আরিফকে কিছুই বললাম না। পরদিন সকালে চাচা কে ডাকলাম। ছবিটা দেখালাম। তিনি চিনতে পারলেন না। তিনি বললেন ওটা নাকি অনেকদিন ধরেই এখানে ঝোলানো। কেউ কখনো সরায় নি। আমি আকার ইঙ্গিতে জানার চেষ্টা করলাম এ নিয়ে কোনপ্রকার কিংবদন্তী আছে নাকি। কিন্তু তেমন কিছুই পেলাম না।
এরপর কিছুদিন শান্তিতে গেল। বড়জোড় এক সপ্তাহ। এখন কেন জানি ছবিটার উপর একটা কৌতুহল তৈরী হয়েছে…অবচেতন মনেই চোখ চলে যায় ছবিটার কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা দেখার জন্য।
সবুরে মেওয়া ফলল। ছবির মেয়েটা হঠাৎ একদিন উধাও।
সবই আছে,ছবির ফ্রেম, জলরং। কিন্তু এখন ওটা শুধুই ফাঁকা এক জলরঙ্গের ছবি। Abstract মনে হতে পারে।
এবার কিন্তু আর পলক ফেললে মেয়েটা ফিরে এলনা। মেয়েটা উধাও হয়েই রইল। একদিন,দুদিন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে মেয়েটা যে নেই এটা কেন যেন কেউ লক্ষ্যই করল না। দুদিন পরও যখন মেয়েটা ফিরে এলনা, কেউ খেয়ালো করল না মেয়েটা নেই,তখন আরিফকে বললাম ছবিটার কথা। আরিফ তো হেসেই উড়িয়ে দিল। ওকে নিয়ে নিচে গেলাম।
মেয়েটা ফিরে এসেছে।
কেন যেন একটা স্বস্তির পরশ বয়ে গেল শরীর দিয়ে।
এর পর ছবিটাকে প্রায়ই নড়াচড়া করতে দেখতাম। ঠিক নড়াচড়া নয়,নানা রকম অবস্থানে। ও মনে হয় আমার উপস্থিতিতে অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছিল। অন্য কাউকে দেখাতে গেলে আগের মত হয়ে যেত। আমার সামনেই অন্যরকম ।
কতটা সহজ হয়ে গিয়েছিল তা টের পেয়েছিলাম আর কিছুদিন পর।
সেদিন কি যেন কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ চোখের কোণে নড়াচড়া দেখে তাকালাম, দেখি মেয়েটা নড়ছে। নড়ছে মানে নড়ছে। নববধূ র গহনাগুলো খুলে খুলে রাখছে…। আমি তাকিয়ে আছি খেয়াল করে হাসল। মেয়েটার হাসি অনেক সুন্দর ছিল। দাঁত অসমান ছিল মেয়েটার, হাসির ঔজ্জ্বল্য আরো বেড়ে গিয়েছিল তাতে।
এরপর আমার যেন কী হয়েছিল। আমি যখনি সময় পেতাম ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মেয়েটা হাসত। ঠোট নাড়ত, কথা বলার চেষ্টা করত বোধহয়,কিছুই শোনা যেত না। মাঝে মাঝে বিয়ের শাড়ির বদলে আটপৌড়ে শাড়ি পরেও আসত। আমার অনেক প্রশ্ন ছিল। ও কে। কেন এখানে সে। কিভাবে সে নড়াচড়া করে ইত্যাদি । কিন্তু ও কিছু শুনতে পেত না। আমি যেমন কিছু পাই না।
ব্যাপারটার অস্বাভাবিকত্ব আমার চোখে তখন ধরা পড়ছিল না। আরিফ প্রথম খেয়াল করল যেদিন,সেদিন আমি নায়লাকে,মানে তোমাকে স্কুল থেকে আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি তোমাকে স্কুলে ঢুকিয়ে বাসায় এসে সেই যে দাড়িয়েছি ছবির সামনে, আমার হুশ ফিরল আরিফের ঝাঁকুনিতে। আমার মাথা তখনো কেমন যেন লাগছিল। আরিফের কথা মাথায় ঢুকছিল না। চাচামিয়া কয়েকদিন ধরেই ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলেন, তিনি সুযোগমত লাগিয়ে দিলেন। আরিফ আরো ক্ষেপে গেল। আমি কিছুই শুনছিলাম না,শুধু হঠাৎ যখন শুনলাম “আমি ওটা পুড়িয়ে দেব”…তখন মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। আমি নাকি “না না” করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।
এরপরের একদিনের ঘটনা আমার আবছা আবছা মনে আছে । আরিফ বাকিটুকু বলেছিল আমাকে। আমাকে বিছানায় শুইয়ে আরিফ চাচামিয়া কে পাঠিয়েছিল ডাক্তারের কাছে…তারপর ও গিয়ে ছবিটা পুড়িয়ে দিয়েছিল…
ঘটনা এখানেই শেষ হবার কথা ছিল।
পরদিন আরিফ অফিসে যাওয়ার আগে তোমাকে স্কুলে দিয়ে গেল। অফিসে গিয়ে সে খালা কে ফোন করেছিল। খালাকে সে পুরোপুরি কিছু না বলে শুধু জিজ্ঞাসা করেছিল ছবিটার কথা…
খালার বয়স হয়েছে। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে আঞ্চলিক ভাষায় অনেক কথা বললেন যার সারমর্ম এই,এই ছবিটা অনেকদিন ধরেই ও বাড়িতে ছিল। তার বাবারো জন্মের আগে। কিন্তু শায়লার বাবা তো ওটা পুড়িয়ে দিয়েছিল, ওটা ওখানে থাকার কথা না…
আরিফ দৌড়ে বাসায় আসে…আমার এ সময়টায় আবছা মনে আছে, আমার জ্ঞান ফেরার পর আমি কেন যেন আবার ওই ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই,হ্যা,ছবিটা যথাস্থানেই ছিল…আমি ওকে দেখতে পাই…ও আমাকে দেখে নড়েচড়ে ওঠে,হেসে ওঠে,যেন বহুদিনের পুরনো সখী ফিরে এসেছে…এবার আমি ওর হাসির শব্দ শুনতে পাই…কি প্রাণোচ্ছল সে হাসি!!!…আমিও হেসে ওঠি…খিল খিল করে…ও আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়…এই প্রথমবার…এই প্রথমবার ওর হাত ফ্রেমের বাইরে আসে…আমিও হাত বাড়াই…এত আনন্দ…এত আনন্দ তখন আমার মনে…!!!…ওকে ছুঁয়ে দিলাম…কেমন যেন ভেজা ভেজা…পুরো হাতটা ধরলাম…ভেজা হাতটা ক্রমে ক্রমে শুকিয়ে আসছে…আমি হাত ধরে টান দিলাম…ও বেরিয়ে এল ফ্রেমের বাইরে, পুরোপুরি বাইরে…ওর পুরো শরীর জলরঙ্গের…আস্তে আস্তে ও শুকিয়ে রক্ত মাংসের মানুষে পরিণত হচ্ছে…ওকে দেখতে আমারই মতন লাগছে যেন…
এবার আমি জ্ঞান হারাই নি…আরিফের আসার শব্দ শুনে ও আমাকে চোখ টিপ দিয়ে আবার ফ্রেমের ভেতর ঢুকে যায়…আরিফ আসে…আরিফ একনজর ছবিটা দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে… আমাকে বলে…”এখানে আর এক মুহূর্তও না”…
আমার মনের ভেতর হাহাকার করে ওঠে…মন হাঁচড়ে পাঁচড়ে অজুহাত খুজতে থাকে… আমি যাব না…কিছুতেই না…”আজ রাতটা…শুধু আজ রাতটা…” মনের ভেতর কে যেন বলে ওঠে…
“আজ রাতটা থেকে যাই…খুব দুর্বল লাগছে…”
আরিফ আমার ক্লান্ত রোগতপ্ত চেহারা দেখে রাজী হয়ে যায়…
সেদিন রাত…নিচে কে যেন বিড়বিড় করে গান গাইছে…আর আমার নাম ধরে ডাকছে…”শায়য়য়য়লা…শায়য়য়লা…”
আমার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে…আমি ঊঠে বসি বিছানায়…সারাদিনের টেনশনে আরিফ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন…নায়লাও ঘুমাচ্ছিল আমার পাশে…
পা টিপে টিপে বাইরে বেরোই…নিচে নামি…ছবির সামনে গিয়ে দেখি ছবি ফাঁকা…খুব আনন্দ লাগে…তাহলে ও এখন আমাকে ছাড়াই বেরুতে পারে…
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে ও…আলো আঁধারিতে কেমন যেন পরিচিত লাগছে মুখটা…কিন্তু…
এ ত… আমার মুখ…
আমার মনে এই প্রথম অশুভ ছায়া উঁকি দেয়…
হাত দুটো ওর পেছনে…ওর পায়ের প্রতিটি পদক্ষেপে নূপুরের শব্দ হচ্ছে…কেন যেন ওর হাসি…নুপুরের শব্দ আগের মত অত মধুর লাগছে না…
উপরে পায়ের শব্দ…আরিফের ঘুম ভেঙ্গেছে…আমাকে বিছানায় না পেয়ে আরিফ নিচে নেমে আসছে..
