হিমু : হুমায়ুন আহমেদ–১১ তম অংশ

 

রূপার চিঠি এসেছে। কী অবহেলায় খামটা মেঝেতে পড়ে আছে। আরেকটু হলে চিঠির উপর পা দিয়ে দাঁড়াতোম। খাম খুলে
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম—এতবড় কাগজে একটি মাত্র লাইন, তুমি কেমন আছ? নাম সই করেনি, তারিখ দেয়নি। চিঠি কোথেকে লেখা তাও জানার উপায় নেই। শুধু একটি বাক্য—তুমি কেমন আছ? প্রশ্নবোধক চিহ্নটি শাদা কাগজে কী কোমল ভঙ্গিতে আঁকা হয়েছে। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে হল রূপার আগের চিঠি পুরোটা পড়া হয়নি। কী লেখা ছিল সেই চিঠিতে? কোনোদিনও জানা যাবে না, কারণ চিঠি হারিয়ে ফেলেছি। নীতুকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যাবে। চিঠিটা নীতু পড়েছে। নীতুর কাছে যেতে হবে। যেতে ভরসা পাচ্ছি না, কারণ ইয়াদের খোঁজ পাচ্ছি না। সে আগের জায়গায় নেই। তুলসী মেয়েটি ছিল। সে কিছু জানে না কিংবা জানলেও কিছু বলছে না।
নীতুর ম্যানাজারও জানে না। নীতু যাদের ইয়াদের পেছনে লাগিয়ে রেখেছিল তাদের ফাঁকি দিয়ে ইয়াদ সটকে পড়েছে। যে-মানুষ ভোল পাল্টে ঢাকার ভিক্ষুকদের সঙ্গে মিশে গেছে তাকে খুঁজে বের করবে। নীতু যখন তার সামনে এসে দাঁড়াবে তখন ইয়াদেক মাথা নিচু করে তার সঙ্গেই যেতে হবে, কারণ নীতুর আছে ভালবাসার প্রচণ্ড শক্তি।এই শক্তি আগ্রাহ্য করার ক্ষমতা ঈশ্বর মানুষকে দেননি। এই ক্ষমতা তিনি শুধু তাঁর কাছেই রেখে দিয়েছেন।
ইয়াদ কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হল মোরশেদ। সেও উধাও হয়ে গেছে। মজনু মিয়ার ভাতের হোটেলে সে খেতে আসে না। পুরানো বাসায় যায় না। তাঁর আত্মীয়স্বজনদের ঠিকানা জানি না। তবে সে তার আত্মীয়স্বজনদের কাছে যাবে, তাও মনে হয় না।
সে একমাত্র এষার কাছেই যেতে পারে। কেন জানি মনে হচ্ছে তার কাছেও যায়নি। বড় শহরে হঠাৎ হঠাৎ কিছু লোকজন হারিয়ে যায়—কেউ তাদের কোনো খোঁজ দিতে পারে না। মোরশেদও কি হারিয়ে গেছে? অদৃশ্য হয়ে গেছে? প্রকৃতি মানুষকে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। অদৃশ্য হবার ক্ষমতা দেয়নি। তবে মানুষের সেই অক্ষমতা প্রকৃতি পুষিয়ে দেবার ব্যবস্থাও করেছে—কেউ অদৃশ্য হতে চাইলে প্রকৃতি সেই সুযোগ করে দেয়।
একদিন গেলাম এষাদের বাড়ি। এষা দরজা খুলে আনন্দিত গলায়, আরে আপনি।
‘কেমন আছেন?’
‘ভালো আছি। ঐ যে আপনি গেলেন আর খোঁজ নেই। দাদিমা রোজ একবার জিজ্ঞেস করে লোকটা এসেছে।’
‘উনি কি আছেন?’
‘না, নেই। আমার কি ধারণা জানেন? আমার ধারণা আপনি খোঁজখবর নিয়ে আসেন। যখন দাদীমা থাকে না, তখনি উপস্থিত হন। আসুন, ভেতরে আসুন।’
আজ এষাকে অনেক হাসিখুশি লাগছে। মনে হচ্ছে তার বয়সও কমে গেছে। উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরেছে। তবে আজো খালি পা।
ঐদিন আপনি দাদীমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। উনার অষুধপত্র লেগেছিল। আপনি কিনে দিলেন। দাদীমা ঐ টাকা আপনাকে দিতে চাচ্ছেন। সে জন্যেই তিনি আপনাকে এত খোঁজ করছেন। আমি দাদীমাকে বললাম, তুমি শুধু-শুধু ব্যস্ত হচ্ছ—টাকা দিলেও উনি নেবেন না।’
‘টাকা নেব না এই ধারণা আপনার কেন হল?’
‘আপনাকে দেখে, আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে। আমি মানুষকে দেখে অনেক কিছু বুঝতে পারি।’
‘না, বুঝতে পারেন না। টাকা আমি নেব। সব মিলিয়ে একচল্লিশ টাকা খরচ হয়েছে। আজ টাকাটা নিতেই এসেছি।’
‘আপনি সত্যি বলছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘বসুন, টাকা নিয়ে আসছি।’
এষা টাকা নিয়ে এল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। এষা বলল, আপনি বসুন। আমি আবার বসলাম। এষা বসল আমার সামনে।সহজ গলায় বলল, আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমি সামনের সপ্তাহে দেশের বাহিরে চলে যাচ্ছি। আমেরিকার নিউজার্সিতে আমার মেজো ভাই থাকেন। ইমিগ্রেন্ট। তিনি আমার জন্যে গ্রীন কার্ডের ব্যবস্থা করেছেন। আমি তাঁর কাছে চলে যাব।
‘বাহ্,ভাল তো!’
‘ভাল-মন্দ জানি না। ভাল-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামাইনি।’
‘ভাল হাবরই সম্ভাবনা। নতুন দেশে, সম্পূর্ণ নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবেন। এখানে থাকলে হঠাৎ-হঠাৎ পুরানো স্মৃতি আপনাকে কষ্ট দেবে। হয়তো হঠা একদিন মোরশেদের সঙ্গে পথে দেখা হল। আপনি কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না, তিনিও ভেবে পাচ্ছেন না। কিংবা ধরুন খিলগাঁয় আপনাদের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ মনে হল, আরে, এই বাড়ির বারান্দায় চেয়ার পেতে জোছনা রাতে দু’জন বসে কত গল্প করেছি…’
এষা আমাকে থামিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এসব আমাকে কেন বলছেন?
‘এম্নি বলছি।’
‘শুনুন হিমু সাহেব! আপনি খুব সুক্ষ্ণাভাবে আমার মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।’
‘চেষ্টা করতে হবে কেন ? আপনার ভেতর এম্নিতেই অপরাধবোধ আছে। দেশ ছেড়ে চলে যাবার পেছনেও এই অপরাধবোধ কাজ করছে।’
‘সেটা নিশ্চয়ই দুষণীয় নয়।’
‘দূষণীয়। মানুষকে পুরোপুরি ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে এমন ক’টি জিনিসের একটি হল অপরাধবোধ। আপনি এই অপরাধবোধ ঝেড়ে ফেলুন।’
‘কীভাবে ঝেড়ে ফেলব?’
‘দেশ ছেড়ে যাবার আগে মোরশেদ সাহেবের সঙ্গে একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি করুন। কথা বলুন, গল্প করুন। তার একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া যায় কিনা দেখুন। চাকরি খোঁজার ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য ও করতে পারি। কিছু ক্ষমতাবান মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।’
‘হিমু সাহেব। আপনি নিতান্তই আজেবাজে কথা বলছেন। আমি এর কোনোটিই করব না। এগারো তারিখ বেলা তিনটায় আমার ফ্লাইট। আমি অসম্ভব ব্যস্ত। তা ছাড়া ইচ্ছাও নেই।’
‘টিকিট কাটা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, মেজো ভাই টিকিট পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট।’
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, এষা, আপনি কিন্তু যেতে পারবেন না। আপনাকে থাকতেই হবে এই দেশেই।
‘তার মানে!’
‘মানে আমি জানি না। আমি মাঝে-মাঝে চোখের সামনে ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। আমি স্পষ্ট দেখছি আপনি মোরশেদ সাহেবের হাত ধরে একটা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন।’
‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন?’
‘ভয় দেখাচ্ছি না। কি ঘটবে তা আগেভাগে বলে দিচ্ছি।’
‘প্লীজ, আপনি এখন যান। আপনার সঙ্গে আমার কথা বলাই ভুল হয়েছে। শুনুন হিমু সাহেব, এগারো তারিখে বেলা তিনটায় আমার ফ্লাইট—আপনার কোনো ক্ষমতা নেই আমাকে আটকানোর। প্লীজ এখন যান। আর কখনো এখানো এসে আমাকে বিরক্ত করবেন না।’
আমাকে দু’টা টেলিফোন করতে হবে। রিকশা নিয়ে তরঙ্গিণী স্টোরে উপস্থিত হলাম। নতুন ছেলেটা কঠিন চোখে তাকাচ্ছে। আমি বললাম, বল পয়েন্ট কিনতে এসেছি। এই নিন দশ টাকা। ছেলেটার কঠিন চোখে ভয়ের ছায়া পড়ল। সে আমাকে বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না বলেই ভয় পাচ্ছে।
‘কয়েকদিন আগে এক ম্যানেজার সাহেবকে কলম কিনতে পাঠিয়েছিলাম। এসেছিল?’
ছেলেটা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তার চোখে ভয় আরো গাঢ় হচ্ছে।
‘সেই কলমেও লেখা হচ্ছে না বলেই আরেকটা কেনার জন্যে আসা।’
‘ভাইজান, আপনার পরিচয় কি?’
‘আমার কোনো পরিচয় নেই। আমি কেউ না। আমি হলাম নোবডি। টেলিফোন ঠিক আছে/’
‘জ্বি আছে।’
‘দু’টা টেলিফোন করব।’
প্রথম টেলিফোন বাদলকে। বাদল চমকে উঠে চিৎকার করল—কে, হিমুদা না?
‘হুঁ।’
‘কোথেকে টেলিফোন করছ?’
‘কোথেকে আবার? জেলখানা থেকে।’
‘জেলখানা থেকে টেলিফোন করতে দেয়?’
‘দেয় না, তবে আমাকে দিয়েছে। জেলার সাহেব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’
‘তা তো দেবেনেই।তুমি চাইলে কে “না” বলবে। তোমার কতদিনের জেল হয়েছে?’
‘ছ’মাস।’
‘সে কী। বাবা যে বলল, এক বছর।’
‘এক বছরেরই হয়েছিল। ভাল ব্যবহারের জন্যে মাফ পেয়েছি।’
‘তা হলে তোমার সঙ্গে আর মাত্র তিন মাস পর দেখা হবে।’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার দারুণ লাগছে। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।’
‘তুই আমার একটা কাজ করে দে বাদল। একজন লোককে খুঁজে বের করে দে। তাঁর নাম মোরশেদ।’
‘কোথায় খুঁজব?’
‘কোথায় যে সে আছে বলা মুশকিল। তবে আমার মনে হয় ১৩২ নম্বর খিলগাঁয় একতলা একটা বাড়ির সামনে সে গভীর রাতে একবার-না-একবার আসে। ঐ বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায়টা সে একটা আমগাছ দেখতে পায়। আসলে কোনো গাছ নেই, কিন্তু লোকটা দেখে। গাছটা দেখার জন্যেই সে প্রতিরাতে একবার সেখানে যাবে। আমার তাই ধারণা।’
‘বল কী!’
‘ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। জেল থেকে বের হয়ে তোকে সব গুছিয়ে বলব। এখন তোর কাজ হচ্ছে ঐ লোকটাকে বের করা । এবং তাঁকে বলা সে যেন অবশ্যি ১১ তারিখ বেলা তিনটার আগেই এয়ারপোর্টে বসে থাকে।’
‘কেন হিমুদা?’
‘একজন মহিলা ঐ সময় দেশ ছেড়ে যাবেন। লোকটার সঙ্গে মহিলার দেখা হওয়া উচিত। বলতে পারিব না?’
‘তোকে যেতে হবে না। তুই শুধু খবরটা দে।’
‘আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। মোরশেদ সাহেবকে আমি নিজেও খুঁজে বের করতে পারতাম, কিন্তু আমার অন্য কাজ আছে। আমাকে যেতে হবে ইয়াদের সন্ধানে। নীতুর সঙ্গেও দেখা করতে হবে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!