খুব সকাল বেরিয়ে পরলাম আমরা। রাকিবের কথা অনু্যায়ী সেই ক্যাথেড্রালটার দূরত্ব এখান থেকে আরো দশ বারো কিলোমিটার দূর। তারওপর পায়ে চলা পথ রয়েছে এক মাইলের মত। আমার একার পক্ষে ওখানে যাওয়া কঠিন কিছু না, কিন্তু মাহিনকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। ওর এ অবস্থায় হাঁটা চলা করাই ঠিক না, যে কিনা পাহাড় বাইতে যাচ্ছে! এবং তাকে এ নিয়ে খুব একটা চিন্তিত মনে হল না। জিন্স পরেছে, আর সাদা একটা ফুল শার্ট। মাথায় লাল রংয়ের একটা রুমাল, পায়ে কেডস, পিঠে ব্যাকপ্যাক। তাতে নানা রকম টুকিটাকি জিনিস পত্র। সঙ্গে ইভাও যাচ্ছে। মাহিনের মতই জিন্স আর শার্ট পরেছে। দুজনে বসেছে জিপের পেছনে। আমি আর রাকিব সামনে। ড্রাইভ করছে রাকিব। আমার ফোর্ডে করে অতদূর পাহাড়ি পথ যাওয়া সম্ভব না, তাই রাকিবের জিপে করে যাচ্ছি। জিপটা একদম নতুন। ঝকঝকে চেহারা। বাহিরের আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি আসার ভয়ে জিপের উপরের তেরপাল তুলে দেয়া।
রাকিব সিগারেট ধরাল। প্যাকেটটা বাড়াল আমার দিকে। আমি বললাম, “নাহ, ছেড়ে দিয়েছি”।
“সেকিরে! তোর মত গাঞ্জা খোর সিগারেট ছেড়েছে!” চোখ কপালে তুলল।
হাসলাম, “বিয়ের পর আর মাহিনের অত্যাচারে খেতে পারিনি। খেতে গেলেই কাঁচি নিয়ে সিগাররেট কেটে দু টুকরো করে ফেলে”।
দাতের ফাঁক রকিব কেবল বলল, “ওউ! শেষ কালে বুড়ো বয়েসে এসে ধরা!”
আমি বাহিরে তাকালাম, আকাশের ঘনকালো জমাট মেঘ গুলো পাহাড়ের মাঝামাঝি ঝুলে আছে। খুব অদ্ভুত দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে আমাদের গাড়িটা মেঘের ওপরে উঠে যাচ্ছে।ঘন কুয়াশার মত। পরক্ষণেই হয়ত আবার নেমে যাচ্ছে। জীপের উইন্ড শীল্ড ভিজিয়ে দিচ্ছে ঘন মেঘ। ওয়াইপার মুছে যাচ্ছে উইন্ডশীল্ড। পেছনে মাহিন আর ইভা কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। আমি চুপচাপ পাহাড় গুলো আর খাদের ঘন জংগল গুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। এত ঘন জঙ্গল যে মনে হচ্ছে ঘন সবুজ কার্পেট বিছিয়ে আছে। অনেক বড় বড় গাছ মেঘ ফুঁড়ে ওপরে উঠে গেছে। কোথাও কোনো পাখি দেখতে পাচ্ছি না। কেবল হঠাৎ হঠাৎ রাস্তার উপর দিয়ে শেয়াল আর কাঠ বেড়ালি দৌড়ে পার হচ্ছে। রাকিব সাবধানে গাড়িটা চালাচ্ছে, নইলে দুই একটা কাঠ বেড়ালি রাস্তায় পিষে যেত গাড়ির চাকার নিচে পরে। চারপাশে নিরেট নিস্তব্ধতা!
মাহিন পেছন থেকে হঠাৎ বলল, “রাকিব ভাই, ক্যাথেড্রলটার সিকিউরিটির জন্য লোক রেখেছেন?”
“রেখেছি মানে? দিন রাত আঠাশ জন সশস্ত্র গার্ড রয়েছে। ক্যাম্প করেছি পাহাড়ের গোড়ায় আর চারটা পাহাড়ের চূঁড়ায়। যাতে কেউ চুরি টুরি করতে না পারে। সার্চ লাইট দিয়ে,তাঁর কাটা দিয়ে, বলতে পারেন দূর্ভেদ্য করে ফেলা হয়েছে চারপাশ। তবে সমস্যা হল জায়গাটা এতই বিশাল যে এত অল্প মানুষ দিয়ে গার্ড দেয়া কঠিন। বলতে পারেন ছোট খাট একটা শহর। মাটির নিচে এত বড় জিনিষ ডেবে গেছে যে কয় দিকে লোক লাগাবো? পোঁচার, ডাকাত চোর এসবের উৎপাত ঠেকানোই মুশকিল। ব্যাপারটা বেশি দিন ধামা চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। প্রায় রাতেই ক্যাথ্যড্রালে চোর ঢুকছে আমাদের চোখ এড়িয়ে। চুরি করার চেষ্টা করছে দামি মুর্তি গুলো। খুব ভারী বলে সুবিধা করতে পারছে না। কিন্তু ছোট খাট অনেক জিনিস পত্র এর মাঝেই গায়েব করে দিয়েছে।”
মাহিন হাত ঘড়ি দেখে বলল “আর কত দূর?”
“এসে গেছি প্রায়। ঐ সামনের চূড়াটা দেখেছেন? ওখান থেকে আরো এক কিলোমিটার যেতে হবে।” রকিব বলল।
ইভা বলল, “ হেটে যেতে খারাপ লাগে না। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে হয় মাইল খানেক। কিন্তু ফেরার সময় জান বের হয়ে যায় এই রাস্তা দিয়ে উপরে উঠতে।”
“তুই আগে এসেছিলি নাকি?” জিজ্ঞেস করলাম।
“ হ্যা,দুবার ঘুরে গেছি। ক্যামেরা দিয়ে অনেক ছবি তুলেছি। ভিডিও করেছি।” গর্ব করে বলল ইভা।
মাহিন আফসোস করল, “আগে বলবে না? আমি একটু দেখে নিতাম।”
“ক্যামেরা আজকেও এনেছি”। ইভা ওর ব্যাক প্যাক ইঙ্গিত করে বলল।
“আছে নাকি? ছবি গুলো দেখা তো?” বললাম আমি।
“এখানে নেই। ল্যাপটপে ঢুকিয়ে রেখেছি। ম্যামোরি ভরে গিয়েছিল।” ইভা জানাল।
“ও তাহলে আর কি করা? সচোক্ষেই দেখা যাক।” আমি আবার বাহিরে তাকালাম। পাহাড়ের চূড়াটার কাছে চলে এসেছি। এতক্ষণ খেয়াল করিনি- মেঘের জন্য বোঝা যাচ্ছিল না। এখানে ফরেস্টের গার্ডদের একটা চেক পোষ্ট। রাকিব জিপ নিয়ে যেতেই খাকি পোশাক পরা দুজন গার্ড এসে সালাম দিল। রাকিব গাড়ি থেকে নামল, “তোমরা গাড়িটা পার্ককরে রাখো। আমি এনাদের নিয়ে ক্যাথেড্রালে যাচ্ছি। সকালের বেচের ডিউটির গার্ডরা গেছে?
“জ্বী, স্যার।” রোবটের গলায় জবাব দিল একজন।
আমরা গাড়ি থেকে নামতেই গাড়িটা একজন নিয়ে এক পাশে পার্ক করে রাখল। রাকিব আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হাটার জন্য তৈরী? একমাইল কষে হাটা দিতে হবে এখন।”
আমি পায়ে ভার বদল করলাম, “হুম।” মেঘের মাঝ দিয়ে রাকিবের দেখানো দিকে তাকালাম। মনে হল বিশাল কোনো কুয়াশা সমুদ্র। তার মাঝ দিয়ে দূরে দূরে চার-পাঁচটাপাহাড়ের মাথা দ্বীপের মত জেগে আছে। অদ্ভুত সুন্দর। বিড় বিড় করলাম, “এই মেঘের সমুদ্রের নিচেই সেই ক্যাথেড্রাল?” রাকিব শুনে হাসল, “হ্যা। রীতিমত একটা শহর লুকিয়ে আছে মাটির নিচে!”
চেক পোষ্ট থেকে হাঁটতে লাগলাম পাহাড়ের কাঁচা পথ ধরে। মাটি কেটে রাস্তা করা হয়েছে। আঁকা বাঁকা ভাবে পাহাড়ের গা ঘেষে পথটা চলে গেছে ক্রমশ নিচের দিকে। জংগল চারপাশে। পাহাড়ের গায়ে গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য দেবদারু গাছ। রেইনট্রির মত বিশালাকার একেকটা লম্বা গাছ। সূর্যের আলো প্রায় আটকে দিয়েছে ঘন ডাল পালা। হাটতে খারাপ লাগছিল না। সারাটা রাস্তা মাহিনের এক হাত ধরে রাখলাম শক্ত করে। যাতে পা পিছলে কোনো দূর্ঘটনা না ঘটায়। মাহিন এক ফাঁকে বলল নিচু স্বরে, “আস্তে ধর হাত ব্যথা করছে তো।” আমি এক হাত ছেড়ে অন্য হাত ধরলাম ওর। তবুও শক্ত করেই ধরে রাখলাম।
জংগলটার ভেতর এই দিনের বেলাতেও মশার উৎপাত। পাহাড়ের ঢালের এই বিশাল জংগল যেন আমাজানের জংগল। মশা আর সাপ খোঁপ দিনের বেলাতেও ছোটাছুটি করছে। সতর্ক থাকলাম। মাহিনকে এখানে নিয়ে আসা উচিত হয়নি- আফসোস হতে লাগল। সব সময় ওর কথা শুনতে গেলে ওর যে ক্ষতি হবে এটা বোঝানোই মুশকিল।
দীর্ঘ পথ। এক ঘন্টা লাগিয়ে পৌঁছালাম। রাস্তাটা যেখানে গিয়ে থেমেছে ওটা একটা ক্যাম্প। ফরেষ্ট গার্ডদের ক্যাম্প। পাহাড়ের চূড়ায় সেটা। এতক্ষন উচুঁ পাথাড় থেকে এক মেইল হেটে নেমে এই পাহড়ের চূড়ায় এসেছি দেখে ভীষণ অবাক লাগল। তার মানে ক্যাথেড্রালের অংশটা আরো অনেক নিচে! ঢোক গিললাম। কম করে হলেও হাজার মিটার নিচে হবে!
এখানেও মেঘের ছোটাছুটি। রাকিব দুজন গার্ড নিয়ে নিল এবার সঙ্গে।
আমি মেঘের জন্য ঠিকমত কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। পাশ থেকে মাহিন হতভম্ভ হয়ে বলল, “ও মাই গড! আমি স্বপ্ন দেখছি? না সত্যি না এটা?”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। মাহিন শক্ত করে আমার হাত খাঁমচে ধরল উত্তেজনায়, ওর দেখানো দিকে তাকালাম।
মেঘের কুয়াশা সামনে থেকে সরে যেতেই দেখলাম আমরা একে বারে পাহাড়ের কিনারে দাড়িয়ে আছি। নিচে অনেক গভীর খাদ। আমাদের পাহড়ের গায়ে গা লাগানো আরো বিশ পঁচিশটা পাহাড়। বিশাল একটা বৃত্ত তৈরী করেছে পাহাড় গুলো, ব্যাস আনুমানিক দুই মাইল হবে! বিশাল এই সার্কেল ভ্যালির মাঝখানটা ঠিক কুয়ার মত গভীর। আর পাহাড় গুলো সেই কুয়ার বৃত্তাকার দেয়াল! ভয়াবহ ঘন জংঙ্গল, তার মাঝ দিয়েও দেখা যাচ্ছে গভীর খাদের মাঝামাঝি ছোট ছোট অনেক পাহাড়। সেই পাহাড় গুলো লেগে আছে বড় বড় পাহাড় গুলোর গায়ে। এবং ভেঙ্গে আলাদা হয়ে আছে কয়েকটা পাহাড়ের ঢাল। নিচে টল টলে পানির লেক। সেই লেকে প্রতিবিম্ব করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক ক্যাথেড্রালের সামনের অংশ! এবং সেটার অর্ধেক পানির নিচে ডুবে আছে, বাকি অংশ পাহাড়ের ভেতর। এই বৃত্তাকার সার্কেল ভ্যালির পাহাড়ের পেটের ভেতর বাকি অংশ ঢুকে আছে। হাজার হাজার লতা পাতা আর আগাছা দিয়ে ক্যাথেড্রালের বেরিয়ে থাকা মুখটা বন্ধ হয়ে আছে প্রায়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্যাথেড্রালটা পিসারের হেলানো মিনারের মত বাম দিকে অনেকখানি হেলে আছে। কোনো বিশাল ভূমিকম্পে এই পাহাড় ধ্বসে পরেছিল ক্যাথেড্রালের ওপর, একপাশে হেলে গিয়ে মাটির নিচে দেবে গেছে। যুগে যুগে পাহাড় গুলো গিলে নিয়েছে ক্যাথেড্রালটাকে। আর পানি জমে তৈরি হয়েছে লেক। লেকের পানি ফুঁড়ে যিশু খ্রিষ্টের একটা মূর্তি উঠে দাঁড়িয়ে আছে। এত ওপর থেকেও মূর্তিটা দেখে অনুমান করা যাচ্ছে ক্যাথেড্রালের চত্বরে বানানো হয়েছিল খ্রিষ্টের দু হাত মেলা ক্রুশ বিদ্ধ এই মূর্তি! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
মাহিন কেবল অস্ফূট একটা শব্দ করল। অনুভর করলাম আমার বাহুতে ওর নখের চাপ আরো বেড়েছে…….
পাহাড়ের গায়ে মাটি কেটে সিঁড়ির মত ছোট ছোট ধাপ তৈরি করা হয়েছে। সবার আগে নামতে লাগল একজন গার্ড। তার পেছনে রাকিব, আমি, মাহিন, ইভা আর সব শেষে আরেকজন গার্ড। সিঁড়ির পাশেই রেলিং এর মত বাঁশের খুঁটি পুঁতে দড়ি দিয়ে দিয়েছে। নামার সময় দড়ি ধরে নামছি। যাতে পা হড়কে গেলেও দড়ি ধরে পতন ঠেকানো যায়। গত রাতের বৃষ্টির কারণে মাটির সিঁড়ি গুলো কাঁদা কাঁদা – পিচ্ছিল হয়ে আছে। মাহিনকে নিয়ে ভয় পাচ্ছি কেবল। এক হাতে ওকে ধরে রেখেছি।
খুব ধীরে ধীরে নামছি আমরা। রাস্তা কিংবা সিঁড়ি যাই বলা হোক না কেন সেটা কখনো খাঁড়া ভাবে নেমে যাচ্ছে, কখনো আঁকা বাঁকা ভাবে এদিক সেদিক হয়ে চলে গেছে পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে। তারওপর দুপাশের ঝোপ ঝার আছে। সেগুলোর ডাল পালার আচোঁড় লেগে এর মধ্যেই দু তিন জায়গায় হাত ছড়ে গেছে আমার। বাকিদের খবর জানি না।
আমরা যতই নামছি, ততই ক্যাথেড্রালের অবয়ব আর লেকের মূর্তিটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। খ্রিষ্টের মূর্তিটার গায়েও যে প্রচুর লতা পাতা জন্মেছে বোঝা যাচ্ছে এখন। প্রায় কালো হয়ে এসেছে মূর্তিটা। যত নামছি ততই বিশাল হচ্ছে ক্রুশ বিদ্ধ যিশুর মূর্তি। রীতিমত দানবীয় আকৃতি! ক্যাথেড্রালটাও যে বিশাল একটা প্রাসাদের মত বড় সেটা এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
আমার ঘড়ির হিসাবে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগল নিচে লেকের পাড়ে পৌছাতে। সেখানেই আরো একটা ক্যাম্প। তাবু, অস্ত্র আর গার্ড দিয়ে ভরা। ক্যাম্পটা লেকের ঠিক অন্য পাশে, ক্যাথেড্রালের মুখোমুখি। মাঝখানে খ্রিষ্টের মূর্তি লেকের পানির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ক্যাম্পের কাছে আসতেই দেখলাম বাহিরে আগুণ জ্বালিয়ে খাবার রান্না করছে গার্ড গুলো। কয়েকজন পুলিশকেও দেখলাম। বয়ষ্ক কয়েকজন ভারিক্কি চেহারার লোকও রয়েছে, স্যুট টাই পরা। বোঝাই যাচ্ছে বড় কোনো আর্কিওলোজিষ্ট এঁরা। কয়েকজন লোক ক্যামেরা আর স্ট্যান্ড নিয়ে ছোটা ছুটি করছে। রীতিমত হূলস্থূল কারবার।
আমি রাকিবের দিকে তাকালাম শূণ্য দৃষ্টিতে, “তুই না বললি মিডিয়া নট এলাউড? এত ক্যামেরা কেন?”
হাসতে লাগল রাকিব, “এরা মিডিয়ার লোক না। এখানে যেসব আর্কিওলোজিষ্ট কাজ করছেন- তাদের লোক। সার্ভে করার জন্য ক্যামেরা লাগে।”
আমি মাহিনের দিকে ফিরলাম। এক কোনায় দাঁড়িয়ে নিজের দু হাত টিপছে। আমার দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকালো, “কলম্বাসে আব্বা, তুমি আমার দু হাতের হাড় মাংস এক করে ফেলেছো!” দেখলাম দু হাতে লাল হয়ে বসে আছে আমার হাতের ছাপ! বেশ জোরেই ধরেছিলাম মনে হচ্ছে। কাঁচুমাঁচু মুখে বললাম, “ইচ্ছা করে করি নাই মাহি। ভয় পাচ্ছিলাম পরে টরে যাও যদি। তাই শক্ত করে ধরেছিলাম।” আড় চোখে দেখলাম একপাশে ইভা মিটিমিটি হাসছে আমাদের কথা শুনে।
রাকিব আমার কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল, “আয় পরিচয় করিয়ে দেই এখানকার আর্কিওলোজিষ্টদের সাথে।” মাহিনের দিকেও তাকাল। এগিয়ে এলো মাহিন।
পুলিশদের সাথে কথা বলছিল দুজন বয়ষ্ক গম্ভীর মুখো ভদ্রলোক। রাকিব তাঁদের কাছে নিয়ে গেল আমাদের। সামান্য কেঁশে মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করল, “স্যার?”
ফিরে তাকালেন দুজন। এক জনের মুখে সাদা ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি, মাথায় টাক। হাল্কা পাতলা চেহারা। অন্যজন মোটা সোটা গোঁফওয়ালা। চোখে ভারী লেন্সের চশমা। তুলনা মূলক ভাবে বয়ষ্ক।
ফ্রেঞ্চ কাট ভদ্রলোক বললেন, আরে রাকিব সাহেব। কখন এলেন?” কেমন একটা দেঁতো হাসি দিলেন।
“মাত্র এলাম। আমার দুজন বন্ধুকেও এনেছি সঙ্গে।” আমাদের দেখাল।
একটা ভ্রূঁ উঁচু হয়ে গেল ফ্রেঞ্চ কাট ভদ্রলোকের, সন্দিহান গলায় বললেন, “মিডিয়া?”
“ না স্যার। এরা মিডিয়ার কেউ না। এ হল আমার বন্ধু মেজর শাহরিয়ার রবি আর ওর ওয়াইফ মাহিন আহমেদ। মাহিন আর্কিওলোজিতে পড়াশোনা করেছে।”
মাহিনের পেটের দিকে আড় চোখে তাকালেন ফ্রেঞ্চ কাট, ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল, “আর্কিওলোজির ছাত্রী? ভাল ভাল। তা এ অবস্থায় চলা ফেরা করাটা আসলে ঠিক না। তাছাড়া এখানে অনেক বড় সড় ব্যপার ঘটেছে। দুনিয়া খবর পেলে রীতিমত হৈ চৈ শুরু হবে, সারা পৃথিবী হামলে পরবে এখানে। কোটি কোতি টাকার জিনিষ পত্র! মাটি খুঁড়লেই টাকা!”
মাহিনকে দেখলাম মিইয়ে গেছে। মুখ কালো করে ফেলেছে।
রাকিব ভদ্রতার হাসি হেসে বলল, “পরিচয় করিয়ে দেই, ইনি ড. আবু তালেব। বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ আর উনি প্রোফেসর নারায়ণ গাঙ্গুলি। পেশায় প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং শিক্ষক।” ফ্রেঞ্চ কাটের নাম তাহলে আবু তালেব। মোটা লোকটাই প্রোফেসব নারায়ণ গাঙ্গুলি। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম হ্যান্ডশেকের জন্য, “হ্যালো স্যার। নাইস টু মিট ইউ।”
ড. আবু তালেব তার সেই তাচ্ছিল্য মার্কা হাসিটা দিয়ে আমার হাতটা ধরলেন। কিন্তু হাত ধরেই বুঝলেন ধরা ঠিক হয়নি। আমি হাসি মুখে হাতটা চাপ দিয়ে ঝাঁকিয়ে দিতেই ওনার তাচ্ছিল্য মার্কা হাসিটা উবে গেল। আগামী কয়েক ঘন্টা গ্লাস ধরে পানি খেতে গেলে আমার কথা মনে পরবে তার।
দ্বিতীয় জনের সঙ্গে হাল্কা ভাবেই হাত মেলালাম। মাহিন কেবল মুখে সালাম দিল দু জনকে। মুখ কালো করে রেখেছে সে। বোধ হয় ড. আবু তালেবের কথা গুলো ভাল লাগেনি। তবে প্রোফেসর নারায়ণ গাঙ্গুলি খুব ভাল ব্যবহার করলেন, “তুমিও আর্কিওলোজিতে পড়েছো? কোথায় পড়তে?”
