►শ্মাশানঘাট (শেষ অংশ)◄

একটু একুটু করে আধ ঘন্টা পেরিয়ে যাবার পর সজলকে ফিরতে না দেখে আমরা সবাই অস্থির হয়ে উঠলাম । মনে মনে এই ভেবে ভয় পাচ্ছি সজল এর কোন বিপদ হলে ওর বাবা মাকে আমরা কি বলব ? সবাই কি ভাববে আমাদের । আমার বাবা তো আমাকে পিটিয়েই মেরে ফেলবে ।

ভয় মানুষের কল্জে শুকিয়ে যায় শুনেছি কিন্তু আমার বেলায় দেখলাম ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে । মনে হলো একটু পানি খেতে পারলে ভাল হতো । আমরা সবাই অস্থির হয়ে পায়চারি করছি । ছোটমামা একটা গাছের গুড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছেন । ফিরোজ একটু পর পর চুক চুক শব্দ করে বিরক্তি প্রকাশ করছে ।

আরো আধ ঘন্টা যাবার পরে আমি বললাম – চল আমরা এগিয়ে দেখি ও এখনও আসছে না কেন ? মামা বললেন – তাই চল, আমার মনে হয় ওর কোন বিপদ হয়েছে । ফিরোজ কিছু বলতে যাচ্ছিল – বাপ্পি বলে উঠল ,তোরা যা, আমি বাবা মরে গেলেও শ্মাশানে যাবো না । মরতে হয় এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে মরে যাবো, তবু বাবা শ্মাশানে যাবো না । অগত্য আমরা রতন আর বাপ্পিকে রেখে রওনা দিলাম । যাবার সময় ওদের বলে গেলাম, আমরা যদি আধা ঘন্টার মধ্যে না ফিরি তাহলে ওরা যেন যা ভাল মনে করে তাই করে । ওরা একজন অন্যজনের গায়ে গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থেকে মাথা নাড়ল ।

শীতটা যেন হঠাতই বেড়ে গেছে । আমরা একজন অন্যজনের গা ঘেষে চাঁদের আলোয় হাঁটছি । কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই যেন বোবা হয়ে গেছি । বেশ কিছুক্ষন হাঁটার পর ফিরোজ হাত দিয়ে সামনের দিকটা দেখিয়ে বলল- ঐ যে দেখ, কে যেন হেঁটে যাচ্ছে । ওর হঠাৎ কথা বলে উঠায় আমি বেশ চমকে গেলেও সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম , সত্যিই কে যেন খুব ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে শ্মাশানের দিকে যাচ্ছে । আমার সাহস বেড়ে গেল – আমি বললাম সজল না তো ?

মামা বললেন – মনে হয় না, এক ঘন্টা আগে রওনা দিয়ে ও এতোক্ষন নিশ্চয়ই এখানে দাঁড়িয়ে থাকেনি !

– তাহলে হয়তো নাইট গার্ডটাড কেউ হবে, তারাতারি পা চালা কাছে গিয়েই দেখি না কে ? বলেই ফিরোজ জোড়ে হাঁটতে লাগল । আমি আর মামাও জোড়ে পা চালালাম ।

হাঁটতে হাঁটতে নদীর পার দিয়ে আমরা অনেকটা দূরে চলে এসেছি । আমাদের সামনে হাঁটতে থাকা আবয়াবটাকে এবার বেশ স্পস্টই দেখা যাচ্ছে । চাঁদের আলোয় চাদরে শরীর ঢেকে হেলে দূলে লোকটা এগিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ্য করে আমারা অবাক না হয়ে পারলাম না । আমরা জোড়ে জোড়ে পা চালিয়েও লোকটার কাছাকাছি হতে পারছি না । আমার কাছে মনে হলো লোকটাও যেন আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একসময় ফিরোজ জোড়ে হাক দিয়ে বলল- এই যে শুনছেন ? একটু দাঁড়ান না ,আমরাও ওদিকে যাবো ।

