ভয়ংকর ভূত পিচ্ছি হান্নু

অনেক অনেক বছর আগের কথা, একদেশে এক গ্রাম ছিলো সেই গ্রামে অনেক মানুষ থাকতো।
বড়রা হাটে মাঠে কাজ করতো আর ছোটরা স্কুলে যেত।
সেই গ্রামের এক প্রান্তে অনেকগুলো বাঁশঝাড় ছিলো সেই বাঁশঝাড়গুলোর ভেতর অনেক পুরনো এক তেঁতুল গাছ ছিলো, তেঁতুল গাছটা এতই প্রকান্ড ছিলো যে দিনের বেলাতেও জায়গা অন্ধকার করে রাখতো।
এই তেঁতুল গাছটা নিয়ে গ্রামে অনেক ভয়ংকর ভয়ংকর সব গল্প ছিলো, গ্রামের সবার ধারনা তেঁতুল গাছটাতে ভূত আছে তাই গ্রামের লোকেরা সেই দিকটা দিনের বেলাতেও যেতে সাহস পেত না।
সেই গ্রামে পল্টু নামের এক ছেলে থাকতো, পল্টু ক্লাস ফাইভ এ পড়ে, তার গায়ের রং শ্যামলা, হাত-পাগুলো লিকলিকে এবং চুলগুলো ছিলো পাখির বাসার মত।
পল্টুর মা ছিলো না এমনকি পল্টুর কোন ভাই বোনও ছিলো না, ওর বাবা ছিলো কৃষক তারা একটা মাটির বাড়িতে থাকতো।
পল্টু রোজ হেঁটে স্কুলে যেত, স্কুলে যাবার পথে দুরে তেঁতুল গাছটা দেখা যেত, গাছটা প্রায়ই বাতাসে অদ্ভুত রকম দুলতো।
সেই দুলুনি দেখে পল্টুর অতদুর থেকেই ভয় ভয় লাগতো। অনেক বাচ্চাই ভয়ে সেদিকে তাকাতোও না।
পল্টুকে সেদিক থেকে সাহসী বলা যেতে পারে। একদিন পল্টু স্কুলে হোমওয়ার্ক করেনি বলে তার টিচার পুরোটা ক্লাস বেঞ্চের উপর দাড় করিয়ে রেখেছিলো।
পল্টুর কি দোষ! সে তো সকালে হোমওয়ার্ক করতে বসেছিলো, তখন তার বাবা বললো – যা চুলগুলো কামারুর সেলুন থেকে কাটিয়ে আয়।
কামারু নাপিতের পুরো নাম কামারুজ্জামান, এই ব্যাটা নাপিত না হয়ে কামার হলে মনে হয় নামকরন সার্থক হতো, কামার-উজ্জামান থেকে কামার।
কামারু দেখতে খুবই নোংরা, মুখ থেকে সারাক্ষন ভকভক করে বিড়ির গন্ধ বের হয়, দাঁতগুলো হলুদ।
বেটার দোকানে বাচ্চারা কখনো চুল কাটাতে চায় না, কারন সে বাচ্চাদের পেলে চুলগুলো এতই ছোট করে দেয় যে দুর থেকে মনে হয় মাথা টাক বেল।
খুব কাছে আসলে তখন বোঝা যায় যে মাথায় ছোট ছোট চুল আছে।
যে সব বাচ্চারা কামারুর দোকানে চুল কাটায় তাদেরকে অন্যান্য বাচ্চারা কয়েকদিন ধরে ‘নাইড়া মাথা চাইড় আনা, চাবি দিলে ঘুরে না’ বলে খেপায়।
তার উপর কামারুর দোকানের চিরুনিগুলোও বেশ ময়লা দেখলেই গা ঘিনঘিন করে। তবে তার সেলুনের নামটা বেশ বাহারী ‘গুলবাহার হেয়ার ড্রেসার’।
সেই গুলবাহার হেয়ার ড্রেসারে চুল কাটাতে হবে শুনে পল্টু হোমওয়ার্ক না করেই তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়েছিলো আজ। যদিও বেঞ্চের উপর দাড়িয়ে থাকতে তার খুব একটা খারাপ লাগছিলো না।
দুপুর বারটায় স্কুল শেষে সবাই যার যার বাড়ি গেলো, পল্টু বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলো বাসায় ফিরলে তো সেই কামারুর সেলুনে যেতে হবে চুল কাটাতে, বাজারে অবশ্য আরো কয়েকটা নাপিতের দোকান আছে তবে সেগুলো একটু দুরে বলে বাবা সবসময় ‘গুলবাহার হেয়ার ড্রেসার’ এ নিয়ে যায়।
নাহ, সে কিছুতেই কামারুর দোকানে চুল কাটাবে না, বন্ধুরা তাকে ‘নাইড়া মাথা চাইর আনা, চাবি দিলে ঘুড়ে না’ বলে খেপাবে এটা সে কিছুতেই হতে দিবে না।
কোন মতে আজকের দুপুরটা পার করতে পারলেই আর চিন্তা নেই বিকেল হয়ে গেলে বাবা আর চুল কাটার কথা বলবে না।
কিন্তু দুপুরটা কোথায় লুকিয়ে পার করবে? এই সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সে দেখলো দুরে তার বাবা রাস্তা দিয়ে আসছে, এটা দেখেই পল্টু কোন দিকে না তাকিয়ে এক দৌড় দিলো, সে খেয়ালও করলো না যে সে তেঁতুল গাছটার দিকে দৌড়াচ্ছে।
বাঁশ ঝাড় পার হয়ে একটা গাছের তলায় এসে থেমে সে হাঁপাতে হাঁপাতে হঠাৎ খেয়াল করলো সে তেঁতুল গাছটার নিচে দাড়িয়ে আছে।
গা ছমছমে সেই নিস্তব্ধ গাছের নিচে দাড়িয়ে পল্টু খুবই ভয় পেলো, সে একপা একপা করে সেখান থেকে যেই পালাতে যাবে তখনই গাছটার উপর থেকে নাকি কণ্ঠে কেউ কথা বলে উঠলো – – কেঁ রেঁ তুঁই? পল্টু কিছুতেই উপরে তাকাবে না চিন্তা করেও উপরে তাকালো, সেখানে আধো আলো আধো ছায়াতে সে শুধু একটা চিকন ডালে বসা বাচ্চাদের মত ছোট ছোট এক জোড়া পা দেখতে পেল।
পল্টু যেই দৌড় দিবে তখনি ডাল থেকে একটা ভূতের বাচ্চা শুকনো পাতার মত উড়ে পল্টুর সামনে নেমে এলো।
পিচ্চিটার গায়ের রং হালকা বেগুনী, মাথায় ললিপপের মত দু’টো শিং সেগুলো মনে হচ্ছে স্প্রিং দিয়ে বসানো একটু পরপর সেগুলো তিড়িংবিড়িং করে নড়ছে।
পল্টুর সামনে এসে সে আবারো বললো- – কেঁ রেঁ তুঁই! তোঁর নাঁম কিঁ? পল্টু ভয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললো- – ইয়ে…. মানে…. আমি কিছু করিনি।
পল্টুর ভয় দেখে ভূতের বাচ্চাটা ফিক করে হেসে দিলো, সে কি প্রশ্ন করলো আর এই ছেলে কি উত্তর দেয়! তার মানে সে ভয় দেখাতে পেরেছে।
ভূতের বাচ্চাটার হাসি দেখে পল্টুরও বেশ হাসি পেল কারন ভূতের বাচ্চাটার সামনের নিচের দুটো দাঁত নেই।
ভূতের বাচ্চাটা এবার বেশ মন খারাপ করে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে উঠলো- – আমাকে দেখে তুমি হাসছো!
