►রিকশাওয়ালা◄

শ্রীপুর উপজেলা নান্দিয়া সাঙগুণ গ্রাম.. অসাধারণ সুন্দর নদী বেষ্টিত এ গ্রামের প্রধান রাস্তার একপাশ দিয়ে অনেক দূর অব্দি শুধুই হাওর , আর এক পাশে হালকা জনবসতি। দুপাশে শারি শারি কাঁঠাল গাছের ছায়া ঘেরা এ রাস্তাটা চলে গেছে বহুদুর।

গল্পটা যাকে নিয়ে, তিনি রকুনুজ্জামান। বর্মি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক,সবাই রকন স্যার নামেই জানে। নান্দিয়া সাঙগুণ গ্রাম এ তার বন্ধুর বাড়ি। অনেক দিন আসি আসি করেও আসা হচ্ছিলনা, শেষ পর্যন্ত সকল ব্যস্ততা উপেক্ষা করে এক শীতের দুপুরে ট্রলার যোগে তিনি নান্দিয়া সাঙগুণ বাজারে এসে নামেন। বাজার পার হয়ে আসেন রিকশার খোজে। বেশ কিছু রিকশার মধ্য থেকে সুঠাম দেহের একজনকে জিজ্ঞেস করেন “ঢালি বাড়ি” যাবে কিনা, রিকশাওয়ালা কোন কথা না বলে ইশারায় তাকে রিকশায় উঠতে বলল,তিনি উঠে বসলেন। পথ অনেক দুরের হলেও গ্রামের সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় এবং রিকশাওয়ালার সাথে টুকিটাকি গল্প করতে করতে তার সময় ভালই কেটে যায়, যদিও রিকশাওালার আচরণ তার কাছে একটু অদ্ভুত লাগে। যাই হোক বিকেলের শুরুতে তিনি পৌঁছে যান তার গন্তব্য।
তার বন্ধু মারজান, অনেকদিন পর দেখা, আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো দু বন্ধুর মাঝে….

: ভাবীকে বল খাবার দিতে? হাতে তেমন সময় নেই ,ফিরতে হবে।
: বলছিস কি!! এতদিন পর এলি একটা রাত থাকবিনা?!!
: নারে, যেতেই হবে, সকালে ক্লাস আছে।
অনেক বলেও তাকে রাজি করানো গেলনা।
খাবার খেতে খেতে মারজান তার প্রয়াত নানাজির (যিনি অত্যন্ত আল্লাহ ভিরু একজন ব্যক্তিত্ত ছিলেন) একটি গল্প শুরু করলেন…
: বুঝলি রকন, নানাজি এক রাতে রিকশায় করে ফিরছিলেন বাড়িতে। হঠাৎ দেখলেন রিকশাওয়ালার ঘাড় নানাজির দিকে পেছনে ঘোরানো এবং এভাবেই সে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে, নানাজি ভয় না পেয়ে আল্লাহ কে স্মরণ করতে থাকলেন। একসময় রিকশা থেমে যায় তিনি নেমে যান। রিকশাওয়ালা রিকশা সহ সোজা গিয়ে হাওরের পানিতে মিলিয়ে যায়….

রকনুজ্জামান গম্প মন দিয়ে শুনলেন, কোন মন্তব্য করলেন না। একজন শিক্ষক হয়ে এসব তিনি বিশ্বাস করতে পারেনা না। অবশেষে তিনি রওয়ানা দিলেন, মারজানের থেকে যাওয়ার আব্দার আবারো টিকলোনা।

শীতের রাত। হাটতে হাটতে আকাশে দিকে তাকালেন। মেঘের আড়ালে মাঝে মাঝে উকি দিয়ে আবার লুকিয়ে পরছে চাঁদ। আবছা আলোয় পুরোটা গ্রামকে ভৌতিক মনে হচ্ছে। যেন কোন প্রাণের অস্তিত্ব নেই, “আশ্চর্য! এত নীরব হতে পারে পৃথিবী!” মনেমনে ভাবলেন। এক দমকা হিম শীতল বাতাস তার গায়ে এসে লাগলো,গায়ের চাদর টা ভালো করে জড়িয়ে নিলেন তিনি। মারজান অনেক করে বলেছে এগিয়ে দিয়ে যাওয়ার জন্য, তিনি-ই না করেছেন রাত বেশি হয়ে গেছে তাই। এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে। অন্তত একটা রিকশা না পাওয়া পর্যন্ত দুজন গল্প করে সময় পার করে দিতে পারতো।

