“এক কাজ করলে পারিস তো,” সুরজিৎ গম্ভীর গলায় বলল। “কী করব?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টি প্রজ্ঞার। “তোর শাশুড়িকে ফোন কর একটা,” বলেই চোখ টিপল সুরজিৎ। প্রজ্ঞা বিরক্তি-মাখানো গলায় বলল, “দেখ সুরজিৎ, তুই আমার বন্ধু, খুব ভাল বন্ধু। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সব ব্যাপারে ইয়ার্কি মারবি। প্রায় একমাসের ওপর হয়ে গেল ওর কোনও খবর নেই…” প্রজ্ঞাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সুরজিৎ বলে উঠল, “আরে বাবা সেই জন্যেই তো বলছি ওর বাড়িতে একটা ফোন করতে।
নাম্বার জানিস না?” “জানি,” বলে একটু থমকাল প্রজ্ঞা। তারপর বলল, “কিন্তু এতদিন হয়ে গেল আমি এখনও জানিনা ওর বাড়িতে আমার সম্পর্কে…” সুরজিৎ আবার বাধা দিল, “তুই কোন সেঞ্চুরিতে পড়ে আছিস বলত? একটা খবর নিবি, তার জন্যে ওর বাড়িতে কী ভাববে, কী ভাববেনা…তোকে কিছু বলার নেই। হোপলেস শালা!” প্রজ্ঞা সুরজিৎ’এর দিকে তাকাল, “করব? বলছিস?” ঠোঁট থেকে সিগারেটটা নামিয়ে সুরজিৎ চোখ বন্ধ করে বলে উঠল, “আলবাৎ!” মাঠে পৌঁছেই এক বীভৎস দৃশ্য। সদ্য পোয়াতি মেয়েটাকে প্রায় গোটা গ্রামের লোক ঘিরে রেখেছে আর অশুভ আত্মা বিতাড়ণের জন্যে তাকে ঝ্যাঁটা দিয়ে পেটাচ্ছে এক ওঝা। সিঁদুর-মাখানো বটপাতা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে জোর করে। “শয়তান কা কীড়া লেকর ঘুম রহী হ্যায় ইয়ে ভূতনী,” বলেই পেটে এক লাথি। লাচ্ছির মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে। উত্তীয় এগিয়ে গেল ওঝার দিকে। কটমট করে বলল, “ইয়ে হো কেয়া রহা হ্যায়?” এমন অনধিকার প্রবেশে ওঝা বিরক্ত। ভুরু কুঁচকে তাকাল ওর দিকে। ধাতুয়া দৌড়ে এল, “আরে কামরিট, ঈ বহুত বড়া ওঝা হ্যায় অপনে পাসওয়ালে গাঁও কে। দেখনা, ঊ সসুরা ভূতনী কা গাঁড় কা পানী ভী সুখা করকে ছোড়েঙ্গে।” উত্তেজিত উত্তীয় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎই সামনে দেখল বংশীলালকে। একটু এগিয়ে বংশীলাল ওঝার দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, “অব আপ যা সকতে হ্যাঁয়, ভূত তো উতর গয়া লগ রহা হ্যায়।” বেগতিক বুঝে ওঝা আর কথা বাড়াল না, স্যাঙাৎ-সমেত চলে গেল নিজের গ্রামে। মকাই চাল আর পয়সাও নিল না।
বংশীলাল উত্তীয়কে ডাকল। লাচ্ছিকে একটা মোটা কাঁথার ওপর তুলে দুজনে মিলে বয়ে নিয়ে চলল – ওর গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। বাচ্চাটাও বোধহয় বাঁচবে না। তামাশা শেষ, তাই গ্রামের সবাই চলে গেল যে যার কাজে। ধাতুয়া ছুটল উত্তীয়দের পিছু পিছু। লাচ্ছিকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে বাইরে এসে বসল উত্তীয়। গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে ফতুয়ার বোতামগুলো আলগা করে নিল। বংশীলাল আর দাঁড়াল না। ধাতুয়াকে দু’চারটে কথা বলে বেরিয়ে গেল ঝোলা কাঁধে। তাকে মুঙ্গের যেতে হবে রাজ্য কমিটির গোপন মিটিঙ অ্যাটেন্ড করতে। আর ক’মাস পরেই ইলেকশান। সম্ভবত সেই নিয়েই কোনো আলোচনা আছে। জোতদার লখন সিং এখান থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছে হাত-পার্টির হয়ে। পুলিশের ট্রাক আর জীপ ঘোরাঘুরি করছে অহরহ। সাঁঝের বেলায় কাউকে পথ চলতে দেখলেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অত্যাচার, অনাহার, কুসংস্কার – এত কিছুর নাগপাশে জড়িয়ে আছে মানুষগুলো। আধপেটা লোকগুলোকে দেখলে যন্ত্রণায় বুক ফেটে যায়। আর কত সহ্য করবে এরা? উত্তীয়র মনে পড়ে গেল দিন কয়েক আগে শোনা ধাতুয়ার একটা গান – “রোয়ী রোয়ী সে কহেলী সুদামা সে বহুরিয়া দিনওয়া পাতার ভইলে, খাইকে সত্তুয়া নেইখে রহেকে ঝোপড়া নেইখে গোড়ওয়ায় জুতা নেইখে দিনওয়া পাতার ভইলে…” গোটা রাজ্যের অর্থনীতি স্থবির হয়ে আছে গত কয়েক দশক ধরে। মানবসম্পদ থেকে খনিজসম্পদ, সব আছে; কিন্তু তার কোনো ব্যবহারিক দিক নেই। কিছু লোকের অঢেল পয়সা! আবার বেশিরভাগ মানুষের হাতে অ্যাল্যুমিনিয়ামের একটা সাধারণ টুকরোও দেখা যায় না। বর্ণ-সমস্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। যখন তখন রণবীর সেনার তাণ্ডব। বর্ণ-বৈষম্য এতটাই মারাত্বক যে ভাবলে বিস্ময়ে পাথর হয়ে যেতে হয়। শুধু বড়লোক নয়, গরীব ক্ষেত-মজুরের মধ্যেও রয়েছে বর্ণ-সংস্কার। গ্রামের বুড়ো জগদীশের কাছে উত্তীয় গল্প শুনেছে— একবার কৃষকেরা শেওপূজন সিংয়ের জমির সব ধান কেটে নিচ্ছিল। তাই দেখে সে দলবল নিয়ে ছুটে আসে। বিশাল বিশাল বৈলগাড়ি চড়ে আসছিল দুই ভাই। হঠাৎই মাঠের একটা গর্তে চাকা আটকে লখন সিং গাড়ি থেকে পড়ে যায় এবং পাথরে তার মাথা ঠুকে যাওয়ার ফলে অঝোরে রক্ত পড়তে থাকে। যেসব প্রতিরোধী চাষীর হাতে কাস্তে আর বুলুয়া শোভা পাচ্ছিল, তারাই দৌড়ে যায় ‘মালিক’-এর কী হয়েছে দেখতে। কিন্তু লখন কাউকে নিজের কাছে ঘেঁষতে দিতে রাজি হয়নি, নীচু জাতের ছোঁয়া লেগে যেতে পারে! এক কালে অবশ্য এই গিঁটগুলো কেটে গিয়েছিল অনেকটাই। এই সব অঞ্চলে মানুষ একটা লোকের নাম জানত – জওহর। দিল্লী’র প্রবাসী বাঙালী। নকশালবাড়ির রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিহারে চলে এসেছিলেন ’৭০-এর একদম গোড়াতেই। তখন থেকে লেগেপড়ে দরিদ্র আদিবাসী এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে ইজ্জতবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। পার্টি ভাগ হওয়ার পর চারু মজুমদার-পন্থী CPI-ML-এর বিহার নেতৃত্বকারী টিমের দায়িত্বে ছিলেন।
কিছু কারণে বিতর্ক দেখা দিলে নিজের ফ্যাকশন তৈরি করে ভোজপুর জিলাতে বিশাল কৃষক-আন্দোলন গড়ে তোলেন, লড়াইয়ের ময়দানে শহীদ হন। এক সময় নাকি বিহারে ঢুকতে হলে সমস্ত ML-গোষ্ঠীকে বলতে হত, “আমরা জওহরের পার্টি থেকে আসছি।” জওহর ভুল করেছিলেন অনেক, তাত্ত্বিক প্রশ্নে বেশ দূর্বলও ছিলেন। কিন্তু তাঁর লড়াইগুলো? স্যাক্রিফাইসটা? উত্তীয়র ভাবলে দুঃখ হয় যে এই লোকটার হাতে গড়া পার্টিটা আজ সংশোধনবাদের পাঁকে ডুব দিয়েছে। মুখে জওহরের নাম নিয়ে অ্যাসেম্বলিতে সীট জিতে ফুটানি মারছে! উত্তীয়দের ক্ষমতাও ক্রমশ কমে আসছে। এত দিন প্রায় পঁচিশটা সশস্ত্র স্কোয়াড ছিল। প্রায় দেড়শ উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু ’৮২-র ধাক্কা আর ’৮৬-এর ভাঙন সংগঠনকে দুর্বল করে দিয়েছে। এছাড়া আছে গোঁড়ামিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী। চারু মজুমদার শেষ লেখায় বলেছেন বৃহৎ বাম ঐক্যের কথা। কিন্তু পার্টি কি সেই দিকে যাচ্ছে? এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে “জল অচল” করে রাখছে! যে সমস্ত গোষ্ঠী সশস্ত্র লড়াই চালাচ্ছে তাদের সবাইকে এক পার্টি শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে অসুবিধে কোথায়? ডিবেট চলুক, কিন্তু মিউচ্যুয়াল কো-অর্ডিনেশানও তো দরকার। বংশীলালকে এই কথাগুলো ও বার বার বলেছে। বংশীলাল কিছু বলেনি, নানা কথায় প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে।
“আপকো কেয়া লগতা হ্যায়? হাম লোগোঁ কো কোই ফিকর নহী হ্যায় পার্টি কে বারে মেঁ? Yes, the question of unity is important, লেকিন উসকে লিয়ে কেয়া দুসরে issues যো হ্যাঁয় ওহ ভী ছোড় দেঁ! লগ তো রহা হ্যায় ক্রান্তি সে জী ভর গয়া হ্যায় আপকা?” রাগত স্বরে বলে উঠল বংশীলাল। উত্তীয় ধীরে ধীরে মাথা তুলল। দুই হাঁটুর ভাঁজে মাথা ঢুকিয়ে শুনছিল এতক্ষণ। বংসীলালের চোখে চোখ রেখে বলে চলল তার মনের কথাগুলো – কেন ঐক্য জরুরি, কেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টে ট্রেড ইউনিয়ন বানাতে হবে, কেন বড় চাষীদের একটা অংশকেও লড়াইয়ের ময়দানে আনতে হবে মধ্য কৃষকদের সাহায্যে… “We are not against forming TUs. But right now, at least in Bihar, our task is to consolidate the secret apparatus of the party. You can’t expect UG leaders leading mass movements like strikes and hartals!” একটু থেমে বিড়িতে একটা টান দিয়ে বংশীলাল আবার বলা শুরু করল, “আপ বোল রহে হ্যাঁয় rich peasants কে সাথ কুছ কুছ issues মেঁ ইউনাইটেড মোর্চা খড়া করনে কে লিয়ে। আপকো পতা ভী হ্যায় আপ কিসকী ভাষা বোল রহে হ্যাঁয়? Do you know that SN’s essential difference with CM began on this question? He advocated unity with the rich peasants in contrast to CM’s emphasis on neutralizing them through struggle. ইয়ে থিওরি ফলো করনে সে কেয়া হুয়া আপকো মালুম হ্যায়? This line developed into that of unity with some sections of the landlords and…” কথা শেষ হল না বংসীলালের।
ওর পায়ের কাছে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বছর ষোলোর দুখন। সারা শরীর ধুলোয় মাখা। ওকে তুলে ধরতেই উত্তীয়র হাত রক্তে চ্যাট চ্যাট করে উঠল। ঝুপড়ির ভেতর নিয়ে যাওয়ার পর একটু জল খেল দুখন। ধীরে ধীরে বলতে লাগল… অড়হর ক্ষেতে কাজ করছিল ওরা। সন্ধ্যে নামবে খানিক পরে – কাজ শেষের কাজ চলছে। হঠাৎই প্রায় জনা দশেক লোক বন্দুক, কিরিচ ইত্যাদি নিয়ে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাঁচ জনকে ওখানেই নিকেশ করেছে। দুখন কোনোক্রমে বেঁচে গেছে। যদিও তার পিঠেও কিরিচের গভীর ক্ষত। প্রিলিমিনারি ড্রেসিং সেরে ঘরের বাইরে এল বংশীলাল। ততক্ষণে ঝুপড়ির সামনে প্রায় গোটা গ্রামের লোক এসে দাঁড়িয়েছে। বজ্রকঠিন কন্ঠে বংশীলাল গর্জন করে উঠল, “খুন কা বদলা খুন!” উত্তেজিত গরীব কিষান হাত তুলে সম্মতি জানাল – কেঁপে উঠেল গাছপালাগুলো। মশাল হাতে মাও-চিন্তা প্রচার টিমের কয়েকজন যুবক গেয়ে উঠল – আগ হ্যায় ইয়ে আগ হ্যায় ভুখে পেট কী আগ হ্যায় ইয়ে আঁসুয়ো কা অঙ্গার হ্যায় ঔর ভড়কতী যা রহী ইয়ে ধড়কতী হুঈ আগ হ্যায়! উত্তীয় এতদিন জানত গেরিলা দল কাজ করে গোপনে, তার খবর কেউ রাখে না। এমন খোলা হাওয়ায় কেউ “খুনের বদলে খুন” বলে চিৎকার করছে, এই অভিজ্ঞতা ওর প্রথম। একটু পরে বংশীলাল উত্তীয়কে ডেকে পাঠাল। দুজনে মিলে বসল দূরের একটা ন্যাড়া গাছের তলায়। মাটি থেকে গরমের ভাপ ওঠা কমে গেছে। ঠাণ্ডা না হলেও পরিবেশটা গুমোট নয়। বংশীলাল ওর দিকে তাকিয়ে হেসে একটা বিড়ি ধরাল। “লোগোঁ মেঁ ভরপুর যোশ হ্যায়,” বলেই চোখ টিপে বলল, “চলো, উপর সে ছও ইঞ্চ কম কর দেতে হ্যাঁয় উন সালোঁ কা!” উত্তীয় একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আপকো লগতা হ্যায় অ্যাইসি অ্যানিহিলেশন সে কুছ হোনেওয়ালা হ্যায়?” বংশীলাল গম্ভীর গলায় উত্তর দিল, “হুমম…পাওয়ার ভ্যাক্যুয়াম হোনে কা কোই চান্স নহী হ্যায়। লেকিন সার্ভাইভ করনে কে লিয়ে ছোটা-মোটা সেলফ-ডিফেন্সিভ অ্যাকশন তো করনা হী হ্যায়। ওয়ার্না ইন লোগোঁ কা হিম্মত টুট যায়গা।” তারপর চশমাটা খুলে চোখ বন্ধ করে বলল, “লগ রহা হ্যায় ওহ সব অভী তক উস জগহ মেঁ হী হ্যাঁয়। চলিয়ে, বহুত কাম হ্যায়। আপকো বুলুয়া চলানা আতা হ্যায়?” উত্তীয় মাথা নাড়ল।
ঘরের কোণে একা বসে থাকতে থাকতে রিক্তার চোখের সামনে অনেক পুরনো ছবি ভেসে ওঠে – ছেলের ছবি। সে কোনওদিন চায়নি ছেলে রাজনীতি করুক; অসীমেষের রাজনৈতিক জীবনের কথা বরাবর লুকিয়ে রেখেছে ওর থেকে। ছেলেও তো পড়াশোনার বাইরে কিছু করত না সেই ভাবে। অসীমেষ বা তার শ্বশুরমশাইয়ের পলিটিকাল ইনভল্ভমেন্টের কারণে বাড়িতে অসংখ্য রাজনৈতিক সাহিত্য থাকলেও, সেগুলো শুধুমাত্র পড়ার জন্যেই পড়েছে ছেলে। রিক্তা কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবেনি কতগুলো থিওরিটিকাল জার্গন তাঁর সন্তানকে এইভাবে প্রভাবিত করবে। আসলে অসীমেষের জন্যেই এগুলো হয়েছে। বার বার রিক্তা বলেছে যাতে কোনওভাবেই