রাত হলেই শ্যামপুর গ্রামে সুনসান নিরবতা নেমে আসে- এই নীরবতার মাঝে থাকে শুধুই পাতার মর্মর আওয়াজ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। একটানা সেই ডাকে মোহনীয় হয়ে থাকে যেন কুসুমপুর গ্রাম।সুনসান নিরবতার এই গ্রামে আজ ও রাত নেমে এসেছে। কিন্তু প্রতিদিনের মত চুপচাপ নেই কেউ। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত যে কৃষক সে ও এসে ভিড় করেছে কালনীর শাখা নদী সুলিনার তীরে। ব্যাপার কিছুই না- সেখানে ভেসে উঠেছে এক মহিলার লাশ।
সবাই যে যার মত বলাবলি করছে, চিনতে চেষ্টা করছে লাশটাকে- কিন্তু কেউ চিনতে পারছেনা। কারন কেউ এই মহিলাকে খুন করে মাথাটা কেটে ফেলেছে। এখন চারদিকে লোক পাঠানো হয়েছে মাথার খোঁজে। মাথা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এই লাশ দাফন করার জন্য কেউ এগোচ্ছেনা । এর মাঝেই কোন কোন উতসুক জনতা গিয়ে দূর থেকে কাঠি দিয়ে লাশের হাত পা দেখার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু কোন ফলাফল নেই। হাতে পায়ে কোন চিহ্ন নেই- যে লাশটাকে চেনা যায়। রাত যত বাড়তে থাকে –তত ভীর বাড়তে থাকে। মাঝে ভীরের চাপ কমে গিয়েছিল। কিন্তু হটাত করে শোনা যায় শেখের বাড়ির সুলেখা কে পাওয়া যাচ্ছেনা। ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করে ঘর থেকে রেগে মেগে বের হয়ে গিয়েছিল সুলেখা। তারপর থেকে ওর পাত্তা নাই। সৎ মা ও সুলেখার কোন খোঁজ করেনাই। এখন ও সুলেখার মায়ের কোন দেখা নাই। শুধু ওর বড় ভাই জমির শেখ এর কান্না কাটি চলছে লাশটার পাশে। অনেকেই ওকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে- কিন্তু পারছেনা। বার বার আছাড় খেয়ে খেয়ে মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে জামাল শেখ। ছোট বোন টাকে অনেক ভালবাসত সে। সকালে ঝগড়া হবার সময় বলেছিল-
“যা- দূরে যাইয়া মর গা” এখন সেই কথা শুনিয়ে বলতে বলতে চিৎকার করে কেঁদে উঠল ও। কিন্তু লাশের পরিচয় পাওয়া গেলনা। এর মাঝেই গ্রামের তিন জন মুরুব্বি এসে নিজেদের মাঝে বাহাস করতে লাগল। কেউ এই লাশ দাফন করতে চায়- কেউ নিয়ে ফেলতে চায় সেই পানিতে- যেখান থেকে ভেসে এসেছে লাশ। কেউ কেউ জানাজা পড়ার জন্যই বসে থাকল। কিন্তু লাশের পরিচয় পাওয়া গেলনা।
এর মাঝেই একটা চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে গেল সেই চিৎকারের উৎসের দিকে। সেখানে এক ১২-১৩ বছরের ছেলে মাটিতে হোঁচট খেয়ে ঊল্টে পড়ে আছে। কিন্তু চিৎকার করেছে ভয়ে। কারন সে যে জিনিস টার সাথে হোঁচট খেয়েছে সেটা আর কিছু না – সেই বেওয়ারিশ লাশের মাথা।মাটিতে সামান্য গর্ত করে কেউ ঢুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু মাটি আলগা হওয়াতে তাতে হোঁচট খেয়েছে ছেলেটা।
এরপর পরই ওঠে কান্না কাটির রোল। সুলেখার নাকের ফুল দেখেই সবাই চিনে ফেলে এটা সুলেখার লাশ। সাথে সাথেই দুই তিন জন মিলে সেই লাশের মাথা নিয়ে এসে লাশের পাশে রাখে। মরা কান্না জুড়ে দেয় জামাল শেখ আর তার আত্মীয় স্বজন রা।
গ্রামের মাতব্বর দের মাঝে দুই-তিনজন এই লাশের জানাজা করে দাফন করতে চায়না।চার পাঁচ জন তাদের সাথে কোরান-হাদিস নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ওই গ্রামের মসজিদের মওলানার সাথে তর্ক লেগে যায় করিম মওলা আর তার ছেলে রহমান মওলার । শেষে কোন মিমাংসা করতে না পেরে সেই লাশ দুই তিন জন মিলে কোন রকম জানাজা পড়ে দাফন করে। এর মাঝে গ্রামের হেডমাষ্টার সবুজ মিয়া ও ছিল। সবুজ মিয়া নিজের দায় থেকে এই কাজে উৎসাহ দেবার জন্য দোষি সাব্যস্থ হয় পরদিন এক সালিশে। দিন সাতেক সবার মুখে মুখে এই ঘটনা একের পর এক ডানা মেলতে থাকে। কেউ কেউ বলা শুরু করে সবুজ মিয়া এই সুলেখার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আর এর রেশ ধরে কয়েকদিন পর আবার সালিস ডাকা হয়। যেই তিন জন লাশ দাফন ও জানাজা করতে চায়নি তাদের রায়ে সবুজ মিয়া কে এক ঘরে করে রাখে সবাই। আসলে ওই তিন জন খুব ক্ষমতা শালী বলে কেউ ওদের মুখে মুখে তর্ক করতে চায়নি।তাদের মাঝে রহমান মওলা পরের মাসে চেয়ারম্যান পদে ভোটে দাড়াচ্ছে। তাই তার সাথে কেউ কথা কাটাকাটি করতে চায়নি।ফলাফল নিরিহ সবুজ মিয়াকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে সবাই। কিন্তু সুলেখার ভাই জামাল শেখের বন্ধুত্ব ছিল।তাই সবুজ মিয়াকে নিজের ঘরে খাওয়াতে শুরু করে সে। এর মাঝে সবাই সুলেখার কথা প্রায় ভুলে যায়।
দুই সপ্তাহ পর একদিন গ্রামের মসজিদের ইমাম ইসমাইল মিয়া ফজরের নামাজের আজান দিয়ে গিয়ে এক বীভৎস দৃশ্য দেখে ভয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সকালে সবাই তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় মসজিদে খুঁজে পায়। কেউ বলতে পারছেনা কেন সে অজ্ঞান হয়েছে। অনেক ক্ষন পর তার জ্ঞান ফিরলে সে সবাইকে নিয়ে যায় সুলেখার লাশ যেখানে দাফন করা হয়েছিল সেখানে। সুলেখার লাশের পাশে একটা জারুল গাছ আছে – সেখানে একটা ডালে পাওয়া যায় করিম মওলার ছিন্ন ভিন্ন লাশ। প্রথমে কেউ চিনতে পারেনি। কিন্তু গাছের গোড়ায় কে যেন লাশের মাথাটা সযত্নে কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে।
দৃশ্যটা দেখে অনেকেই সহ্য করতে পারেনি। শেষে পুলিশ দেকে পাঠানো হয়। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায় ময়না তদন্তের জন্য। এর মাঝে রহমান মওলা ক্ষেপে যায় নিজের পিতার এই অবস্থা দেখে। বিকেল যেতে না যেতেই সবুজ মিয়ার বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয় সে। সবাইকে বলে বেড়াতে থাকে যে সবুজ মিয়ে গুন্ডা লাগিয়ে তার বাবাকে হত্যা করিয়েছে। এই সময় তার সাঙ্গ পাংগরা মিলে সবুজ মিয়াকে গাছের সাথে বেধে ইচ্ছা মত মারতে থাকে। শেষে মার খেয়ে সবুজ মিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে ওকে নিয়ে স্কুল ঘরের একটা রুমে বেধে রাখে। সবাই গোপনে সুলেখার ভুতের কথা বললেও রহমান মওলার সামনে কেউ তর্ক করেনি মার খাবার ভয়ে। এর পর থেকে দুইদিন ধরে বন্দি থাকে সবুজ মিয়ে সেই স্কুল ঘরে। সকাল বেলা এসে রহমান মিয়ার লোক খাবার দিয়ে যায়। সবুজ মিয়ের খাওইয়া শেষ হলেই মার শুরু হয়। শেষে অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে দড়ি বেধে রেখে যায় রহমান মওলার লোকজন।
এর তিন দিন পরেই আবার শ্যামপুর গ্রামে শোর গোল ঊঠে। এবার ভোর সকালে পাওয়া যায় রহমান মওলার মাথা কাটা লাশ। মাথা কাটা লাশ গ্রাম বাসি দুইটা দেখেছে। কিন্তু এই রহমান মওলার লাশের পায়ের দিকটা ছিলনা। পাশেই পড়েছিল হাড় গোড়। যেন কেউ এসে খেয়ে গেছে লাশটাকে। এবার পুলিশ এসে সবাইকে জেরা করতে শুরু করে। এবং গ্রামের বেশ কয়েকজন লোকজন পালিয়ে যায় ভয়ে। কিন্তু পুলিশকে রহমান এর ভাই রহিম মওলা টাকা খাইয়ে বিদায় করে দেয়। গ্রাম বাসি স্বস্তি পেলেও ভয়ে বাড়ি থেকে দিনের বেলা ও লোকজন বের হওয়া বন্ধ করে দেয়। সবুজ মিয়াকে নির্যাতন বন্ধ করা হয়- কিন্তু তাকে বন্দি করেই রাখা হয় সেই স্কুল ঘরে।
এর সাত দিন পরেই পর পর দুই জন লোকের লাশ পাওয়া যায় মাথা কাটা অবস্থায়। এই দুই জন হল গ্রামের সেই দুই মুরুব্বি যারা সুলেখার লাশ দাফনে বাঁধা দিয়েছিল। যারা সুলেখার জানাজা পড়তে চায়নি।গ্রাম বাসি এরপর প্রায় চুপচাপ হয়ে যায়। যারা সেই রাতে মুরুব্বি দের সাথে গলা মিলিয়েছিল তারা দুরের গ্রামে পালিয়ে যায়। এর মাঝে পুলিশ এসে দুইবার সবাইকে জিজ্ঞাসা বাদ করে। কিন্তু খুনি ধরা পড়েনা।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।