ও এখনো হাসছে…ওর হাত পেছন থেকে সামনে এল হঠাৎ…ওর হাতে কি ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না…একপাশের সিড়ি দিয়ে আরিফ নামছে,আমি ছবির ফ্রেমের সামনে আর ও আরেকপাশের সিড়ির সামনে…ও এগিয়ে আসতে থাকে…ওর হাতে ধরা জিনিসটা উপরে উঠতে থাকে আস্তে আস্তে… আমার চোখে পড়ে জিনিসটা…সাথে সাথে বিদ্যুৎ চমকের মত সব বুঝে যাই আমি…সবকিছু…অতিত,বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব একাকার হয়ে যায় চোখে্র সামনে…সব…
কিন্তু আমার কিছু করার নেই…আমি বর্তমানের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছি…আমার মুক্তি নেই…২০ বছর আগে দেখা ঘটনাপ্রবাহ আবারো ঘটতে থাকে…আমি এগিয়ে যাই ওকে আটকাতে…আমি আরিফকে মরতে দিতে পারি না…আমি জানি বাঁচাতে পারবো না…কিন্তু চেষ্টা তো আমাকে করতেই হবে…আরিফ তাকিয়ে আছে…আমি চেপে ধরেছি “ও”র ছুরিটা …জানি আরিফ “ও”কে দেখতে পারছে না…ও দেখছে আমার হাতে ছুরিটা ধরা…কিন্তু আমি থামাতে চাইছি ওকে…ওর গায়ে অমানুষিক শক্তি…ওর ছুরি ধরা হাত এখন মাথার ওপর…আমার হাতও ওটার উপর…আরিফ বিষ্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়া আছে…ওকে আঘাত করার আগ মুহূর্তে ও আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে…”কেন?”
আমার মুখ থেকে আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসে আর ওর মুখ থেকে অট্টহাসি… অবশেষ তখন বুঝতে পারলাম ওইদিন আমার ঘুম ভেঙ্গেছিল কিসের শব্দে…
আমার আর ওর ছুরি ধরা হাত ছোবল মারে আরিফের বুকে…আরিফ পড়ে যায়…আমি পারলাম না প্রথম আঘাতটা ঠেকাতে…দ্বিতীয়টাও না…না তৃতীয়টা…
“আম্মু…”
বাকিটুকু তো তোমার মনেই আছে,তাইনা নায়লা?
নায়লা…আমি আর তোমার বাবা তোমাকে আমাদের জীবন থেকেও বেশী ভালবাসি, ভালবেসে যাব…আমি তোমার বাবাকে খুন করিনি…এটা তুমি জান…আমার মত আজীবন এই কষ্টটা তোমাকে বয়ে বেড়াতে হবে না আর…এটাই তোমার জন্য আমার বিদায়ী উপহার…
তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ মা…তুমি ওই ছবির ধারে কাছেও যেও না …..পারলে বাড়িটা পুড়িয়ে ফেলো…
অতীত,আর বর্তমান তো ধ্বংস হয়েছে…ভবিষ্যৎ যেন নিরাপদ থাকে…এই কামনায়
ইতি
তোমার মা শায়লা
————————
নায়লার দাদীর রেখে যাওয়া চিঠি টা আজই জেলখানায় নায়লার হাতে পৌছেছে…
নায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেলে…”বড় দেরী করে ফেললে মা…”
“অসুবিধা নেই মা…আমার কাছে সারাজীবন আছে…”…জেলখানার গার্ডের কাছে খাতা কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসে নায়লা…
এখন আর বাংলাদেশ সরকার ফাঁসির দন্ডাদেশ দেয় না…
(পালিয়ে বিয়ে করায় শায়লার প্রতি আগে থেকেই ক্ষোভ ছিল আরিফের পরিবারের , শায়লা আরিফের খুনিও বটে…তাই শায়লার ফাঁসি হবার আগে লেখা এই চিঠি কখনোই নায়লার হাতে পৌছেনি…দাদী মারা যাবার পর সেটা ওর এক চাচা ওর কাছে পাঠায়)
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।