আসতেই তার নাকে লাগলো মধুর ঘ্রাণ। চোখ তুলে তাকিয়ে বিরাট মৌচাক দেখে তার জিভে পানি চলে এলো। দেরি না করে তখনই সে মুখের দানা ফেলে দিয়ে মধু খাওয়ার জন্য পাথর বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা শুরু করল। কিন্তু যত চেষ্টাই করুক না কেন, কিছুতেই উঠতে পারছিল না। কিছুদূর উঠার পরই পরে যাচ্ছিল মাটিতে।
কিন্তু মধুর লোভ তাকে পাগল করে তুললো। শেষ পর্যন্ত পিঁপড়া চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো :
পিঁপড়া: “তোমরা কে, কোথায় আছো…দয়া করে আমাকে মৌচাকে উঠিয়ে দাও। আমি মধু খাবো, আমি মধু খাবো।”
এ সময় পাশেই উড়ে যাচ্ছিল একটি ভোমরা। পিঁপড়ার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সে বললো :
ভোমরা: “এই পিঁপড়া! হয়েছে কী? এতো মধু মধু করছো কেন? তুমি কি জানো না, মৌচাকে গেলে বিপদ হতে পারে?”
পিঁপড়া: “আমি বিপদ-আপদ বুঝি না। আমি মধু খেতে চাই। বিপদ-আপদ আমিই ঠেকাবো। তুমি আমাকে সাহায্য কর।”
ভোমরা: “আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো না। কারণ মৌমাছির বিষ আছে ওখানে। তাছাড়া মধু খুবই আঠালো। ওতে তোমার হাত-পা লেগে তখন আর কিছুতেই বাঁচতে পারবে না।”
পিঁপড়া: “মৌমাছির বিষের থোড়াই কেয়ার করি আমি। যেভাবেই হোক আমি মধু খেতে চাই।”
ভোমরা: “শোন পিঁপড়া! জেদ করো না। তুমি যদি বাঁচতে চাও তাহলে মধু খাওয়ার মতো বিপদজনক আশা ছেড়ে দাও। মনে রেখ, লোভের ফল কখনো ভাল হয় না।”
পিঁপড়া: “আরে রাখো তোমার ওয়াজ-নছিহত! যদি পারো তাহলে আমাকে মৌচাকে উঠিয়ে দাও আর যদি না পারো তাহলে দাদাগিরি না দেখিয়ে এখান থেকে কেটে পড়ো।”
ভোমরা: “ঠিকাছে! আমার কথা যখন তোমার পছন্দ হচ্ছেই না তখন আমি চলে যাচ্ছি।”
তবে তোমাকে আবারো মধু খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান করে দিচ্ছি। এ কথা বলে ভোমরা চলে গেলো। পিঁপড়া আবারো চিৎকার জুড়ে দিলো অন্য কারো সাহায্য পাওয়ার আশায়। ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিল একটি মাছি। পিঁপড়া মধু খেতে চায় শুনে সে তাকে শায়েস্তা করতে চাইল। কিন্তু তা প্রকাশ না করে বলল:
মাছি: “আরে মাছি ভাইয়া যে! তুমি মধু খেতে চাও তা আগে আমাকে বলবে না? এসো, আমার সাথে এসো। আমি এক্ষুনি তোমাকে মৌচাকে নিয়ে যাবো।”
মাছির কথা শুনে পিঁপড়া খুশিতে লাফিয়ে উঠল। এরপর বললো:
পিঁপড়া: “বাহঃ বাহঃ কী মজা! কতো বড় কপাল আমার! আমি মধু খেতে পারবো এরচেয়ে সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? মাছি ভাই, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তুমিই হচ্ছো, গরীবের সত্যিকারের বন্ধু।”
পিঁপড়ার কথা শুনে মাছি খুব খুশী হলো। তারপর পিঁপড়াকে মাটি থেকে তুলে মৌচাকের কাছে নিয়ে রাখল এবং নিজে বিদায় হলো। মাছি চলে গেলে পিঁপড়া প্রথমে এদিক-সেদিক থেকে কিছুটা মধু চুষে খেলো। এরপর আস্তে আস্তে মৌচাকে ভেতরে প্রবেশ করলো। মধু খেতে খেতে দেখলো কিছুতেই মাথা নাড়ানো যাচ্ছে না। হাত-পা ছুড়ে মাথা উঠাতে গিয়ে দেখতে পেলো, হাত-পাও মধুর আঠায় লেগে গেছে। আরো চেষ্টা করতেই সারা শরীর মধুতে ভিজে লেগে গেলো। মধুর আঠা থেকে নিজেকে ছাড়াতে না পেরে পিঁপড়া চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো:
পিঁপড়া: “কে কোথাও আছো, আমাকে বাঁচাও। মহা বিপদে পড়েছি আছি। কোন বীর যদি আমাকে উদ্ধার করতে পারো তাহলে আমি দুটো গম পুরষ্কার দেবো।”
এদিকে কাজ সেরে ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিল ভোমরা। পিঁপড়ার চিৎকার শুনে তার মন কেঁদে উঠলো। সে দ্রুত পিঁপড়াকে মৌচাক থেকে উদ্ধার করলো। তারপর বললো:
ভোমরা: “তোমাকে গালমন্দ করতে চাইনে। লোভের ফল যে ভাল না তা নিশ্চয়ই এতক্ষণে টের পেয়েছো। তোমার ভাগ্য ভাল ছিল যে আমি এ পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। নইলে তোমার পরিণতি কী হতো তা আমার আর বলার দরকার নেই। শোন পিপড়া, ভবিষ্যতে সাবধানে চলবে। আর মাছিদের কথা শুনো না। মাছিরা পিঁপড়াদের দরদী নয়। ওরা তোমাদের মঙ্গলও চায় না।”
ভোমরার কথা শুনে পিঁপড়া খুব অনুতপ্ত হলো। জীবনে আর লোভ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করলো এবং নিজের ব্যবহারের জন্য ভোমরার কাছে ক্ষমা চাইলো।