ছেলেকে রাজনৈতিক বিষয়ে এন্টারটেন না করা হয়, তবু অসীমেষ কানে তোলেনি সে কথা। গত ক’মাস কোনও খবর নেই ছেলের। চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। অনিমেষকে কিছু বললে সে চুপ করে থাকে। এর ওপর গতকাল রাতে পুলিশের রেইড…ছেলেকে এইভাবে পুলিশ তাড়া করে বেড়াবে! সমস্ত মান-সম্মান ধুলোয় মিশে গেছে এক মুহুর্তে। ফোনটা আবার বাজছে। এই নিয়ে তিনবার। অনিচ্ছাসত্তেও উঠে গিয়ে ফোনটা ধরল রিক্তা। “হ্যালো…” উল্টোদিক থেকে কোনও কন্ঠস্বর ভেসে এল না। রিক্তা আবার বলল, “হ্যালো…কে বলছেন?” এইবার উত্তর এল খানিকটা অস্বস্তি-মেশানো গলায়, “হ্যাঁ, মানে…আমার নাম প্রজ্ঞা বসু…” চিরুনি-তল্লাশী শুরু হয়েছে। লখন সিং থানায় ডায়রি করেছে যে, দুখন আর ওর কিছু স্যাঙাৎ মিলে ওর ওপর চড়াও হয়েছিল খুন করার জন্যে। নকশালদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথাও বলেছে। সেদিনের অ্যাকশনের পর থেকে জমিদার-পুলিশের যৌথ আক্রমণে সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে। স্কোয়াড ছত্রভঙ্গ। বংশীলাল সবাইকে ম্যান্ডেট দিয়েছে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে। সে নিজেও হয়তো অন্য কোথাও আছে। আধমরা দুখনকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। বেশ কিছু বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে ওরা। পাটনা-তে এসে উত্তীয় আশ্রয় নিয়েছে পরিচিত একজনের বাড়িতে। এটা ওর মামাবাড়ির দেশ। মানুষগুলোকে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় ফেলে আসতে মন চায়নি উত্তীয়র। কিন্তু উপায় কী? কে জানে কেমন আছে বুড়ো জগদীশ, লাচ্ছি, ওর বর লাল্লন, ধাতুয়া… এত দিনের না-কামানো দাড়ি-গোঁফ কেটে বেশ স্বস্তি পাচ্ছিল উত্তীয়।
খবরের কাগজ খুলে খুঁজতে চেষ্টা করছিল কোনও খবর আছে কিনা। নাহ। এইসব ঘটনা বিহারে এতটাই জল-ভাতের মতন যে খবরওয়ালারা কভার করার চেষ্টাই করে না। আরওয়ালের মত বিশাল কিছু না হলে “ভগবানের নিদ্রা” ভাঙে না। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। খবর তৈরি করে যারা পেট চালায় তাদের কাছে এর চেয়ে বেশি কীই বা আশা করা যায়? “গুড মর্নিং।” উত্তীয় দেখল সুনন্দা ঘরে ঢুকেছে। হাতে চায়ের সরঞ্জাম। উত্তীয় হেসে সুপ্রভাত জানাল। ছোট্ট টেবলে পিরিচ-পেয়ালা রেখে সুনন্দা বসল সামনের চেয়ারে। “কেমন আছ এখন? কাল রাত্রেও অ্যাস্থমায় কষ্ট পেয়েছ?” সুনন্দা প্রশ্ন করল। “ভালই। আর অ্যাস্থমা নিয়ে বেশি ভেবে কাজ নেই। ওটা আমার সঙ্গের সাথী। একটু টান না উঠলে কেমন যেন কী নেই কী নেই মনে হয়!” উত্তীয় হাসতে হাসতে উত্তর দিল। সুনন্দা ডোডোমামা’র মেয়ে। B.I.T.’