“বেথুনে।”
“ও! খুবভাল খুব ভাল। তুমি আসায় খুব লাভ হল মা, এই বুড়ো বয়সে চোখে কম দেখি। সাথে ছোট কেউ থাকলে কাজে সুবিধা হবে।” মাথা নাড়াতে নাড়াতে আপন মনে অন্য দিকে চলে গেলেন প্রোফেসর নারায়ণ।
রাকিব ইঙ্গিতে চোখ টিপে বুঝিয়ে দিল নারায়ণ গাঙ্গুলি আত্নভোলা গোছের লোক। আমার বেশ ভাল লাগল তাঁকে। মাহিনকেও দেখলাম ওর মুখে হাসি ফুটেছে।
ড. আবু তালেব গলা খাকারি দিয়ে নিজের দিকে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলেন, “কোটি কোটি টাকার ব্যাপার বুঝলে? সো ডোন্ট ট্রাই টু ডিসক্লোজ দ্য সিক্রেট অব দিস ক্যাথেড্রাল। বড় লোক হয়ে যাবে এসব বেঁচলে।”
আমি গাল চুলকালাম, “বেঁচলে দেশ বড় লোক হবে। খারাপ না। ভালই তো।”
ড. আবু তালেব চোখ ছোট ছোট করে তাকালেন আমার দিকে এক মুহূর্তের জন্য। বোধ হয় আমার কথাটা পছন্দ হয়নি তার। রাকিবের দিকে তাকিয়ে কর্তৃত্ব ভরা গলায় বললেন, “এদেরকে সব ঘুরিয়ে দেখিয়েছো? ঘুরিয়ে দেখাও। কিন্তু কিছুতে হাত দিও না। নষ্ট হয়ে গেলে সমস্যা। কবে কার জিনিষ ঠিক নেই। সাবধান থাকবে তাই।” বলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে অন্যদিকে চলে গেলেন।
আমি বিরক্ত মুখে তাকালাম রাকিবের দিকে, “এই চোরটাকে কোত্থেকে ধিরে আনলি? কথা শুনেই তো মনে হচ্ছে সব খালি করে দেয়ার তালে আছে!”
হেসে ফেলল রাকিব, “আমার দোষ নাই। ওপর থেকে কড়া আদেশ ড. আবু তালেব এখানে কাজ করবেন তার টিম নিয়ে। কেউ যেন তার ওপর খবরদারি না করে। শুনেছি ওপর মহলে বেশ ভাল যোগাযোগ আছে ড. তালেবের।”
মাহিন শুকনো মুখে বলল, “আর প্রোফেসর নারায়ণ? তিনিও ওনার দলে?”
“আরে নাহ। নারায়ণ স্যারকে ড. তালেব নিজেই ডেকে এনেছেন। কারণ নারায়ণ স্যার ওনার থেকেও বড় আর্কিওলোজিষ্ট। নিজের কাজের স্বার্থে ডেকে এনেছেন।”
“তাই নাকি।” নাকের ডগা চুলকালাম, “ডেখে বেশ ভালই মনে হল ভদ্রলোককে। আত্নভোলা।”
কাষ্ট হাসি হাসল রাকিব, “আত্নভোলা এবং ভয়াবহ রাগী মানুষ। পান থেকে চুন খসলেই ক্ষেপে যান।”
“ওরে বাবা! তাই নাকি! দেখে তো একবারও মনে হল না।।” অবাক হলাম।
“হুম। খুব রাগী। একটু উল্টা পাল্টা কাজ করলেই ধমক মারেন যার তার সামনে। তবে মানুষ হিসেবে খুবই ভাল।” রাকিব আরেকটা সিগারেট ধরালো, “নৌকা ঠিক করা আছে। উঠে যা। লেকটা ঘুরিয়ে ক্যাথেড্রালে নিয়ে যাবে মাঝি। তোরা যা।”
“তুই?”
“আমি সিগারেটটা শেষ করে কিছু কাগজ পত্র দেখে আসছি। তোরা খ্যাথেড্রালের মুখে অপেক্ষা করিস। আমি টর্চ আর হ্যালমেট নিয়ে আসবো।”
লেকের ঘাটে তিনটা নৌকা বাঁধা ছিল। একটায় আমি, মাহিন আর ইভা উঠলাম। খাকি পোশাক পরা গার্ড একজন দাড় বাইতে লাগল। লেকের পানি স্বচ্ছ, পরিষ্কার। নিচের সব দেখা যায়। নানান জাতের মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে নিচে। অনেক গভীর। তবুও বোঝা যাচ্ছে নিচে অনেক মূর্তি রয়েছে। বেশির ভাগই মাটি চাপা পড়ে আছে। কোনোটার হাত বেরিয়ে আছে, কোনোটার মাথা। দেখে বোঝা যাচ্ছে নিচের মূর্তি গুলো যিশুর মূর্তিটার মত এত বড় না, দশ বারো ফুট করে হবে উচ্চতা। পানির ওপর দিকে ছুই ছুই করেছে সেগুলোর মাথা। তবে পানির ওপরে কেবল যিশুর মূর্তিটাই বেরিয়ে রয়েছে। বাকি মূর্তি গুলো পানির খুব কাছাকাছি উঠে রয়েছে। মাঝে মাঝে নৌকার তলা লেগে যেতে চায় সেগুলোর গায়ে! মাছ গুলো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে সেই মূর্তি গুলোর ফাঁক দিয়ে দৌড়াচ্ছে! অদ্ভূত দৃশ্য!
নোউকা ছাড়াও লেকের পাশ দিয়ে হেটে ক্যাথেড্রালে পৌছানো যেত। কিন্তু অনেক সময় লেগে যাবে। কারণ লেকের পরিধি প্রায় বারো তের কিলোমিটারের কম না। ঘুরে গেলে অন্তত ছয়- সাত কিলোমিটার পথ। তাই নৌকায় করে যাচ্ছি। যিশুর বিশাল মূর্তিটার কাছাকাছি আসার পর হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ব্রাজিলের জেজাস ক্রাইষ্টের সেই মূর্তির চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এটা। লতা পাতা ঝুলছে ছড়ানো দুই হাত থেকে। সারা শরীরে কালো শ্যাওলা আর শামুকের ভীড়। ফার্ণ আর লতা দিয়ে শরীরটা প্রায় ঢেকে আছে। প্রকৃত রঙ বোঝার উপায় নেই।
ইভা ওর ক্যেমেরা দিয়ে একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছে। আমি আর মাহিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছি।
মূর্তিটার পাশ কাটিয়ে ক্যাথেড্রালের মূল চত্বরের দিকে এগোতে লাগলাম। পানির নিচ দিয়ে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিশাল বিশাল সিঁড়ির একেকটা ধাপ। যেগুলো উঠে গেছে ক্যাথেড্রালের মূল ফটকের দিকে। আমাদের নৌকাটা থামল। ক্যাথেড্রালটা সত্যি সত্যি বাম দিকে হেলে আছে প্রায় বিশ পঁচিশ ডিগ্রীর মত। মানে স্বাভাবিক অবস্থান থেকে বিশ পঁচিশ ডিগ্রী বামে হেলে রয়েছে। মাহিন নৌকা থেকে পানিতে নামল। অবাক হয়ে বলল, “ভ্যাটিকেনের ক্যাথেড্রাল! কোনো পার্থক্যই নেই! কেবল এটা আরেকটু বড়!” ওর কন্ঠই বলে দিল ভীষণ অবাক হয়েছে সে।
আমিও ওর পাশে নামলাম। পাহাড়ের ভেতর থেকে মুখ বের করে রেখেছে লতা পাতায় ঢাকা বিশাল প্রাসাদ। ছবিতে দেখা ভ্যাটিকেনের রোমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে কোনো পার্থক্যই নেই! একই রকম বিশাল বড় বড় পিলারের ওপর ছাদটা দাঁড়িয়ে আছে! ওপর থেকে মোটা মোটা শেকড় আর লতা ঝুলছে।
মাহিন ফিসফিস করে বলল, “যে বানিয়েছে এটা- মানতেই হবে অসাধারণ শিল্পী ছিল! তিন শতাব্দী পরও টিকে আছে পাহাড়ের ভেতর!”
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।