একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে শহরে গিয়েছিল তানজিম। ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। চাকরির ইন্টারভিউ শেষ হয়েছে দুপুর নাগাদ। সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ডে চলে এলো ও। বাস ছাড়তে তখনো আধঘণ্টা বাকি আছে জেনে বাসস্ট্যান্ডের পাশেই একটা চায়ের দোকানে এক কাপ চা আর একটা বনরুটি খেয়ে বাসে উঠে বসলো তানজিম।
বাস ছাড়লো নির্দিষ্ট সময়ের পনেরো মিনিট পরে। তাতেই প্যাসেঞ্জাররা ড্রাইভারের ওপর মহাখাপ্পা।
কিন্তু বাস তো ছেড়েছে, আধাঘণ্টার মতো চলার পর বাসের চাকা পাংচার হয়ে গেল। প্যাসেঞ্জারদের বাস থেকে নামিয়ে চাকা বদলাবদলি করতে অনেকটা সময় কেটে গেল। তারপর বাস যখন ফেরিঘাটে এলো, তখন আরেক বিপত্তি। ফেরি এপারে ঘাট থেকে মাত্রই ছেড়ে গেছে। তার মানে ওপারে বাস-গাড়ি আর যাত্রী নামিয়ে আবার নতুন করে ফেরি লোড করে ফিরতে ঘণ্টাখানেক লেগে যাবে।
যাহোক, এতসব বিড়ম্বনা কাটিয়ে বাস যখন তানজিমদের বাড়ির কাছাকাছি স্টপেজে এসে থামলো, তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। অথচ সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছে যাবার কথা ছিল। তা সন্ধ্যা তো দূরের কথা, রাতও এগিয়েছে অনেক দূর।
বাড়ির কাছের স্টপেজ বলতে অন্যান্য স্টপেজের চেয়ে এই স্টপেজ থেকে বাড়ি কাছে হয় তানজিমদের। কিন্তু পথের দূরত্ব একেবারে কম নয়। যদিও রিকশা-ভ্যানে চড়ে গ্রামে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এত রাতে সেসব পাওয়ার আশা দুরাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবু রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলো তানজিম। শীতের কুয়াশা বেশ জেঁকে বসেছে! চলতে চলতে পুরো যাত্রার ওপর বিরক্তি ধরলো তানজিমের। ভাবে চাকরি তো হবেই না, শুধু শুধু এই কষ্ট ভোগ করা!
সত্যিই, তানজিম এতোটাই ক্লান্ত যে, বাসস্টপেজ থেকে বাড়ি পর্যন্ত যে পথটুকু হেঁটে আসতে হয়েছে, অন্যান্য সময় হলে রিকশায় না এসে হেঁটে এলেও গায়ে লাগতো না, কিন্তু এখন বেশ গায়ে লাগলো। আর এখন চৌধুরীদের বাগানের কাছাকাছি এসে ক্লান্তিটা যেন আরো জেঁকে ধরেছে! বাড়ির একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলেই কি ক্লান্তিটা এভাবে জেঁকে বসেছে? চৌধুরীদের এই বাগানটা পেরোলেই তানজিমদের বাড়ি।
বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তানজিমের খেয়াল হলো বেশ অন্ধকার! সামান্য দূরত্বেও কিছু দেখা যাচ্ছে না! তানজিম ভাবে চৌধুরীদের বাগানটা কি রাতের বেলা সবসময় এমন অন্ধকার থাকে? মনে পড়ছে না ওর। বেশ ঘন ঘন গাছে বাগানটা সয়লাব। সেই জমিদার আমলের বাগান। বুড়ো গাছপালা এখনো জানান দেয় গাছপালা আর বাগানের প্রতি রাজ-রাজড়াদের কতোটা ঝোঁক ছিল! ঘন বাগানে এই গাছপালাগুলো যেমন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, তেমনি দাঁড়িয়ে আছে তাদের প্রাসাদটা। পুরনো আমলের বাড়ি বলে, ওটা না পারছে দাঁড়িয়ে থাকতে না পারছে পুরোপুরি ভেঙে পড়তে। তাই ইট-সুরকি, পলেস্তরা খসে খসে বয়সের কথা জানান দিলেও রাজ-রাজড়াদের পুরনো আমলের মজবুত বাড়ি বলে হয়তো এখনো ভেঙে পড়েনি ওটা। কিন্তু লতাপাতা আর দেয়ালের গায়ে পরগাছা জন্মে বাড়িটাকে ঢেকে ফেলেছে! বাগানের পুবদিকে চৌধুরীদের বাড়ি। পশ্চিমে একটা মসজিদ। মসজিদের বাঁ পাশ দিয়ে বিশাল এক দীঘি। এই মসজিদটাতে লোকজন এখনো নামাজ পড়ে বলে এটাকে মেরামত-টেরামত করে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু রাজার আমলের মসজিদের সেই জৌলুস আর নেই।
বাগান পেরোতে পেরোতে অন্ধকারে তানজিমের পথ চলতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু এত রাতে মসজিদে আলো জ্বলতে দেখে ওর চমক লাগে। তানজিম ভাবে আজ কি বিশেষ কোনো রাত? এতো রাতে লোকজন মসজিদে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল?
আর কী ঝকমকে আলো জ্বলছে। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। রাতের বেলায় তানজিমও তো মাঝে মাঝে মসজিদে এসেছে। কিন্তু তখন তো এত আলো ঝলমলে মনে হয়নি!
দূর থেকে এসব ভাবতে ভাবতে তানজিম যখন মসজিদের কাছাকাছি এলো, তখন আতর-লোবানের গন্ধে মন ভরে গেল ওর। মসজিদের কাছাকাছি আসতেই তানজিম দেখলো কয়েকজন লোক লাশের খাটিয়া কাঁধে তুলে দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে কবরস্থানের দিকে চলেছে! তানজিম ভাবলো গ্রামের কেউ মারা গেছে হয়তো! কিন্তু যে লোকগুলোকে লাশ নিয়ে যেতে দেখলো, তাদের কাউকে চিনতে পারলো না ও। লোকজনের মধ্যে নিজের বাবাকেও খুঁজলো। তাকে দেখতে না পেয়ে ভাবলো বাবা হয়তো এতো রাতে আসেননি। তার এ্যাজমার সমস্যা আছে। তাই শীতের রাতে বের হননি হয়তোবা! তাই বলে এতোগুলো লোকের মধ্যে কাউকে চিনতে পারলো না সে! অবাক-বিস্ময়ে ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো তানজিম।
বাড়িতে এসে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না এ প্রসঙ্গে। মা ভাত বাড়লেন। মুখ-হাতে ধুয়ে এসে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো তানজিম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবার সঙ্গে দেখা হতেই তানজিম জিজ্ঞেস করল, বাবা, আমাদের গ্রামে কে মারা গেছে?
ছেলের প্রশ্ন শুনে ভ্র কুঁচকালেন আজিম উদ্দিন। কই? কেউ মরেনি তো!
বাবার কথা শুনে ভারী এক হোঁচট খেল তানজিম। গত রাতের দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠলো ওর। হ্যাঁ, স্পষ্ট দেখেছে ও ঝলমলে আলো জ্বলছে মসজিদে। খাটিয়ায় কাফনে মোড়ানো লাশ নিয়ে যাচ্ছে লোকজন। বাবার কথার সাথে তো এসবের কিছুই মিলছে না। কেউ যদি মারা না-ই যায়, তাহলে মিলবেই বা কেমন করে!
তুই কোথায় শুনলি, গ্রামে লোক মরেছে? আজিম উদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন।
তানজিম ভাবল বাবা যেহেতু বললেন গ্রামে কেউ মরেনি, সেহেতু গতরাতের ঘটনা বললে ওকে নিয়ে হাসাহাসি পড়ে যেতে পারে। তাই ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইল তানজিম। কিন্তু গতরাতের ঘটনা মোটেই অবিশ্বাস করতে পারছে না ও। ঘটনাটা মনে পড়লেই মসজিদ থেকে ভেসে আসা আতর-লোবানের গন্ধ নাকে লাগে যেন। ঝলমলে আলো চোখে ভেসে ওঠে।
তানজিমের ঘোর কাটে না। বাবা বলেছেন গ্রামে কেউ মরেনি, দু’চারজন বন্ধু-বান্ধবকে জিজ্ঞেস করেও একই কথা জানলো। তাহলে সেই রাতে কার লাশ…। ভাবতে ভাবতে মনের ভেতরে এক ভয়ার্ত শিহরণ বয়ে যায়। দিনরাত কেবল এই ঘটনাটা ঘুরপাক খায় তানজিমের মনে।
এর দু’দিন পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ভয়ংকর এক স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো তানজিম। শীতের মধ্যেও দরদর করে ঘামলো। কিছুটা শান্ত হয়ে স্বপ্নটার কথা মনে করতে চেষ্টা করলো। কিন্তু না, একদম মনে করতে পারলো না। শুধু এইটুকু বুঝল স্বপ্নটা বেশ ভয়ংকর ছিল। হুট করে একটা বিষয় মনে পড়ল তানজিমের সেদিন মসজিদের ওখানে যে লোকগুলোকে দেখেছিল, তাদের একজনকেও তো চিনতে পারেনি ও। তার মানে তাদের কেউই এই গ্রামের কেউ নয়! এই গ্রামের হলে তো চেনাই যেত। এবার ভয়ে আতঙ্কে ভরে উঠল তানজিমের মন।
এই ক’দিনে তানজিম সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরেছে। কারণ দিনের বেলায়ই চৌধুরীদের বাগানের ভেতর দিয়ে আসতে সাহস হয় না ওর, রাত হয়ে গেলে তো কথাই নেই।
এরমধ্যে ঢাকায় যে ফার্মে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছিল তানজিম, সেখান থেকে এ্যাপয়েনমেন্ট লেটার এসেছে। পরবর্তী মাসের এক তারিখে জয়েন করতে হবে। হাতে আর মাত্র ৭ দিন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো তানজিম। সে ভাবে, চাকরিটা তো তার দরকার ছিলই, কিন্তু গ্রামে থেকে সেই রাতের ঘটনাটা যে তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, আর রাত হলেই বারবার ওই ঘটনা মনে পড়লে তাকে যে আতঙ্ক জড়িয়ে রাখে, ঢাকায় গেলে এই সমস্যা থেকে তো পরিত্রাণ পাওয়া যাবে!
হাতে যদিও সাতটা দিন আছে, তবু তানজিম ভাবলো, এর আগেভাগেই ঢাকায় যাবে। গ্রাম থেকে পালাতে পারলেই যেন বেঁচে যায় সে! তাছাড়া আগেভাগে গিয়ে একটা মেস খুঁজে উঠে পড়তে হবে।
ঢাকায় এসে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে একটা মেস পেয়ে গেল তানজিম। মেসে টুকটাক সমস্যা তো আছেই। টিনসেডের পাকা বাড়ি। সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তিন-চারটা গাছ রয়েছে। কিন্তু বাথরুম-টয়লেট বাইরে। ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের উঠোনের মতো জায়গাটা পেরিয়ে বাথরুম-টয়লেট আর কলতলায় যেতে হয়। এই অসুবিধা সত্ত্বেও নিরিবিলি পরিবেশের কারণে মেসটা পছন্দ হলো তানজিমের। বাড়িঘরে ঘিঞ্জি ঢাকা শহরে এমন নিরিবিলি থাকার জায়গা খুব কম মেলে। রুমমেটকেও পছন্দ হলো। বেশ মজার মানুষ জাফর হোসেন। মধ্য বয়স্ক। একটা বীমা কোম্পানিতে চাকরি করেন। তানজিম তাকে ‘জাফর ভাই’ বলে ডাকে। অল্প ক’দিনেই ওর সঙ্গে বেশ ভাব জমে গেল। ছুটির দিনে দু’জন একসঙ্গে ঘুরতে বের হয়। তানজিম গ্রাম থেকে এসেছে। ঢাকা শহরটা তার অচেনা। জাফর ভাই নিজ উদ্যোগেই এখানে-ওখানে নিয়ে যায় ওকে। তার আসল উদ্দেশ্য তানজিমকে ঢাকা শহর চেনানো।
তানজিম ভাবে যাক, এখানে ভালোই কাটবে।
একরাতে খেয়েদেয়ে ঘুমানোর আগে মুহূর্তে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে গল্প করছিল তারা দু’জন।
এ প্রসঙ্গে-ও প্রসঙ্গ ঘুরে জাফর ভাই হঠাৎ বললেন, এখানে একটু সাবধানে থাকবেন। এই মেসে একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে একবার। আমার ধারণা সেই ঘটনার পর আরো কিছু ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। এই মেসের অন্যান্য মেম্বাররা তা খেয়াল করে কিনা জানি না। কিন্তু আমি খেয়াল করেছি।
জাফর ভাইয়ের কথা শুনে বুক কেঁপে উঠলো তানজিমের। ভাবলো গ্রামে থাকতে যে আতঙ্ক তাকে আঁকড়ে রেখেছিল, ঢাকায় এসেও সেই একই অবস্থায় পড়তে হলো!
জাফর ভাই বললেন, আমাদের পাশের রুমে আলম ভাই থাকতেন। লোকটার একটা বড় গুণ ছিল নিজের কাজ নিজে করতেন। তো গতবার শীতে, একদিন সকাল বেলা তার লেপটা রোদে দেবেন বলে অফিসে যাবার আগে টিনের উপর মেলে দিয়ে গেলেন। সন্ধ্যায় মুখে অফিস থেকে ফিরে মই বেয়ে লেপটা নিয়ে নেমে আসার সময় উপুড় হয়ে পড়ে জায়গায় মরে গেলেন লোকটা। এমনভাবে উপুড় হয়ে পড়েছিলেন যে, তার ঘাড় মটকে গেল! আমরা অবাক এইটুকু উঁচু থেকে এভাবে কেউ পড়ে! সে যাক, এই নিয়ে সন্দেহজনকভাবে থানা-পুলিশ হলো। কিন্তু প্রমাণ হলো তাকে কেউ খুন করেনি। নিছক এক্সিডেন্ট। আমাদের বিস্ময় কাটে না তবু এই সামান্য উঁচু থেকে পড়ে এমনিভাবে কেউ মরতে পারে! আর পড়লেও এইটুকুতেই মরার মতো ঘটনা ঘটার কথা নয়। এর পেছনে নিশ্চয়ই অশুভ কিছু থাকতে পারে। এই যেমন অশরীরি কিছুর প্রভাব। এই জায়গাটা নিরিবিলি তো। তাছাড়া, তখন মেসেও তেমন কেউ ছিল না। অফিস থেকে ফেরেনি সবাই। একটু থেমে জাফর ভাই বললেন, কিন্তু আলম ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে একটা বিষয় খেয়াল হলো আমার। মাঝরাতে আমাদের মেসের টিনের চালে কে যেন হেঁটে বেড়ায়! সেই হেঁটে বেড়ানোর শব্দ এতই সূক্ষ যে, নিবিড়ভাবে কানখাড়া করে না রাখলে টের পাওয়া যায় না। যত গাঢ় ঘুমেই ডুবে থাকি আমি, টিনের চালে কারো হাঁটার শব্দে ঠিকই ঘুম ভেঙে যায়। শুধু তাই নয়, ঠিক এ সময় একটা বেড়ালের ডাক শোনা যায়। বেড়ালটা এমনভাবে ডাকে, শুনে মনে হবে কোনো বাচ্চা কাঁদছে! কথার মাঝে আবার একটু থামলেন জাফর ভাই। তারপর বললেন, আপনি এই মেসে নতুন। রাতে ঘুম থেকে উঠে হয়তো টয়লেটে যেতে হতে পারে! একটু সাবধানে থাকবেন।
তানজিম এতক্ষণ যাবৎ শুনছিল ঠিকই, কিন্তু ভয়ে শরীর শক্ত হয়ে এলো ওর।
এরপর থেকে প্রতি রাতেই তানজিমের এমন অবস্থা হয়। জাফর ভাই ঘুমিয়ে পড়ে, তানজিমের ঘুম আসে না কিছুতেই। রাত একটু ভারী হতেই ও টের পায় টিনের চালে কেউ যেন হাঁটছে! আর প্রতিদিন সকাল হলে ভাবে যে আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে পরিত্রাণের আশা করেছে সে, সেই আতঙ্ক শহরেও তার পিছু ছাড়লো না! তাই ঠিক করলো এই মেসে আর বেশিদিন থাকবে না সে।
কোনো কোনো রাতে কান খাড়া করে টিনের চালের ওপরে হাঁটার শব্দ শুনতে চেষ্টা করে তানজিম আসলেই কেউ টিনের চালে হাঁটাহাটি করছে কিনা। শুনে তার কখনো মনে হয় ওসব আসলে ভ্রম! আবার মনে হয় না, অবিকল মানুষের হাঁটার শব্দ ভ্রম হয় কী করে! এই ধারণা থেকে রাতের বেলা প্রস্রাবের বেগ হলেও ঘর থেকে বের হতো না তানজিম। প্রস্রাব চেপে রাখতো। কিন্তু একদিন তার পেটে গন্ডগোল বাঁধলো। দুপুরের পর অফিসে বসেই ব্যাপারটা টের পেল সে। আগের রাতে মেসের রান্নাটা ভালো ছিল না। তরকারি অতিরিক্ত তেল আর ঝালে মাখামাখি। তাই এই পেটে গন্ডগোল। যদিও দুপুর থেকেই ওষুধপত্র খেতে শুরু করেছে, কিন্তু ওষুধের কাজ করতেও তো কিছুটা সময় লাগবে! মেসে ফিরে একটু পরপরই টয়লেটে যেতে হচ্ছে। তাই চিন্তা বাড়ে রাত বাড়লে মেসের সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, তখন টয়লেটে যেতে হলে একা কেমন করে যাবে? জাফর ভাইও নেই। অফিস থেকে সাত দিনের ছুটি নিয়ে আজ সকালেই গ্রামের বাড়ি গেছে। উনি থাকলে না হয় ঘুম থেকে জাগিয়ে হলেও তাকে মেসের বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখে টয়লেটে যেতে পারতো তানজিম!
ঘুমিয়ে পড়েছিল তানজিম। শরীর এতোটাই দুর্বল, ঘুমিয়ে না পড়ে উপায় আছে? রাত আড়াইটা নাগাদ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তানজিমের। টয়লেটে যাবার প্রয়োজন অনুভব করলো। এ কারণেই বোধহয় ঘুম ভেঙেছে তার। কিন্তু টয়লেটে যেতে সাহস পাচ্ছে না। কান খাড়া করে টিনের চালে হাঁটাহাটির শব্দটা শোনার চেষ্টা করলো। নাহ্, কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। একবার, দু’বার, তিনবার… পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শব্দটা শোনার চেষ্টা করলো। কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। এতে বোধহয় কিছুটা সাহস জন্মালো তানজিমের মনে। রুমের দরজা খুলে বাইরে বের হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকালো। তারপর একরকম দম বন্ধ করে টয়লেটের দিকে ছুটলো। একদম এদিক-ওদিক তাকালো না। কিন্তু টয়লেট থেকে বেরিয়ে যখনই রুমের দিকে পা বাড়াবে, অমনি খুব কাছ থেকে বেড়ালের কাঁইকুঁই ডাক শুনতে পেল তানজিম। শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো তার। খুব ধীরে পা ফেলতে লাগলো, যেন তার শরীর ঘেঁষে আছে ভয়ংকর কিছু একটা! একটু নড়াচড়া করলেই বিপদ। বেড়ালের কাঁইকুঁই ডাকাডাকি একতরফা চলছেই। আর শব্দটা ক্রমশ খুব সূ² হচ্ছে। তানজিমের মনে হলো এটা কোনো বেড়ালের ডাক নয়, কোনো ছোট্ট শিশুর ডাক। ভীষণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে শিশুটি!
বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে রুমের দিকে চলেছে তানজিম। বেড়ালের ডাকটা এমন শোনালো, ভয়ে-আতঙ্কে শরীরটা যেন অসাড় হয়ে গেল তানজিমের। যেন তাকে দেখেই বেড়ালটা এভাবে ডেকে উঠলো। কিন্তু এমন ডাক যে অশুভ, তানজিম তা খুব ভালো করে বুঝতে পারে।
একটু থেমে আরেকবার ডেকে উঠল বেড়ালটা। শুরু থেকেই তানজিম বেড়ালের ডাক হিসেবে ধরে নিলেও, এবার আর ডাকটা কিছুতেই বেড়ালের ডাক বলে মনে হলো না। একবার নয় পরপর তিনবার শোনা গেল ডাকটা। আর প্রতিবারই কানে বাজলো আতঙ্ক জড়ানো তরঙ্গ। ভয়ে জড়োসড়ো অবস্থা তানজিমের। তখনই সে দেখলো একটা নয়, চার-পাঁচটা ভয়ানক কালো বেড়াল জ্বলজ্বলে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি তো নয়, যেন ভয়ংকর হিংস্রতা ঝরে পড়ছে চোখগুলো থেকে।
এমন পরিস্থিতিতেও তানজিমের মনে হলো ওই জন্তুগুলো সাধারণ বেড়াল নয়, যেন ভয়ংকর কোনো দানব! এর বেশি কিছু বোঝার সুযোগ হয়নি তানজিমের। সকালবেলায় মেসের সবাই তাকে কলতলায় অজ্ঞান অবস্থায় পেল।