
মাস দেড়েক আগের কথা। রাতে খেয়ে আমি, সুমন আর মিলু যে যার মত পড়ছিলাম। সারাদিন প্রচুর খাটুনি ছিল—ল্যাব আর ক্লাসের চাপে সবাই ক্লান্ত। চোখে ঘুম ঘুম ভাব, তবুও ঘুম আসছিল না। তাই গল্প জুড়ে দিলাম, যদি ঘুম আসে এই আশায়।
মিলু বোতল নিয়ে পানি আনতে গেল। আমি আর সুমন প্ল্যান করলাম, মিলু ফিরে আসার সময় ওকে দরজার পাশ থেকে ভয় দেখাব। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়লাম আমরা। মিলু দরজা খুলতেই হো হো করে হেসে উঠলাম। কিন্তু মিলুর কোনো ভাবান্তর হল না! হতাশ হয়ে বসে পড়লাম। আমার কাছে বিস্কুট ছিল, তাই খেতে খেতে পানি খেলাম সবাই।
মিলু বলল, “আমার কাছে একটা নতুন ইংলিশ মুভি আছে, ভ্যাম্পায়ারের। চল দেখি সবাই মিলে।” অনেকদিন রুমে একসঙ্গে মুভি দেখা হয়নি, তাই আমরা রাজি হয়ে গেলাম। পাশের রুমের ইমরানকে ডাকলাম, সে মুড়ি আনতে গেল।
মুভি শুরু হয়ে গেল। হরর মুভি হলেও আমাদের ভয় লাগার বদলে হাসি পাচ্ছিল। ভ্যাম্পায়ারদের কীর্তিকলাপ দেখে মজা পাচ্ছিলাম। মুভির নাম ‘ড্রাকুলা’। নায়ক ছিল ‘ম্যাট্রিক্স’ মুভির নিও। তিনটা নারী উদ্ভট ভঙ্গিতে নায়কের রক্ত চোষার চেষ্টা করছিল। ভয়ের বদলে আমাদের যেন একধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল।
মুড়ি খাওয়া শেষ হবার পর মুভি দেখার আগ্রহ কমে গেল। মিলু বলল, “চল বারান্দায় বসে চাঁদ দেখি।” প্রথমে আমরা যেতে চাইনি, কিন্তু মিলুর ডাকাডাকিতে শেষমেশ গেলাম। সত্যিই সুন্দর চাঁদ উঠেছিল, পরিষ্কার আলোয় যেন বই পড়া যাবে।
এমন সময় সুমনের ফোনে কল এল। বেশ বিরক্ত মনে হলো তাকে। রিসিভ করতে করতেই কল কেটে গেল। পরপরই মিলুর ফোন বেজে উঠল, তারপর আমার। কিন্তু সব কলে একই ঘটনা, রিসিভ করার আগেই কেটে যাচ্ছে। নাম্বারগুলো ভিন্ন হলেও যেন মিল ছিল। কৌতূহল হলেও গভীর রাতে খতিয়ে দেখার ইচ্ছে হল না।
কিছুক্ষণ পর আবার সুমনের ফোন বাজল, এবার সে রিসিভ করল। ওপাশ থেকে কী বলা হল, আমরা জানি না, কিন্তু সুমনের মুখ দেখে মনে হল ব্যাপারটা গুরুতর। সে বলল, “ঢাকা মেডিকেল থেকে কল করছিল, মুমূর্ষু এক রোগীর প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে, রক্ত দরকার, কাউকে না পেয়ে আমাকে ডেকেছে।”
এত রাতে একা না যাওয়াই ভালো, তাই আমরাও রেডি হয়ে গেলাম। রিকশা পাওয়া যাবে না, হেঁটেই রওনা দিলাম।
বকশী বাজার মোড়ে পৌঁছে অদ্ভুত একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। পুরো এলাকা ফাঁকা, সব দোকান বন্ধ। এমনকি পেনাংও বন্ধ! মেডিকেলের হলের দিকেও সব লাইট নিভে আছে। সবচেয়ে অস্বাভাবিক বিষয়, কোথাও কোনো টহল পুলিশ নেই।
আমরা ইমারজেন্সির দিকে এগোলাম। সেখানেও সব অন্ধকার। একটা কলাপ্সিবল গেটের পাশে একজন লোক বসে ছিল। সারা গায়ে চাদর জড়ানো, মাথায় মাফলার। এত গরমেও এমন পোশাক!
মিলু জিজ্ঞেস করল, “ব্লাড কোথায় নেওয়া হয় বলতে পারবেন?”
লোকটা আমাদের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, “এত দেরি হলো কেন? আমি কি সারারাত বসে থাকব?”
আমরা ভেতরে ঢুকলাম। লোকটা আমাদের একটা ওয়ার্ডে নিয়ে গেল, তারপর দরজা বন্ধ করে দিল। বুঝলাম না দরজা বন্ধ করার কী দরকার? আধা ঘণ্টা বসে থাকার পর হঠাৎ ভেতরের দরজা খুলে গেল। কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। সুমন উঁকি দিয়ে দেখতে গিয়েছিল, তখনই কণ্ঠ শোনা গেল, “সুমন, তুই প্রথমে আয়।”
আমাদের রক্ত হিম হয়ে গেল। আমরা তো রক্ত দিতে এসেছি, কিন্তু ডাক আসছে শুধু সুমনকে! তারপর বলা হলো, “যে বলছিস, সে আসবি সুমনের পর, তারপর অন্যজন।”
আমি মেঝের দিকে তাকালাম। ফোটা ফোটা রক্ত! পুরো মেঝে রক্তে ভেজা, যেন কিছুক্ষণ আগে মুছে দেওয়া হয়েছে। এমন সময় গেটের বাইরে পাহারাদার লোকটা এল। কিন্তু এবার সে খালি গায়ে। গায়ে এক ফোঁটা মাংস নেই, শুধু হাড়! সে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোদের মোবাইল ফোনগুলো দে, তাড়াতাড়ি!”
আমরা অসহায়ভাবে ফোন তুলে দিলাম। লোকটা হাসতে লাগল। তার উপরের দুইটা দাঁত বড় বড়, যেন তীক্ষ্ণ ছুরি!
আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। তখনই সুমনের চিৎকার শুনলাম। সে দরজার ওপাশ থেকে দৌড়ে আসছে। হঠাৎ দরজা খুলে গেল। সুমন ছুটে এল। তার ধাক্কায় পাহারাদার পড়ে গেল। সে চিৎকার করে উঠল, “আমীন, পালা, দৌড়া!”
আমরা আর কিছু ভাবিনি। দৌড় দিলাম প্রাণপণে। ভাগ্যিস, গেট খোলা ছিল। না হলে আজ আমরা থাকতাম না!
ইমারজেন্সি থেকে বের হয়ে দেখি, আকাশে চাঁদ নেই। চারপাশ অন্ধকার। দৌড়ানোর সময় মিলু পড়ে গিয়েছিল। আমি বাঁ পায়ের আঙুল ভেঙে ফেললাম, যা আর কখনো ঠিক হবে না। কিন্তু তাতে কী? বেঁচে যে আছি, সেটাই বড় কথা!
সুমনের গলায় গভীর কামড়ের দাগ পড়েছে। এখনো পুরোপুরি সারেনি, হয়তো সারাজীবন থাকবে! কিন্তু যেটা সবচেয়ে ভয়ংকর—আমরা জানি না, সেই রাতে আমাদের সাথে আসলে কী হয়েছিল!