গত একমাস ধরে উত্তীয় এই গ্রামে আছে। দেখেছে, যা ও কখনও দেখেনি, শোনেওনি। যারা শুধু গালভারি পত্রিকায় বিভিন্ন পরিসংখ্যান ঘেঁটে কৃষি উৎপাদনে পুঁজিবাদ এল কি এল না, বা ভারত রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের স্বরূপ ইত্যাদি নিয়ে চুলচেরা গবেষণা করে, তাদের প্রতি একটা অদ্ভুত ঘৃণা জেগে উঠছিল ওর মনে। Extortion আর exploitation, এই শব্দ দুটোর আসল মানে বোঝা যায় না এখানকার গ্রাম না দেখলে। জোতদার লখন সিং আর তার ভাই শেওপূজন সিংয়ের বাড়ির সামনে দিয়ে কোনও ক্ষেত-মজুর পরিষ্কার ধুতি পরে যাবে, অ্যাইসি মজাল!
হরিজনের বাচ্চা চিরকাল হরিজন থাকবে, সে সাদা ধুতি পরবে কেন? শুধু ধুতি পরাই নয়, জোতদারের সামনে মাথা উঁচিয়ে সোজাভাবে হাঁটাও নাকি বেআইনি! চড়, থাপ্পড়, জুতোর বাড়ি খেয়েও দরিদ্র কৃষক মাথা নীচু করে থাকে, “আহ” শব্দটুকু করে না – হাজার হোক উঁচু জাত! কাস্ট স্ট্রাগল-ই ক্লাস স্ট্রাগলের রূপ নিয়েছে। “জোতদার মেরেছে” – এমনটা এখানে কেউ বলে না। “রাজপুত মেরেছে” বললেই বোঝানো হয়ে যায় কে মারতে পারে। ’৪৭-এর পর নাকি জমিদারদের ধরে প্রাণে মেরে দেওয়া হয়েছে। কৃষককে আর বেগার খাটতে হয় না। বন্ডেড লেবারও নাকি উঠে গেছে। কিন্তু আসল চিত্রটা কলেজ-ইউনিভার্সিটির পাঠ্য-পুস্তক থেকে ঢের আলাদা। হ্যাঁ, বেগার নেই, কিন্তু বনিহার আছে, যা আসলে বেগারেরই আধুনিক রূপ, নামটাই যা আলাদা। যাইহোক, ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে অত্যাচারের মাত্রা এখন খানিকটা হলেও কম। গত বছর শেওপূজনের খাস লেঠেলের একটা হাত টাঙ্গির এক কোপে নামিয়ে দিয়েছিল কৃষকরা। সেই থেকে ওদের মনে ভয় উঁকি মারতে শুরু করেছে। বংশীলালের কাছ থেকে উত্তীয় এরকম অনেক কথা শুনেছে। লোকটাকে দেখলে কেমন অবাক লাগে ওর। কোথায় গোরখপুরের কোন এক কলেজের অধ্যাপক, শেষে চাকরি ছেড়ে বিহারের এই এঁদো গ্রামে পড়ে আছে আঠেরো বছর ধরে! হয়তো এই লোকগুলো আছে বলেই আজও মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায়। হয়তো এই ধরণের মানুষগুলোর জন্যেই এক না একদিন দেশে বিপ্লব হবে, প্রতিষ্ঠিত হবে সাধারণ জনতার হুকুমত।
ঝুপড়ির সামনের বড় নিমগাছটার তলায় বসে এসব ভাবছিল উত্তীয়। সম্বিৎ ফিরল ধাতুয়ার চিৎকারে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে, নিঃশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। “বহুত গজব হো গইল কামরিট, লাচ্ছি কো ভূতনী নে পকড় লিয়া!” বলেই দৌড় লাগাল ধাতুয়া। উত্তীয় উঠে জানতে চাইল কী হয়েছে। ছুটতে ছুটতে ধাতুয়া জবাব দিল, “ভূতনী নে পকড় লিয়া…” এখন কোথায় আছে বংশীলাল? ধাতুয়ার মত কৃষক-কমরেডের যদি এই হাল হয়, তাহলে গ্রামের অন্যদের কী হবে? লাচ্ছির কী হয়েছে? এসব ভাবতে ভাবতে মেঠো পথ ধরে দক্ষিণের মাঠের দিকে জোরকদমে হাঁটা লাগাল উত্তীয়। গল্পের চতুর্থ পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন