আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো মার্ক। দৃশ্যটা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। মুখটি মড়ার মতো সাদা, চোখ আর থুতনির নিচে কালো রঙের পোঁচ। ব্যাকব্রাশ করা কালো চুল চকচকে কালো একটা টুপির মতো লাগছে। হাসার সময় ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো ঘণ্টাখানেক আগে লাগানো একজোড়া শ্বদন্ত।
‘মার্ক, রেডি হয়ে নাও,’ একটা কণ্ঠ ভেসে এল দোরগোড়া থেকে। ‘ওরা এসে পড়বে এখুনি।’
আয়নার সামনে থেকে ঘুরলো মার্ক। তাকালো প্রধান সহকারী এলিয়টের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। এলিয়টের সুদর্শন চেহারাটা মেকআপ নেওয়ার ফলে এ মুহূর্তে বিকৃত দেখাচ্ছে। তবে পিশাচবাড়িতে আসা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপতে তারা নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসলো। কিন্তু মার্কের কালো পোশাক পরা প্যাঁকাটি শরীর আর শুকনো মুখটার দিকে একবারের বেশি কেউ তাকায় না।
পিশাচবাড়ির ভারী ওককাঠের পাল্লাজোড়া ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে যেতে ওদিকে মনোযোগ ফেরালো মার্ক। স্পিকারে বেজে উঠেছে পরিচিত যন্ত্রসংগীত। হরর ছবির মিউজিক ট্র্যাকের মতো, শুনলেই শিরদাঁড়া বেয়ে বরফজল নামতে থাকে মার্কের। ঘরের অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে আছে মার্ক। দর্শনার্থীরা এখনই ঢুকবে ভিতরে। শুরু করবে ট্যুর।
একে একে ওরা পা রাখলো এন্ট্রাস হল-এ, চেহারায় ফুটে আছে নার্ভাস ভঙ্গি। ঘরের মধ্যে হঠাৎ ঝলসে উঠলো বিদ্যুৎ। লাউডস্পিকারে ভেসে এল বজ্রনিনাদ। লাফিয়ে উঠলো সবাই। তারপর এলিয়ট মসৃণ গলায় পিশাচবাড়ি দেখার জন্য স্বাগত জানালো সকলকে, সতর্ক করে দিল ঘরগুলোর অন্ধকার ছায়া আর ওঁৎ পেতে থাকা আতঙ্কের ব্যাপারে। মার্ক ঈর্ষা নিয়ে লক্ষ্য করলো মেয়েগুলো হাঁ করে তাকিয়ে আছে এলিয়টের দিকে। তারপর কান ফাটানো, কর্কশ একটা চিৎকার শোনা যেতে রেডি হয়ে গেল মার্ক। এবার ওর বলার পালা।
‘এদিক দিয়ে আসুন, ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়াগণ,’ কণ্ঠে যতটা সম্ভবত থমথমে ভাব ফুটিয়ে তুললো মার্ক। ‘আমার সঙ্গে সিটিংরুমে চলুন।’ দর্শকরা ওর দিকে প্রত্যাশা নিয়ে তাকালো একবার, তারপর সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো। হাতে ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে দলটার পেছনে থাকলো মার্ক।
সিটিংরুমে সবার আগে গটগট করে ঢুকে পড়লো এক স্বর্ণকেশী। প্রায় সাথে সাথে সে এমন গগনবিদারী চিৎকার দিল, বাকিদের আত্মা কেঁপে গেল। আড়ষ্ট হাসি ফুটলো তাদের ঠোঁটে, চোখে ভয়। দরজা বন্ধ করে দিল মার্ক। দর্শনার্থীদের পেছন পেছন অন্ধকার সিটিংরুমে ঢুকলো। এখানে চেয়ার এবং সোফায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মোমের লাশ। স্পটলাইটের আলোয় আলোকিত তাদের শরীর। কী ভয়ংকর চেহারা একেক জনের!
মার্ক লাশগুলোর দিকে না-তাকানোর চেষ্টা করলো। ওগুলো ওর কলজে শুকিয়ে দেয়। এক রোগা তরুণ, ঘাড়ে গোটা চারেক আঘাতের চিহ্ন, চিৎ হয়ে পড়ে আছে সোফায়। মুখখানা মৃত্যুযন্ত্রণায় বীভৎস দেখাচ্ছে। এদের দিকে না-তাকাতে চাইলেও চোখ বারবার ওদিকেই চলে যেতে চায়। মার্ক জোর করে দর্শকদের দিকে নজর ফেরালো। বিকট চেহারার সব লাশ দেখে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে গেছে বলে শুনেছে মার্ক। আজ সেরকম কোনো ঘটনা না। শুধু একটি মেয়ে ভয়ানক আঁতকে উঠলো কাঁধে মার্কের আঙুলের টোকায়। মার্ক তাকে সামনে বাড়তে বলছে।
পিশাচবাড়ির পরের অংশ লাইব্রেরি। লাইব্রেরির দরজা খোলার সময় উত্তেজনায় হাত কাঁপছিল মার্কের। দরজা খুলে দর্শকদের ইঙ্গিত করলো ভিতরে ঢুকে পড়তে। উঁকি দিল লাইব্রেরি ট্যুর গাইড লিসার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। ওর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লিসা। ভারী ও কালো মেকআপের কারণে ভয়ঙ্কর লাগছে চোখজোড়া। লিপস্টিকে রাঙানো লাল ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। তারপর, বেড়ালের মতো, লিসা আঁধারের মাঝে যেন পিছলে চলে এল মার্কের পাশে। ‘আজ রাতে পার্টি আছে, মার্ক,’ ফিসফিস করলো সে কানের কাছে মুখ এনে। ‘কিছুক্ষণ পরেই…দেরি কোরো না।’
মেয়েটা দীর্ঘ একটা সময় তাকিয়ে রইলো মার্কের দিকে, তারপর লাইব্রেরির আঁধারে মিশে গেল যেখানে মোমের তৈরি পাঠকরা চেহারায় তীব্র আতঙ্কের মুখোশ এঁটে মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
দলের শেষ দর্শক লাইব্রেরিতে ঢোকার পরে মার্ক অনিচ্ছাসত্ত্বেও বন্ধ করে দিল দরজা। লিসাকে আর দেখা যাচ্ছে না। উত্তেজনায় মাথাটা হঠাৎ কেমন ঘুরে উঠলো। পিশাচবাড়িতে অল্প ক’দিন হল কাজ করছে মার্ক, অন্যান্য গাইডরা ওকে পাত্তাই দিতে চায় না, সেই তাদের সঙ্গে আজ আর কিছুক্ষণ বাদে পার্টি। ভাবা যায়!
আজকের দিনটি যেন অসহ্য ধীর গতির। ফুরোতেই চায় না। দর্শকদের একেকটি দল সিটিংরুম থেকে লাইব্রেরিতে যাচ্ছে, লিসার সঙ্গে চোখাচোখি হচ্ছে মার্কের। প্রতিবার ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে মেয়েটা, যেন পার্টি কখন শুরু হবে সেজন্য ওরও তর সইছে না।
রাত ৮:৪৫। আলোকিত ডায়ালে সময় দেখল মার্ক। বিনোদন পার্ক বন্ধ হবার এখনও পনেরো মিনিট বাকি। আরেকটি দল সম্ভবত আসবে পিশাচবাড়ি দেখতে। তারপর নিভে যাবে স্পটলাইট, বিল্ডিং-এর দরজা বন্ধ হয়ে যাবে আজকের দিনের জন্য, গাইডরা বাড়ি ফিরবে। মিস্টার হিলারের চোখ এড়িয়ে গাইডরা কীভাবে পার্টি দেবে মাথায় ঢুকছে না মার্কের। পিশাচবাড়ির কঠিন ম্যানেজার এ লোক, তার নজর ফাঁকি দিয়ে কারও এদিক-সেদিক কিছু করার জো নেই।
দর্শনার্থীদের শেষ দলটা ওককাঠের দরজা দিয়ে ঢুকতে যাচ্ছে এন্ট্রাস হল-এ, ঠিক আগে আগে এলিয়ট একপাশে টেনে নিল মার্ককে। ‘লিসা তোমাকে পার্টির কথা বলেছে?’ জিজ্ঞেস করলো সে।
মুচকি হেসে মাথা দোলালো মার্ক, এই প্রথমবার এলিয়টকে ভালো লাগলো তার।
‘হিলার যেন তোমাকে দেখতে না পায়,’ নিচু গলা এলিয়টের। ‘এই শেষ দলটাকে সিটিংরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে তুমি কোথাও লুকিয়ে পড়বে। হিলার প্রতিরাতে ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে বের হয়, মোমের মূর্তিগুলোর কেউ কোনো ক্ষতি করলো কিনা পরীক্ষা করে দেখে। সে চলে যাবার পরে আমরা সবাই বেরিয়ে আসবো।’
মার্ক জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কোথায় ওরা মিলিত হবে, দরজা খোলার শব্দে চট করে নিজের জায়গায় ফিরে গেল এলিয়ট। শেষবারের মতো বেজে উঠলো ভৌতিক সংগীত, মার্কের শিরদাঁড়া বেয়ে আবার বরফ-জল নামলো। হঠাৎ মনে হলো আজ রাতটা শুধু মজার নাও হতে পারে। পার্টিতে যাওয়া মানে চাকরির ঝুঁকি নেওয়া। লিসার চোখ আর পারফিউমের কথা মনে পড়তে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেললো মার্ক। লিসার জন্য যে-কোনো ঝুঁকি নেওয়া যায়।
সিটিংরুমে শেষ দলটাকে নিয়ে দুরুদুরু বুকে ঢুকলো মার্ক। এ দলের লোকজন যা দেখছে তাতেই চেঁচিয়ে ঘর ফাটাচ্ছে। লাইব্রেরির দরজা যখন খুললো মার্ক, সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে সে। দেখলো, লিসা স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে ঠোঁটে হাসি এঁকে। শেষ লোকটা লাইব্রেরিতে ঢোকার পরে লিসা চলে এল মার্কের কাছে, ‘বেশিক্ষণ লাগবে না,’ ফিসফিস করলো সে। তারপর লাইব্রেরির আঁধারে মিশে গেল।
মার্কের হাঁটুজোড়া দুর্বল ঠেকল, হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। লাইব্রেরি এবং সিটিংরুমের মাঝখানের দরজাটা বন্ধ করে দিল সে, ঘরের অন্ধকার কোণগুলোতে ফ্ল্যাশলাইট ঘোরালো। সাধারণত রাতের এ সময়টাতে সে দর্শকদের শেষ দলটার সাথে বেরিয়ে পড়ে পিশাচবাড়ি থেকে, হাঁটা দেয় বাড়ির উদ্দেশে। মনে পড়লো বাসায় ফিরতে দেরি হবার কথা জানাবার এখন আর সুযোগ নেই। মা চিন্তা করবেন। কিন্তু কোনোকিছুর জন্য পার্টি মিস করতে পারবে না মার্ক।
সিটিংরুমটা রেইলিং দিয়ে ঘেরা, যাতে দর্শক হাত বাড়িয়ে মোমের মূর্তি ছুঁতে না পারে। মার্ক রেইলিং টপকালো। দেখলো, দুই মোমের মহিলার আতঙ্কিত চেহারা থেকে ইঞ্চি কয়েক দূরে আছে সে। গায়ে কাঁটা দিল মার্কের, ওগুলোর ছায়ার আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো। ফ্ল্যাশলাইটের সরু আলোর রেখায় আলোকিত হয়ে উঠলো মখমলের পর্দা। এটা মূর্তিগুলোর ব্যাকড্রপ হিসাবে কাজ করে। এ পর্দার পেছনে কী আছে তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি মার্ক। আজ দেখবে কী আছে। ইতস্তত ভঙ্গিতে সে পর্দার একটা কোণ তুলে আলো ফেলল। দ্রুত কী একটা ছুটে গেল মেঝে দিয়ে। লাফ মেরে পিছিয়ে এল মার্ক, এদিক-ওদিক তাকালো। লুকানোর জায়গা খুঁজছে। পর্দার পেছনে লুকিয়ে পড়ার মতো তেমন জায়গা নেই। এমন সময় সদর দরজা খোলার শব্দ শুনলো মার্ক। ঝট করে পর্দার আড়ালে চলে গেল সে এবং সুইচ টেপার শব্দে পাথরের মূর্তির মতো জমে গেল। আলোয় ভেসে গেছে ঘর।
2
ঘড়ি দেখলো মার্ক। ন’টা বাজে। নিশ্চয় হিলার, পিশাচবাড়ি বন্ধ করার আগে রাতের টহল দিতে এসেছে। মাথাটা সামান্য কাত করে পর্দার সরু একটা ফাঁক দিয়ে তাকালো মার্ক। ম্যানেজার কার্পেটে মোড়া প্যাসেজ ধরে হাঁটছে, সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করছে প্রতিটি মূর্তি, উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছে আসবাবের পেছনদিকটা। মোমের মূর্তির মতোই স্থির হয়ে রইলো মার্ক যতক্ষণ পর্যন্ত না হিলার তার টহল শেষ করলো। শেষে বাতি নেভালো সে, চলে গেল লাইব্রেরিতে।
অন্ধকারে সেই সড়সড় শব্দটা আবার শুনতে পেল মার্ক। যেন ইঁদুর ছুটে যাচ্ছে মেঝে দিয়ে। পায়ে ওটার শরীরের স্পর্শ পেল সে। বহুকষ্টে উদ্গত চিৎকারটা ঠেকিয়ে রাখলো মার্ক, একটানে পর্দা সরালো, তারপর দৌড় দিল। অন্ধকারে একটা মূর্তির গায়ে হোঁচট খেয়ে কাঁপা হাতে ফ্ল্যাশলাইট জ্বাললো মার্ক, পেতলের রেইলিং-এর কাছে মূর্তিগুলোর দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো। এখানে বসলো মার্ক। নিভিয়ে দিল আলো। এখন ওর কাজ অপেক্ষা করা। হিলার তার টহল শেষ করে কখন ফিরে যাবে আর তারপর পার্টি শুরু হবে সে অপেক্ষার প্রহর গোনা।
অন্ধকারে মনে মনে হাসলো মার্ক, লিসা পাশের ঘরেই আঁধারে লুকিয়ে আছে ভেবে। লিসাও হয়তো মার্কের কথাই ভাবছে। লাইব্রেরিঘরের দরজা খুলে লিসার কাছে চলে যেতে ভীষণ ইচ্ছে করছে মার্কের। হিলারের কাজ এতক্ষণে শেষ হয়ে যাবার কথা। তবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ওকে থামিয়ে রাখলো। মার্ক ঠিক করেছে অপেক্ষা করবে। এলিয়ট, লিসা কিংবা গাইডদের অন্য কেউ সময় হলেই এ-ঘর থেকে ওকে ডেকে নিয়ে যাবে। তা ছাড়া মার্ককে বসে থাকতেই হবে। কারণ ওদের সঙ্গে কোথায় সাক্ষাৎ হবে বলেনি ওকে কেউ।
মিনিটগুলো ঘণ্টার মতো লাগলো মার্কের কাছে। উত্তেজনা বাড়ছে। চিন্তা করলো, হিলার পিশাচবাড়ির কোন জায়গাটায় এ মুহূর্তে থাকতে পারে। দোতলার কাজ শেষ করে মাটির নিচের জেলখানার মতো সেলারটাতে হয়তো উঁকি দিচ্ছে। আবার ঘড়ির দিকে তাকালো মার্ক। পোনে দশটা। শিউরে উঠলো সে হিম বাতাসে। এয়ার কুলার চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুনেছে রাতের বেলা গোটা বিল্ডিংকে বরফ-ঠাণ্ডা করে রাখা হয়, যাতে মোমের মূর্তিগুলো শক্ত থাকে।
সিধে হলো মার্ক, সিটিংরুমের লাল কার্পেটে মোড়া সরু প্যাসেজে পায়চারি করতে লাগলো। এলিয়ট আর লিসার কথা ভাবছে। ঘরের তাপমাত্রা দ্রুত নামছে, বাড়ছে ঠাণ্ডা। কালো জ্যাকেটের কলার টেনে দিল মার্ক। রাত দশটার সময় সিদ্ধান্ত নিল এন্ট্রান্স হল-এ যাবে সে, এলিয়ট নিশ্চয় ওখানে আছে।
দরজা খুললো মার্ক। ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেললো ছোট ঘরটিতে। আশা করছে যে-কোনো মুহূর্তে হুম করে লাফ মেরে ওর সামনে চলে আসবে এলিয়ট। কিন্তু ঘর সম্পূর্ণ খালি। কালো, প্যানেল করা দেয়ালের কোথাও লুকোবার জায়গা নেই। ভয় লাগলো মার্কের, হেঁটে গেল দুইপাল্লার দরজার দিকে। এ দরজা দিয়ে দর্শকরা ঢোকে। দুটি পাল্লাতেই তালা মারা। ধাক্কা দিল মার্ক। খুললো না। ভয়ের ঠাণ্ডা একটা হাত থাবা বসালো মার্কের কলজেতে, একছুটে সিটিংরুম থেকে ঢুকে পড়লো লাইব্রেরিতে, হিলার আশপাশে থাকতে পারে, সে শঙ্কা আর কাজ করছে না মনে।
‘লিসা!’ অন্ধকারে হাঁক ছাড়লো মার্ক। কণ্ঠটা প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে এল ওর কাছে। তারপর ঘরের মখমলের মতো মসৃণ আঁধারে ডুবে গেল। ভয়ের আরেকটা ধাক্কা দাঁড়া করিয়ে রাখলো মার্ককে। হয় এলিয়ট এবং লিসা ওকে নিয়ে খেলছে, নতুবা ওদের কথা বুঝতে ভুল করেছে সে। আতঙ্কিত মার্ক মনে করার চেষ্টা করলো ওরা কী বলেছিল। ওর পরিষ্কার মনে পড়ছে লিসা আজ রাতে পার্টির কথা বলেছিল আর এলিয়ট বলেছিল হিলার চলে না-যাওয়া পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে।
ঘরের মোমের মূর্তিগুলোর উপরে আলো ফেললো মার্ক। বীভৎস মুখগুলো দেখছে, এক স্বর্ণকেশী সুন্দরী মহিলার চেহারায় স্থির হলো। ওটা লিসা। মোমের মুখখানায় একই রকম টলটলে বাদামি চোখ আর লাল টকটকে অধর। তবে ঠোঁটের উপরে চারটে সাদা কাটা দাগ। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় মুখখানা ভীষণ জ্যান্ত মনে হলো, যেন ওর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, ঠোঁট বেঁকে গেছে বিদ্রƒপাত্মক হাসির ভঙ্গিতে। ভয়ানক চমকে গেল মার্ক। আলো সরিয়ে নিল ভৌতিক মুখের উপর থেকে, লাইব্রেরির দরজা দিয়ে একছুটে ঢুকে পড়লো ডাইনিংরুমে।
‘এলিয়ট! লিসা!’ কাঁপা গলায় ডাকলো সে। কোনও জবাব নেই। আছে শুধু খালি পিশাচবাড়ির গভীর নীরবতা। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় দেখা গেল ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে কয়েকজন। হাঁ হয়ে আছে মুখ, বিষাক্ত খাবার খাওয়ার যন্ত্রণায় অস্থির। ছুটতে শুরু করলো মার্ক, দ্রুত থেকে দ্রুততর হল গতি, দোতলায় বেডরুমে চলে এল। এখানেও শুধু মৃত্যু আর হত্যার বিকট দৃশ্য। একেকটি ঘরের দরজা খুলছে মার্ক ক্ষীণ আশা নিয়ে, ওকে পার্টির কোনো গাইড উল্লসিত অভ্যর্থনা জানাবে। কিন্তু প্রতিটি ঘর খালি। এখন শুধু নিচতলার জেলখানাটা দেখা বাকি।
নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো মার্ক, প্রতি পদক্ষেপে পুরনো কাঠের তক্তা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে আপত্তি জানালো। শেষ আশা জেলখানার দরজার সামনে চলে এল মার্ক। কিন্তু দরজা খুলতে শুধু নিকষ আঁধার ওকে ভেংচি কাটলো।
প্রচণ্ড রাগে শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে মার্কের। ওকে আচ্ছা বুদ্ধু বানিয়েছে এলিয়ট এবং লিসা। আজ রাতে পার্টি-ফার্টি কিচ্ছু নেই। ওকে পিশাচবাড়িতে একা ফেলে রেখে যাবার বুদ্ধি করেছিল ওরা। পরিকল্পনা সফল হয়েছে। এ মুহূর্তে হয়তো একসাথেই রয়েছে দুজনে, মার্কের বোকা বনে যাবার কথা ভেবে হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে। লাল কার্পেট বিছানো রাস্তায় আলো ফেললো মার্ক। সোজা জেলখানার দিকে চলে গেছে। ওর দুপাশে নির্যাতিত লাশের সারি। ওদিকে তাকালো না মার্ক। সে শুধু বাইরে যাবার দরজাটা খুঁজছে। এখান থেকে যত দ্রুত বেরিয়ে পড়া যায় ততই মঙ্গল।
কার্পেট বিছানো রাস্তার শেষ মাথায় চলে এল মার্ক, কতগুলো লাল পর্দার সামনে এসে হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেছে রাস্তা। একটানে পর্দা সরিয়ে ফেললো মার্ক। পর্দার পেছনে একটা দরজা। এ দরজা খুলে পিশাচবাড়ির বাইরে যাওয়া যায়। জোরে দরজায় ধাক্কা দিল মার্ক। একটুও নড়লো না দরজা। দমাদম ঘুসি মারলো, কাঁধ দিয়ে ঠেলা দিলো। কোনও লাভ হলো না। বন্ধই রইলো দরজা। অবশেষে ভয়ংকর সত্যটা উপলব্ধি করতে পারলো মার্ক : আজ রাতের মতো সে বন্দি পিশাচবাড়িতে।
আবার দরজায় ঘুসি মারলো মার্ক। ব্যথার চোটে আর্তচিৎকার ছাড়লো। নানা দুশ্চিন্তা কালো বাদুড়ের মতো ডানা ঝাপটাতে লাগলো মস্তিষ্কে। পিশাচবাড়ির কোন ঘরে সে রাতটা কাটাবে বুঝতে পারছে না। একেকটা ঘরের কথা মনে পড়ে আর শিউরে ওঠে। সবচেয়ে ভয়ংকর ঘর হলো এই জেলখানা। খুন হয়ে যাবার ভয়ে ভীত প্রাণীর মতো সে জেলখানার কার্পেট মোড়ানো রাস্তা দিয়ে পা বাড়ালো সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি বেয়ে বেডরুমে যাবে।
মাঝামাঝি পথ পেরিয়েছে মার্ক, আঁধার ভেদ করে ওর সামনে থেকে একটা শব্দ ভেসে এল। ভয়ে হিম হয়ে গেল গা। কান খাড়া করলো মার্ক। দ্বিতীয়বার শব্দটা শুনতে পেল। ইঁদুর-টিদুর হবে হয়তো, নিজেকে সান্ত্বনা দিল মার্ক, কিন্তু মস্তিষ্কের একটা অংশ এ ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হলো না। কোনো মানুষ করেছে শব্দটা, পায়ের আওয়াজের মতো, অন্ধকারে ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে ওর দিকে।
ছুটলো মার্ক, ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলছে ডানে-বামে, চকিতে তাকাচ্ছে মোমের বিকট মূর্তিগুলোর দিকে। একটা মূর্তি দেখে চমকে গেল এক স্বর্ণকেশী সুন্দরী, গাঢ় বাদামি চোখ, লাল টুকটকে অধর। জেলখানায় এ মূর্তি আগে দেখেনি ও। এটাকে না সে কয়েক মিনিট আগে লাইব্রেরিতে দেখে এসেছে?
সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে গেছে মার্ক, কাঁপা পায়ে কয়েক কদম ওঠার পরে হোঁচট খেল। মাথাটা দারুণ জোরে বাড়ি খেল এক জল্লাদের লোহার মূর্তির সাথে। সিঁড়িতে কয়েক মুহূর্ত চিৎ হয়ে পড়ে রইলো মার্ক, নড়াচড়ার শক্তি নেই। বোঁ বোঁ ঘুরছে মাথা। এমন সময় পায়ের শব্দ আবার শুনতে পেল ও। সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে।
3
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে হাঁটু মুড়ে বসলো মার্ক, পাগলের মতো খুঁজছে ফ্ল্যাশলাইট। পড়ে যাবার সময় কোথাও ছিটকে গেছে ওটা, আলোও নিভে গেছে। অন্ধকারে খামোকাই হাতড়ে বেড়ালো মার্ক।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ ক্রমে কাছিয়ে আসছে। মার্ক টলতে টলতে সিধে হলো, দৌড়ালো দোতলার ঘরগুলোর দিকে। হলওয়ের শেষ মাথায়, দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো, হাঁপাচ্ছে বেদম। মখমলের মতো ঘন অন্ধকার আর কবরের মতো নিস্তব্ধ। ধীরে ধীরে শ্বাস নিয়মিত হয়ে এল মার্কের। কল্পনা, মনকে বোঝালো ও। আসলে সে এতক্ষণ কল্পনা করেছে। কোথাও কেউ নেই তো! আর ঠিক তখন দোতলার হলওয়েতে প্রতিধ্বনি তুললো পায়ের আওয়াজ। মার্ককে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে, ধীরে এবং উদ্দেশ্য নিয়ে, আঁধার ভেদ করে।
গলা দিয়ে উঠে আসা চিৎকারটাকে গিলে ফেললো মার্ক, সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ের গতিতে নামতে শুরু করলো, যাচ্ছে ডাইনিংরুমের দিকে। পায়ের শব্দটা দ্রুত হলো। অনুসরণকারীও এবার ছুটছে। প্যাসেজে মোড় নিতে ভুলে গিয়েছিল মার্ক, প্রচণ্ড বাড়ি খেল তামার রেইলিং-এ। ব্যথায় ফুসফুসের সমস্ত বাতাস যেন বেরিয়ে গেল, ওর গলা থেকে বেরিয়ে আসা আর্তনাদ বিশাল শূন্যঘরে প্রতিধ্বনি তুললো। টলমল পায়ে পিছিয়ে এল মার্ক, চোখে সর্ষেফুল দেখছে। এমন সময় হাসির শব্দটা শুনতে পেল নিচু গলায়, খনখনে ভৌতিক হাসি বেরিয়ে এল আঁধার ফুঁড়ে। আতঙ্কের স্রোত ওকে অবশ করে ফেলছে, তবু দরজার দিকে ছুটলো সে। এ দরজা ডাইনিংরুমকে আলাদা করে ফেলেছে লাইব্রেরি থেকে। এক ধাক্কায় দরজা খুলে লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়লো মার্ক, গলা ফাটিয়ে চেঁচালো, ‘লিসা!’
ওর কণ্ঠ ওকে ব্যঙ্গ করতেই যেন ফিরে এল প্রতিধ্বনি হয়ে। সিটিংরুমের দরজার দিকে অনুমান করে ছুটলো মার্ক, কিন্তু ওখানে পৌঁছার আগেই লাইব্রেরিতে পায়ের শব্দ শুনতে পেল সে। অটল ও অশুভ পায়ের আওয়াজ, ওকে খুঁজছে অন্ধকারে। দরজার পাল্লা হাতড়াচ্ছে মার্ক, ঘাড়ের কাছে ফোঁস করে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো কেউ। তারপর, পেছনের অন্ধকারে, ঘরঘরে গলার হাসি শোনা গেল। মুখ হাঁ করেছে মার্ক, চিৎকার দেবে, ধারালো কিছু একটা বিদ্যুৎবেগে ঢুকে গেল ওর ঘাড়ে, দড়াম করে মেঝেতে আছড়ে পড়লো মার্ক পিশাচবাড়ির আরেক শিকার হয়ে।
পরদিন বিকেলে লিসা লাইব্রেরিঘরে ঢুকলো রুটিন কাজটা করতে। মার্ক কখন আসবে, তর সইছে না ওর। কাল রাতে ছেলেটা কীরকম ভয় পেয়েছে জানার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছে সে। লাইব্রেরির মোমের মূর্তিগুলোর গায়ে টর্চের আলো ফেললো লিসা। লক্ষ্য করলো স্বর্ণকেশী মহিলা তার আগের জায়গায় নেই, মেঝেতে একটা শরীরের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্য দম বন্ধ হয়ে এল লিসার। সে নিশ্চিত ওখানে এর আগে কেউ ছিল না।
সামনে পা বাড়ালো লিসা, ঝুঁকলো। স্বর্ণকেশীকে ঠেলে সরিয়ে দিল। মোমের একটা মূর্তি। এক তরুণের। মুখটা আতঙ্কে বিকৃত। লিসা ভয়ে চিৎকার দিতে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। চেহারাটা অবিকল মার্কের মতো। হাত বাড়ালো লিসা। ছুঁল মুখখানা। ঠাণ্ডা মোমের স্পর্শ পেল হাতে।