অজুর বদনা হাতে তুলে সাপটা দেখতে পেল মেঘনা।
বদনার আড়ালে মেটে রঙের ছোট্ট বিষধর কি করছিল কে জানে! বিপদ বুঝে ফণা তুলে চক্র গেড়ে
বসলো সে। দুলতে শুরু করল ছোবলের আকাঙ্খায়।
সাপ দেখে ভয় পেয়ে একটু পিছিয়ে এলেও হাত থেকে বদনা খসে পড়লো না মেঘনার। বুকও
কাঁপলো না। ফিসফিস করে সে বলল–কামড়াবি নাকি, আয়, দেখি তোর বিষে কত জ্বালা!
গ্রাম-জীবনের সবখানে সাপে-মানুষে সহবাস। মানুষ সাপকে এড়িয়ে চলে। সাপও মানুষকে। সাক্ষাত
সংঘাত হয় খুব কম। একপক্ষ ছুটে পালায়। সংঘাত মানেই তো অনিবার্য মৃত্যু একজনের।
গোরস্থান থেকে রান্নাঘর, সাপের চরাভূমি সবখানে। মানুষের চোখের আড়ালে থাকতে সদা-সচেষ্ট
এই সরীসৃপ। বিপদ বুঝলেই ফণা তোলে। আত্মরক্ষার তাগিদে ছোবল মারে। তেমন-ই এক জীব
মেঘনার কথা শুনলো কিনা কে জানে। ফণা নামিয়ে সুড়সুড় করে চলে গেল কলতলার দিকে।
বারান্দায় মোড়ার উপরে বসে মেঘনার দাদি সিরাজুন্নেসা। মেঘনার চমকে পিছিয়ে যাওয়া তাঁর
মোটা ফ্রেমের চশমায় ধরা পড়েছে। বললেন–কি হলো মেঘনা?
মেঘনা জানে, সাপের কথা শুনলে দাদি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করবেন। শ্রাবণের মেঘের মতো
মানুষের মাথার ভিড়ে হাজারো সম্ভাবনা তথা প্রতিকারের বৃষ্টি হবে। অত্যুৎসাহীদের বে-পরোয়া
সন্ধানে মেঘনার বহু যত্নে তৈরী করা ফুলের বাগান তছনছ হবে।
গর্তের গোলকধাঁধা খুঁড়ে সাপ পাওয়া না গেলেও কিছু বিষাক্ত-দৃষ্টি মেঘনাকে জর্জরিত করবে।
ওদের হাবভাব দেখে মনে হয়, মেঘনার আহ্বানে জীবন দিতে পিছ-পা হবে না কেউ।
অস্বস্থিকর সেই পরিস্থিতি এড়াতে মেঘনা মৃদু হেসে বলল–কিছু হয়নি দাদিজান, বদনা নিতে
গিয়ে পা পিছলে গেল।
বদনা নিয়ে কলতলা গেল মেঘনা। সিরাজুন্নেসাকে অজুর পানি দিয়ে অজু করবে সে। সেই
অবসরে যদি সাপটার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যায়, তখন নিশ্চয় ছোবল মারতে ভুল করবে না সে। তা
যদি মারে কাউকে কিছু বলবে না মেঘনা। নামাজ শেষে না হয় বলবে–কি-সে যেন কামড়ালো
দাদিজান!
সিরাজুন্নেসার আর্তনাদে ছুটে আসবে পাড়ার ভালমন্দ সকলে। পাশের বাড়ি থেকে ফোন হবে।
দেড়শো টাকা ভাড়ার প্রত্যাশায় আঠারো কিলোমিটার দূরের মহুকুমা হাসপাতাল থেকে ছুটে
আসবে অ্যাম্বুলেন্স। ততক্ষণে নিশ্চয় আজরাঈলের ডানার শব্দ শ্রুতিময় হবে।
কলতলার আশেপাশে সাপের নামগন্ধ নেই। কলের পরিতক্ত পানিতে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠা গাছগুলি মৃদু বাতাসে তিরতির করে পাতা দোলাচ্ছে। ফুলের পাপড়ির ঝিরিঝিরি কাঁপন দেখে মেঘনার মনে পড়লো, দু-বছর আগে অনার্স গ্রাজুয়েট হয়েছে সে। ততদিন এই গাছগুলি সুবাস ছড়াচ্ছে। তবু একটি মালা গাঁথার খেয়াল হয়নি তার।
মগরিবের নামাজ পড়ে স্টোভে চা তৈরী করলো মেঘনা। সিরাজুন্নেসা মাড়ি-সম্বল। মুড়ি, চায়ে
ভিজিয়ে চামচে তুলে খান। এটিই তাঁর নৈশ আহার। খেতে-খেতে তিনি বললেন–বেসিক না
কি-যেন ট্রেনিং দিবি বলছিলি, তা কর না একটা দরখাস্ত। জমিন-মোড়ল ক’দিন ধরে ঘুরছে,
ভাবছি শামপুকুরের ডাঙাটা ওকেই বেচবো।
মেঘনার ঠোঁটের পাপড়িতে হাসির রোদ। নিস্প্রভ ত্বকের আড়ালে সিরাজুন্নেসাকে বিস্ময়কর উজ্জ্বল
মনে হয় তার। দু-সপ্তাহ ধরে বিভিন্নভাবে মেঘনাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন তিনি। আশ্চর্য
মনের জোর এই বৃদ্ধার। কত ঝড় তাঁর জীবনময়। নুইয়ে গেছেন, তবু ভেঙে পড়েননি কখনও!
মেঘনার হাসিতে অশনি-সংকেত অনুমান করলেন সিরাজুন্নেসা। মুখের ভাঁজগুলি আরো গভীর হলো
তাঁর। তবু স্নিগ্ধ-স্বরে বললেন–নামাজ পড়িস আর এটা ভাবতে পারিস না, আল্লাহপাক যা করেন,
আমাদের ভালোর জন্যে করেন।
–কে বললো ভাবছি না? এই-রে, হেঁশেলে আবার বেড়াল ঢুকলো, বিল-বিল-বিল! বলতে-বলতে
ছুটে রান্নাঘরের দিকে গেল মেঘনা।
সিরাজুন্নেসা বোঝেন, প্রসঙ্গ এড়াতে ছুটে পালালো মেঘনা। নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয় তাঁর।
সারা সন্ধ্যা লন্ঠনের আলোয় ঘর গুছিয়ে গেল মেয়ে। বইপত্তরের ধুলো ঝেড়ে তাকে রাখলো। জামা-
কাপড় গুছিয়ে রাখলো আলনায়।
চুপচাপ সব দেখলেন সিরাজুন্নেসা। জন্মলগ্নে বাপ মরেছে,মেয়ে তাই অত অভিমানী। কিন্তু তোর
বাপ যে আমার পেটের ছেলে। মা হয়ে তার মরণ আমি সয়েছি, তুই কেন সয়বি না?
এশার নামাজ পড়ে হেঁশেলের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো মেঘনা। বাসনমাজা, ধোয়া, সব কলতলার
অন্ধকারে। কতবার লন্ঠনের কথা বললেন সিরাজুন্নেসা। মেয়ে কানে তুললো না।
সিরাজুন্নেসা মানছেন, তিনি অন্যায় করেছেন। আজ থেকে বিশ বছর আগে তিনি নিজের মেয়ের
হাত ধরে বলেছিলেন, মেঘনাকে তোর আলফাজের বউ করিস মা।
সে-মেয়ে বেঁচে থাকলে, তার কাছে জবাবদিহি করতেন সিরাজুন্নেসা। এমনকি হাঁটাচলার ক্ষমতা
থাকলে, আলফাজকেও ছাড়তেন না তিনি। মুখে স্যান্ডেল ছুঁড়ে মেরে বলতেন, তোর মনে যদি
এই ছিল, তবে সেদিন আমাকে কথা দিয়েছিলি কেন?
প্রাচীন বনস্পতির মতো এ-বাড়িতে মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন সিরাজুন্নেসা। চোখের সামনে কত
মহীরুহ-পতন দেখলেন! সব সয়তে হয় মেঘনার মুখ-চেয়ে। জন্মলগ্নে বাপ-মরা, শৈশবে মা-হারা
মেয়ে। সিরাজুন্নেসা ছাড়া কেউ নেই তার।
বারান্দায় বিছানা পাতছে মেঘনা। এখনও সে বাচ্চা মেয়ের মতো সিরাজুন্নেসার গলা জড়িয়ে
ঘুমোয়। আলফাজের মাস্টারণী বউ কি মেঘনার চেয়ে সুন্দর? অনেক মেয়ে দেখেছেন সিরাজুন্নেসা,
মেঘনার মতো স্নিগ্ধতা কোথাও নজরে পড়েনি তাঁর।
মশারী খাটিয়ে সিরাজুন্নেসাকে বাতরুমে নিয়ে গেল মেঘনা। নিজেকে বড় বোঝা বলে মনে হয়
সিরাজুন্নেসার। তাঁর পেছনে কত সময় এবং শ্রম দিতে হয় মেঘনাকে। তবু মেয়ের মুখভার হয় না।
আলফাজ নামের শিক্ষিত-শয়তানটা মানুষ চিনলো না। সহকর্মী শিক্ষিকাকে রেজিস্ট্রি-ম্যারেজ
করে সে নিশ্চয় সুখী হয়েছে। কিন্তু মেঘনার স্বপ্নদেখা চোখে তা যে কতবড় আঘাত সিরাজুন্নেসা
টের পাচ্ছেন।
মেঘনা বরাবর চাপা এবং মৃদুভাষী। তবু তো কখনো-সখনো গুনগুনিয়ে উঠতো নজরুল-সংগীত।
এখন তা করে না। যন্ত্রের মতো কাজ করে যায়। প্রয়োজন ছাড়া একটিও কথা বলে না। কথা না
বলা মানে মনের ভেতর অনর্গল কথা বলা।
মেয়ের দোষ কোথায়, আশৈশব সে শুনে আসছে, আলফাজের সঙ্গে বিয়ে স্থির হয়ে আছে
তার। প্রতিদিন আঠারো কিলোমিটার যাওয়া-আসা করে কলেজ করেছে সে। কষ্টার্জিত সেই
বিদ্যার বুঝি দাম নেই, বৃথা শ্রম সব?
বাথরুম থেকে সিরাজুন্নেসাকে তুলে এনে বিছানায় বসিয়ে ওষুধ দিলো মেঘনা। বললো–ওষুধটা
খেয়ে নিন দাদিজান।
ওষুধ খেতে ইচ্ছে করে না সিরাজুন্নেসার। বাঁচার ইচ্ছে মরে গেছে তাঁর। তবু বেঁচে আছেন শুধু
মেঘনার মুখ চেয়ে।
জমিজমা সব বর্গাদারের দখলে। তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে প্রতিবছর প্রাপ্য ধান আদায় করেন
সিরাজুন্নেসা। মেঘনা তা পারবে না। কিন্তু আজরাঈলেরও যে তর সয়ছে না। তাঁর ডানার শব্দ
স্পষ্ট শুনছেন সিরাজুন্নেসা। প্রতিদিন, প্রতিরাতে!
আজরাঈলের ডানার শব্দে সন্ত্রস্ত সিরাজুন্নেসা ঘটক ডাকছেন প্রতিদিন। তারা আসছে। জামাই-
আদরে খাওয়া-দাওয়া করছে। পকেট-ভর্তি রাহা-খরচ নিয়ে রওনা হচ্ছে। আর আসছে না।
বিয়ে স্থির হয়ে থাকা মেয়ের সমন্ধ ভেঙে গেলে বুঝি সে লগ্নভ্রষ্টা হয়? নইলে ওই ঘটকগুলোই
তো এতদিন কত ডাক্তার-মাস্টার-ব্যারিস্টারের ফটো এনে অনুনয়-বিনয় করেছিল। সব নাকচ
করেছিলেন সিরাজুন্নেসা। আলফাজ শুনেছে তা। মনে রাখেনি।
ওষুধ খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন সিরাজুন্নেসা। লক্ষী-মেয়ের মতো মেঘনাও শুয়ে পড়লো তাঁর পাশে। মনেমনে হাসলেন সিরাজুন্নেসা। ইদানিং তিনি লক্ষ্য করছেন, মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে উঠে যায় মেঘনা। আঙিনায় পায়চারি করে। ভয়ে শিউরে ওঠেন সিরাজুন্নেসা। বলেন–আর টহল দিতে হবে না। আমার কাছে আয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেব। কখন ঘুম আসবে টের পাবি না।
লক্ষী-মেয়ের মতো আবার বিছানায় আসে মেঘনা। মেয়ের সুবুদ্ধি দেখে সিরাজুন্নেসার দমবন্ধ হৃৎপিন্ড আবার সচল হয়।
সিরাজুন্নেসার এই উৎকন্ঠা আজরাঈলের ডানার চেয়েও তীব্র শব্দময়। এখনকার রাতগুলিতে
টুপ-টাপ্ শব্দে ঢিল পড়ে আঙিনায়। সিরাজুন্নেসা বোঝেন, মেঘনার সমন্ধ ভেঙে গেছে তাই
পাড়ার শয়তানরা পরখ করছে, মেঘনার মন ভেঙেছে কিনা।
ঢিলের কথা মেঘনা জানে। সে মুখটিপে হাসে। সিঁদুরের সব লাল তার গালে জড়ো হয়। দু-চোখে
খেলা করে উজ্জ্বল চাঁদ। বলে–ঢিল মেরে আমার মাথা কেউ ফাটাতে পারবে না দাদিজান,
আপনি মিছিমিছি চিন্তা করছেন।
বুক থেকে ঢেউয়ের পাহাড় নেমে যায় সিরাজুন্নেসার। তবু প্রতি রাতে শোবার আগে তিনি
মোনাজাত করেন–আমার নাক-চুলের সম্মান তুমি রেখো-গো মওলা !
সিরাজুন্নেসার নিরুচ্চার মোনাজাত শুনতে পায় না মেঘনা। সে শোনে তাঁর নাক-ডাকার শব্দ।
অন্য রাতগুলির মতো মশারীর বাইরে বেরিয়ে আসে সে। আলুথালু খোঁপা খুলে কুঞ্চিত চুলের
প্লাবন ছড়িয়ে দেয় পিঠের উপর।
আকাশে চাঁদ নেই। তারা নেই। ফুলের সুবাস ছড়ানোর মত একটুখানি বাতাসও নেই। তবু কিসে
যেন টানছে মেঘনাকে।
নেশাগ্রস্থ মানুষের মতো নিথর প্রকৃতিতে কান পাতে মেঘনা। তার মন বলছে, আজরাঈল আসছে।
কেমন তার ডানার শব্দ?
কলতলার পাশে সযত্নে- লালিত বাগানের মধ্যে হাঁটছে মেঘনা। ছোট ফুলগাছ-গুলি ছুঁয়ে-ছুঁয়ে
সবুজ-সজীবতা পরখ করে সে। পাপড়ির স্নিগ্ধতা গাল-ঠোঁটে অনুভব করতে-করতে মনের ভেতরের
মেঘনা বলে–সাপটা এখন কোথায়?
সাপের কামড়ে মৃত্যু মানে তো জান্নাতী। মেঘনার মৃত্যু কোন পর্যায়ে পড়বে, ইচ্ছামৃত্যু নাকি অপমৃত্যু?
পোস্ট-মর্টেম হবে? আইবুড়ো মেয়ে মারা গেলে তো অনেক গুঞ্জন ওঠে। মেঘনার অকালমৃত্যু
কলঙ্কের গন্ধ ছড়াবে বুঝি?
যে সাপের খোঁজে মেঘনা দিশেহারা। সে তার উপস্থিতি বুঝিয়ে গেল সিরাজুন্নেসাকে।
কাশতে-কাশতে সিরাজুন্নেসা ডাকলেন–মেঘা দ্যাখ তো বুবু কিসে যেন কামড়ালো, নাকি
খুয়াব দেখলাম কে জানে?
মেঘনা ছুটছে। তার হৃদয়ের সব গতিবেগ পায়ের তলায়। বারান্দায় জ্বেলে রাখা লন্ঠনের শিখা
দপ্-দপ্ করছে। সেটি যেন হৃৎপিন্ড হয়ে গেছে মেঘনার!
মেঘনার দৃঢ়-বিশ্বাস, তার ডাকে সাড়া দিয়েছে সাপ। বিছানায় গেছে। মশারীর শাসন অগ্রাহ্য
করে ছোবল মেরেছে। অবুঝ সরীসৃপ খেয়াল করেনি, তরুণী নয়, লোলচর্ম এক বৃদ্ধার পা সেটি।
আর্তনাদ করে উঠলো মেঘনা।
পড়শীদের জমায়েত। টেলিফোন। অ্যাম্বুলেন্স। ভিড়ের মত মেঘ জমে গেছে আকাশেও। বিজলী
যেন মেঘনার হৃদয় হয়ে চমকায়।
হাসপাতালের এমার্জেন্সী-তে ডিউটি-রত তরুণ ডাক্তারের উজ্জ্বল মুখে জড়ুলের মতো
হতাশা জমে উঠেছে। মেঘনাকে পাশে ডাকলো সে। বললো–সবরকম চেষ্টা করে দেখলাম,
উন্নতির লক্ষণ নেই। আপনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত হোন।
একটু আগেও মেঘনাকে কাছে ডাকছিলেন সিরাজুন্নেসা। নাকি বিকারে প্রলাপ বকছিলেন!
চোখের পাতা খোলার সে-কি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। সারাজীবনের অপূর্ণ ঘুমের অভিযান যেন
মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরেছে সিরাজুন্নেসার চোখের পাতা। যে ঘুম তাঁকে একটু-একটু করে নিয়ে
যাচ্ছে চিরঘুমের দেশে।
চাহারম হয়ে গেছে। পড়শী-মেয়েরা ফিরে গেছে নিজের-নিজের সংসারে। যে যখন ফাঁক পায়
খোঁজ নিয়ে যায়। এই কয়দিন মায়ের মতো মেঘনাকে আগলে রেখেছে ওরা। নিজেরা সিদ্ধান্ত
নিয়েছে, পালা করে রাতে এসে মেঘনার কাছে শোবে।
মেঘনার সামনে উন্মুক্ত দিন। চোখ-মুখ, এলোচুলে এলিয়ে পড়েছে পড়ন্ত বেলার রোদ। ঠিক
যেন সিরাজুন্নেসার অস্থি-চর্মসার হাতের পরশ। কর্কশ তবু স্নেহে মায়াময়।
কলতলায় হুটোপুটি করছে তিনটে কাক। এঁটোকাটার সন্ধানে তাদের তেড়ে যাচ্ছে দুটো কুকুর।
সিরাজুন্নেসার উপস্থিতিতে এই ‘ বেলেল্লাপনা’ সম্ভব ছিল না। তাঁর গলার জোরে ঘাবড়ে যেতো
কাক-কুকুর, এমনকি মানুষও। মেঘনা শুধু জানে ভেতরের মানুষটি কত মোলায়েম ছিল। সে
আরও জানে, মেঘনাকে রক্ষা করতেই তিনি এঁটেছিলেন রুঢ়তার মুখোশ।
সিরাজুন্নেসা নেই। তাঁর স্মৃতি ছড়িয়ে আছে এ-বাড়ির সবখানে। মেঘনার প্লাবিত চোখ-দুটি
সিরাজুন্নেসাকে খুঁজছে। অনর্থক সেই সন্ধানের সামনে এসে দাঁড়ালো হাসপাতালের সেই ডাক্তার।
আজরাঈলের মতো তার নিঃশব্দ উপস্থিতি মেঘনাকে চমকে দিলো। রুঢ়-স্বরে সে বললো–
আপনি এখানে?
মেঘনার রুঢ়তায় তরুণ-ডাক্তার হতচকিত। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখচোখের অপ্রস্তুত-ভাব মুছে ফেললো সে। সাবধানী উচ্চারণে বললো–আপনার মানে তোমার এখনকার
অবিভাবক কে, আমি তাঁর সাথে কথা বলতাম।
ডাক্তারের উঁচু নাক টিয়াপাখির নাকের মতো বাঁকা। মাথার চুলে টাঁকের আভাষ। কুকুর এবং
কাকের দল তা দেখছে না। হঠাৎ নিজেকে মেয়েমানুষ মনে হয় মেঘনার। তবু স্পষ্ট উচ্চারণে সে
বললো–আমার অবিভাবক আল্লাহ, যান তাঁর সাথে কথা বলুন।
একটানা কথা বলা নাকি টেনশনে ডাক্তারের চোখ ক্রমান্বয়ে বন্ধ হচ্ছিল এবং খুলে যাচ্ছিলো।
সে কাঁপা-স্বরে যা বললো তা হলো–আমি ওয়াশিম হায়দার, মহুকুমা হাসপাতালে আর মাস
ছয়েক আছি। বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাঁরা নেই তাই নিজের বিয়ের কথা নিজেকেই
বলতে হচ্ছে। আমাকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি আছে?
সাপটা কোথায় যেন ফোঁস করে উঠলো। মেঘনার পায়ে কাঁটার অনুভব। ঠোঁট একটু কাঁপলো।
তবু সে উচ্চারণ করতে পারলো–আমার বিয়ের বিষয়ে যা বলার তা আমার দাদিজান বলে
গেছেন, তাঁর অবর্তমানে আপনি আমার পড়শি-মায়েদের সাথে কথা বলতে পারেন।
–
-ধন্যবাদ। বলে মৃদু হাসলো ওয়াশিম।
উচ্ছিষ্টের খোঁজে হয়রান কুকুর এবং কাকের দল। মেঘনার ফুলবাগানের একটি গাছ নড়ে উঠলো
যেন। মনেমনে সেখানে ঢিল ছুঁড়লো মেঘনা। তার বিশ্বাস, এই ঢিলে সাপটা মরবে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।