তিনি উৎসুক চোখে এদিক ওদিক তাকালেন রিকশার আশায়। নাহ, কোথাও কিছু না দেখতে পেয়ে তার হাটার বেগ বারিয়ে দিলেন। যদি সামনে কিছু পাওয়া যায় সে আশায়। হঠাৎ টিংটিং শব্দ শুনে থেমে গেলেন। হে, পেছন থেকেই আসছে শব্দটা। তিনি ঘুরে তাকালেন, একটা রিকশা, অন্ধকারে ঠিক ভালো দেখা যাচ্ছেনা তবে বোঝা যাচ্ছে বেশ সুঠাম দেহের অধিকারি একজন এটা চালিয়ে আসছে। তিনি হাত উঁচিয়ে থামতে বললেন, রিকশা থামলনা, চলতেই থাকলো। তিনি গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, “আরে ভাই থামেন, এতো রাতে কিছু পাচ্ছিনা, অনেক দূর যেতে হবে আমার”। রিকশা তবুও থামলনা। তিনি হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, আর ঠিক তখনই খেয়াল করলেন রিকশাটা কিছু দূর গিয়ে থেমে গেলো। তার বুকে আশা উকি দিল।

রিকশায় উঠেই তিনি গল্প শুরু করলেন রিকশাওয়ালার সাথে..
: “ভাই আপনার নাম কি?” রিকশাওয়ালা কোন উত্তর দিলনা, তিনি আবার একটু জোরে বলে উঠলেন” ও ভাই আপনার নামটা কি ?” এবার সে উত্তর দিলো কিন্তু রকনুজ্জামান ঠিক বুঝলেন না তার কথা। তিনি সেটাকে উপেক্ষা করে কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন এবং কথায় কথায় একসময় মারজানের নানাজির কাহিনীটা তাকে বলা শুরু করল। বলা শেষ হতেই রিকশাওয়ালা অদ্ভুত ভাবে হাসলো..
: কি ভাই আপনারও কি আমার মতই বিশ্বাস হলনা?

কথাটা শেষ করতেই রকনুজ্জামান দেখলেন রিকশাওয়ালা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথাটা যেন আলগা করে উল্টো দিকে বসানো,কপালের মাঝখানে একটা চোখের মতো, ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলল “এইভাবে?” …
তিনি হকচকিয়ে গেলেন,তার চোখ যেন কোঠর থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে ,তিনি ঘামতে শুরু করলেন। কিছু না ভেবেই রিকশা থেকে লাফিয়ে পরে উল্টো দৌড়াতে শুরু করলেন। কিছুদুর যেয়ে কৌতূহল বশত পেছনে ফিরে তাকালেন। দেখলেন রিকশাটি দ্রুত গতিতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তিনি তার সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌড়াতে লাগলেন। একসময় হোঁচট খেয়ে পরে গেলেন, ব্যাথায় কুঁকড়ে কোন রকমে মাথা তুলে তাকালেন…..যা দেখলেন!! তাতে তার স্পন্দন তিনি নিজেই যেন শুনতে পান এমন অবস্থা। এক শুভ্র বসন বৃদ্ধ তার ঠিক তার সামনেই দাড়িয়ে..হাতে লাঠি, কিছু বুঝে ওঠার আগেই বৃদ্ধ তাকে ইশারা করলেন রাস্তার দিকে,এবং চিৎকার করে বললেন” দৌড়া, বাঁচতে চাইলে দৌড়া “……বলেই তিনি লাঠি দিয়ে মাটিতে জোরে একটা ঘা বসালেন।

রকুনুজ্জামান দৌড়ানো শুরু করলেন,তার শরীরে যেন অশুরের শক্তি এসে ভর করল।

দরজায় কড়া নারার শব্দ, মারজান দরজা খুলে অবাক, “ কিরে! ” রকনুজ্জামান কিছু বলতে পারলেন না, হাপরের মতো হাপাচ্ছেন শুধু। পানি,পানি খাব একটু…..

: নানাজির কোন ছবি থাকলে নিয়ে আস, দেখব।
মারজান একটু অবাক হলেও কিছু বললেন না। অনেক পুরনো সাদাকালো অস্পষ্ট একটা ছবি আনলেন। রকুনুজ্জামান ছবিটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন…….

সে রাতে রকুনুজ্জামানের ঘুম হলনা। তিনি এ পাশ ও পাশ করতে থাকলেন, তার বার বার মনে হতে থাকলো শুভ্র বসন নানাজি তার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!