
মাহের, জিতু, রকি, আর শান্ত।। চার বন্ধু।। প্রানের বন্ধু বলতে যাকে বোঝায়।। স্কুল লাইফ থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি অবদি সবাই একসাথে।। একজন আরেকজনের জীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, পাওয়া–না পাওয়ার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।। যখন তারা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, তখন কত মজা করেই না দিনরাত এক করে আড্ডা দিতো।। টি, এস, সি, রমনা পার্ক, কার্জন হল, ধাপিয়ে বেড়াতো চারবন্ধু মিলে।।
কিন্তু সুখপাখি কখনো চিরদিনের জন্য খাঁচায় বন্দি থাকতে চায় না।। ছাড়তে তাকে হবেই।। ভার্সিটি পাশের পর একেকজন চলে গেলো একেক দিকে।। কারো চাকরি হল টেলিকম কোম্পানিতে, তো কারো হল ব্যাংকে।। কেউ আবার চলে গেলো ঢাকা ছেড়ে সুধুর পঞ্চগড়ে।। এখন তাদের মাঝে আর দেখা সাক্ষাত হয় না তেমন একটা।। এইবার ঈদের ছুটিতে সব বন্ধু একত্র হবার প্ল্যান করলো তারা।। পরিকল্পনাকারী মূলত জিতু।। পাশ করার পর গ্রামীনফোনে চাকরি করছে।। খোলামেলা জীবনটা হটাত করে যেনও খুব বেশি যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে।। যেইসব বন্ধুদের ছাড়া আগে একটি দিন কাটানো মুশকিল হয়ে যেত, আজ তাদের সাথে ফোনে কালেভদ্রে কথা হয়।। আর দেখা প্রায় হয় না বললেই চলে।। পরিকল্পনার কথা খুলে বলল সবাইকে।। ঈদের তৃতীয়দিন টি, এস, সি তে চারবন্ধু দেখা করবে ঠিক হল।। যথাসময়ে জায়গামত পৌঁছে গেলো তিনজন।। শুধু মাহেরের দেখা নেই।। রকি জানালো, মাহেরের সাথে কথা হয়েছে তার।। মাহের নাকি অফিসিয়াল কি একটা কাজে ঈদের পরদিনই পঞ্চগড় ফিরে গেছে।।
আজকে সকালে ঢাকায় এসে তাদের সাথে যোগাযোগ করার কথা।। কিন্তু কথা রাখেনি সে।। হয়তো অফিসিয়াল কাজটা বেশি জরুরি ছিল, হয়তো শেষ মুহূর্তে আটকে গেছে।। পরস্পরকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল তারা।। কিন্তু মাহেরের একেবারেই যোগাযোগ না করার ব্যাপারটা কেমন কেমন যেনও ঠেকল সবার কাছেই।। তবে কি শুধু সময়ের প্রয়োজনেই বন্ধুত্ব?? আজ সবার জীবন আলাদা পথে ধাবমান।। কে কার জন্য কোথায় বসে আছে তা দেখার সময় কই?? ভুলটা ভাঙল পরেরদিনের খবরের কাগজ পড়ে।।
খবরের কাগজে ছোট করে একটা খবর দেয়াঃ বেপরোয়া গাড়ি চালানোঃ বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে পঞ্চগড়ে রুটে ৫জন নিহত।। ব্যাপারটা সর্বপ্রথম লক্ষ্য করে জিতু।। বাকিদের সাথে সাথে জানায়।। হতদন্ত হয়ে ছুটে মাহেরের বাসায়।। যেখানে ঈদের খুশিকে ছাপিয়ে আকাশে বাতাসে গুঞ্জন তুলে বেড়াচ্ছিল মাহেরের আত্মীয় স্বজনের আহাজারি।। যান্ত্রিক জীবনে বেঁচে থাকা এবং নিজেকে মানিয়ে নেয়ার তাড়নায় আবার নতুন করে জীবন শুরু করে তিনবন্ধু।। সেই জীবনে নেই তাদের একজন প্রিয় মানুষ।। যার জন্য তারা অপেক্ষা করে ছিল।। একবারের জন্যও শেষ দেখাটা হল না।। প্রায় ৪-৫ মাস পরের ঘটনা।। শান্ত বিয়ে করেছে ২ বছর হল।। ভার্সিটিতে পরিচয়, সেই সুত্রেই বিয়ে।। বাবা–মা বিয়ে মেনে নেয়নি দেখে আলাদা বাসা নিয়ে থাকে জামাই বউ।। মঙ্গলবার রাত ১২টার পরের ঘটনা।।
ঘুমুচ্ছিল শান্ত।। পাশেই তার বউ মাধবী শোওয়া।। হটাত শান্ত অনুভব করলো তার বিছানার পাশে বসে কে যেনও আলতো করে হাত রাখল তার গায়ে।। মাধবীর হাত মনে করে প্রথমে পাত্তা দিল না সে।। কিন্তু পরের কণ্ঠস্বরটা শুনে ঘুম ছুটে গেলো তার।। এই কণ্ঠস্বর যে তার চিরচেনা!! এ তো মাহেরের কণ্ঠ!! আস্তে আস্তে তাকে ডাকছে, “কিরে গাধা!! এখনও আগের মতই আছিস?? ঘুমুলে আর ঘুম ভাঙ্গানো যায় না রে তোর।। উঠ একটু।। তোর সাথে কথা ছিল।। আমি বেশি সময়ের জন্য আসতে পারেনি।। এখুনি আবার চলে যেতে হবে।।” ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলো শান্ত।। এইতো, সামনে তো মাহেরই বসা!! তার প্রানের বন্ধু, মাহের, ফিরে এসেছে!! শান্তর মাথায় এই বুদ্ধিটুকু তখন কাজ করছিলো না যে মাহের জীবিত নয়।। মৃত।। নিজ হাতে কবর দিয়ে এসেছে সে তাকে।। “উঠলি শেষ অবদি!!” হাল্কা করে হেসে বলল মাহের।। উল্লসিত শান্ত মাহেরের একটা হাত নিজের হাতে নিলো, “দোস্ত, আছিস কেমন তুই??” একটু হেসে বলল মাহের, “ভালোই রে!!” “তারপর কেমন চলছে সব??” “ভালোই!! শোন, তোর সাথে খুব জরুরি কথা ছিল দোস্ত।। আমার হাতে বেশি সময় নেই।। আমি যা বলব তা চুপচাপ শুনে যা।।” “আচ্ছা” সুবোধ বালকের মতন উত্তর দিল শান্ত।। ঠিক যেনও একটা ছোট বাচ্চা তার অনেকদিনের প্রিয় খেলনাটা ফিরে পেয়েছে।। “সেদিন আমি তোদের সাথে মিট করার জন্যই রাতের বাসে পঞ্চগড় থেকে রউনা দেই।। পথে আমাদের বাসটা এক্সিডেন্ট করে।। ঘটনাস্থলেই আমি মারাত্মক ভাবে আহত হই।। বারবার তোদের কথা মনে পড়ছিল।।
মারাত্মক কষ্ট হচ্ছিল রে।। মনে হচ্ছিল কেউ যেনও আমার জ্যান্ত দেহটা থেকে চুরি দিয়ে কেটে কেটে হৃৎপিণ্ডটা খুলে নিচ্ছে।। শ্বাস নিতে পারছিলাম নাহ।। পৃথিবীটা যেনও লাটিমের মত ঘুরছিল।। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় হাসপাতালে নেয়া হয় আমাকে।। ডাক্তাররা চেষ্টা করার আগেই মারা যাই আমি।।” বিমুঢ়ের মত শুনছিল শান্ত।। প্রশ্ন করলো, “তারপর??” “দোস্ত, এতো কষ্ট কেন হচ্ছিল জানি না।। বার বার চোখে তোরা ভাসছিলি।। তোদের কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি দোস্ত।। পড়ে জেনেছি সেদিন আমার জন্য রাত ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলি তোরা।। জিতুটা তো আবার একটু পাগল।। ও নাকি রেগেছিল আমার উপর।। আড়ালে কেঁদেছে আমার উপর অভিমান করে!! আমাকে মাফ করে দিস তোরা।। যাবার বেলায় তোদের বিদায় নিয়ে যেতে পারলাম নাহ।। শেষবারের মত দেখতে পারলাম না চামড়ার চোখ দিয়ে।। আমি অনেক বেশি সরি রে।। মাফ করবি তোদের এই বন্ধুটাকে??” ঘোড়ের মধ্যে বলল শান্ত, “ছিঃ, এইসব কি বলছিস তুই??” এই পর্যায়ে শান্তকে জোড়ে ধাক্কা দেয় মাধবী।। “এই, কি ঘুমের মধ্যে বসে বসে বকবক করছ?? শুয়ে পড়ো!!” সাথে সাথে যেনও ঘুম থেকে জেগে উঠে শান্ত।। নিজেকে খাটের উপর বসে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করে।। সাড়া গাঁ ঘামে ভিজে একাকার।। আসনপিঁড়ি করে বসে আছে।। ঠিক যেই ভঙ্গিতে বসে কথা বলছিল মাহেরের সাথে।। নিজের মোবাইলের ডিসপ্লে দেখে সে।। রাত ২.৫৫।। ঘটনার ৩দিন পর।। ঢাকার একটি স্বনামধন্য রেস্তোরায় বসে আছে জিতু, রকি, আর শান্ত।। কারো মুখে কথা নেই।। শান্তর বলার জন্য অপেক্ষা করছে।। মূলত শান্তর ফোন পেয়েই এখানে ছুটে এসেছে তারা।। অনেক ইতস্তত করে অবশেষে মঙ্গলবার রাতে ঘটে যাওয়া পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল শান্ত।। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল বাকি দুজন।। বলা শেষ হলে রকি প্রশ্ন করলো, “ঘড়িতে তখন কটা বেজেছিল মনে আছে তোর??” “হুম।। ২.৫৫।।” শান্তর উত্তর।
“মাহের আমার কাছে ঠিক ৩.০০ টার দিকে আসে এবং ঠিক একই রকমের কথাবার্তা হয় তার সাথে।। বারবার বলতে থাকে যেনও তাকে আমরা মাফ করে দেই।।” জিতু জানালো, তার সাথেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটে।। সময় তখন ৩ টা বেজে ১০ মিনিট।। উপরোক্ত ঘটনাটি আমার ভাইয়ের মুখ থেকে শোনা।। উক্ত কাহিনীর জিতু আমার ভাইয়ের সহকর্মী।। গ্রামীনফোনে কর্মরত।। তিনি নিজে ঘটনাটি সবার সামনে খুলে বলেন।। এর সত্যতা প্রমানের জন্য শান্ত এবং রকির সাথে কথা বলা হয়।। তারাও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।।