এঁজঁন্যই কেঁউ আঁমাঁকে পঁছঁন্দ কঁরে নাঁ। আঁমি নাঁকি ভূঁত হঁবাঁর যোঁগ্যঁই নঁই। এই দেখো নাঁসবাই ভঁরদুঁপুঁরে বিঁলে গেঁছে মৃঁগেঁল মাঁছের কাঁটা চাঁবাঁতে আঁমাঁকে কেঁউ নেঁয় নিঁ, আঁমাঁকে কেঁউ পঁছঁন্দ কঁরে নাঁ।
পল্টুর এবার মন খারাপ হলো।
আহারে বেচারা মৃগেল মাছের কাটা না পেয়ে কতই না কষ্টে আছে! সে এবার সাহস নিয়ে বললো – – আমার নাম পল্টু। আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি, রোল নাম্বার ১৯।
তোমার নাম কি? সাথে সাথে ভূতের বাচ্চাটা বললো- – আঁমাঁর নাঁম হাঁন্নু, আঁমি সাঁইঁজে ছোঁট তোঁ তাঁই সঁবাঁই আঁমাঁকে পিঁচ্চি হাঁন্নু বঁলে ডাঁকে।
আঁমি তোঁ স্কুঁলে পঁড়ি নাঁ তঁবে আঁমি অঁনেঁক কিঁছু পাঁরি। ভূঁতদেঁর অঁনেঁক কিঁছু জাঁনঁতে হঁয়।
– কি কি জানো তুমি? – এঁই যেঁমন ধঁরো উঁড়তে জাঁনি, ইঁচ্ছে কঁরলে অঁদৃশ্য হঁয়ে যেঁতে পাঁরি, পাঁনির নিঁচে যঁতক্ষঁন খুঁশি থাঁকতে পাঁরি। – ও আচ্ছা।
– কিঁন্তু তুঁমি এঁই ভঁরদুঁপুরে এঁখাঁনে কিঁ কঁরছিঁলে? – আমি তো কিছুক্ষন লুকিয়ে থাকতে এসেছিলাম। সরি তোমার গাছের কাছে এসে তোমাকে বিরক্ত করলাম। – আঁরে সেঁটা কোঁন সঁমস্যা নাঁ।
কিঁন্তু তুঁমি লুঁকিয়ে থাঁকতে এঁসেছো কেঁন? পল্টু তখন পিচ্চি হান্নুকে পুরো ঘটনা খুলে বলে।
সব শুনে পিচ্চি হান্নু আবারো ফোকলা দাঁতে হাসি দিয়ে বললো – – আঁমাঁর তোঁ চুঁলঁই নেঁই তাঁই চুঁল কাঁটাঁবাঁর ভঁয়ে আঁমাঁকে লুঁকাঁতে হঁয় নাঁ… হিঁ হিঁ হিঁ।
তঁবে তুঁমি যঁদি চাঁও তোঁমাঁকে আঁমি সাঁহাঁয্য কঁরঁতে পাঁরি, আঁমি কাঁমাঁরু নাঁপিঁতকে ভঁয় দেঁখাঁতে পাঁরি যাঁতে সেঁ আঁর কঁখঁনো বাঁচ্চাদেঁর চুঁল নাঁ কাঁটাঁতে পাঁরে।
কিঁন্তু তাঁর আঁগে তোঁমাঁকে আঁমাঁর দোঁস্তো হঁতে হঁবে, আঁমাঁর তোঁ কোঁন দোঁস্তো নেঁই তাঁই সঁব সঁমঁয় আঁমাঁর মঁন খাঁরাঁপ থাঁকে। – ঠিক আছে তাহলে আমরা দু’জন বন্ধু হলাম।
– উঁহু, বঁন্ধু নাঁ। দোঁস্তো। – আচ্ছা ঠিক আছে দোস্তো। এরপর পল্টু আর পিচ্চি হান্নু ফিসফিস করে কিভাবে কামারু নাপিতকে শায়েস্তা করবে সেই মহাপরিকল্পনা করলো।
বাঁশঝাড় থেকে বেড়িয়ে পল্টু ভালো ছেলের মত বাসায় ফিরলো, বাবা বাসাতেই ছিলো, পল্টুকে দেখে বললো – – এতক্ষন কোথায় ছিলিরে? চল গোসল করে খেয়ে নে, আমি আবার মাঠে যাবো।
পল্টু উদাস গলায় মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো- – বাবা সকালে যে চুল কাটাবার কথা বলছিলে তখন তো স্কুলের সময় হয়ে গিয়েছিলো তাই যেতে পারিনি, এখন গিয়ে কাটিয়ে আসি তারপর গোসল করে খেয়ে নিবো।
বাবা ভাবলেন, বাহ! পল্টু তো লক্ষীছেলে হয়ে গেছে! বাবা পল্টুকে নিয়ে গুলবাহার হেয়ার ড্রেসারে দিয়ে আবার মাঠের কাজে চলে গেল, যাবার আগে পল্টুকে লক্ষী ছেলের মত চুল কাটিয়ে বাসায় ফিরে গোসল করে ভাত খেয়ে পড়তে বসতে বলে গেল।
কেউ খেয়াল করলো না পল্টুর সাথে পিচ্চি হান্নু নামের ভূতের বাচ্চাটাও আছে, সে অনেক আগে থেকেই অদৃশ্য হয়ে পল্টুর সাথে সাথে হাঁটছে।
কামারুর সেলুন একেবারে ফাঁকা, পল্টুকে দেখে কামারু নাপিত তার সবক’টা হলুদ দাঁত বের করে কাঁচি আর ময়লা চিরুনী হাতে কাছে ডাকলো।
পল্টু ভদ্র ছেলের মত উদাস মুখে চেয়ারে গিয়ে বসলো। কামারু যেই পল্টুর চুলে চিরুনী চালাবে তখনি চিরুনীটা তার হাত থেকে ছুটে গিয়ে কামারুর মাথায় ঠাস ঠাস করে কয়েকটা বাড়ি দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।
কামারু ভড়কে গিয়ে ‘ওরে বাপরে!’ বলে চিৎকার দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। শুধু পল্টু বুঝলো তার দোস্তো পিচ্চি হান্নু ‘কাজ’ শুরু করে দিয়েছে।
কামারু ভয়ে ভয়ে চিরুনীটা যেই ধরতে গেলো অমনি একটা কাঁচি ঘচাং ঘচাং করে কামারুর মাথার সামনের কিছু চুল কেটে দিলো।
কামারু এবার ভয় পেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো- – এ সব কি হচ্ছে! এ সব কি হচ্ছে!! পিচ্চি হান্নু তখন অদৃশ্য থেকে বললো- – হিঁ হিঁ হিঁ … এঁই ব্যাঁটা কাঁমাঁরু! তোঁর চুঁল দাঁড়ি সঁব আঁজ শেঁভিং জেঁল মাঁখিয়ে চেঁছে নিঁবো… হিঁ হিঁ হিঁ !!! কামারু ভয়ার্ত গলায় পল্টুর দিকে তাকিয়ে বললো- – কে কথা বলছে!! পল্টু হাই তুলতে তুলতে বললো- – কই চাচা ! কে আবার কথা বলে!! আমি তো কিছুই শুনছি না।
পিচ্চি হান্নু আবারো বলে উঠলো- – তুঁই বাঁচ্চাদেঁর পেঁলেঁই চুঁল এঁকেবাঁরে ছোঁট ছোঁট কঁরে দিঁস! আঁজ তোঁর মাঁথা টাঁকবেঁল কঁরে ‘টাঁকডুঁম টাঁকডুঁম বাঁজাই’ গাঁন কঁরবোঁ আঁর তোঁর মাঁথাঁয় ঢোঁল বাঁজাঁবো।
কামারু এবার প্রচন্ড ভয় পেলো। সে কাতর গলায় হাঁটু গেড়ে বললো- – আমি আর বাচ্চাদের চুল ছোট করবো না।
তুমি যা বলবে আমি তাই করবো শুধু আমার মাথায় ঢোল বাজিও না তাহলে একেবারে মারা যাবো।
– তাঁহলে শোঁন, এঁই যেঁ বাঁচ্চাঁটা বঁসে আঁছে চুঁল কাঁটাবাঁর জঁন্য তাঁর চুঁল সুঁন্দর কঁরে কেঁটে দেঁ, যঁদি পাঁরিস তঁবে ‘রাঁহুল ছাঁট’ দিঁস, আঁর এঁটাই তোঁর জীঁবনেঁর শেঁষ চুঁল কাঁটা এরঁপর থেঁকে তুঁই কাঁমাঁরের কাঁজ কঁরবি।
ব্যাঁটা কাঁমাঁর-উঁজ-জাঁমাঁন কাঁল থেঁকে তুঁই সঁত্যিকাঁরের কাঁমাঁর হঁবি, মাঁটির হাঁড়ি পাঁতিল বেঁচবি।
কামারু নাপিত পিচ্চি হান্নুর কথা মত পল্টুকে সুন্দর করে চুল ছেটে দিলো, এরপর নাকে খত দিয়ে তার দোকানের সমস্ত কিছু বিক্রি করে মাটির হাড়ি পাতিলের দোকান দিলো।
এরপর থেকে তার নাম হয়ে গেল ‘কামারুকামার’।
আর কেউ কখনো জানতেও পারলো না পল্টুর একটা নতুন দোস্তো হয়েছে সেই দোস্তের সাথে পল্টু প্রায়ই ভরদুপুরেতেঁতুল তলায় হাডুডু খেলে।

►সোবহানবাগের ঘটনা◄

খ্যাতির বিড়ম্বনা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *