►চতুরঙ্গ – শেষ পর্ব◄

“ জাহিদকে আমি আপনার সাথে দাবা খেলতে দেখেছি স্যার। ছাদে, উল্টো ভাবে……।

আপনি বোধ হয় বুঝতে পারছেন আমি কাকে বোঝাচ্ছি। আমার খুব কাছের বন্ধু। হাসপাতালে আপনারা মিট করেছিলেন……”

“ জানি। তোরাব চাচার নাতি সে-ই। হাসপাতালে ওকে পেয়ে খুব অবাক হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমাকে চিনবে ও। কিন্তু একেবারেই চিনতে পারেনি। একটা নতুন ফ্যামিলিতে অ্যাডপ্ট করা হয়েছিল বোধ হয় ওকে। কারণ আমার জানা মতে অনাথ ছিল ছেলেটা।” কপাল ডললেন চিন্তিত ভাবে।

“ আপনাকে চিনতে পারেনি ঠিক আছে। কিন্তু ছাদ থেকে ঝুলে আপনার সাথে দাবা খেলার ব্যাপারটা বুঝলাম না। এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটার সাথে জাহিদ জড়াচ্ছে কি করে? আমি যতটা ওকে চিনি- ও অনেক সহজ সরল একটা ছেলে। পড়া শোনা আর কবিতা লেখা-লেখি ছাড়া জীবনেও ওকে আর অন্য কিছু করতে দেখিনি। দাবা খেলা তো দূরের কথা।” ভ্রুঁ কুটি করলাম।

ডাঃ এমরান দু’হাতের আঙ্গুল গুলো এক সাথে লাগিয়ে মোচার মত করে সেটার দিকে তাকালেন, “ তুমি তো বুঝেই গেছো আমি ছোট খাটো একটা ক্ষমতা হঠাৎ করেই পেয়ে গেছি। এটা ক্ষমতা না অভিশাপ সেটাই জানি না……” একটু থামলেন। আমি কিছু বললাম না, কেবল কৌতুহলি চোখে তাকিয়ে রইলাম।

“ ক্ষমতাটা পাওয়ার অল্প কিছুদিন পরের কথা, তখনো আমি ক্ষমতার ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। হঠাৎ করেই একদিন লক্ষ করলাম – আমার ব্যক্তিগত ডায়েরীতে ভিন্ন ভিন্ন হাতের লেখা। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ঘটনাটা কি ঘটেছে। আমি ভেবেছি কেউ আমার অগোচরে আমার ডায়েরী খুলে তাতে হাবি জাবি সব অংক, ফিজিক্স এসব লিখে ভরিয়ে দিয়েছে। যে গুলোর আগা মাথা আমি কিছুই বুঝি না। কিন্তু কার এমন ঠেকা পরল যে আমার ডায়েরীতে এসে অংক নিয়ে গবেষণা পত্র লেখতে যাবে? খুব অবাক হলাম। এরকম ঘটনা পর পর তিন দিন ঘটল।” দাঁড়িতে আঙ্গুল চালালেন অস্বস্তি নিয়ে।

“ বুঝলাম না! আপনার ডায়েরীতে অন্য মানুষ লিখবে কেন?” আমি অবাক গলায় বললাম।

“ কথাটা সেখানেই। আমার খঁটকা লাগল। এই বিশাল বাড়িতে কাজের মানুষ তিন জন ছাড়া আর কেউ থাকে না। আর তারাও সবাই বিশ্বস্ত। বহু দিন ধরে এখানে আছে। আমার অজান্তে এসে আমার ডায়েরীতে লিখবে- এটা পুরোপুরি অসম্ভব! তার ওপর ডায়েরীটা থাকে আমার বালিশের নিচে। কেউ এসে যে ওটা নেবে- সেটাও সম্ভব না। তাই পরের রেতে জেগে রইলাম সারা রাত। সারা রাতে কেউ এল না আমার ঘরে। শেষ রাতে তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিল। অল্প সময়ের জন্য চোখ বন্ধ করেছিলাম। হঠাৎ চোখ মেলতেই দেখলাম বিছানার ওপর ডায়েরীটা পরে আছে, খোলা- তাতে নতুন নতুন সব ফিজিক্সের আংক! আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এত কম সময়ে কে এল- আর লেখলোই বা কি এসব? ব্যাপারটা নিয়ে আমি এত চিন্তায় পড়ে গেলাম যে আমার এক প্রোফেসর বন্ধুকে ডায়েরীটার লেখা গুলো পাঠিয়ে দিলাম ফ্যাক্স করে। ফিজিক্সের টিচার ও, ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটেতে পড়ায়- ড. নিকোলাস অগাস্টাস। সে তো ফ্যাক্স পেয়ে পরের ফ্লাইটেই বাংলাদেশে এসে হাজির! আমি তো তাকে দেখে অবাক! আমার বাড়িতে এসেই আমাকে বলে বসল, “ কে লিখেছে এটা? যে লিখেছে তাকে আমার সামনে হাজির করো! তাকে আমার চাই! সে সায়েন্সের কি বিশাল বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছে নিজেও জানে না।”

আমি তার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না। কিছুক্ষন পর একটু ধাতস্থ হয়ে আমাকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে লাগল নিকোলাস। যা বোঝালো তার সারমর্ম হলঃ এই ডায়েরীতে লেখা অংক গুলো হল স্পেস টাইমিং এবং গ্র্যাভিটি বিষয়ক একটা এম্যানুস্ক্রিপ্ট প্যাপার, গবেষণা পত্র। যদিও অর্ধেক, কিন্তু সায়েন্স ওয়ার্ল্ডে হূল স্থূল ফেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এক বস্তু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কিভাবে মুহূর্তেই চলে যাবে, এবং তার গ্র্যাভিটিকে কিভাবে সেই হাইপার ডাইভের জ্বালানি কিংবা বল রুপে ব্যবহার করবে- তার বিশাল বর্ণনা। আমি নিজে ডাক্তার মানুষ, এক সময় আগ্রহ করে এইচ.জি.ওয়েলসের বই পড়ার সময় ঝোঁকের বশে ফিজিক্স নিয়ে এক আধটু নাড়া চাড়া করেছিলাম। টুকটাক লেখা লেখি করতাম বলে পড়তে হত। ব্যস এটুকুই। কিন্তু এত কঠিন ফিজিক্স বোঝার মত জ্ঞান আমার নেই। তাই নিকোলাসের সব কথা বুঝতে পারলাম না।

নিকোলাস আমাকে জিজ্ঞেস করল কে লিখেছে এটা? আমি কিছুই চাপলাম না। বলে দিলাম সব। খুব অবাক হল নিকোলাস। কি যেন ভাবল অনেক্ষণ ধরে। তারপর বলল রাতে সে আমার বাড়িতেই থাকবে। কে এসে লেখে যায় বের করা দরকার। আমিও তাই চাচ্ছিলাম। বলার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম।

সেদিন বিকালেই সারা বাড়িতে দশ বারোটা ক্লোসড সার্কিট ক্যামেরা বসিয়ে দিল নিকোলাস। বিজ্ঞানী ভদ্রলোক আসলেও ক্যামেরা এড়িয়ে আসতে পারবে না। ধরা পড়তেই হবে ক্যামেরার চোখে।

সব ঠিক করে রাতে খাওয়ার পর অপেক্ষা করতে লাগলাম দু’জনে। বসে আছি তো আছিই। কোনো কিছুই হল না। নিকোলাস লম্বা জার্নি করে এসেছিল। তাই ক্লান্ত ছিল। জেগে থাকতে পারল না। ঘুমিয়ে পড়ল খুব তাড়াতাড়ি। আমিও বসে বসে ঢুলতে লাগলাম ঘুমে।” দম নেয়ার জন্য থামলেন।

আমি বসে আছি। অপেক্ষা করছি ওনার বাকি কথা গুলো শোনার জন্য। জাহিদের প্রসঙ্গ থেকে এই প্রসঙ্গে চলে আসার ব্যাপারটা এখনো বুঝতে পারছি না। কিন্তু চুপ থাকলাম।

ডাঃ এমরান বলা শুরু করলেন আবার, “ পরদিন সকালে নিকোলাসকে হিষ্টোরিয়া রোগীর মত কাঁপতে কাঁপতে পাগলের প্রলাপ বকতে দেখা গেল। রীতিমত উন্মাদ হয়ে গেছে! দু-তিন জন মিলেও ধরে রাখা যাচ্ছে না। বারবার আমাকে দেখিয়ে বলছে, “ He’s not a human! something else! I saw him that he was walking on the roof of the hall room! It seems like – he was hanging from the roof!”

আমি তো হতবাক ওর কথা শুনে। কি বলে এসব? কোনো মতে ওকে হাসপাতালে পাঠিয়ে সি.সি. ক্যামেরা গুলোর ভিডিও দেখতে বসে গেলাম। কি এমন দেখেছে ও যে এরকম ভয় পেল?

ভিডিও দেখতে গিয়ে আমি নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মনিটরের মধ্যে আটটা ভাগ, আমার পুরো বাড়িটার ভেতর বাহির সব দেখা যাচ্ছে। আবছা অন্ধকার। ভিডিওর প্রথম কয়েক ঘন্টা সব কিছু স্বাভাবিক, স্থির, চুপচাপ। তার পরেই ঘটনাটার শুরু। আবছা অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে রাত প্রায় আড়াইটার দিকে আমার দোতলার রুমের দরজা খুলে ভাসতে ভাসতে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি। হাতে কলম আর ডায়েরীটা। নভোচারীদের মত শূণ্যে ডিগবাজি খেয়ে সোজা হল রুমের ছাদের দাবা বোর্ডের দিকে উঠতে লাগলাম। গিয়ে ঝুলে পড়লাম উল্টো ভাবে। গম্ভীর মুখে হাটতে হাটতে ডায়েরীতে লিখে যাচ্ছি কি যেন! এবং লিখছি আমার বাম হাত দিয়ে! যদিও আমি রাইট হ্যান্ডেড!

আমি বজ্রাহতের মত বসে রইলাম। নিকোলাস সরাসরি আমাকে এ অবস্থায় দেখেছে কাল রাতে! কারণ আমি ভিডিওতেই দেখতে পেলাম নিকোলাসের ভয়ার্ত চিৎকার- হল রুমের নিচে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে। আর ছাদে ঝুলে থাকা “আমি” খুব বিরক্ত হয়ে নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে ইসারা করতেই নিকোলাস শুণ্যে উঠে ঝুলতে থাকল বিচিত্র ভঙ্গিতে! চেঁচাচ্ছে সে অবস্থাতেই!

আমি সেদিনই প্রথম আবিষ্কার করি আমার Split personality বা দ্বৈত সত্ত্বা রয়েছে। রোগটা কবে থেকে হয়েছে আমি নিজেও জানি না। যেখানে নিজের ভেতরেই আরো একটা অস্তিত্ব সৃষ্টি হয়েছে! আমি ঘুমিয়ে পড়লেই ওটা জেগে ওঠে। সেই অস্তিত্বটাই এতদিন বাম হাতে আমার অজান্তেই ডায়েরীতে এসব লিখে এসেছে!” থামলেন ডাঃ এমরান।

আমি প্রায় শোনা যায় না এমন ভাবে আস্তে আস্তে বললাম, “ আমার অ্যাক্সিডেন্টটা আসলে আপনার Split personality’র ঐ অংশটা ঘটিয়েছে- তাই না স্যার?” গলার স্বরই বলে দিলো আমি ভয় পাচ্ছি।

ডাঃ এমরান কাঁশলেন খুঁক খুঁক করে, “ দুঃখ জনক হলেও ব্যাপারটা সত্যি। সেরাতে আমি তোমাকে বারবার চলে যেতে বলেছিলাম, ভয় পাচ্ছিলাম রাতে আমার ওই অংশটা জেগে উঠলে তোমার ক্ষতি করতে পারে। তাই। কিন্তু তুমিই শুনলে না কথাটা।”

আমি ভয়ার্ত চোখে তাকালাম তাঁর দিকে, “ অন্যদিন ক্ষতি না করে সে রাতেই করতে গেলেন কেন?” নিজের কাছেই নিজের কন্ঠটা কেমন বেখাপ্পা শোনালো।

“ সে রাতে জয়নাবের ডোর বেলটা ভেঙ্গেছিলে তুমি, আর আমি কষ্ট পেয়েছিলাম তখন- তাই।” নির্লিপ্ত গলায় বললেন।

আমি ঢোক গিললাম, “ তাহলে আমাকে মিথ্যা বলেছিলেন কেন? যে আমি সম্মোহিত হয়েছি?”

