রাত ১০:৩৭৷ হামিদুর রহমান সাহেব মোহাম্মদপুর এলাকার খিলজী রোডে এক নির্জন মাঠের পাশে দাড়িয়ে আছেন৷ পুরান ঢাকার লালবাগে ছোট একটা চাকরি করেন হামিদুর রহমান৷ যে বেতন পান, তা দিয়ে ৩ ছেলে মেয়ের সংসার চালানো অনেক কঠিন৷ বাধ্য হয়েই কোম্পানী তে তাকে ওভারটাইম কাজ করতে হয়৷ জিনিসপত্রের দাম তো কখনো কমেনা৷ প্রতিদিনের মত আজ ও কাজ শেষ করে তিনি এই মাঠের পাশের রাস্তায় দাড়িয়ে আছেন রিকশার অপেক্ষায়৷ অত তাড়া নেই৷ কিছুক্ষন মাঠের ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করেন মাঠের বাউন্ডারির পিলারের উপর বসে৷ রাস্তাটাও মোটামুটি নির্জন থাকে সবসময়৷ রাত হলে তো আরও খারপ অবস্থা৷ ছিনতাইকারীরাও কম যায়না৷ ২-৩ বার ধরাও খেয়েছিলেন৷ এখন আর ভয় পান না৷
রাত এখন ১০:৪৫৷ এখনও এদিক দিয়ে একটা রিকশা ও আসছেনা৷ অবশ্য এর আগে একটা রিকশা আসছিল৷ কিন্তু অনেক বেশি ভাড়া চায়৷ যাওয়া সম্ভব না৷
“কি ব্যাপার? আজ রিকশাওয়ালাদের কি হইল? ১১ টা বাইজা যাইতাছে একটার ও খবর নাই” নিজে অনেকটা বিরক্ত৷ বাসায় স্ত্রী তার জন্য অপেক্ষা করছে৷ এত দেরী হলে কি চলবে?
“আপনি কোথায় যাবেন?” পিছন থেকে অচমকা একটি লোক হামিদ সাহেব কে প্রশ্ন করেলন৷ পিছনে ফিরে হামিদ সাহেব দেখলেন এক বয়সী লোক, পাকা চুল আর দাড়ি৷ হাসিমুখে হাত বাড়িয়েছেন হাত মেলানোর জন্য৷
লোকটার হাসিমুখ একদম অমায়িক৷ হামিদ সাহেব এর আগে কখন ও এত সুন্দর মুখ আর হাসির কোন পুরুষ কে দেখেন নি৷ এরকম সুন্দর শুধু তার স্ত্রী কেই দেখেছেন৷ লোকটাকে কেন জানি অনেকিদনের চেনা জানাও মনে হচ্ছে কিন্তু ……..থাক……এখন ভাল লাগলেই তো আর হবেনা৷ লোকটা তো অপরিচিত৷ হামিদ সাহেব ভাবতে লাগলেন ছিনতাইকারীদের কথা৷ তবুও লোকটার সাথে হাত মেলালেন৷
“জ্বী, আদাবর যাব৷ কিন্তু আপনি……..”
“আমি এই সামনের বাড়ীতেই থাকি৷ এই সময় আমি সবসময়ই এখানে আসি৷ আপনাকে প্রায়ই দেখি এই সময় এই মাঠের পাশে দাড়াতে৷ তাই একটু আগ্রহ বশতই……..”
“তাই তো আপনাকে চেনা লাগতেছে৷ আপনাকে আমি এখানেই কোথাও দেখেছি৷৷”
“আপনি এখন বাসায় যাবেন? কিন্তু আজ এই এলাকায় রিকশাওয়ালাদের একটা ধর্মঘট চলছে৷ আপনি তো এখন রিকশা পাবেননা৷”
“কিসের ধর্মঘট?”
“আপনি জানেন না বুঝি! গতকাল এলাকায় রাতে এক রিকশাওয়ালা নিঁখোজ হয়৷ সবাই এ জন্য মালিক কে দায়ী করে এ ধর্মঘট করে৷”
“ও৷ জানতাম না”
“আচ্ছা আমি আপনার জন্য একটা ব্যবস্থা করছি৷”
“না ধন্যবাদ৷ আমি অন্য ব্যবস্থা করব”
“এসব কি বলছেন? আপনার বিপদে আমি আপনাকে সাহায্য করবনা!! আপনি আমার বাসায় আসেন৷ চা নাস্তা খান৷ আমি নুরু কে বলি আপনার পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে” হমিদ সাহেব প্রথমে যেতে রাজি হননি৷ অনেক বিনয়ের সাথে লোকটি অনুরোধ করাতে হামিদ সাহেব তার সাথে যেতে রাজি হলেন৷
নুরু ঐ বাড়ীর কাজের লোক৷ কিন্তু কি কাজ করে তা বঝা দায়৷ একটা পা নেই৷ দেখে মনে হচ্ছে পা টা কেটে ফেলা হয়েছে বা কাটা পড়ছে৷
হামিদ সাহেব বাড়ীতে ঢুকতেই অনেক অবাক হলেন৷ কিছুটা ভয় ও পেলেন৷ বাড়ীটা অনেক পুরানো৷ বিশাল এক ড্রইং রুমের এক কোণে ৬০ ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলছে৷ যা ঘরটিকে খুব অল্পই আলোকিত করতে পেরেছে৷ বিশাল ড্রইং রুম এর আর এক কোণে বৃত্তাকার কাঠের সিঁড়ি ৩ তলা পর্যন্ত উঠে গেছে৷ আসবাবপত্র গুলো অনেক পুরানো মনে হল৷ ৬০ ওয়াটের সেই বাল্ব ছাড়া পুরো বাড়ীটাই অন্ধকার মনে হল৷
হামিদ সাহেবের জন্য কিছু চা নাস্তার ব্যবস্থা করে নুরু বের হয়ে পড়ল৷ “আপনি এই বাড়ীতে একলাই থাকন?”
“কোথায় একলা? এই যে নুরু আছে৷ আমার সকল কাজ তো ওই করে দেয়৷ ওর জন্য খুব মায়া হয়৷ ওর একটা পা……”
“কি হয়েছিল ওর পায়ের?”
“ট্রেনে কাটা পড়ছে৷ ওর অনেক কষ্ট হত দেখে আমার সাথেই রেখে দিছি”
হামিদ সাহেব আর লোকটির মধ্যে অনেক কথা হল৷ হামিদ সাহেব বললেন তার অভাবের জীবনের কথা আর লোকটি তার নি:সঙ্গতার কথা৷ তার এক ছেলে মারা গেছে৷ স্ত্রী গত হয়েছে বহুবছর৷ এভাবেই তাদের গল্প চলতে থাকে৷ রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু গল্প শেষ হয়না৷ নুরু ও আসছেনা৷
এক সময় লোকটি বলল “আমার এই সম্পত্তি কোন কাজে আসবেনা৷ আমি আমার সব তোমার নামে লিখে দেব৷ তুমি নিবে?”
হামিদ সাহেব অবাক হলেন৷ “আমি আপনার সম্পত্তি কেন নেব?”
“দেখ হামিদ, তুমি আমার ছেলের মত৷ আর আমি জানি তুমি অনেক অভাবে দিন কাটাও৷ আমার এ সম্পত্তি তো দেখার কেউ নেই৷ তুমি মানা কইর না৷আমি আর কয়দিন বাঁচব?”
হামিদ সাহেব অজানা এক কারণে নুরুর কথা ভুলে গেল৷ তিনি ভাবলেন অভাবের সংসারে যদি একটু আনন্দ……..৷
“তবে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে৷”
“আচ্ছা বলুন কি কাজ?”
হামিদ সাহেব লোকটির সাথে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠলেন৷ পুরো অন্ধকার একটি করিডোর পেরিয়ে একটি রুমে ঢুকে লোকটি টর্চ লাইট দিয়ে একটি ট্রাংক দেখিয়ে বললেন “এই টাংকের ভিতর কি আছে? বা কি থাকতে পারে? যত ইচ্ছা সুযোগ নাও৷ কাছাকাছি গেলেও চলবে৷ পারলে সম্পত্তি তোমার৷”
অনেক চেষ্টা করলেন৷ বিরক্ত ও হলেন৷ কিন্তু লোকটার বিষন্ন বদন যেন সব কথা বলে৷৷
“পারতেছিনা আর পারতাছিন৷ আমারে ছাইরাদেন৷ লাগবনা আমার কিছু”
“তাহলে ট্রাংকের ভিতর কি আছে এটা তো জেনে যাও”
লোকটা ট্রাংক খুলল৷ সঙ্গেসঙ্গেই উৎকট পচা মাংসের গন্ধ বেরুলো৷ ”এইটা!!??…………..”
“এইডা আমার সন্তান……আপনেরে এখন ওর লাগব৷
“আমারে ছাইড়া দেন ভাই৷ আমার ঘরে বউ বাচ্চা আছে৷ আমার লাইগা অপেক্ষা করতাছে৷”
]]]]]
রক্তমাখা জামা পাল্টিয়ে এক তৃপ্তির ঘুম দিল লোকটি৷ আরও কয়েকদিন আরামে ঘুমানো যাবে৷
পরশু সকালের পত্রিকা দেখে লোকটির সেই অমায়িক হাসি আবার দেখা গেল৷
“রাজধানীতে হামিদুর রহমান নামে এক ব্যাক্তি নিঁখোজ”
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।