র ছাত্রী। ছুটিতে বাড়ি এসেছে। গত তিন-চার দিনে মূলতঃ ওর সাথে গল্প করেই সময় কেটেছে উত্তীয়র। কাপে চা ঢালতে ঢালতে সুনন্দা বলল, “আচ্ছা, তোমরা কী ভাব বল তো? কয়েকজন মিলে দেশ দখল করতে পারবে? আর দখল করবেই বা কেন ও কী ভাবে? একটা পীসফুল মুভমেন্ট, ইলেকশন, এইসব দিয়ে হয় না? ফাইনালি তো সাধারণ মানুষ মরছে। এই ভাবে নিজের কেরিয়ার শেষ করার কোনও মানে হয় না। ইউটোপিয়ার পেছনে ছুটছ…কী হল? কিছু বলছ না যে!” নাকের ওপর চশমা তুলতে তুলতে সুনন্দার এইসব মতামত শুনতে উত্তীয়র ভালই লাগছিল। একটা কথারও প্রতিবাদ করছিল না। হাসছিল শুধু। কি হবে বলে? আর বলবেই বা কী? সে নিজেই তো বিভ্রান্ত। উত্তর না পেয়ে সুনন্দা প্রশ্ন ঘোরাল, “তোমার ‘তিনি’ কেমন আছেন?” “জানিনা,” চুমুক দিতে দিতে জানাল উত্তীয়। সুনন্দা চোখ গোল গোল করে বলল, “স্ট্রেঞ্জ! তুমি কি ইরেসপন্সিবল গো! জানে তুমি এখানে আছ?” উত্তীয় মাথা নাড়ল দুদিকে। সুনন্দা বলল, “ফোন করবে একটা? নাম্বার আছে? বাড়িতেও তো কিছু জানাতে দিলে না।” “হ্যাঁ আছে। কিন্তু এখন করতে হবে না। কলকাতা ফিরব তো। তখন না হয় দেখা করা যাবে। আর এখন বাড়িতে কিছু না জানানোই ভাল। ফালতু টেনশন।” চেয়ারে হেলান দিয়ে উত্তীয় একটা হাই তুলল। তারপর প্রশ্ন করল, “গল্পের বই-টই পড়? কার লেখা ভাল লাগে?” সুনন্দা বিস্কুটে একটা কামড় দিয়ে চিবোতে চিবোতে জবাব দিল, “পড়ার জিনিস নিয়েই হিমশিম খেয়ে গেলাম; তার ওপর আবার গল্প!” একটু চুপ করে থেকে বলে উঠল আবার, “তবে পুজোসংখ্যাগুলো পড়ি। এখানে আসে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ।” “হুমম…আর কিছু পড় না?” “বললাম তো, সময় পাই না। উফ! তুমি না দিন দিন একটা বোর হয়ে যাচ্ছ!” উত্তীয় হা-হা করে হেসে উঠল। হাওড়া স্টেশনে নেমে বড় ঘড়ির কাছে একটা STD বুথ দেখতে পেল উত্তীয়। বাড়িতে একটা ফোন করা দরকার। তিন-চারটে রিঙের পর ওপার থেকে অসীমেষের কন্ঠস্বর ভেসে এল, “হ্যালো…” “হ্যাঁ, আমি উত্তীয়।” একটু থেমে, থমকে যাওয়া গলায় অসীমেষের জিজ্ঞ্যেস করল, “তুই! কোথায় আছিস?” উত্তীয় শুনতে পেল অসীমেষের পাশ থেকে রিক্তার গলার আওয়াজ, “কে ফোন করেছে? কি গো…” উত্তীয় বলল, “এই মুহুর্তে বলতে পারছি না। অবস্থা কী?” “দু সপ্তাহ আগে রেইড হয়েছে, তুই এখন ফিরিস না কোনও ভাবেই।
” “হুমম…তোমাদের শরীর ভাল তো? চিন্তা কোরো না। রাখছি।” “এক মিনিট। তোর মা’র সাথে একবার কথা বল।” “কেমন আছিস? কোথায় তুই?” কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল রিক্তা। “ঠিক আছি, তুমি কিছু ভেব না। পরে ফোন করব। এখন রাখি। তোমরা…” “তুই সাবধানে থাকিস। আমার ভয় করছে।” “ভয়ের কিছু নেই। চিন্তা কোরো না তুমি। রাখি এখন।” “রাখ। ও হ্যাঁ, তোর এক বন্ধু ফোন করেছিল দিন দশেক আগে।” “কে?” “নাম বলল প্রজ্ঞা বসু। জানতে চাইছিল তুই কোথায় আছিস।” “আচ্ছা, এখন রাখি।” ফোনের টাকা মিটিয়ে বেরিয়ে এল ও। অনেক দূর যেতে হবে এখন। পকেটে পয়সা কম আছে, তাই বাস ধরবে না ঠিক করল। মিনিট চল্লিশ হেঁটে কলেজ স্টীট পৌঁছল। এখান থেকে মেডিকাল কলেজের ভেতর দিয়ে গেলেই সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন। টালিগঞ্জের ভাড়া কত সেন্ট্রাল থেকে? ছ’টাকা না? ফতুয়ার পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট আর কিছু খুচরো পয়সা বার করল। হ্যাঁ, বেহালা অব্দি চলে যাওয়া যাবে। টালিগঞ্জ মেট্রো সেটেশন থেকে বেরিয়ে উত্তম কুমারকে পেছনে ফেলে উত্তীয় এগিয়ে গেল অটো স্ট্যাণ্ডের দিকে। অটোতে উঠে বলল, “সখেরবাজার।” একই রকম আছে শহরটা। অদ্ভুত একটা প্রাণ আছে। পেট্রোল-পোড়া হাওয়াও যেন ভাল লাগে। ভাঙাচোরা রাস্তাগুলো বার বার মনে করিয়ে দেয় তাদের অস্তিত্বের কথা। অটো থেকে নেমে রাজা জগৎ রায় রোডের একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল উত্তীয়।
ঢুকবে? ভাবতে ভাবতেই গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এল প্রজ্ঞা। উত্তীয়কে প্রথমে লক্ষ্য করেনি, তারপর ওর মুখের দিকে তাকাতেই অবাক দৃষ্টিতে কয়েক সেকেণ্ড চেয়ে থাকল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠল, “তুই! এখানে! কী হয়েছে? কেমন আছিস? কি চেহারা হয়েছে তোর!” উত্তীয় একটু হাসল, “নাহ, এমনিই দেখা করতে এলাম। মানে, অনেক দিন তো…” “কিভাবে দিনগুলো কাটিয়েছি জানিস? ভেতরে আসবি?” “নাহ, জাস্ট দেখা করতে এলাম। জানতাম তোকে পেয়ে যাব এই সময়ে…” “চল,” বলে প্রজ্ঞা হাঁটতে শুরু করল। উত্তীয় চলতে লাগল পেছন পেছন। চৌরাস্তার কাছে পৌঁছে একটা ফাস্ট-ফুডের দোকানের সামনে দাঁড়াল দুজন। “কিছু খেয়ে নে।” “নাহ।” “কথা না বাড়িয়ে খা। কিভাবে…তুই কি একবারও ভাবলি না আমার কী হবে? জানিস বাড়িতে কী…” পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করল উত্তীয়। প্রজ্ঞা হাতে একটা থাপ্পড় মেরে বিড়িটা ফেলে দিল। “মুর্গিওয়ালাদের মত বিড়ি খাওয়াটা বন্ধ কর। একটা ফোনও কি করতে নেই?” উত্তীয় আস্তে করে বলল, “এটা রাস্তা…প্লিজ।” “হুঁ,” প্রজ্ঞা চুপ করে গেল।
“এখন কোথায় যাবি?” “দেখি।” “দেখি মানে? টাকা আছে?” “যা আছে তাতে হয়ে যাবে। চাপ নিস না।” “তার মানে নেই। পঞ্চাশে হবে?” “বললাম তো লাগবে না। আছে আছে…” “আমার কাছে এই মুহুর্তে পঞ্চাশই আছে। এটা নে। প্লিজ। আর একটু…” বলতে বলতে চুপ করে গেল প্রজ্ঞা। উত্তীয় অধৈর্য্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী? আরে বলবি তো…” “একটু প্র্যাক্টিকাল হ’…” টাকাটা ওর ফতুয়ার বুকপকেটে গুঁজে দিল প্রজ্ঞা। “আসি,” বলে উত্তীয় এগিয়ে গেল দূরের বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে। ফিরে তাকাল একবার, হাত নাড়ল প্রজ্ঞার উদ্দেশ্যে। প্রজ্ঞা দেখছে উত্তীয়কে। হ্যাঁ, উত্তীয় হাঁটছে। সেটব্যাক সত্ত্বেও হাঁটছে। অস্তাচল সূর্য আজকের মত শেষবারের জন্য ছড়িয়ে দিচ্ছে রক্তিম আভা। উত্তীয় হাঁটছে, মিলিয়ে যাচ্ছে মানুষের ভীড়ে। গল্পের প্রথম পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন