►প্রাচীন রাজবাড়ি◄

হয়তো এটা আমার একটা বিভ্রান্তি, তবুও আপনাদের সবার সাথে শেয়ার করতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। তখন আমি অনেক ছোট, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। মুক্তাগাছা রাজবাড়ির পাশেই একটা বাসায় আমরা থাকতাম। আমাদের বাসায় যিনি কাজ করতেন, তার একটা ছোট মেয়ে ছিল। সেই মেয়েটাই ছিল আমার প্রতিদিনের খেলার সঙ্গী।

মূল ঘটনায় আসি। একদিন স্কুল থেকে বাসায় আসার পর বরাবরের মতোই আমি হাত-মুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়েছি খেলা করতে। সাথে ছিল আমার সঙ্গিনী। বাসার সামনেই বড়সড় একটা মাঠ ছিল, যেখানে এলাকার আর অন্যান্য সব বাচ্চারাও খেলা করতো। মাঝে মাঝে তাদের সাথে মিলেমিশে খেলতাম আমরা।

সেদিন হঠাৎ ২২-২৩ বছর বয়সী একটা মেয়ে আমাকে ডাকল, রাজবাড়ির গেটের সামনে থেকে। আমি এলাকায় পরিচিত ছিলাম আমার বাবার জন্য, সেখানে সবাই আমার সাথে স্নেহের সহিত কথা বলত, তাই তার ডাকে সাড়া দেয়াটা খুব বেশি অস্বাভাবিক ছিল না আমার জন্য।

তার কাছে গিয়ে, তিনি একটু এগিয়ে এসে আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। নাম বলার পর, কোথায় থাকি, বাড়িতে কে কে আছে ইত্যাদি প্রশ্ন করলেন। সব কিছু মোটামুটি উত্তর দেয়ার পর তিনি বললেন, তিনি এখানে নতুন এসেছেন এবং রাজবাড়িটা একটু ঘুরে দেখতে চান। সম্পূর্ণ কথোপকথন আমার মনে নেই, তবে তার ব্যবহার আমার খুব ভালো লেগেছিল, তাই আমি রাজি হয়ে যাই তাকে রাজবাড়িটা ঘুরে দেখানোর জন্য।

রাজবাড়িটা অনেক পুরনো, বেশ কয়েকটি স্বতন্ত্র ভবন নিয়ে এখন টিকে আছে। প্রধান ফটকটাই আকর্ষণীয় বেশি। তার দুপাশে রাজবাড়ির কেয়ারটেকার, তার পরিবারসহ থাকতেন। সেই ফ্যামিলির সবাই আমাকে খুব ভালো করে চিনতেন। ঢুকবার মুখেই কেয়ারটেকারের স্ত্রী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছি, আমার আম্মি ভালো আছে কিনা ইত্যাদি। আমি অল্প কিছু উত্তর দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাই।

কেয়ারটেকারের স্ত্রী আমাদের বেশি ভেতরে যেতে মানা করেন। এমন মানা আগে অনেকবার শুনেছি, তাই গ্রাহ্য করলাম না। সেই মহিলাকে পুরো রাজবাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখাই—পুরনো সিন্ধুক, কুয়া, মন্দির, ফাঁসিঘর (শোনা কথা, ঘটনার সত্যতা জানি না), নর্তকীর ঘর, বলরুম ইত্যাদি। অনেক সুন্দর জায়গা ছিল, কিন্তু ঐ মেয়েটির উচ্ছ্বাস ছিল না তেমন, কেমন যেন নির্লিপ্ত একটা ভাব। আমাদের সাথে চলছে, কিন্তু আমাদের কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছিল না।

হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, “উপরের দিকে উঠবেন?” ঐটা ছিল সীমানার শেষ দিকের বিল্ডিং, আর ঐ বিল্ডিংয়ের ভেতরের অংশ ধসে গিয়েছিল, তাই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, একজন অতিথি যেতে চাচ্ছিল, তাই আপত্তি করলাম না। বরঞ্চ আর উৎসাহের সাথে দেখাতে নিয়ে চললাম।

হঠাৎ দেখি, কেয়ারটেকার চাচ্চু আমাদের নিচ থেকে ডাকছেন। “আরেহ মা রা!! তোমরা এখানে কেন? নাম, জলদি নাম!” এই বলে তিনি নিজেই উপরে উঠে এলেন এবং আমাকে কোলে করে, এবং আমার সঙ্গিকে হাত ধরে ধরে নামিয়ে নিয়ে আসলেন। আমরা দুজনই খুব ভয় পাচ্ছিলাম। তিনি যদি এই কথা আব্বুকে বলে দেন তাহলে কপালে পিটটি আছে।

ওহ, ঐ মেয়েটার দিকে তখন আর আমাদের দৃষ্টি ছিল না। নিজের ব্যাপার নিয়েই বেশি ভাবছিলাম। গেটের সামনে এসে কেয়ারটেকার চাচ্চু, তার স্ত্রীর দিকে ধমক দিতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, “এরা ভেতরে গেলো কিভাবে? গিয়ে একেবারে ভাঙ্গা ছাদে উঠছে! যদি সেখান থেকে পড়ে যেত তাহলে কি হতো?” এবার আমার দিকে ফিরে বললেন, “তুমি যদি পড়ে যেত তাহলে কি হতো? বল! আমি কিভাবে তোমার আব্বাকে বলতাম?” আর কখনো এতো ভেতরে যেও না, জায়গাটা ভালো না। এরপর তিনি আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেলেন।

আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একছুটে মাঠে চলে গেলাম যেন আম্মি কিছু বুঝতে না পারে। ছোট ছিলাম, তাই ব্যাপারগুলো ভুলে গেছিলাম খুব দ্রুত। কিন্তু এখন, এই বয়সে এসে কিছু ব্যাপার খুব গোলমেলে লাগে। কিছু ব্যাপার শেয়ার করতে চাচ্ছি:

১. মেয়েটাকে আমি আগে কখনো দেখিনি।
২. তার হাতে কিছু ছিল না, মানে কোন ব্যাগ বা এই জাতীয় কিছু ছিল না, কিন্তু সে নিজেকে একজন ট্যুরিস্ট বলে পরিচয় দেয়।
৩. ঢোকার পথে কেয়ারটেকার চাচ্চুর স্ত্রী শুধু আমার আর আমার সঙ্গীর সাথে কথা বলছিলেন, ঐ মেয়েটিকে তিনি কিছু জিজ্ঞেস করেননি।
৪. ভেতরে যাবার পর মেয়েটা আমাদের কথার খুব একটা জবাব দিচ্ছিল না। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার, আমি তার মতিগতি খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করিনি।
৫. যখন কেয়ারটেকার চাচ্চু আমাদের বোকা দিচ্ছিলেন, তিনি ঐ মেয়েটার দিকে ভ্রুক্ষেপও করেননি। কিন্তু এমন অবস্থায় অবশ্যই একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষকেই প্রথমে বোকা দেয়াটা যৌক্তিক। তার মানে কি, চাচ্চু তাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না?
৬. আমি তাকে এরপর আর দেখিনি। আমি জানি না, সত্য ঘটনা বা এর পিছনে কি লুকিয়ে আছে। তবে, আমার সেই সঙ্গীটি এই ঘটনার কিছুদিন পর ভয়ানক জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং ১১ দিনের মাথায় মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে সে কিছু একটা দেখতে পেত এবং সে বলেছিল, সে ভয় পেয়েছে—মারাত্মক ভয়, সেই রাজবাড়িতেই।

►রক্তমাখা হাত◄

►বন্ধুত্ব◄

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *