
প্রবাসের স্ট্রাগল পিরিয়ডটা তখন শেষের দিকে। ঘনঘন চাকুরী বদলের কারনে থাকার জায়গা বদল করতে হচ্ছিলো। এমন একটা সময়ে একজন রহস্যজনক ক্যারেকটারের সাথে রুম শেয়ার করতে হয়েছিলো। বয়সে হয়তো সে আমার ৫/৬ বছরের বড়ই হবে। প্রথমে আলাপচারিতা ও পরে বন্ধুর মত সহজ সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল তার সাথে, কিন্তু সে কখনোই ঠিক আমার বন্ধু হতে পারেনি। এমনো সময় গিয়েছে আমরা দুজনে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিয়েছি ব্যালকনিতে বসে আড্ডা দিয়ে, নানা রকমের গল্প কথা হত।
প্রায়ই সারারাত না ঘুমিয়েই সকালবেলা আমি অফিসে আর সে তার কাজে গিয়েছে। আমার কাছে সে নাজির নামে পরিচিত থাকলেও বাইরের লোকের কাছে সে বিভিন্ন নামে পরিচিত। তার আসল নামটি শেষ পর্যন্ত জানা হয়ে উঠেনি। তার বাড়ি খুলনার সুন্দরবনের একদম কাছের লোকালয়ে। তার কাছ থেকে শোনা বিভিন্ন আশ্চর্য ঘটনা থেকে একটা ঘটনা ঠিক তার মত করেই উপস্থাপন করছি। নাজির বলছেঃ আজ থেকে প্রায় বছর পনের আগের কথা, তখন আমি এক টকবগে তরুন। কমরেডের খাতায় নাম লিখিয়েছি মাত্র বছর দুয়েক হবে, এমন সময় খুন হয়ে যান আমাদের জোনের সর্বচ্চ নেতা। আমার সামনেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করে বিপক্ষ পার্টির দশবারো জন ছেলে। প্রচন্ড আতঙ্কে আমি কয়েক ঘন্টার জন্য বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলি। তার পরের দিনই আমাকে প্রধান আসামী ও আমাদের আরো কয়েক জন কমরেডকে আসামি করে মামলা করা হয়। পার্টি থেকে গা ঢাকা দেবার নির্দেশ আসে। আমার মানষিক অবস্থা তখন প্রায় পাগলের মত, সেই অবস্থায়ই আমাকে বাড়ী ছেড়ে পালাতে হয়, শুরু হয় আমার আন্ডার গ্রাউন্ড জীবন। প্রথমে আমাকে পাঠানো হয় গভীর বনে একদল আন্ডার গ্রাউন্ড কমরেডের কাছে। মাস খানেক সেখানে থাকার পর আবার মুভ করার নির্দেশ আসে। এরপর কিছুদিন নৌকোয় করে ঘুরে বেড়াই একটা ডাকাত দলের সাথে। আমার চোখের সামনে ঘটে কিছু দুধর্ষ ডাকাতি।
কলাগাছের মত মানুষের গলা কাটা হয় আমার সামনেই। একসময় সব কিছুই সহ্য হয়ে যায়। একমাসের বেশী কোথাও থাকার নির্দেশ নেই তাই যাযাবরের মত ঘুরতে থাকি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। পলাতক জীবনটাকেই একসময় উপভোগ করতে থাকি নিজের মত করে। বছর খানেক বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াবার পর এক সময় আমাকে একটা শ্মশানে পাঠানো হয়ে একজন তান্ত্রিকের কাছে। শ্মশানের কথা শুনে প্রচন্ড আপত্তি থাকা সত্বেও আমাকে সেখানে যেতে হয়। শ্মশান ভুমিটা সুন্দর বনের একটা নদীর তীরে অবস্থিত। নদী পথে একটা নৌকা দিয়ে আমাকে শ্মশানের প্রান্তে নামিয়ে দিয়ে আমার সাথের লোক জন দূরের একটা ঝুপড়ি ঘরকে ইশারা করে চলে যায়। আমি ধীরপায়ে হাটতে হাটতে ঘুপড়ির কাছে গেলে ঝুপরি থেকে বেড়িয়ে আসে একজন চল্লিশোর্ধ সাধু, মাথায় তেল দেয়া ঝাকড়া চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে কুচকুচে কালো দাড়ি, তামাটে বর্ণের শরীরে একটা লাল সুতি লুঙ্গী ছাড়া দ্বিতীয় কোন বস্র নেই। তার অদ্ভুত শীতল চাহনিতে আমার শিরদাড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত নেমে যায়। সাধু তার তার চাহনির মতই শীতল কন্ঠে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, শ্মশানে থাকতে তোমার কোন অসুবিধা নেইতো? আমি তার চোখ থেকে দৃষ্টি নামিয়ে না সুচক মাথা নাড়লাম। সে একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে ঝুপড়িতে ঢুকে গেল। এবার আমি চারপাশটা ভালো করে দেখে নিলাম। বিশাল শ্মশান ভুমির এক পাশে নদী আর তিন দিকে ঘন জঙ্গল। ঘোর লাগা ঘিরঝিরে ভেঁজা হাওয়া উঠে আসছে নদী থেকে। বিচিত্র কোন কারনে শ্মশান ভুমির এলাকাটায় প্রায় আধাহাত উঁচু ঘাস ছাড়া অন্য কোন গাছ জন্মায় নি। বাতাসের ঝাপটা ঘাসগুলোকে হাজার তরঙ্গে পরিনত করছে, ঝুপড়িটা শ্মশান ভুমির উত্তর দিকে। পরে সাধুর কাছ থেকে জানতে পারলাম প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে হিন্দু একটা লোকালয় আছে। সেই লোকালয়ে কখনোই যাওয়া হয়নি, সাধুর নিষেধ ছিল।
কোন হিন্দু মারা না গেলে এই দিকে সাধারনত লোকজন আসে না। তাই এলাকাটা সম্পুর্ন জনকোলাহল মুক্ত। কিছুক্ষন পর সাধু ঝুপরি থেকে বের হয়ে আমাকে ভেতরে ডাকল। মাথা নিচু করে ঝুপড়িতে ঢুকে দেখি ছালার চট দিয়ে ভেতরটা পার্টিশন করা। একপাশে বিছানা আর অপর পাশে বিচিত্র জিনিষ্পত্রে ঠাসা, মাটির তৈরী ছোট বেদির উপর একটা কালীমুর্তি, মুর্তিটা কোন কুচকুচে কালো পাথরের তৈরী। সাধু আমাকে কাঁথার তৈরী বিছানাটা দেখিয়ে বললঃ “এখন থেকে ওটাই তোমার বিছানা। আমি রাতে ঘুমাইনা, শুধুমাত্র সকালে কয়েক ঘন্টার জন্য আমাকে বিছানাটা ছেড়ে দিতে হবে, তোমার অসুবিধে হবেনাতো?” আমি আবার না সুচক মাথা নাড়লাম। ঝুপড়ির সামনের বেড়াটাই দরজা, বেড়াটা পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে, এখন সামনে ধুঁধুঁ উন্মুক্ত শ্মশান ভূমি। শেষ বিকেলের আলোয় পরিবেশটা কেমন ভিষন্ন লাগছিলো।
আশ্চর্য নিরব পরিবেশটা আমার মাথায় হাল্কা একটা মানষিক চাপ ফেলছিলো। ঝুপড়ির পাশেই সাধু একটা উনোনে মাটির হাড়িতে চাল ফুটাচ্ছে, চালের সাথে দুটো আলু সেদ্ধ দেয়া হয়েছে। সেদিন সুর্য ডোবার আগেই সাধুর সাথে খাওয়া পর্ব সম্পন্ন করি। সেদ্ধ আলুর সাথে পেঁয়াজ ভেঙ্গে দিয়ে কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা ও লবন দিয়ে আলুভর্তা বানানো হয়েছে, আলু ভর্তা আর ভাতই সাধুর তিন বেলার মেন্যু। মাটির বাসনে খেতে খেতে সাধু জানালো সুর্যাস্তের পর তার খাওয়া দাওয়া নিষেধ তাই সুর্য ডোবার আগেই তাকে দিনের শেষ খাবার সম্পন্ন করতে হয়।
