ডাঃ এমরানের সঙ্গে দেখা করাটা খুব জরুরী হয়ে পড়ল। হাসপাতেলের ঘটনাটার পর আমি জ্ঞান হারিয়েছিমাল অল্প সময়ের জন্য। জাহিদ আর মিথিলা এসে চোখে মুখে পানি দিয়ে আমার জ্ঞান ফেরায়। জ্ঞান ফেরার পরপরই আমি ওদেরকে বাসায় চলে যেতে বলে ডাঃ এমরানের মিউজিয়ামের দিকে রওয়ানা দেই। জাহিদ আমাকে অসুস্থ শরীরে যেতে দিতে চাচ্ছিল না। কিন্তু আমি শুনলাম না। কারণ ডাঃ এমরানের সঙ্গে আগে কথা বলা দরকার। কথা না বলে আমি এক মুহূর্ত স্বাভাবিক থাকতে পারবো না। জাহিদ আমার সঙ্গে যেতে চাইলো – কিন্তু সেটাও নিষেধ করে দিলাম। কারণ ব্যাপার গুলো ওকে বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না, অবশ্য ওর জায়গায় আমি নিজে হলেও বিশ্বাস করতাম কিনা সন্দেহ আছে। আজগুবী এসব কথা বার্তা কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই হাসপাতেলের ব্যাপারটা চেপে গেলাম ওর কাছে। আর মিথিলা তো আগা গোড়া কিছুই জানে না, বলিনি। শেষে খালাকে বলে দিলে আমার চাকরি করা নিয়ে টানা টানিতে পড়ে যাবো।
আমাকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে জানালায় দু হাত রেখে সামনে ঝুঁকলো জাহিদ, সামান্য সন্দিহান গলায় বলল, “ তুমি শিওর যে তুমি ঠিক আছো? না হলে বল, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে পিছে পিছে আসি?”
মাথা নাড়াতে গিয়ে ব্যথাটা আবার টনটন করে উঠল, “ হুম। ঠিক আছি। তুমি চিন্তা কোরো না। ডাঃ এমরানের সঙ্গে দেখা করেই বাসায় ফিরে যাবো। তুমি মিথিলাকে বাসায় পৌছে দিও।”
একটা নিঃশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল, “ বাসায় ফিরে ফোন দিও বেগাম। রাতে আবার মিউজিয়ামে থেকে যেও না। আমি কিন্তু খুব সন্দেহ প্রবণ জামাই। যদি টের পাই আমাকে ছেড়ে ওই বুড়োর ঘাড়ে ঝুলে পরার তালে আছো- তাহলে কিন্তু পানি পথের চতুর্থ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।”
“ জানি।” মৃদু হেসে বিদায় জানালাম জাহিদকে। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল ড্রাইভার। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম জাহিদ চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। যতক্ষণ না চোখের আড়াল হলাম দাঁড়িয়ে রইল।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়।
উল্টো পাল্টা বাতাস শুরু হয়েছে। বৃষ্টি আসবে বোঝা যাচ্ছে। থেকে থেকে মেঘের গুর গুর শব্দ শোনা যাচ্ছে। ট্যাক্সি থেকে নামলাম মিউজিয়ামের সামনে এসে। সন্ধ্যার আলোতে দেখা যাচ্ছে আকাশে ঘন কালো মেঘ জমে কুন্ডলী পাঁকিয়েছে জীবন্ত প্রাণির মত, ঠিক দূর্গটার ওপর দিকে। খুব স্বাভাবিক দৃশ্যটাও বড় অবাস্তব লাগল।
সোলেমান আলী আমাকে দেখার সাথে সাথে গেট খুলে দিল, “ আপা এখন কেমন আছেন? মাথার ঘাঁ শুঁকাইছে?”
“ হ্যা এখন একটু ভাল আছি। তুমি কেমন আছো?” বাতাসে চুল বারবার উড়িয়ে মুখের ওপর এনে ফেলছে দেখে ওড়নাটা ভাল করে মাথায় চাপিয়ে নিলাম।
“ কি যে চিন্তায় ফালায়া দিছিলেন আপনি!” সরল হাসি হাসল। বিশাল দেহী এই মানুষটার হাসি দেখলে মনে হয় ছোট বাচ্চা হাসছে।
“ স্যার আছেন? নাকি বাহিরে গেছেন?”
“ না। আছেন। যায় নাই কোথাও। আপনারে দেখতে গত পরশু দিন হাসপাতালে গেছিলান একবার। তারপর আর কোথাও যায় নাই।” গেটটা আবার লাগিয়ে দিতে দিতে বলল।
আমি খোয়া বিছানো পথ ধরে বিশাল সবুজ লনের মাঝ দিয়ে দূর্গটার দিকে হেটে গেলাম। লনের মাঝে এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বড় বড় কালো মূর্তি, গ্রীক পুরাণের নানান দেবতা, দেবীর আদলে গড়া সেগুলো। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে লনের লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আজকে এখনো জ্বালানো হয়নি। আবছা অন্ধকারে মূর্তিগুলো খুব রহস্যময় লাগছে তাই। হাটার সময় বারবার মনে হচ্ছিল ওগুলোর আড়াল থেকে কেউ তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। অদ্ভূত একটা গা ছমছম করা অনুভূতি!
নার্গিস আশে পাশেই ছিলেন। ডোর বেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, “ ওফ! শান্তি পেলাম। আমি তো ভেবেছিলাম তোমাকে আর সুস্থ দেখবো কিনা! যে ভাবে মাথা ফেটে রক্ত দিয়ে ফ্লোর ভাসিয়ে দিয়েছিলে!” আমার হাত ধরে ভেতরে ঢোকালেন, “ আছো কেমন এখন?” শান্ত স্বভাবের এই মহিলাটির আন্তরিকতাটুকু খুব ভাল লাগল হঠাৎ।
আমি ওড়নার ওপর দিয়ে মাথার পেছন দিকে হাত বুলালাম নিজের অজান্তেই। চুলের আড়ালে ব্যান্ডেজটা ঢাকা পড়ে আছে। “ এখন একটু ভাল আছি…… স্যারের সাথে কিছু জরুরী কথা ছিল- উনি জেগে আছেন?”
“ মনে হয়। ওনার রুমের লাইট জ্বলতে দেখলাম একটু আগেও। স্যার তোমাকে নিয়ে কি যে দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন! পুরো দিশেহারা!” সিঁড়ির দিকে এগুতে লাগলাম দুজনে।
“ তাই?” ভাবলেশহীন কন্ঠে বললাম।
“ হ্যা। বারবার বলছিলেন- ‘মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে সারা জীবনেও ক্ষমা করতে পারবো না আমি’। নিঃসন্তান মানুষ তো, তোমাকে নিজের মেয়ের মত ভাবে।” সিঁড়ি পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়ালাম আমি। হল রুমের দরজাটা খোলা। তার মাঝ দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম পুরো হল রুম বহাল তবিয়তে রয়েছে! একটা জিনিসও এদিক সেদিক নেই! কোনো কাঁচের জিনিসও মিসিং নেই। অথচ সে রাতে তো কেয়ামত হয়ে গিয়েছিল! আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। এর মাঝেই আবার কারেন্ট চলে গেল। বাহিরে ভীষণ শব্দে বাজ পড়ছে। দূর্গের প্রতিটা ইট কাঁপছে থর থর করে। কাঁচের সব জিনিস পত্র ঝন ঝন করে উঠল।
অন্ধকারের মধ্যে নার্গিস বিরক্ত গলায় বললেন, “ দেখো দেখি কান্ড! সময় অসময় নাই কারেন্ট চলে যায়। তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি মোম জ্বালিয়ে আনি। জেনারেটরটা কয় দিন হল ঝামেলা করছে খুব। সোলেমান আজ সকালেই ঠিক করতে বসেছিল। কি জানি একটা পার্টস নতুন কিনে আনতে হবে। আজকে কেনা হয়নি। মোমবাতিই ভরসা আজকে।” অন্ধকারের মাঝে হারড়ে হাতড়ে চলে গেলেন তিনি। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম সিঁড়ির কাছে। অন্ধকারের মাঝেও কাঁচের জানালা দিয়ে বাহির থেকে আসা ম্লান আলোতে আবছা ভাবে ঘরের জিনিস পত্র গুলো দেখা যায়। আমি সিঁড়ির রেলিং ধরে গলা বাড়িয়ে দো’তলার ঘরের দিকে তাকালাম। অন্ধকার। ডাঃ এমরান কি করছেন কে জানে। নার্গিসও আসছে না মোমবাতি নিয়ে। অস্বস্তি লাগছে খুব। বাহিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কাঁচের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ চমকানোর সাদা আলো হঠাৎ হঠাৎ এসে দূর্গের ভেতরটাকে রহস্যময় করে তুলেছে।
হঠাৎ একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। আমি ছাড়া মিউজিয়ামের, অর্থাৎ হল রুমের দরজা কেউ খোলে না। তালার চাবি আমার কাছেই থাকে সব সময়। অন্য আরেক সেট চাবি থাকে ডাঃ এমরানের কাছে। আমি না থাকলে খুব একটা আসেন না তিনি এখানে। কিন্তু অন্য কারো এখানে আসার কথা না। তাহলে হল রুমের দরজা খোলা কেন? নাকি ডাঃ এমরান এসেছেন এখানে? কথাটা মাথায় আসতেই কৌতুহল হল। আবছা আলো ছায়ার মাঝ দিয়ে ত্রস্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম হল রুমের দরজাটার কাছে। নিজের অজান্তেই চোখ চলে গেল চার তলা ওপরের ছাদের দিকে। বজ্রপাতের সাদা আলোতে দেখা যাচ্ছে বিশাল দাবার বোর্ডে স্থির হয়ে ঝুলে আছে মূর্তি গুলো, কোনো স্পন্দন নেই। কেবল রহস্যময় একটা ভাব ওদের মাঝে।
অন্ধকারে ডুবে থাকা মিউজিয়ামটার ভেতর ঢুকতেই হাটুতে বাড়ি লাগল একটা ছোট কাঁচের মূর্তিতে। সতর্ক হয়ে গেলাম। পায়ে লেগে কোনো কিছু ফেলে দিয়ে ডাঃ এমরানের মিউজিয়ামের ক্ষতি করতে চাই না।
কেমন যেন একটা চাপা অস্বস্তি লাগছিল। ভূতুড়ে কিম্বা অবাস্তব কিছু একটা দেখবো- এরকম একটা ভয় করছিল ভেতরে ভেতরে। কাঁপা গলায় ডাকলাম, “ স্যার? ডাঃ এমরান? আপনি এখানে আছেন?”
কথা গুলো প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বিশাল হল রুমের দেয়ালে।
প্রায় সাথে সাথেই হল রুমের অন্য প্রান্ত থেকে ডাঃ এমরানের গলা ভেসে এল, “ কে? নোভেরা? এই অসময়ে তুমি এখানে?” গলা শুনেই মনে হল ভীষণ খুশি হয়েছেন আমাকে এখানে পেয়ে। আমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। অস্বস্তি জড়ানো গলায় বললাম , “ আপনি কোথায় স্যার? এই অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না।” পায়ের ভার বদল করলাম।
হল রুমের অন্য মাথা থেকে টর্চেরর আলো নড়া চড়া করতে দেখা গেল। “ দাঁড়াও, আসছি। লাইব্রেরীতে এসেছিলাম মাত্র। কারেন্ট যাওয়ার আর সময় পেল না। আর জেনারেটরটাও কিনা আজকেই নষ্ট হয়েছে।”
দেখলাম মাঝারি একটা ব্যাটারিওয়ালা টর্চ হাতে হইল চেয়ারে করে নিঃশব্দে কার্পেটের ওপর দিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলেন ডাঃ এমরান। এ ক’দিনে আরো শুকিয়ে গেছেন। চোখ ঢুকে গেছে কোটরে। চশমার ওপাশের চোখ দুটো কেবল জ্বল জ্বল করছে। মুখে হাসি। খুব কম সময়ই এই হাসিটা দেখেছি আমি।
“ এখন কেমন আছো?” টর্চটা একটা বক্সের ওপর শুইয়ে রাখলেন যাতে সব দিকে আলো যায়।
“ মোটামুটি ভাল। আপনি এত শুঁকিয়ে গেছেন! খাওয়া দাওয়া করেন না?” একটা টুল টেনে বসে পড়লাম তাঁর সামনে।
“ আমার কথা বাদ দাও। আছিই দু-চার দিন। তার আবার খাওয়া দাওয়া। তোমার কথা বলো। আজকেই ডিকসাস হলে? ওষুধ পত্র খাচ্ছো ঠিকমত?”
“ হ্যা।” কথার খেঁই হারিয়ে ফেললাম। এত সহজ সরল মানুষটার কারণে আমার জীবনে যে বিরাট একটা আতংকের সৃষ্টি হয়েছে- কেমন করে বলি?
“ কি ব্যাপার? তোমাকে খুব টেন্সড লাগছে। কোনো সমস্যা?” ভ্রুঁ জোড়া কাছাকাছি হল তাঁর। আমার ওপর স্থির হল দৃষ্টি।
অস্বস্তিতে নড়ে চড়ে বসলাম। বার কয়েক খুঁক খুঁক করে কেঁশে জড়তা কাটিয়ে বলা শুরু করলাম, “ স্যার, আমি বোধ হয় মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছি।”
“ কি রকম?” তীক্ষ্ণ হল তাঁর চোখের দৃষ্টি।
“ আমি মে বি আপনাকে নিয়ে হ্যালুসিন্যাসনে ভূগছি। আমি প্রায়ই আপনাকে দেখছি আপনি ছাদের দাবা বোর্ডে উল্টো ভাবে ঝুলে হাটা চলা করছেন, নামায পড়ছেন। এমনকি হাসপাতালেও আপনাকে আমার কেবিনে উল্টো ভাবে ছাদ থেকে ঝুলে থাকতে দেখেছি। আমি…… আমি খুব কনফিউজড স্যার…… “ বিব্রত গলায় বললাম।
ডাঃ এমরান হাসতে লাগলেন আমার কথা শুনে, “ সে দিন জ্বরের ঘোরে তোমাকে কি না কি বলেছি আবোল তাবোল- আর ওমনি তুমি ভয় পেয়ে গেলে? বুঝ্রছি। আমার কথাতে হিপনটাইজড হয়ে গেছো। তাই এসব উল্টো পাল্টা জিনিস দেখছো। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। ডাক্তার হয়ে অবাস্তব জিনিসকে বস্তব ভাবো কি করে?”
আমি অপ্রস্তুত ভাবে বসে রইলাম, কিছু বললাম না।
“ তুমি ছোট মানুষ। তোমাকে সে দিন এত সব কথা বলা উচিত হয়নি। ভয় পেয়ে গেছো। ভয়টা কাটাও।” হাসি থামিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন।
প্রায় শোনা যায় না, এমন ভাবে আস্তে আস্তে বললাম, “ তার মানে সবটাই সম্মোহন?”
“ হুম। আনওয়ান্টেড হিপনোটাইজিং।” গম্ভীর মুখে হেলান দিলেন হুইল চেয়ারে।
“ তার মানে যা কিছু দেখেছি – সবটাই আমার ঊর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা? বাস্তবে এর অস্তিত্বই নেই?” হতাশ গলায় বললাম।
“ ঊর্বর মস্তিষ্ক না। অনুর্বর। মস্তিষ্ক ঊর্বর হলে এসব দেখতে না, বিশ্বাসও করতে না।”
আমি খুব আশাভঙ্গ হলাম। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “ আজ তাহলে যাই আমি স্যার? কাল সকাল থেকে আবার আসা শুরু করবো।”
“ সুস্থ মনে করলে এসো। না হলে আরো কয়েকদিন ছুটি নিতে পারো। সমস্যা নেই।”
“ নাহ। যথেষ্ট ছুটি কাটিয়েছি। এবার কাজে ফেরা দরকার। আসি।” ঘুরে হাটা শুরু করলাম দরজার দিকে। বাহিরে যে হারে ঝড় বৃষ্টি চলছে- তাতে আজ বাসায় দাঁড় কাকের দশায় ফিরতে হবে।
মিউজিয়ামে একা বসে রইলেন ডাঃ এমরান। আমি দরজার কাছে চলে এসেছি- হঠাৎ বিচিত্র একটা জিনিস খেয়াল করলাম। ডাঃ এমরানের টর্চটা একটা বাক্সের ওপর রাখা ছিল। সেটার আলোটা এতক্ষণ দরজার এদিকে ছিল, তাই আমার ছায়াটা লম্বা হয়ে ছিল সামনের দিকে। কিন্তু আচমকাই ছায়াটা দ্রুত ছোট হয়ে আসা শুরু করল। যার অর্থ হল পেছন থেকে আলোক উৎসটা সোজা ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে! তাই আমার ছায়াটা খাঁড়া হয়ে এসেছে। আমি তীব্র একটা আতংক নিয়ে পেছন দিকে ঘুরলাম। ডাঃ এমরান হুইল চেয়ারটা ছেড়ে ধীর গতিতে শূণ্যে ভাসতে ভাসতে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছেন! তাঁর সঙ্গে সেই টর্চটাও শূণ্যে উঠে ওপরের দিকে চলে যাচ্ছে! তিনি আমার দিকে তাকিয়ে নেই, লাইব্রেরীর উঁচু শেল্ফ থেকে বই নামাচ্ছেন ভাসতে ভাসতে! শুধু তাই না, বই বের করে শূণ্যে ছেড়ে দিচ্ছেন আর বই গুলো বজ্রপাতের আলোয় দেখা যাচ্ছে সেই দাবার বোর্ডের দিকে উঠে চলে যাচ্ছে!
আমি ভয়ে চিৎকার দেবো সেই শক্তিটাও পাচ্ছি না! বিদ্যুতের সাদাটে আলোয় স্পষ্ট দেখলাম ডাঃ এমরান বই গুলো ওপরের দিকে পাঠিয়ে নিজেও উঠে যেতে লাগলেন। হল রুমের ফ্লোর আর ছাদের মাঝা মাঝি উচ্চতায় গিয়ে তিনি দড়াবাজিকরদের মত ডিগবাজি খেয়ে উলটে গেলেন! পা চলে গেল ছাদের দিকে, মাথা চলে এলো ফ্লোরের দিকে! আমি হতভম্ব হয়ে আবিষ্কার করলাম ছাদের দাবার বোর্ডে অন্ধকারের মাঝে একটা টেবিল আর দুটো মুখোমুখি চেয়ার উল্টো ভাবে ঝুলে আছে। ডাঃ এমরান ধীর গতিতে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন। যেন মধ্যাকর্ষন শক্তি ছাদের দিকে তৈরি হল। ঠিক এ সময়ে-ই আবার বিদ্যুৎ চমকালো। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ও অদ্ভূত দৃশ্যটা দেখলাম-
ডাঃ এমরানের সামনের দিকের সেই চেয়ারে কম বয়সী নীল শার্ট পরা এক যুবক উল্টো ভাবে বসে আছে। গম্ভীর মুখে টেবিলের ওপর দাবার ঘুটি সাজাচ্ছে! যেন দাবা খেলবে এখন তাঁরা! একটা মোমবাতি উল্টো ভাবে টেবিলের ওপর জ্বলছে। টেবিলের একপাশে সেই বই গুলো একটার ওপর একটা সাজিয়ে রাখা। পড়ে যাচ্ছে না কোনোটাই। ভয়টা ধীরে ধীরে আতংকে রুপ নেয়া শুরু করল হঠাৎ । এসব দেখে চমকাইনি আমি। যেটা দেখে আমার মাথা ঘুরে উঠল ভয়াবহ আতংকে – সেটা হল – বজ্রপাতের ক্ষণিক সাদাটে আলোয় দেখা যাচ্ছে নীল শার্ট পরা যুবকের মুখটা………… জাহিদ!
আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল!