
অতনুর পুরো নাম শিহাব শাহিন অতনু— ওর নানার রাখা নাম। ওদের বাড়ি উত্তরবঙ্গে, বর্ডারের কাছে। জায়গাটা ভয়াবহ রকমের দুর্গম। ইলেকট্রিসিটি তো দূরের কথা, একটা খাম্বাও নেই। যাতায়াতের মাধ্যম কেবল পায়ে হাঁটা পথ। প্রায় ১০ মাইল হাঁটলে পাকা রাস্তা পাওয়া যায়।
অতনুর এই অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম হলেও ওর আধুনিক নামই বলে দেয়, ওদের পরিবার গ্রামের আর দশটা পরিবারের থেকে আলাদা। ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর নানা বাড়িতেই বড় হয় সে। ওর নানারা ওপারের লোক— যুদ্ধের পর এপারে চলে আসেন। পরিবারের নামটাই শুধু ছিল, এছাড়া একেবারে নিঃস্ব হয়ে এপারে আসতে হয়।
ও আবছা ভাবে জানে, নানারা নাকি শুদ্ধ ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে ধর্মান্তরিত হন।
ওদের পরিবারে তিনটি আজব ঘটনা ঘটেছে— বড় মামা, মেজ খালু আর মেজ নানা, তিনজনই খুন হন। বর্ডার এলাকায় এসব স্বাভাবিক ঘটনা, তাই কোনো থানাপুলিশ হয়নি। লাশ পাওয়ার পর ২-৪ দিন চোখের পানি ফেলে আবার কাজে মন দিয়েছে সবাই।
এইসব ঘটনা যখন ঘটে, তখন ওর বয়স ১১। আজ থেকে ১৭ বছর আগের কথা।
এখন সে ঢাকায় থাকে। তিন দিন হলো গ্রামে এসেছে— শেষ যেটুকু ভিটেমাটি ছিল, তা বিক্রি করে দিতে।
শনিবার রাত
গ্রামে এখন এক ছোট মামা ছাড়া আর কেউ থাকে না। বিশ রুমের একটা টিনশেড দোতলা বাড়ি— পুরো ফাঁকা পড়ে থাকে। অতনু উপরের ঘরটা নিল। রাতে বেশ চাঁদ দেখতে দেখতে ঘুমানো যাবে। গ্রামে কতদিন রাত কাটানো হয়নি!
রাত তিনটা। টয়লেট পেলো ওর। এখানের একটা সমস্যা হলো— টয়লেট করতে নিচে নামতে হয়।
কি আর করা! নেমে টয়লেট সারলো।
কলপাড়ে গিয়ে হাত ধোবে, হঠাৎ দেখল— দুজন লোক বসে আছে নিচতলার বারান্দায়। কিছু নিয়ে তর্কাতর্কি চলছে তাদের মধ্যে, বোঝা গেল।
ও খেয়াল করল— টর্চ আনতে ভুলে গেছে।
কিন্তু এত রাতে এখানে বসে ঝগড়া করছে কারা?
ভালো করে তাকাল, দেখল— একজন উঠে দাঁড়িয়েছে। তীব্র রেগে গেছে সে। আচমকা একটা ছুরি বের করে আমূল বসিয়ে দিল অপর লোকটার বুকে!
পিচ করে একটা শব্দ হলো। আঁতকে উঠল ও— খুন!!!
দ্রুত লুকানোর জায়গা খুঁজল, পেল না।
ওদিকে লোকটা এদিকেই এগিয়ে আসছে! মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ও।
কিন্তু লোকটা ওর চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল, ওর দিকে তাকালও না।
লোকটা একটু দূরে ডোবার ধারে গেলে চাঁদের আলো পড়লো লাশটার মুখে।
চাঁদের আলোয় চিনতে কোনো সমস্যা হলো না।
বড় মামা!!!
লাশটা আর কারও না, বড় মামার!!!
সারা গা ঝিমঝিম করে উঠল ওর।
দ্রুত ছুটল বাম পাশের ঝোপের দিকে— ওখানেই বড় মামার কবর।
কিন্তু…
গিয়ে যা দেখল, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য।
কবরটা খোঁড়া! চারদিকে মাটি ছড়িয়ে আছে!
পাশে একটা রক্ত মাখা ইট পড়ে আছে!!
গ্রামের লোকদের ডাকে জ্ঞান ফেরে অতনুর।
কবরের পাশে পড়ে আছে ও। চারদিকে অনেক লোকজন, প্রত্যেকের মুখে একেকটা প্রশ্ন।
তার মাঝেই ও তাকাল কবরের দিকে—
সব স্বাভাবিক। শান্ত।
কবরের মাটি দেখে সহজেই বোঝা যায়— গত ১৭ বছরে কেউ তা খোঁড়েনি।
তাহলে কি দুঃস্বপ্ন দেখছিল ও?
তাই হবে হয়তো।
ধীরে ধীরে লোকের কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল ও।
ঠিক তখনই— চোখ আটকাল একটা ইটের দিকে।
গোল, এক পাশে রক্ত মাখা।
বুকটা ছাঁৎ করে উঠল ওর!
ঠিক তখনই—
ইটটা গড়িয়ে পাশের ডোবায় পড়ে গেল।
২ ঘণ্টা পর…
অতনু ঢাকার বাসে উঠে বসল। কাউকে কিছু জানাল না।
সবকিছু একটা দুঃস্বপ্ন বলে ভেবে নিল।
দুই দিন পর…
বাসায় কেউ নেই।
একাই ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিল ও।
হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল।
মোম জ্বালাতে রান্নাঘরে গেল ও। আইপিএসটাও আবার নষ্ট!
ফিরে এসে দেখল—
ড্রয়িংরুম ভর্তি ৬-৭ জন লোক!!!
সবার মুখে লাল কাপড় বাঁধা।
একজন লোককে বেঁধে রেখেছে তারা।
মোমের আলোয় চিনতে কষ্ট হলো না—
ওটা মেজ খালু!!!
হঠাৎ লোকগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল খালুর ওপর।
মুহূর্তে টুকরো টুকরো করে ফেলল ছুরি দিয়ে!
শুধু ধড় আর মাথা রেখে— বাকি হাত, পা আলাদা হয়ে গেল।
এক ফোঁটা রক্ত ছিটকে এসে লাগল অতনুর শার্টে।
ওখানেই জ্ঞান হারাল ও।
পরদিন…
হাসপাতালে জ্ঞান ফেরে ওর।
ঘরে ফিরে দেখে সব ঠিকঠাক।
তবে শার্টে রক্তের দাগ লাগল কিভাবে—
স্ত্রীর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না।
চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন একটা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
তীব্র কঠিন ওষুধ খেয়ে স্রেফ বেঁচে আছে।
দুইটি মৃত্যুর রাজসাক্ষী হয়ে—
তৃতীয় ঘটনাটি ঘটার অপেক্ষায়…