“ ভয় পাবে তাই বলতে চাই নি।” পানির গ্লাসটার দিকে হাত বাড়ালেন। খালি ছিল সেটা। আমি উঠে গিয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে দিলাম তাঁকে। এসে আবার বসলাম টুলে, “ আর জাহিদের ব্যাপারটা কি?” জিজ্ঞেস করলাম।

পানি খেতে খেতেই বললেন, “ এখনো বোঝোনি? ওর-ও একই সমস্যা আছে। স্প্লিট পারসোন্যালিটি ডিসওর্ডার। বিচিত্র কোনো কারণে ওর অন্য অস্তিত্বটা আমার সঙ্গে দাবা খেলে। মানে আমার অন্য অস্তিত্বের সাথে দাবা খেলে। হারানোর জন্য। সেদিন হাসপাতালে পরিচয়ের সময়েই বোধ হয় ওর অন্য সত্ত্বাটা আমাকে চিনেছিল।”

“ আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না স্যার।” বিভ্রান্ত গলায় বললাম।

“ জাহিদের অন্য সত্ত্বাটা অসম্ভব স্ট্রং। বলতে পারো ওর ক্ষমতাটার সামনে আমার কোনো শক্তিই নেই। গ্র্যাভিটিকে ফোর্স বানিয়ে হাইপার ডাইভ দেয়ায় রীতিমত ওস্তাদ জাহিদের অন্য অস্তিত্বটা। এ জন্যই ওকে হঠাৎ করেই এখানে সেখানে চলে আসতে দেখা যায়। নিজের অজান্তেই করে। অবশ্য তুমি দেখেছো কিনা সেটা জানি না।” এক মুহূর্ত থামলেন। “ ছাদের বিশাল দাবা বোর্ডে ওর সঙ্গে খেলা হওয়ার কথা ছিল। অনেক ছোট বেলা থেকে। ওর দাদুই সেটা বলে গিয়েছিলেন। কখন, কিভাবে বলেছেন জানি না। জাহিদ ভূলে গেলেও ওর অন্য অস্তিত্বটা ভোলেনি। সেটাই খেলবে জাহিদ।”

“ কবে?”

“ আজ রাতেই হওয়ার কথা ছিল। অন্তত আমার ডায়েরীতে আমার অন্য অস্তিত্বটা সে কথাই লিখে গেছে।” টেবিলের ওপর থেকে তাঁর ডায়েরীটা তুলে একটা পাতা খুলে দেখালেন।

দেখতে পাচ্ছি এখান থেকেই, সেখানে অন্য কারো হাতের লেখাঃ

“ ২৬ আগস্ট রাত সাড়ে আটটায় জাহিদের সঙ্গে বড় বোর্ডে দাবা খেলা হবে।”

আমি বিড়বিড় করে বললাম, “ এটা আপনার অন্য অংশের লেখা?”

“ হ্যা।” হাসতে লাগলেন হঠাৎ, চিকচিক করে উঠল ডাঃ এমরানের চোখ।

আমি মূর্তির মত বসে রয়েছি। মাথা কাজ করছে না আমার। আবার বিড়বিড় করলাম, এসব কেন হচ্ছে স্যার?”

হাসতে লাগলেন মিটিমিটি। চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন রহস্যময়। আমি টুল ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। আমার মাথা ঘুরছে, অসুস্থ গলায় বললাম, “ আপনি এর ব্যাখ্যাটাও জানেন?”

উনি জবাব না দিয়ে বসে রইলেন কাঠের চেয়ারে। চোখে রহস্যময় সেই হাসি।

“ স্যার প্লিজ?” অনুনয় করে বললাম, চোখে পানি এসে গেল।

“ সব ক’টা জিনিসের ব্যাখ্যা জানতে নেই নোভেরা। মানুষকে তার জ্ঞান আর মেধা খাঁটিয়ে সেটা আবিষ্কার করার সুযোগ দেয়া উচিত। তুমি আসতে পারো- আমার নামাযের সময় হয়ে গেছে।”

আমি নিজের অজান্তেই ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে দৌড়ে চলে এলাম।

 

সে রাতে হল রুমে তালা লাগিয়ে যখন চলে আসবো- ছাদের দিক থেকে ইকামাত দেয়ার শব্দ শোনা গেল। কন্ঠটা খুব পরিচিত লাগলো। কিন্তু কার মনে পড়ল না। আমি ফিরে তাকালাম। অন্ধকারের মাঝে দেখা যাচ্ছে, ছাদের দাবা বোর্ডে উল্টো হয়ে অসংখ্য সাদা পোশাক পরা মানুষ জামাতে নামাযে দাঁড়িয়েছে! কোথাও কোনো মূর্তি নেই! ইমামের পেছনে নীল শার্ট পরা কেউ একজন দাঁড়িয়েছে, নিচ থেকেও চিনতে পারলাম- জাহিদ! এবং ইমাম আর কেউ নন- ডাঃ এমরান!

আমি জানি নামাযের পরেই হয়ত সেই বড় খেলাটা শুরু হবে…… আমি দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার কাছে। দেখতে পাচ্ছি লম্বা নামাযটা শেষে সাদা পোশাক পরা মানুষ গুলো মিলিয়ে যাচ্ছে….. দাবা বোর্ডে আগের মূর্তি গুলো একে একে ফিরে আসছে…… যেন বোর্ড ফূঁড়ে গজিয়ে উঠল।

আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি দ্রুত। দেখতে পাচ্ছি দাবা খেলার শুরুর সমত যেভাবে ঘুটি সাজানো হয়- তেমন ভাবে ঘুটি সজ্জিত হচ্ছে আপনা আপনি। অভাব থাকা ঘুটিটা হিসেবে হল রুম থেকে বেশ কিছু মূর্তি শূণ্যে উথে যাচ্ছে! গিয়ে ছাদের ওই ঘর গুলোতে বসছে নিজে নিজে! আমি নিজের পায়ের ওপর ভর রাখতে পারছি না। ওপরে খেলা শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে বাহিরে প্রকৃতিও যেন ঝড়ের তান্ডব লীলা শুরু করেছে! বজ্রপাতের আলোয় দেখা যাচ্ছে মূর্তি গুলো যুদ্ধের ময়দানের মত একটা আরেকটাকে গিয়ে প্রচন্ড জোরে আঘাত করে গুড়িয়ে দিচ্ছে। উপর থেকে ভেঙ্গে সেগুলো হল রুমের ফ্লোরে আছড়ে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে! চারপাশে ধূলো বালুর ঝড় হল রুমের ভেতর! যেন যুদ্ধ লেগেছে!

ডাঃ এমরান ছাদের এক মাথায় ঝুলে আছেন- অন্য মাথায় জাহিদ। দু জনের চোখেই অদ্ভূত উল্লাস ভরা রহস্যময় একটা হাসি…..

সমস্ত বাড়ির জিনিস পত্র গুলো মাটি থেকে দু তিন হাত ওপরে উঠে যাচ্ছে, আবার নেমে বসে যাচ্ছে…… আমার ভয়টা ছড়িয়ে পরছে দ্রুত সারা শরীরে….. ওপরে ছাদের দাবা বোর্ডের অতি প্রাকৃত খেলাটা আমার ভেতরে আতংকের সৃষ্টি করছে ক্রমশ…… তার থেকেও ভয়ংকর ব্যপার হল হল রুমের অল্প আলোতে দেখা যাচ্ছে শাড়ি পরা, মাথায় স্কার্ফ দেয়া একজন মহিলা এলোমেলো জিনিস পত্র গুলোকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছেন….. জয়নাব আরা!

আমি অস্বাভাবিক রকম আতংকিত হয়ে পাগলের মত দৌড়াতে লাগলাম। মিউজিয়ামের পরিধি যেন বাড়ছেই….. পথ আর শেষ হচ্ছে না……

লনের সব গ্রীক দেবতা মূর্তি গুলো সে রাতে মাটি থেকে দু তিন তলা উঁচুতে ভাসছিল লনের ওপর- আমি যখন পালাচ্ছিলাম…….

 

সেদিনের পর আমি ডাঃ এমরানের মিউজিয়ামের চাকরি ছেড়ে দেই। বলা বাহুল্য ডাঃ এমরানের সঙ্গেও আর দেখা করিনি। আমি সুস্থ থাকতে চাই। পাগল হয়ে মরতে চাই না। আমার ধারণা ওই বাড়ির বাকি তিন জন মানুষ ডাঃ এমরানের এই অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে জানে। নইলে কখনই তাদেরকে কাছে পাই নি কেন?

আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসার অনেক দিন পর আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন ডাঃ এমরান। তিনি হাসপাতালে ভর্তি তখন। খুব অসুস্থ। মেরুদন্ডে ভর রাখতে পারেন না এখন আর। শুয়ে শুয়ে থাকতে হয় তাঁকে। এসব ফোনে জেনেছিলাম নার্গিসের কাছ থেকে। দেখা করতে যাইনি।

ডাঃ এমরান এক পৃষ্ঠায় কাঁপা হাতে পেন্সিল দিয়ে চিঠি লেখেছিলেন। শুয়ে থেকে কলম দিয়ে লিখতে পারেননি।

“ মা নোভেরা,

জানি হয়ত এ বুড়োর ওপর তোমার অভিমান কিংবা ভয় এ জীবনে যাবে না। তবুও বলি জয়নাবকে হারানোর এত বছরের বন্দী জীবনে তুমি ছাড়া কেউ আমার কাছে কখনো জেদ ধরে বাচ্চাদের মত কেঁদে ফেলত না। কখনো কেউ জিজ্ঞেস করত না ‘শুঁকিয়ে এ কি অবস্থা করেছেন শরীরের?’ তুমি যখন জিজ্ঞেস করতে বড় মায়া লাগত। খুব কষ্টে চোখের পানি আড়াল করতাম। কাঠ খোট্টা মানুষের চোখে পানি মানায় না। তোমার সাথে জয়নাবের একটা মিল ছিল- সে যখন তখন আমার সাথে কথা বলার জন্য টুল টেনে বসে পড়ত। সেখানে চেয়ার থাকলেও টুলেই বসত। সারা বাড়িতে টুল আর টুল ছড়িয়ে রেখেছিল সে। অবাক লাগছে? এই বুড়ো এত কিছু খেয়াল করত? হাঃ হাঃ! তাহলেই বোঝ, আমি কতটা চুপচাপ একা একা সময় কাটাতাম যে তোমাকে এতটা লক্ষ করার সময় পেয়েছি। ব্যস্ত হবার জন্য বোধ হয় মিল খোঁজাই ছিল আমার এক মাত্র কাজ।

আমি জানি আমাকে তুমি ভয় না পেলেও আমার চারপাশটাকে খুব ভয় পাও। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। আজ যা রহস্য- কাল তা সাধারণে পরিণত হবে। তুমি জাহিদ বিষয়ক একটা দো টানায় আছো জানি। তাই তোমাকে বলি। আমরা বিভক্ত। আমাদের আরো অস্তিত্ব রয়েছে। অনেক ‘তুমি’ আছো, অনেক ‘আমি’ আছি, অনেক ‘আমরা’ আছে। তুমি এগুলোকে যতই অস্বীকার করো না কেন, এড়াতে পারবে না। তাই এদের নিয়েই বসবাস করতে হয় আমাদের। কারণ এরাও ভালবাসার কাঙ্গাল।

অনেক স্নেহ আর ভালবাসা রেখে গেলাম তোমার জন্য। কে জানে এই ‘অনেকের’ মাঝে নিশ্চই কোথাও না কোথাও তুমি আমার সন্তান ছিলে। নইলে এতটা কষ্ট লাগে কেন?

-ডাঃ এমরান চৌধুরী”

চিঠি পাওয়ার তিন মাস পর মারা যান ডাঃ এমরান। আমি দেখা করতে যাইনি তখনো। কেবল একা একা কাঁদতাম। আমার দেখা পৃথিবীর সব চেয়ে ভাল মানুষটা মারা যাবার সময় আমাকে কাছে পাননি।

 

জাহিদের সঙ্গে আমার বিয়েটা হল আরো এক বছর পর। ও তখন একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চিফ ইঞ্জিনীয়ার পদে কাজ করছে।

রাতে জাহিদকে প্রায়ই বলি, “ তোমার সেই ‘পথের শেষ’ কবিতাটা শোনাবে?”

“ হঠাৎ?” খুশি খুশি গলায় বলে ও।

“ কটন বার্ডের প্যাকেটটা খুঁজে পাচ্ছি না। কানে ময়লা হয়েছে। পরিষ্কার করা দরকার। তোমার কবিতার মূল্য পাবলিক বুঝলে এতদিনে কটন বার্ডের কোম্পানি গুলো উঠে গিয়ে তোমার কবিতার ক্যাসেট বের করত।”

“ অ!” হতাশ গলায় বলে জাহিদ।

“ কি হল? বল?”

“ ও!” গলা খাকারি দেয় জাহিদ, বলা শুরু করে-

“ কতই শত টানা পোড়েন

নিত্য এ সংসার,

অশ্রু জলে সাজিয়ে তুমি

হারিয়ে যাবে আর?

একাই অনেক পথ হেটে আজ

হাত বাড়ালাম তাই,

পথের শুরুয় পাইনি তো কি?

পথের শেষে চাই।”

“ কবিতাটা তো অন্য রকম ছিল! শেষের লাইন দুটো বাদে।” অবাক হয়ে বলি।

মাথা চুলকায় জাহিদ, “ অ! তাই নাকি? ভূলে গেছি আগের লাইন গুলো। শেষের লাইন দু’টো মনে থাকে কেবল।”

“ অসুবিধা নেই। প্রত্যেক রাতে নতুন নতুন লাইন বানিও তুমি, কেবল শেষের লাইন দুটো ঠিক রেখো।”

“ কেন? শেষের লাইন দুটো বেশি ভাল?”

“ নাহ। ও দুটো শুনলে মনে হয় কানের পোঁকা বেরিয়ে গেল। তাই।” হেসে ওর চুল গুলো এলোমেলো করে দেই। জাহিদও হাসতে থাকে।

ঠিক এই সময়েই পাশের দোলনা থেকে আমাদের বাবুটা ‘ওয়া ওয়া’ শুরু করে দেয়। বলিনি তো, আমার একটা বাবু হয়েছে। ছয় মাস বয়স। নাম রেখেছি “বাবাই”।

ভাল নামটা বলবো না। বাবুদের বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত ডাক নামেই ভাল শোনায়। বড় নাম বললে মনে হয় বড় বড় মানুষ!

বাবাই ওয়া ওয়া শুরু করলে জাহিদ কৃত্রিম বিরক্তি নিয়ে বলে, “ ওহহো রে! মাম্মি- ডেডির রোমান্সের মাঝখানে ‘ওয়া ওয়া’ ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিক ক্যান? তোমার ছেলে তো বড় হলে ডি.জে. হবে দেখছি!”

তখন উঠে লাইট জ্বালিয়ে গিয়ে দেখি বাবাই মহা আনন্দে একটা নতুন দাবার ঘুটি নিয়ে খেলছে। ফোকলা মাড়ি দিয়ে সেটাকে কামড়াচ্ছে। আমাদের বাবাই প্রতি রাতে একটা করে দাবার ঘুটি পায়। আমি জানি কে দেয়। খুব যত্ন করে সে গুলোকে জমিয়ে রাখি আমি। আমাদের বাবাই বড় হলে দাবা খেলবে। আমি জানি, কেউ ওকে হারাতে পারবে না। অন্তত বাবাইয়ের দ্বিগ্বীজয়ী ফোকলা হাসিটা সেটাই বলে দেয়!

দ্রষ্টব্যঃ “চতুরঙ্গ” কোনও সত্য ঘটনার উপর নির্মিত নয়।। লেখক মূলত ঘটনাটি সপ্নে দেখেন এবং পরবর্তীতে সেটাকে গল্পে রূপান্তরিত করেন।।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!