লোকটা আমাদের দিকে না তাকিয়েই মেয়েলি গলায় মিনমিন করে বলল- এগিয়ে আসো । কিন্তু, আমরা আরো জোড়ে পা চালিয়েও লোকটার কাছাকাছি হতে পারলাম না । এভাবে আরো কিছুক্ষন হাঁটার পর হঠাৎ মামা বললেন – দাঁড়াও তোমরা, আমারা মনে হয় আমরা খারাপ জিনিষের পাল্লায় পরেছি । আমি আর ফিরোজ সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলাম । সমগ্র শরীর দিয়ে ঘাম টপটপ করে পরছে । ফিরোজ প্রশ্ন করল – খারাপ জিনিষ মানে কি মামা ?

– খারাপ জিনিস মানে হচ্ছে খারাপ জিনিষ । দেখছো না আমরা কতো চেষ্টা করেও ওটার কাছাকাছি হতে পারছি না । মামার কথা শুনে আমার সারা শরীর ঝিম ঝিম করে উঠল । ফিরোজ কিছু বলল না । চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল । মামা বললেন – দাঁড়িয়ে থেক না হাঁটতে থাকো ওটা যদি বুঝতে পারে যে আমরা ভয় পেয়েছি তাহলে খবর আছে । আমরা ধীর পায়ে আবারও হাঁটতে লাগলাম ।

একসময় ফিরোজ ফিসফিস করে বলল- মামা চলেন ফিরে যাই । ফিরোজ যেন আমারই মনের কথাটা বলল । মামা বললেন- আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি এখন সামনে যাওয়া যা,পেছনে যাওয়া তার চাইতেও ভয়ন্কর । দোয়া দুরুত পড়ে বুকে ফু দিয়ে হাঁটতে থাকো । আমি মনে মনে দোয়া দুরুত পড়তে চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না । কিছুই মনে পড়ল না । বিরবির করে উল্টা পাল্টা কি সব পড়লাম ।

একটা মোড় ঘুরে শ্মাশান ঘাটের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ করে চাঁদটা মেঘের আড়ালে চলে যাওয়ায় চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল । আমি আর ফিরোজ ভয় পেয়ে মামার জামা টেনে ধরলাম । মামা বিরবির করে বললেন – ভয় পাবি না ,ভয় পাবি না । একদম না । একদম না । মামা ভয় পেতে না করলেও আমি কিন্তু ঠকঠক করে কাঁপছি । আর মামাকে ধরে একটু একটু করে এগুচ্ছি । শ্মাশান ঘাটের গেটে আসার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদটাঁ আবার মেঘের আড়াল হতে বেড় হয়ে এলো । মনে মনে আলাহকে ধন্যবাদ দিলাম । ততোক্ষনে আমাদের সামনে হাটতে থাকা লোকটা কোথায় যেন উদাও হয়ে গেছে ।

লোকটাকে কোথাও আর দেখলাম না । আমরা গেট দিয়ে শ্মাশানের ভেতরে ঢুকলাম । পুরো শ্মাশানে শুনশান নীরবতা । ঝিঝিপোকাও ডাকছে না । আমরা সজলকে খুঁজতে লাগলাম । কিন্তু কোথাও ওকে দেখা গেল না । গেটের কাছে দাঁড়িয়েই ফিরোজ – এই সজল, বলে বার দুয়েক ডাক দিলো । কিন্তু কেউ উত্তর দিলো না । রাতের অন্ধকারে সে ডাক প্রতিধ্বর্ণিত হয়ে ফিরে এলো।

মামা বললেন – চলো ভেতরে দিকে যাওয়া যাক , হয়তো ও ভেতরে আছে । মামা আমাদের জন্য আর অপেক্ষা না করে পা বাড়ালেন । আমরাও দুরুদুরু বুকে মামার পেছন পেছন যেতে লাগলাম । কিছুটা ভেতরে ঢুকে বামপাশে ঘুরতেই কিছুটা দূরে চারকোনায় চারটা কালো লোহার মোটা রর্ড পোতা উচু একটা পাঁকা জায়গা দেখে বুঝলাম – এখানেই লাশ পোড়ানো হয় । তার কিছুটা দূরেই ডান পাশ দিয়ে নদীটা দেখা যাচ্ছে । আমি ডাক দিলাম – সজল ! এ্যই সজল , তুই কোথায় ? নিজের গলা নিজের কাছেই কেমন অপরিচিত মনে হলো ।

– সজল এখানে নেই , মামা কথাটা বলে নদীর দিকে এগিয়ে গেলেন । আমরাও পেছন পেছন গেলাম । নদীর ঘাটটাও ফাঁকা কেউ নেই । এদিক সেদিকে ভাঙা মাটির হাড়ি, পাতিল , কলসি পরে আছে । বাম পাশের একটা গাছ থেকে কুরকুর করে একটা অচেনা পাখি ডেকে উঠতেই আমরা চমকে উঠলাম । একবার মনে হলো ঝেড়ে একটা দৌড় মারি । আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মামা বললেন- আমার এখন মনে হচ্ছে, সজল তোদেরকে ফাঁকি দিয়েছে । ও এদিকটায় আসেইনি । আমি বললাম -হতেই পারেনা মামা, ওতো আমাদের সবার চোখের সামনে দিয়ে এদিকে আসলো ।

– আসলো তো আমিও দেখলাম । কিন্তু তাহলে গেল কৈ ?

– কোন বিপদ আপদ হয়নি তো ? ফিরোজ ফিসফিস করে বলল । ঠিক এমন সময় মামা বলে উঠলেন – ঐটা কে রে ? সঙ্গে সঙ্গে আমি আর ফিরোজ চমকে উঠে মামার দেখানো হাত বরাবর লাশ পোড়ানোর বেদিটার দিকে তাকালাম । তাকিয়ে কিছু দেখতে না পেয়ে ফিরোজ বলল কোনটা মামা ?

– ঐ যে বেদিটার বামপাশের রডটার কাছে বসে আছে । আমার বুকের ভেতরটা তখন ধকধক করছে । হাত পা’গুলো ঠকঠক করে কাঁপছে । মনে হলো জ্ঞান হারিয়ে পরে যাবো । ভাল করে তাকিয়ে দেখি সত্যিই কে যেন হাঁটুতে ভর দিয়ে বেদীটায় বসে আছে । মামা জোড়ে জোড়ে বললেন – কেরে, কে ওখানে ? কেউ উত্তর দিল না । মামা এবার এগুতে লাগলেন । আমরাও ঘোরের মধ্যে মামার পেছন পেছন যেতে লাগলাম । বেদীর কাছে ছাঁয়াটার কাছাকাছি হতেই সেটি আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ালো । দেখে মনে হলো না, কোন তারা আছে । মামা আবারও বললেন- কে ? কে ওখানে ?

আমার কাছে মনে হলো, কে যেন নাকি স্বরে উত্তর দিল – আমি?

– আমি কে ? মামা আর একটু জোড়ে জিজ্ঞেস করলেন । ছাঁয়াটা প্রথমে কিছু না বললেও হঠাৎ ঘোৎঘোৎ শব্দ করে বলে উঠল তুই কে রে শুয়োর ? আমাকে জিজ্ঞেস করিস আমি কে ?

আমরা চমকে উঠলাম । কেননা ছাঁয়াটা চোখের পলকে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে । হালকা পাতলা শরীরে লাল টকটকে টু-টো চোখ । আমার জ্ঞান হারিয়ে ফেলার দসা হলো । মনে হলো আমি বুঝি ভয়েই মরে যাবো । হঠাত করেই যেন চাঁদটা আবার মেঘের আড়ালে চলে গেল । আমি আর ফিরোজ মামার জন্য অপেক্ষা করলাম না – ওরে মাগো বলে ঝেড়ে দৌড় মারলাম গেটের দিকে । টের পেলাম মামাও আমদের সঙ্গে দৌড় লাগাল । আমরা গেটেই কাছে আসতেই ধুমধাম বিকট শব্দ করে গেটটা বন্ধ হয়ে গেল । আমরা তিনজন আছড়ে পড়লাম গেটের উপড় । ভয়ে আমি জ্ঞান হারা হয়ে গেছি । গেটের মধ্যে দু’হাত দিয়ে আঘাত করতে করতে হিস্টিরিয়ার রোগির মতো দরজা খোলার জন্য চিৎকার করতে লাগলাম । পেছন ফিরে দেখি ছাঁয়াটা হাসতে হাসতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে । আমরা যা যা বলে চিৎকার করতে লাগলাম । কিন্তু ছাঁয়াটা বাতাসে ভেসে ভেসে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতেই লাগল । মনে মনে ভাবলাম আজই বুঝি জীবনের শেষ দিন । হে আল্লাহ, মাফ করে দাও । মাফ করে দাও , বলে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম । ছাঁয়াটা আমাদের কাছ থেকে যখন হাত তিনেক দূরে, ঠিক সে সময় কে যেন খুব গম্ভীর গলায় বলে উঠল – দাঁড়া ? টোন্ট মুভ । সঙ্গে সঙ্গে ছাঁয়াটা থেমে গেল ।

আমি চমকে তাকিয়ে দেখি নদীর কাছে ভাঙা হাড়িগুলোর কাছে আরেকটা খুব লম্বা ছাঁয়া দাঁড়িয়ে আছে । ছাঁয়াটা লম্বা একটা আলখাল্লা পরে আছে বলে আরো লম্বা লাগছে । চুলগুলো কানের দু’পাশে পরে আছে । ছাঁয়াটার হুকুমে আমাদের দিকে আসতে থাকা ছাঁয়াটা থেমে গিয়ে ভয়ন্কর ভাবে গোৎগোৎ শব্দ করতে করতে হুকুমকারীর দিকে ছুটে গেল । কিন্তু হুকুমকারী ছাঁয়াটার দিকে দু’হাত উপরে তুলেতেই ছাঁয়াটা ছিটকে এক দিকে পরে গিয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল ।

আমরা এবার হুকুমকারী ছাঁয়াটার দিকে তাকালাম – দেখলাম ছাঁয়াটা আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে । আর ঠিক সে সময় ঘটাং করে গেটটা খুলে গেল । আমরা আর দাঁড়ালাম না ঝেড়ে দৌড় লাগালম । এক দৌড়ে কর্টন মেলের গেটে । কর্টন মেলের ঘেটে আসতেই দেখি রতন ওর বাবা-চাচাদের ডেকে এনেছে সবাই মিলে – শ্মাশানে যাবার জন্য প্রস্তুত হোচ্ছিল। আমরা ফিরে আসায় সবাই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো । সজল কোথায় জিজ্ঞেস করাতে রতন বলল- ও ওর বাসাতেই আছে । ওর বাবার সঙ্গে আমার আব্বুর কথা হয়েছে । ও বাসায় গেল কি ভাবে ? জিজ্ঞেস করতে রতন কিছু বললো না । বলল কাল কথা হবে । এখন বাসায় যা ।

পরিশেষ : পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মার কাছে শুনি, সজল এসেছে । ড্রয়িং রুমে বসে আছে । আমি ড্রয়িং রুমে ছুটে গেলাম । ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি ছোট মামা সজলের সঙ্গে কথা বলছেন । আমাকে দেখে সজল উঠে দাঁড়াল । আমি বললাম – তুই ঠিক আছিস তো সজলা ? সজল মাথা নেড়ে পকেট থেকে দু’শো টাকা বেড় করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল – আমায় মাফ করে দে, আমি কাল রাতে ভয়ে তোদের কাছে আসতে পারিনি । খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম । এ্যই নে তোদের বাজির দু’শো টাকা । আমার তো আক্কেল গুরুম সজলা বলে কি ? তাহলে গতরাতে আমরা কার জন্য শ্মশান ঘাটে গেলাম ? কেই বা আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে শ্মাশান ঘাটে গেল ? তাহলে কি ওটা সজল ছিল না ? ছিলো অন্য কেউ ??

দুঃখিত!