
হিনা একটি পুতুল। জাপানি সংস্কৃতিতে ৩ মার্চ হিনামাতসুরি বা কন্যা উৎসব উদযাপিত হয়। এই উৎসবে মেয়েদের সুখ, স্বাস্থ্য ও সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করা হয়। সরকারি ছুটি না থাকলেও ফেব্রুয়ারির শেষের দিক থেকে প্রায় প্রতি ঘরেই এই আয়োজন শুরু হয়। পনেরোটি বিভিন্ন রকমের পুতুল দিয়ে সাজানো হয় হিনামাতসুরি স্টেজ, যেখানে রাজা ও রানির প্রতীকী দুটি পুতুল থাকে। সংস্কার অনুযায়ী, যদি ৪ মার্চ পর্যন্ত পুতুলগুলো সরানো না হয়, তবে সেই পরিবারের মেয়ের বিয়ে দেরিতে হয়।
গত বছর সিটি সাপ্পোরো সেন্টার থেকে বিদেশিদের জন্য হিনামাতসুরি উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। আমি ও আমার স্বামী লটারির মাধ্যমে রাজা-রানি নির্বাচিত হলাম। নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে আমাদের ঐতিহ্যবাহী কিমোনো পরানো হলো। সেই অনুষ্ঠানে আমাদের সাথে ছিল আমার জাপানি বন্ধু, মাইকো ইয়ামাউচি। অনুষ্ঠানের মাঝেই খেয়াল করলাম, মাইকো আমার দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে—যেন তার দৃষ্টি আমার মনের গভীরে কোথাও আঘাত করছে।
মাইকো আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল। সে একজন দোভাষী, যদিও বিমান সংস্থায় চাকরি করত। জাপানে আসার পর, ভাষাগত সমস্যার কারণে অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম না। তখন মাইকো আমাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করত। একসাথে কেনাকাটা, কফি পান কিংবা আড্ডা দিতে দিতে আমাদের সম্পর্ক গভীর হয়েছিল। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করতাম—যখনই সে আমার বাসায় আসত, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো কাজের চাপের জন্যই সে এত ক্লান্ত থাকে। তবে একদিন জানতে পারলাম, মাইকো একসময় বিবাহিত ছিল, যা সে কখনও আমাকে জানায়নি।
একদিন, তোবেতসু নামের একটি জায়গায় এক বাংলাদেশি পরিবারের বাসায় যাওয়ার পরিকল্পনা করি। তাদের একটি ছোট্ট শিশু হয়েছে, তাই আমরা শুভেচ্ছা জানাতে যাই। বাংলাদেশি আতিথেয়তায় মাইকো মুগ্ধ হয়েছিল, তবে বাচ্চাটিকে একবারও কোলে নেয়নি। তখনই প্রথমবার মনে হলো, মাইকোর মধ্যে যেন কোনো অদ্ভুত শূন্যতা আছে।
কিছুদিন পর, সে টোকিও থেকে ফেরার পর আমার জন্য একটি ছোট্ট পুতুল নিয়ে এলো। আমি রান্নাঘরের এক কোণে সেটি রেখে দিলাম। সেদিন থেকেই একের পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকল। দরজার কলিংবেল বেজে উঠত, অথচ বাইরে কাউকে পাওয়া যেত না। ফ্রাইপ্যানের তেল অকারণে গরম হয়ে আগুন দপদপ করতে লাগল। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা ঘটল এক রাতে।
সেদিন রাত ১০টা। আমি হোক্কে নামের এক ধরনের জাপানি মাছ বারবিকিউ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখি, মাইকো দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, ‘আজ কাজ তাড়াতাড়ি শেষ, তোমার স্বামী ফিরেছেন?’
আমি বললাম, ‘না, একটু দেরি হবে।’
সে রান্নাঘরে ঢুকে আমার সাথে যোগ দিল। আমি কিছুক্ষণ টিভি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তিন-চার মিনিট পর রান্নাঘর থেকে অস্বাভাবিক শব্দ আসতে লাগল। দরজা সামান্য খুলতেই আমার চোখ কপালে ওঠে। মাইকো বারবিকিউ করা মানুষের হাত আমার সামনে ধরে বলল, ‘আমি আজ অনেক মানুষের হাত এনেছি। এটা খাও! মানুষের হাতের বারবিকিউ খুব মজা!’
আমার সারা শরীর শিউরে উঠল। প্রচণ্ড ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম। মাইকোর চোখ দুটো উল্টে গিয়েছিল, তার মুখে রক্তের দাগ। সে হো হো করে হেসে বলল, ‘তুমি আমাকে নিজেই ডেকে এনেছো! তোমার সুখ, ভালোবাসা, স্বামী—সবকিছু চাই আমার! আমরা মানুষরূপী পিশাচ, তোমরা আমাদের চিনতে পারো না।’
তারপর আমার মনে শুধু অন্ধকার…
চোখ খুলে দেখি, স্বামী ডাকছেন, ‘ডিনার রেডি করো, আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে।’ আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, সব স্বাভাবিক। তাহলে কি সব স্বপ্ন ছিল? নাকি অন্য কিছু?
দুই সপ্তাহ পর মাইকোর ইমেল এলো, ‘আমি তোমার বাসায় আসতে চাই, তুমি কবে ফ্রি?’
আমি উত্তর দিলাম, ‘আমি এখন ব্যস্ত।’
ভয়াবহ সেই রাতের স্মৃতি আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মানুষের জীবন শুধু রহস্যে মোড়া নয়, বরং কিছু রহস্য জীবনের জন্য বিপজ্জনক। তাই, ভালোবাসার সাথে সাথে দৃষ্টির বিচক্ষণতাও জরুরি।