খাওয়া শেষে সাধু পানি গরম করে দুধ চিনি বিহিন চা বানিয়ে আমার দিকে এক পেয়ালা বাড়িয়ে দিলো। আমি স্বানন্দে বিস্বাদ তরলটায় চুমুক দিয়ে সূর্যাস্ত দেখছি। পলাতক জীবনের কারনে ততোদিনে আমার খাওয়া দাওয়ার রুচিবোধ প্রায় পশুর পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো। যখন গভীর বনে থেকেছি তখন শুধু হরিণ আর পাখী পুঁড়িয়ে খেয়েছি। শীতের সময় অতিরিক্ত গেওয়া খাওয়ার কারনে হরিণের মাংশ টক ও বিষাদ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে সেই বিষাদ মাংসই খেতে হয়েছে। একমুঠো ভাতের জন্য প্রানটা আনচান করত, কিন্তু গহীন জঙ্গলে ভাত কেবল স্বপ্ন হয়েই ছিলো। জেলেদের সাথে থাকা কালীন সময়টা সর্গের মত মনে হত। গরম ভাতের সাথে চিংড়ির ঝোল বা মাছের তরকারি, স্বর্গের চেয়েই বা কম কিসে? সুর্য ডোবার সাথে সাথে আমার একটা খটকা লাগল। বনের দিক থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক আর বানরের চিতকার হঠাত থেমে গেল। আসচর্য্য! এমনতো হবার কথা না। পাখীগুলো অন্তত আরো আধাঘন্টা পরে শান্ত হবার কথা। শুধু মাত্র বাঘ এলেই কয়েক মুহুর্তের জন্য বনে এমন নিরবতা নেমে আসে, পাখীগুলো উড়ে যায় গাছ থেকে, কিন্তু এখানে পাখীদের উড়াউড়িতো বুঝা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা সাধুর কাছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি কোন জবাব না দিয়ে আমার হাত থেকে শুন্য চায়ের পেয়ালাটা নিয়ে নদীর দিকে চললেন। তার হাতে আমাদের খাওয়া দাওয়ার এটো মাটির বাসন ও হাড়ি।
কিছুদুর গিয়ে হঠাত দাঁড়িয়ে আমাকে হাত ইসারায় ডাকলেন, তাকে একটু চিন্তাযুক্ত মনে হচ্ছে। আমরা নদীর কিনারায় পৌঁছলে তিনি তৈজসপত্র পরিষ্কার করলেন এবং আমাকে হাত মুখ ধুঁয়ে নিতে বললেন। আমি বাধ্য ছেলের মত হাত মুখ ধুঁয়ে ফিরে যাবার জন্য পিছনে ফিরলাম, দেখলাম নদীর কিনাটা ঢালু বলে সেখান থেকে ঝুপড়িটা দেখা যাচ্ছে না। আমার ভেতর একটা অজানা সঙ্কা তৈরী হলো। সাধু কি কোন কারণে আমাকে দৃষ্টির আড়াল করতে চাচ্ছেননা? সেকারনেই কি তিনি ডেকে আমাকে সাথে নিয়ে এসেছেন? কিন্তু কেন আমাকে দৃষ্টির আড়াল করতে চাচ্ছেননা? বনাঞ্চলে সন্ধ্যার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই রাত নেমে আসে। দিনের আলো সম্পুর্ন নিভে গেলে সাধু আমাকে ঝুপড়িতে ঢুকিয়ে ঝাপ লাগিয়ে দিলেন। সাধু আমাকে বললেনঃ বাবা তুমি এখন ঘুমিয়ে পড়। আমি সারারাত (তান্ত্রিক) সাধনা করি, এতে করে আশা করি তোমার কোন সমস্যা হবে না। আর একটা কথা, এই দিকটা সাপখোপে ভরা, তোমার কোন কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে বলবে একা একা বাইরে যাবার দরকার নেই। আমি অন্ধকারে বসে আছি আর চটের পর্দার ওপাশে সাধু আসন পেতে বসেছেন। সাধু সরিষার তেলের একটা প্রদ্বীপজেলে রেখেছে, চটের পর্দা ভেদ করে ক্ষিন আলো এপাশের অন্ধকারকে কিছুটা দূর করছে। আমি অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝ রাত্রে প্রকট একটা পোড়া গন্ধে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চটের পর্দাটা একটু ফাঁক করে দেখি সাধু মাটির বেদীর সামনের ছোট্ট একটা গর্তে আগুন জালিয়েছে, বেদীর উপর কালো কালী পাথরের মুর্তি। একটু পরপর সাধু বিদঘুটে কিছু জিনিষ আগুনে ফেলছে আর সেখান থেকেই প্রকট গন্ধ আসছে। সাধু বিরবির করে কিছু উচ্চারন করছে। আমি ঘুমন্ত চোখে আবার বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ালাম। ঘুম ভাঙ্গল একদম ভোর সকালে। পলাতক জীবনের কারনে ততোদিনে আমি খুব দ্রত ভিন্ন পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে শিখে গেছি। দু-তিন দিনের মধ্যেই আমার শ্মশান বাস স্বাভাবিক মনে হতে লাগল। এরই মাঝে আমার খাওয়া দাওয়ার বিপত্তি দূর করতে ভাতের সাথে ঢেড়শ সেদ্ধ আর পোঁড়া বেগুনের ভর্তা যোগ হয়ে গেছে।
ঠিক পঞ্চম দিনেই বিপত্তিটা ঘটল। শেষ বিকেলে আমি নদীর দিকে মুখ করে আনমনা হয়ে বসে আছি একম সময় মানুষের ক্ষিন কোলাহলে পাশে তাকিয়ে দেখলাম মানুষের একটা দল এদিকে এগিয়ে আসছে। আরেকটু কাছাকাছি আসতেই বুঝতে পারলাম এটা একটা শবযাত্রা। বাঁশের একটা মাচা কাঁধে নিয়ে হরিনাম জপতে জপতে দলটা শ্মশানে আসছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই তারা চিতা সাজিয়ে লাশ পোড়ানোর কাজ শুরু করল। তত্বাবধানে আছেন শ্মশানের সাধু। শবযাত্রায় লোকজনের সাথে চোলাই মদ ও গঞ্জিকা উতসবে আমি তখন মত্ত। পরে আশ্চর্য হয়েছিলাম কারন কেউই আমার পরিচয় জানতে চায়নি। লাশ পুঁড়িয়ে আনুমানিক রাত দশটার দিকে সবাই চলেগেলে আমি নেশার ঘোরে ঝুপড়িতে অচেতনের মত ঘুমিয়ে পড়েছি। ঠিক কতক্ষন ঘুমিয়েছিলাম জানি না। আমার ঘুম ভাঙ্গলো প্রচন্ড ভয়ে। ঝুপড়িটা কে যেন প্রচন্ড ভাবে ঝাকাচ্ছে, বাইরে জ্যান্তব একটা বিকট আওয়াজ়ে আমার শরীর ভয়ে জমে গেলো। নিজেকে কোনমতে টেনে তুলে চটের পর্দা সরিয়ে দেখলাম সাধু চোখ বন্ধ করে আসনে বসে আছে। বেশ শব্দ করে বিচিত্র মন্ত্র উচ্চারন করছে, এদিকে কে যেন ঝুপড়িটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে চাইছে। নেশার প্রভাব আমার তখনো কাটেনি, উত্তেজিত মস্তিষ্ক আর দুর্বল নার্ভের কারনে আমি একসময় অচেতন হয়ে গেলাম। পরদিন সকালে বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠে দেখি সাধু বাইরে আমার জাগার অপেক্ষা করছে। তার অমায়িকতায় মুগ্ধ হলাম কারন আমাকে তিনি জাগিয়ে তুলে নিজে ঘুমাতে আসেননি। সাধুর চোখ বেশ লাল হয়ে আছে, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। আমি তাকে গত রাতের ঘটনা জিজ্ঞাসা করলে সাধু বললঃ হয়তো বন থেকে বানরের ঝাঁক নেমে এসে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। সাধুর কথার সাথে আমি মনকে বুঝাতে পারিনি। আমি বনাঞ্চলের মানুষ, বানরের আওয়াজ ভালো করেই চিনি। ভেতরে ভেতরে একটা খটকা নিয়ে আমি হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা করলাম। সেদিন বিকেলেই সাধুর কাছে আমি কথাটা পাড়লাম। তাকে জানালাম আমি তন্ত্র বিদ্যা শিখতে চাই। সাধু কিছুক্ষন নিরব থেকে আমাকে জানালো, এবিদ্যা সবার কাছে ধরা দেয় না, আর কেউ তান্ত্রিক সাধনা করতে চাইলে তাকে সম্পুর্নরূপে সমাজ বর্জন করতে হয়। আমি নাছোড়বান্দার মত একরোখামো করলে সাধু বলল; তোমাকে প্রথমে পরীক্ষা দিতে হবে। পরিক্ষায় পাশ করলেই কেবল তোমাকে তান্ত্রিক শিক্ষা দেয়া সম্ভব। কি ধরনের পরীক্ষা জানতে চাইলে সাধু জানালো পরীক্ষাটা হবে দুদিন পরের আমাবস্যা রাতে। সেদিনই জানানো হবে কি ধরনের পরীক্ষা। আমি আর বেশী গাঁইগুই করলামনা। অপেক্ষা করছি দুদিন পরের আমবস্যা রাতের জন্য। এই দুদিন আর তেমন কোন বিশেষ ঘটনা ঘটেনি, শুধু রাতের বেলায় মনে হত কারা যেন ঝুপড়ির বাইরে ঘোরাফেরা করছে।
আমি মনের ভুল ভেবে পাত্তা দেইনি। অবশেষে এলো সেই কালো রাত। বিকেল থেকেই থেমে থেমে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি দিচ্ছে তাই সুর্য ডোবা দেখা হয়নি। দিনের আলো মিলিয়ে যাওয়ার একটু আগে সাধু তার লোহার শিকটি দিয়ে শ্মশানের মাঝখানে একটা বেশ বড় বড়সর বৃত্ত আঁকলেন। সন্ধ্যা মেলাতেই সাধু আসনে বসে গেল আর আমি প্রতিক্ষা করছি পরীক্ষা দেয়ার জন্য, অনেক্ষন কেটে গেল কিন্তু সাধু আসন ছেড়ে উঠছেনা। অপেক্ষা করতে করতে তন্দ্রা লেগে গেলে একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। মাঝ রাতে সাধু আমাকে ডেকে তুললেন। এই পর্যন্ত বলে নাজির থামল, আমি শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি, নাজিব একটা সিগারেট ধরিয়ে উদাস মুখে ধোঁয়া ছাড়ছে। আমি জানতে চাইলাম, তারপর কি হলো। নাজির হাত ইশারায় আমাকে থামিয়ে পুরা সিগারেটটা দ্রুত টেনে শেষ করে আবার বলতে লাগলঃ সাধু আমাকে ডেকে বললঃ আমি শ্মশানের মাঝ খানে একটি বৃত্ত এঁকে বৃত্তের মাঝখানে আমার হাতের শিকটি রেখে এসেছি, তোমাকে সম্পুর্ন উলঙ্গ হয়ে একা সেখানে যেতে হবে, শরীরে কোন সুতার রশিও থাকতে পারবেনা। বৃত্তের ভেতরে কতগুলো মানুষের মাথার খুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে, আছে সেখান থেকে তোমাকে পাঁচটা খুলি একত্রে করতে হবে। একটা একটা করে খুলি এনে শিকের গোড়ায় রাখতে হবে, একসাথে দুটা খুলি আনা যাবে না। তুমি কি পরীক্ষা দিতে রাজী আছ? ভয় পেলে বাদ দাও, যাওয়ার দরকার নেই। আমার ভেতর একটা একরোখামি কাজ করছিলো। আমি বললামঃ আমি রাজী আছি। এই বলে আমি শরীরের সমস্ত কাপড় খুলে ঝুপড়ি থেকে বের হব এমন সময় সাধু বললেনঃ একটা কথা মনে রাখবে, কেউ যদি তোমাকে ডাকে তুমি জবাব দেবে না। খবরদার সকাল হওয়ার আগে বৃত্ত থেকে বের হবে না। আমি নিজেও যদি তোমাকে চলে আসতে বলি তবুও বৃত্তের বাইরে যাবে না। তাহলে কিন্তু খুব বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি সমস্ত কাপড় খুলে ঝুপড়ি থেকে বের হলে সাধু ঝুপরির ঝাপ ফেলে দিয়ে ভেতরের প্রদীপ নিভিয়ে দিল। আমি অনুমান করে শ্মশানের মাঝ বরাবর হাটা দিলাম। ঘাসগুল ভেঁজা আকাশটা মনে হয় মেঝাচ্ছন্ন কারন কোন তারা দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে নিঃছিদ্র অন্ধকারে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছেন। কিছুদুর হাটার পরেই আমার মনে হল আমার সাথে সাথে অনেকগুলো লোক হাটছে। আমার একটু ভয়ভয় করতে করছিলো। আমি হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম, কে যেন আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল তুই কেন এখানে এসেছিস? ভয় পেয়ে আমি অন্ধকারে পাগলের মত দৌড়ে সামনে এগুতে লাগলাম। একসময় আমার মনে হলো আমি শ্মশানের মাঝ ববরাবর এসে গেছি, কিন্তু লোহার শিকটি খুঁজে পাচ্ছি না, আমি হামাগুড়ি দিয়ে হাতড়াতে লাগলাম, কিছুক্ষনের মাঝেই আমার হাত পড়ল একটা খুলিতে। আমি খুলিটা হাতে নিয়ে হাতরে বেড়াচ্ছি শিকের খোঁজে। প্রায় ঘন্টা খানিক পাগলের মত হামাগুড়ি হাতরে শিকটা পেয়ে গেলাম।
একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য বসলাম শিকটার পাশে মাথাটা প্রচন্ড ঝিমঝিম করছে, অদুরেই কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে, আমি ভয় প্রচন্ড পেতে শুরু করছি, কিন্তু বৃত্ত ছেড়ে চলে যাবার উপায় নেই। আমি খুলিটা শিকের গোড়ায় রেখে আবার হাতড়ে হাতড়ে খুলি খুঁজছি, কিছু দূর যেতেই আমার হাতে আরেকটা খুলি লাগল, আমি খুলিটা হাতে নিয়ে অনুমান করে আবার শিকের দিকে গেলাম। খুলিটা শিকের গোড়ায় রাখতেই অদুরে অনেকগুলো কন্ঠ একসাথে হেসে উঠল। ভয়ে আমার শিরা-উপশিরা সব জমে যাচ্ছে। একটা অদম্য ইচ্ছা আমাকে তাড়া করছে তাই আমি আবার খুলি খুঁজতে গেলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই তৃতীয় খুলিটা আমার হাতে লাগল। আমি হাতড়ে হাতড়ে শিকের কাছে ফিরে এলাম। কিন্তু আশ্চর্য আগের রেখে যাওয়া একটা খুলিও সেখানে নেই। আমি প্রচন্ড ভয় পেতে শুরু করেছি আর ঠিক সেই সময়েই দূরে কারা যেন ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদে উঠল। ভয়ে আমার তখন মাথা খারাপ অবস্থা, শিকের পাশে বসে পুরো পরিস্থিতি বোঝার চেষ্ঠা করছি। হঠাত প্রচন্ড একটা হুটুপুটি শুনতে পেলাম সেই সাথে জোরে ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। কোন কিছুকেই পাত্তা না দিয়ে আমি আবার খুলির খোঁজে মাটি হাতড়াচ্ছি। একটা নাড়ী কন্ঠ বেশ স্পষ্ট ভাবে আমাকে বলল “নাজির তুই ফিরে যা, তোর ভালো হবে। আয় আমার কাছে আয় আমি তোকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবো”। ভয়ে আমার নার্ভ ততোক্ষনে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। সাধুর কথামতো আমি সে দিকে কান না দিয়ে খুলি খুঁজছি। পাগলের মত এদিক সেদিক ছুটছি, হঠাত আমার নাকে বিদঘুটে একটা পঁচা গন্ধ এসে লাগল। আমি সামনে এগুচ্ছি গন্ধটা বাড়ছে। সামনে এগোতে এগোতে একসময় একটা নড়াচড়া অনুভব করছি আর বিশ্রী মাংস পঁচা গন্ধে আমার নাড়ী উপড়ে আসছে এমন সময় সাধু ঝুপড়ি থেকে চিতকার করে বললেনঃ খবরদার নাজির আর এক পা সামনে আগাবি না। আমার একদেড় হাত সামনে কে যেন বিকট একটা হাসি দিয়ে উঠল, আমি আর টাল সামলা পারলাম না, অজ্ঞান হয়ে গেলাম। আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখনো আমি খোলা মাঠে পড়ে আছি। পুবের আকাশ ততোক্ষনে ফর্সা হতে শুরু করেছে আমার পাশেই সাধু বসে আছেন, আমি তখনো উলঙ্গ। আমি উঠে বসে দেখি সাধুর দেয়া বৃত্তের আধাহাত দূরে আমি বসে আছি। সাধু আমাকে বলল ভয় পেয়েছ? আমি হ্যা সুচক মাথা নাড়লাম। সাধু বললেন যাও নদীতে গোসল দিয়ে কাপড় পড়ে নাও। আমি নিঃশব্দে উঠে গিয়ে নদীতে গোসল দিয়ে ঝুপড়িতে ফিরে গিয়ে কাপড়-চোপর পড়লাম। সাধু ততোক্ষনে চা বানিয়ে ফেলেছে, এক কাপ আমার হাতে দিয়ে বলল; সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয়না। মা-কালী সবাইকে আশীর্বাদ করেন না। তিনি আমার ডান হাতে একটা কবজ বেঁধে দিয়ে বললেন, কখোনো মনের ভুলেও এই কবজটা খুলবে না। তারা তোমাকে চিনে ফেলেছে, যেকোন সময় তোমার ক্ষতি করতে পারে। এই কবজটা তোমাকে রক্ষা করবে। সেদিন বিকেলেই আমাকে অনত্র সরিয়ে নেয়া হয়।আমি কয়েক দিন পর্যন্ত মানষিক ভাবে ঠিক সুস্থ ছিলামনা। নাজির তার টিশার্টের ডান হাতা দিকে উলটিয়ে আমাকে কবজটা দেখিয়ে বললঃ এই কবজটা আমি আজো সাথে নিয়ে ঘুরছি।
একুশ শতকে এমন গাঁজাখোড়ি কাহিনী হজম করা আমার পক্ষে সত্যিই কষ্টকর। আমি নাজিরকে প্রশ্ন করার জন্য তার দিকে তাকালাম, তার মুখে একটা ভয়ানক আতঙ্কের ছাপ দেখে আর প্রশ্ন করা হয়নি। পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে যার কোন ব্যাক্ষা নেই, নাজিরের কাহিনীকে সেই রকম ঘটনা মনে করেই আমি ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করিনি। টিকাঃ সেই রাতের কাহিনী আমি যথাসম্ভব কমিয়ে বলার চেষ্ঠা করেছি, অনেক কিছুই বাদ দিয়েছি কারণ মানুষ যখন একা থাকে তখন ভয় নামক দানবটা তাকে জেঁকে ধরে। সেই রাতে নাজির অনেক কিছুই দেখেছিলো বলে দাবী করেছে। সাইকোলজিকাল কারনে সেই দৃশুগুলো বর্ননার অন্তর্ভুক্তি বর্জন করলাম।