১টা কিনুন, ১০টা নিন—শেখর বসু

ওই বিজ্ঞাপন দেখে যথারীতি জয়িতা দৌড়েছিল। তার দু’ দিন বাদে বিজ্ঞাপনদাতার পক্ষ থেকে একজন লোক এসে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে জয়িতার কেনা আর উপহার পাওয়া জিনিসগুলো খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বলল: আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমাদের কোম্পানির লোক এসে জিনিসগুলো নিয়ে আপনাকে মারুতি দিয়ে যাবে। শুনে জয়িতার সে কী উত্তেজনা! কনসালট্যান্ট প্রসাদ সি পলের কথামতো আমি ওই সময় খুব নিস্পৃহ ভাব দেখিয়েছিলাম। তিন দিন পরে কোম্পানি থেকে আর একটা লোক এসে লিস্টি মিলিয়ে গোডাউন মার্কা সব মাল ম্যাটাডরে তুলে লাল রঙের একটা নতুন মারুতি উপহার দিয়ে চলে গেল। বুঝতে পারছিস নিশ্চয়ই— মারুতি কেনার টাকা, বিজ্ঞাপনের খরচ আর ম্যাটাডরের ভাড়া আমার। সেন্টুদা অবশ্য আমার কাছ থেকে এক পয়সাও ফিজ নেননি। অনেক দিন ধরে আমার গাড়ি কেনার একটা শখ ছিল, সেই শখটাও মিটল; আবার বাড়ির এই আপদগুলোও বিদেয় হল। তুই কিন্তু খুব সাবধান! এ সব কথার একটাও যেন মুখ ফসকে জয়িতার সামনে বেরিয়ে না পড়ে!’ আমি আশ্বস্ত করার গলায় বললাম, ‘পাগল!’ একটু বাদে একটা ট্রেতে তিন কাপ কফি সাজিয়ে ঘরে ঢুকল জয়িতা। তারপর কফির কাপ হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘আজ দুপুরে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাব। আমাদের একটা মারুতি হয়েছে। কিনিনি কিন্তু। কীভাবে পেলাম, খেতে খেতে বলব আপনাকে।’ চোখেমুখে যত দূর সম্ভব বিস্ময় ফোটাবার চেষ্টা করে বললাম, ‘মারুতি কেনোনি, কিন্তু পেয়েছ— মানে! লটারিতে নাকি?’ ছেলেমানুষের মতো হাসতে হাসতে জয়িতা বলল, ‘লটারিতে নয়, তবে লটারির মতো বলতে পারেন। এখন নয়, দুপুরে খেতে খেতে সব বলব।’ আমি কৌতূহল দমন করার ভঙ্গি করে বললাম, ‘বেশ!’
জয়িতার চেহারাও সেই আগের মতো ঝকঝকে। হাসিখুশি গলায় বলল, ‘যাক, অ্যাদ্দিন বাদে তা হলে মনে পড়ল আমাদের কথা! আগের দিন আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি বলে কী বিচ্ছিরি যে লেগেছিল আমার! আসুন, দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন।’ ঘরে ঢুকে আড়চোখে চারদিক দেখে নিলাম। ঘরের চেহারা আবার সেই আগের মতো সাজানোগোছানো। ঘরের কোথাও কোনও বাড়তি জিনিস নেই। শো-পিসের মাথায় সেই পেতলের টব। গাঢ় সবুজ লতানো গাছ টবের গা বেয়ে নেমে এসেছে নীচের দিকে। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল সুখী দম্পতি। এক ফাঁকে রূপেশ ওর স্টাডি আর গেস্টরুম দেখিয়ে দিল আমাকে। ঘর দুটো আগের সেই রুচিসম্মত চেহারায় ফিরে এসেছে আবার। কিছুক্ষণ গল্প করার পরে কফি বানাতে রান্নাঘরে গেল জয়িতা। রান্নাঘর এ ঘর থেকে একটু দূরেই। আমি ফিসফিস করে রূপেশকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোদের সেই গোডাউনের মালপত্তরগুলো গেল কোথায়?’ গলার স্বর আরও নীচে নামিয়ে রূপেশ বলল, ‘সেন্টুদার দয়ায় এ যাত্রায় খুব বেঁচে গিয়েছি। তুই সেদিন চলে যাওয়ার সাত দিন বাদেই কাগজে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল— গিভ লটস অব স্মল আইটেমস অ্যাণ্ড টেক ওয়ান মারুতি। গাদা-গাদা ছোটখাটো জিনিসপত্র দিলেই মারুতি উপহার। তবে বদলাবার জন্যে ছোটখাটো জিনিসপত্র বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত অবশ্য কোম্পানির একার এবং সেটাই চূড়ান্ত। পছন্দ হলে নেবে, না হলে নয়।’
‘সেন্টুদার নাম জানিস না! উনি অবশ্য বিখ্যাত প্রসাদ সি পল নামে। কনসালট্যান্ট। সমস্যা যত বিদঘুটেই হোক না কেন, উনি একটা পথ ঠিক বাতলে দেন। এই তো কিছু দিন আগে একজনের বাপের শ্রাদ্ধের স্পনসর ধরে দিয়েছেন। উনি পারেন না, এমন কাজ নেই। তবে আমার কপাল তো— আমার কপালের দোষেই হয়তো ওঁর আইডিয়া ভেস্তে যাবে। সব ভেঙে বলেছি সেন্টুদাকে। উনি ভরসা দিয়ে বলেছেন, চেষ্টা করবেন। দেখি কী হয় এখন—’ আরও ঘণ্টা দেড়েক সমব্যথীর ভঙ্গিতে রূপেশের কথাবার্তা শোনার পরে বিদায় নিয়েছিলাম আমি। এর পরে মাস পাঁচেক আর রূপেশের বাড়িমুখো হইনি। কিন্তু তারপর একটা কাজে ওদের পাড়ার দিকে যেতে হয়েছিল। চটপট কাজ মিটে যাওয়ার পরে দোনামনা শুরু হয়ে গিয়েছিল আমার। যাব কি একবার? কিন্তু গিয়ে কী দেখব কে জানে! কৌতূহলের চাপ এড়ানো কঠিন। এক সময় দেখি, পায়ে পায়ে পৌঁছে গিয়েছি রূপেশদের ফ্ল্যাটের দরজায়। ডোরবেলের বোতামে আঙুল ঠেকাবার আগে ইতস্তত করেছিলাম বেশ কয়েকবার, শেষকালে বেল বাজিয়ে দিয়েছিলাম। দরজা খুলল রূপেশ। ওর চেহারা আবার সেই আগের মতো ঝলমলে। হইহই করে উঠে বলল, ‘তোকে কম করে বার সাতেক ফোন করেছি, একবারও ধরতে পারিনি। কোথায় থাকিস বল তো! আয় আয়, ভেতরে আয়। জয়ী, দেখো কে এসেছে!’
‘গড়িয়াহাটের শপার্স’ মার্টে। এক ডজন বিলিতি ছুরি কিনলে দশটা উপহার পাওয়া যাবে।’ ‘বলেছে তোকে?’ ‘বলা-কওয়ার পাট চুকে গিয়েছে বহু দিন। ছটফটে ভঙ্গিতে ওর চলাফেরা শুরু হলেই আমি আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারি। আজকের কাগজে আধ পাতা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে— বাই ওয়ান, টেক টেন। এক বাক্স ছুরি কিনলে দশটা উপহার।’ আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু অতগুলো ছুরি দিয়ে কী করবে জয়িতা?’ ‘কিচ্ছু না। ছুরি উপলক্ষ, লক্ষ্য দশটা উপহার। তবে আমার যে ধরনের মানসিক অবসাদ শুরু হয়েছে এখন, ওই ছুরিগুলো হয়তো আমার জ্বালাযন্ত্রণা জুড়োবার কাজে লেগে যাবে একদিন।’ আহত মানুষের গলায় বললাম, ‘বাজে কথা বলিস না তো। আমার মন বলছে, সমস্যাটা মিটে যাবে শিগগিরই।’ ‘জানি না মিটবে কি না, তবে আমার ভরসা এখন সেন্টুদা।’ ‘সেন্টুদা কে?’
’ ‘বাড়তি আছে বলে। তা, আমি জয়িতাকে বললাম— মেয়ে না হয়ে ছেলের মুখেভাত হলে দাড়ি কামাবার মেশিন দিলেও দিতে পারতে— ঠিক আছে, উপহার পাওয়ার না হয় বিশ বছর বাদে সে দাড়ি কামাবে। উত্তরে জয়িতা বলল— যে উপহার পেয়েছে তাকেই যে সেই জিনিসটা ব্যবহার করতে হবে— তার কোনও মানে নেই। ওর বাবাই তো এখন ব্যবহার করতে পারে। বললাম, ওই বাচ্চা মেয়েটার বাবা তো দাড়ি রাখে। আমার কথায় চটে উঠে জয়িতা বলেছিল: বিশ-বাইশ বছর বাদে মেয়েটার তো বিয়ে হবে, তখন না হয় ওর বরই দাড়ি কাটবে এই ব্যাটারি-শেভার দিয়ে। এর উত্তরে কী বলব বল? আমি এখন একদম বোবা হয়ে গিয়েছি।’ সমস্যাটা যে অত্যন্ত জটিল— এ ব্যাপারে আমার আর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সমাধানের কোনও একটা গলিপথও আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল না। শুকনো মুখে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে রূপেশ বলল, ‘জয়িতা আজ সাত-তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে কোথায় ছুটেছে আমি জানি।’ ‘কোথায়?’
‘বুঝিয়ে বুঝিয়ে মুখে ব্যথা হয়ে গিয়েছে। কোনও কাজ হয়নি। এখন তাই একদম চুপ করে থাকি। ওই সঙ্গে যদি চোখও বন্ধ করে রাখতে পারতাম— শান্তি পেতাম! আচ্ছা, এটা কী বল তো? পাশের টেবিলের ওপরে রাখা ডালপালাসমেত মস্ত একটা আঙুরের থোকার মতো দেখতে জিনিসটার দিকে আমার নজর পড়েছিল আগেই। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী?’ ‘এটা হচ্ছে মাল্টি প্লাগস, প্লাগ এন সকেটস। একগুচ্ছ প্লাগের এক্সটেনশন কর্ড। এই জিনিস তিনটে এসে ঢুকেছে।’ ‘তিনটে কেন?’ ‘এই প্রশ্নটা জয়িতাকেও করেছিলাম আমি। তা, ও বলেছিল: গাদা-গাদা জিনিসপত্র উপহার পাওয়া যায়— দু-চারটে তো কমন হতেই পারে। উপহারের সেট থেকে কোনও আইটেম বদলে নেওয়ার নিয়ম নেই। আমাদের তো পাঁচটা সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে হয়— তখন এই কমন আইটেমগুলোর ভেতর থেকে উপহার দিলেই সমস্যা মিটে যাবে।’ ‘ভালই তো বুদ্ধি দিয়েছে জয়িতা।’
‘ঠিক, কিন্তু তুই এ সব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস কেন?’ ‘ঘামাচ্ছি কি আর সাধে! তবে ইদানীং আর ও নিয়ে আগের মতো চিন্তাভাবনা করি না। পুরো ব্যাপারটাই হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। এখন আমি সব কিছুর জন্যে প্রস্তুত। হয়তো কিছুকাল বাদে দেখবি, এই ফ্ল্যাট ছেড়ে আমি চলে গিয়েছি—’ রূপেশের চোখমুখ বেশ থমথমে হয়ে উঠেছিল। একটু জোর দিয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে? ব্যাপারটা কি একটু খুলে বলবি?’ শুকনো মুখে উত্তর দিল রূপেশ, ‘শুনলে মনে হবে খুবই তুচ্ছ কারণ। কিন্তু এটার চেহারা এখন এমনই দাঁড়িয়েছে যে, এই নিয়ে জয়িতার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়াটাও বুঝি অসম্ভব নয়।’ হাতের সিগারেট অ্যাশট্রের মধ্যে গুঁজে দিয়ে আবার মুখ খুলল রূপেশ। ‘জয়িতার এই বাতিকটা হয়েছে মাস সাত-আট। বাতিক না বলে রোগ বলাই ভাল, জটিল রোগ। সপ্তাহে তিন-চার দিন ওই ধরনের বিজ্ঞাপন বার হয় কাগজে, আর জয়িতা ওগুলো কেনার জন্যে ছোটে। একটাও কিন্তু প্রয়োজনের কেনাকাটা নয়। গাদা-গাদা টাকা গচ্চা যাচ্ছে স্রেফ উপহার পাওয়ার লোভে। আর উপহারের কী ছিরি, দেখলি তো ওই দুটো ঘরে। দুটো ঘরে উপচে পড়ার পরে মালপত্তর এখন ঢুকতে শুরু করেছে বসার ঘরে। দু’ দিন পরে তো রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।’ ‘তুই জয়িতাকে বুঝিয়ে বলিসনি?’
‘ধর, উপহার হিসেবে পেলি। এখন পাওয়ারকাটের ঝঞ্ঝাট নেই, তুই শহরের বাসিন্দা, পথেঘাটে টর্চ জ্বালাবার কোনও প্রয়োজন হয় না— এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উপহার পাওয়া ব্যাটারিগুলো নিয়ে তুই কী করবি?’ হেসে উঠে বললাম, ‘কী আবার করব— তোকে দিয়ে যাব, তুই তোর রিটেল শপের শো-উইণ্ডোতে রেখে দিবি।’ আমার রসিকতায় আচমকা গম্ভীর হয়ে গেল রূপেশ। তারপর গম্ভীর মুখে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ভাসাতে লাগল বাতাসে। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ সিগারেট টানার পরে বলল, ‘আজকাল খবরের কাগজ খুললেই একটা বিজ্ঞাপন প্রায়ই নজরে পড়ে— বাই ওয়ান, টেক টু। দেখেছিস নিশ্চয়ই?’ হেসে জবাব দিলাম, ‘না দেখে আর উপায় কী? খবরের কাগজ খুললেই বিরাট বিরাট সব বিজ্ঞাপন— কখনও-কখনও আবার পুরো পাতা জোড়া।’ ‘এগজ্যাক্টলি। অসংখ্য প্রোডাক্ট, কিন্তু বিজ্ঞাপনের ভাষা ওই একটাই। হালে দেখছি উপহারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কখনও দুই। কখনও চার। কিছু দিন আগেই একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল— বাই ওয়ান, টেক টেন। ভাবতে পারিস! কিছু একটা কিনলি, সঙ্গে উপহার দিচ্ছে দশ-দশটা! একটা কিনুন, দশটা নিন। এটা হয় কখনও? পাকা মাথার ব্যবসাদাররা তো ব্যবসা লাটে তুলে দিয়ে দান খয়রাত করতে বসেনি। দশটা উপহার দিক আর বিশটা দিক— ওরা তো মাল বেচে লাভ করছে। আমার মনে হয়, মোটা লাভই করছে। নয় কি?’
রূপেশ আমার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘চল এবার ও ঘরে গিয়ে বসি। বসার ঘরেও এখন মালপত্র ঢুকতে শুরু করেছে, দু’ দিন বাদে তোকে এখানে হয়তো আর বসার জায়গাটুকুও দিতে পারব না—’ বসার জায়গায় ফিরে এসে রূপেশ বলল, ‘তোর সিগারেট না খাওয়ার ব্যাপারটা কি এখনও চলছে?’ মৃদু হেসে বললাম, ‘চলছে, নতুন করে আর ধরিনি এখনও।’ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে শুকনো গলায় রূপেশ বলল, ‘আমি দিব্যি ছেড়ে দিয়েছিলাম। আড়াই বছর একটাও খাইনি। এখন আবার ধরেছি। সিগারেট ধরালে দেখেছি টেনশন একটু কাটে।’ ‘কিসের টেনশন?’ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল রূপেশ, ‘আচ্ছা, তোকে কেউ যদি তিন ডজন টর্চের ব্যাটারি দেয়, তুই নিবি?’ ধাঁধা জিজ্ঞেস করার মতো প্রশ্ন। হেসে বললাম, ‘লোকে আমাকে খামোখা তিন ডজন ব্যাটারি দিতেই বা যাবে কেন?’
রূপেশ থমথমে গলায় বলল, ‘এটাকে এখন স্টাডি না বলে গোডাউন বলাই ভাল। গোডাউন এই ফ্ল্যাটে এখন আরও একটা আছে, আয়।’ কোণের দিকের ঘরটার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এ ঘরেও ঢুকতে পারবি না। এখান থেকেই একবার দেখে নে।’ ঘরের ভেতর দিকে তাকিয়ে আমি ধরতে গেলে আঁতকেই উঠেছিলাম। ঝকঝকে-তকতকে গেস্টরুমটার এ কী দশা! শুধু মেঝেয় নয়, খাটের ওপরেও গাদা-গাদা মালপত্র চাপানো। পাশে একগাদা প্যাকিং-বক্স। বোঝাই যায়, বাক্স খুলেই জিনিসগুলো বার করা হয়েছে। খসখসে গলায় রূপেশ বলল, ‘এখন আর এদিকে ফিরেও তাকাই না, তবে প্রথম দিকে মালপত্তরের একটা হিসেব নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। তখনকার হিসেবের খানিকটা তোকে শোনাচ্ছি। এ ঘরে তখন পাঁচটা বার্নার, সাতটা মিক্সি, দশটা ওয়াল-ক্লক, তিনটে ব্যাটারি শেভার, দুটো মাইক্রোওয়েভ ওভেন ছিল। পরের দিকের হিসেব আর রাখার চেষ্টা করিনি।’ আমার বিস্ময় কাটতে চাইছিল না। কয়েক মুহূর্ত থমকে থাকার পরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু এগুলো কেন? তোরা কি কোনও ব্যবসায় নেমেছিলি? নানা ধরনের জিনিসপত্র নিয়ে কোনও রিটেল শপ—’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পরে রূপেশ বলল, ‘চল্‌ তোকে ওই ঘর দুটোর হাল দেখিয়ে নিয়ে আসি আগে।’ ‘কোন ঘর দুটোর কথা বলছিস?’ ‘একটু আগে যে দুটো ঘরের কথা তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিলি— একটা সময় যা আমার স্টাডি আর গেস্টরুম ছিল—।’ রূপেশের এই অদ্ভুত কথাটার কোনও মানে বুঝতে পারলাম না। ‘আয়’ বলে রূপেশ এগিয়ে গেল, আমি ওর পিছু নিলাম। বসার ঘর থেকে ভেতরের ঘরে যাওয়ার মুখে একটা করিডর। কিন্তু করিডরে পা দেওয়ার উপায় ছিল না। নানা ধরনের জিনিসপত্র এলোমেলো ভাবে ছড়ানো ছিল। একটু ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে এগোতে হয়েছিল আমাকে। করিডরের শেষেই রূপেশের স্টাডি। বিষণ্ণ গলায় ও বলল, ‘ভেতরে বোধহয় ঢুকতে পারবি না, এখান থেকে একবার উঁকি দে।’ উঁকি দিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কী সুন্দর স্টাডি ছিল, দেওয়াল জোড়া বইয়ের আলমারি, জানলার ধারে পড়ার চেয়ার-টেবিল। ঘরের এদিক-ওদিক পাথর আর ব্রোঞ্জের তৈরি কয়েকটা পাথরের মূর্তি সাজানো ছিল। কোণের দেয়ালে মস্ত এক অয়েলপেন্টিং ছিল, আর তার পাশে ছিল পুরনো আমলের একটা আরামকেদারা। একটু দূরে মিউজিক সিস্টেম। স্টাডিটা আমার এত ভাল লেগেছিল যে, সব কিছু মনে আছে পরিষ্কার। কিন্তু কোথায় সে সব! হয়তো আছে, ঘরের এক-দেড় মানুষ সমান মালপত্র আর প্যাকিং বক্সে ঢাকা পড়ে গিয়েছে।
বাইরে বেরুবার শাড়িটাড়ি পরেই খেতে বসেছিল জয়িতা। আলমারি খুলে হ্যাণ্ডব্যাগ বার করে নিয়ে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমি তাহলে আসি এখন—’ ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, ঠিক আছে। পরে না হয় একদিন—’ জয়িতা আর একটাও কথা না বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। এ পাড়াটা খুব নিরিবিলি, সিঁড়ি দিয়ে ওর নেমে যাওয়ার শব্দও শুনতে পেয়েছিলাম। দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল রূপেশ। ভঙ্গিটা এমন— যেন একটানে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে ওকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অসাড় শরীর। আরও কিছুক্ষণ একই ভাবে বসে থাকার পরে রূপেশ উঠে পড়ে বসার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে আসতে আসতে বলল, ‘আমি ক’ দিন ধরে তোর কথাই খুব ভাবছিলাম। বিশ্বাস কর—’ এ কথাটা অবিশ্বাস করার কিছু নেই। রূপেশ আমার ছেলেবেলার বন্ধু, খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। নিজের জীবনের এই রকম একটা বিপর্যয়ের কথা যাকেতাকে তো আর বলা যায় না, সুতরাং আমার সঙ্গ ও চাইতেই পারে। কিন্তু এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমার ভূমিকা কী হতে পারে! কী হওয়া উচিত!
বিয়ে হয়েছে মাত্র সাত বছর। সুখী দম্পতির আদর্শ উদাহরণ ছিল রূপেশ আর জয়িতা। ওরা কেমন যেন হাওয়ায় ভেসে সংসার করত। সুখের সংসার। সেই সংসারে কি অন্য কোনও পুরুষ বা নারী এসে ঢুকেছে? আরও কী যেন ভাবতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় জয়িতা ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে চমকে উঠে বলল, ‘ওমা! আপনি কতক্ষণ! কই, কেউ তো আমাকে বলেনি!’ ওদের দুজনের সংসারে চব্বিশ ঘণ্টার কাজের লোক বলে কেউ নেই। তাহলে ‘কেউ’ বলতে কি রূপেশ! ওদের মধ্যে কি এখন স্বাভাবিক ভাবে কথা বলাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে! একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, ‘এই তো এক্ষুনি এলাম—’ কয়েকটা মুহূর্ত থমকে থাকার পরে অপ্রস্তুত মুখে জয়িতা বলল, ‘আপনি এলেন অথচ আমি… আমাকে এখন একটু বেরুতে হচ্ছে—’। বিব্রত হয়ে উঠে পড়ে বললাম, ‘আরে! কী আশ্চর্য! বেরুবার যখন দরকার আছে, নিশ্চয়ই বেরুবে। আমি এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম। তাড়াতাড়ি কাজটা মিটে গেল। ভাবলাম— দেখি তোমরা বাড়িতে আছ কি না। পরে আবার একদিন আসা যাবে। তোমরা বেরুচ্ছ যখন বেরিয়ে পড়ো।’ জয়িতা শুকনো মুখে বলল, ‘আমি একাই বেরুচ্ছি, আপনি বসুন।’
শুকনো মুখে জবাব দিল রূপেশ, ‘ওখানে যাওয়া যাবে না।’ ‘গেস্টরুমে চল্‌ তাহলে। লাগোয়া বারান্দাটা তো দুর্দান্ত!’ ‘ওখানেও যাওয়া যাবে না।’ ‘যাওয়া যাবে না! কেন?’ রূপেশ ওর গলা বেশ খানিকটা নামিয়ে বলল, ‘তোকে একটু পরে সব বলছি।’ আমার আর কোনও সন্দেহ রইল না যে, ওদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যাচ্ছেতাই রকমের খারাপ হয়ে গিয়েছে। এর পরে যা বাকি থাকছে তা হয়তো তিক্ততা দূর করার জন্যে আইনি ব্যবস্থা। খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বাদেই জয়িতা বেরিয়ে যাবে এই ফ্ল্যাট থেকে, তারপরেই আমাকে ওর জীবনের দুঃখের কাহিনী শোনাবে রূপেশ। বেশ অস্বস্তি শুরু হয়ে গিয়েছিল আমার। এক-একবার মনে হচ্ছিল, আজ এখানে না এলেই ভাল হত! কিন্তু আগে থেকে কী করে বুঝব মাত্র এক বছরের মধ্যে ওদের দাম্পত্যজীবন এতখানি খারাপ হয়ে গিয়েছে! এদিকে একটা কাজ পড়েছিল, তখনই ঠিক করেছিলাম ওদের বাড়িতে একটা ঢুঁ মেরে যাব। এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে গত বছরের সুখস্মৃতি কাজ করেছিল অনেকখানি। কিন্তু ওদের সুখের সংসার এভাবে নষ্ট হওয়ার কারণটা কী?
আমাকে থামিয়ে দিল রূপেশ। ‘না। যেখানে যাওয়ার সেখানেই যাচ্ছে—’ এ কথার জবাবে বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলাম না। আড়চোখে বসার ঘরটা দেখে নিলাম আমি। ঘর কেমন যেন শ্রীহীন হয়ে যাচ্ছে। ওদিকের ঘর দুটোর বেশ কিছু জিনিসপত্র এ ঘরে এসে ঢুকেছে। রাখার মধ্যে কোনও ছিরিছাঁদ নেই, কেমন যেন ডাঁই করে ফেলে রাখা। অথচ বছরখানেক আগে এ ঘরটা ছিল তাকিয়ে দেখার মতো। রুচিসম্মত আসবাবপত্র, দেয়ালে শো-পিস, বইয়ের আলমারির মাথায় ঝকঝকে পেতলের টবে পাতাবাহার। পেতলের ওই টবটাকে এখন দেখা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, অত সুন্দর বইয়ের আলমারিটাকে ঢেকে দিয়েছে ও ঘর থেকে টেনে আনা ওয়ার্ডরোবটা। বেতের চেয়ারে গোটা শরীরটা ছড়িয়ে দিয়ে বসেছিল রূপেশ। চোখেমুখে বিষণ্ণ ভাব। আমি ওর ছেলেবেলার বন্ধু, আমার সঙ্গে সৌজন্য দেখাবার কোনও ব্যাপার নেই, কিন্তু কিছু তো বলবে! বুঝতে পারছিলাম, বছরখানেকের মধ্যে জল বেশ ঘোলা হয়ে গিয়েছে। আকাশপাতাল ভাবা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনও কাজ নেই আমার। বছর চারেক এই ফ্ল্যাটটা কিনেছে রূপেশ। প্রায় বারোশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। চারটে ঘর। এদিকে বড়-সড় স্টাডি। আর গেস্টরুম। পাশের ঘরটাই ওদের শোবার ঘর। দু’ দিকে দুটো ঝুলবারান্দা। বছরখানেক আগে রূপেশ আমাকে কখনও গেস্টরুম, কখনও স্টাডি কখনও ঝুলবারান্দায় নিয়ে গিয়েছিল। ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে মনের মতো করে সাজানো ফ্ল্যাট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানোর মধ্যে বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিকতা নেই। সেদিন ওদের সুখের ভাগ নিতে আমার খুবই ভাল লেগেছিল। পুরনো স্মৃতির চাপেই বলে বসলাম, ‘চল্‌, তোর স্টাডিতে গিয়ে বসি।’

দুঃখিত!