ইলিশ

ইয়ামিনের ইলিশ মাছ খুব পছন্দ। সে ওই ইলিশের লোভেই ভোরের আলো না ফুটতেই নদীর ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সারারাত পদ্মায় ইলিশ ধরে এ সময় বাবা নৌকা নিয়ে ফেরে। পাড়ে ইয়ামিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাবা তাকে নৌকায় ডেকে নেন। তারপর বলেন, ‘ক দেহি, কোনটা তোর পছন্দ?’ একসঙ্গে এত ইলিশ দেখে ইয়ামিনের ধাঁধা লেগে যায়। আগেপিছে না ভেবেই সে একটা ইলিশের দিকে আঙুল তুলে দেখালে ওই ইলিশ বাবা তার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘বাড়ি যা। মাকে বলবি সরষে দিয়ে রানতে।’ ইলিশ নিয়ে কাগজের প্লেনের মতো উড়তে উড়তে বাড়ির পথ ধরে ইয়ামিন।

পথে হঠাৎ পুরোনো বটগাছের নিচে আসতেই সে থমকে দাঁড়ায়। কে ডাকে? আশপাশে কাউকে দেখা যায় না। হেমন্তের সকাল কুয়াশাঘেরা। ইয়ামিন পা বাড়ায়। কিন্তু এবার সে আরও স্পষ্ট শুনতে পায় তার নাম। ইয়ামিন চোখ কচলে ভালোভাবে তাকাতেই বটগাছের নিচে এক বৃদ্ধাকে দেখতে পায়। সে খুব অবাক হয়—এই সাতসকালে বুড়ি এলো কোত্থেকে! তাকে এর আগে কখনও দেখেছে বলেও তার মনে পড়ে না। ইয়ামিন একটু ভয়ে ভয়েই বুড়ির কাছে এগিয়ে যায়।

‘আমাকে ডাকছেন?’
‘হ্যাঁ, বাবা। আয়, কাছে আয়।’

ইয়ামিন এক পা এগিয়ে যেতেই কুয়াশা সরে গিয়ে স্পষ্ট হয় বৃদ্ধার মুখ। একি! বৃদ্ধার এক চোখ রক্তজবার মতো ফুটে আছে কপালজুড়ে। এটুকু দেখেই ইয়ামিন যা বোঝার বুঝে ফেলে। সে ভীষণ ঘাবড়ে গেলেও জ্ঞান হারায় না। ইয়ামিন দ্রুত বাঁচার উপায় ভাবতে থাকে। তাকে চুপ থাকতে দেখে বৃদ্ধা চিকন গলায় বলে, ‘অনেকদিন ইলিশ খাইনি। আমায় দিবি?’

বৃদ্ধা ইলিশের দিকে হাত বাড়াতেই ইয়ামিন উল্টো দিকে ঘুরে দৌড়াতে শুরু করে। এমন দৌড় এই জীবনে ইয়ামিন আর কখনও দেয়নি। দৌড়াতে দৌড়াতে সে ওসমান হুজুরের বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। আসলে হুজুরের বাড়ি ইয়ামিনদের বাড়ির পথেই। সুতরাং জীবন বাঁচাতে সে ওখানেই ঢুকে পড়ে।

হুজুরের সামনে দাঁড়িয়ে ইয়ামিন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। ইয়ামিনের ভয় পাওয়া ফ্যাকাশে চেহারা দেখেই হয়তো হুজুরের মন নরম হয়। তিনি গুরুগম্ভীর গলায় জানতে চান—‘বিয়ানবেলা এখানে কী?’
‘না মানে…’ ইয়ামিন মিনমিন করে বলে, ‘ভূত। না না, ভূতানি!’
‘ভূতানি!’ হুজুর ধমকে ওঠেন।

ইয়ামিনকে তিনি বিলক্ষণ চেনেন। তার মক্তবের সবচেয়ে দুষ্ট ছাত্র। ফলে তিনি ইয়ামিনের মতলব বুঝে উঠতে পারেন না। কিন্তু কিছু একটা যে হয়েছে, এটা বুঝতে পেরে নরম গলায় পুনরায় জানতে চান। এবার একটু দম নিয়ে ইয়ামিন পুরো ঘটনা খুলে বললে তিনি ইয়ামিনের কাঁধে হাত রেখে অভয় দেন। তারপর ইয়ামিনকে দাওয়ায় বসিয়ে রেখে ঘরের ভেতর থেকে একটা লাঠি এনে দেন।

‘নে ধর। রূপ ধরে এসেছিল, ইলিশ দেখছে না! এবার সামনে পড়লে আল্লাহর নাম নিয়ে দিবি একখান বাড়ি। পারবি না?’

ইয়ামিনের এতক্ষণে সাহস ফিরে এসেছে। সে লাঠিটি হাতে নিয়ে শক্ত করে ধরে বলে, ‘পারব।’ এক হাতে লাঠি, এক হাতে ইলিশ নিয়ে ইয়ামিন দ্রুত পায়ে বাড়ির পথ ধরে। পূর্ব আকাশে সূর্য উঁকি দিয়েছে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্যের আলো এসে পিছলে যাচ্ছে রূপালি ইলিশের গায়ে।

তবুও ইয়ামিনের মনের ভয় পুরোপুরি কাটে না। সে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই আচমকা দাদির মুখোমুখি হয়। আর ঠিক তখনই বটগাছের নিচের ওই বৃদ্ধার মুখ তার চোখের সামনে এক ঝটকায় ভেসে ওঠে। ইয়ামিন চিৎকার দিয়ে লাঠি উঁচিয়ে ধরে দাদির মাথা বরাবর।

তার চিৎকার শুনে ছুটে আসে বাড়ির অন্যরা। তারা জোর করে ইয়ামিনের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নেয়। কিন্তু ইলিশ মাছটা ইয়ামিন ছাড়ে না। বাম হাতে শক্ত করে মাছটা ধরে সে চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘না, আমি দেব না। দেব না। এই ইলিশ আমার।’

দাদি ডাকে, ‘ও নাতি, কী হয়েছে?’
মা ডাকে, ‘ইয়ামিন, বাবা, কী হয়েছে?’

কারও কথাই যেন ইয়ামিনের কানে যায় না। সে ইলিশ মাছটা আরও শক্ত করে ধরে রাখে।

পিতামাতাকে অসন্তুষ্ট করার পরিণাম

কুরাইশ নেতাগণ কর্তৃক গোপনে রাসুল (সাঃ) এর কুরআন পাঠ শ্রবণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *