যুবকটি দ্রত পায়ে হাঁটে, কোথায় যাবে জানে না। ফার্মগেট চৌরাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে অতিক্রম করে যায় দ্রুতগামী শহরের গাড়ি।
সে গোনার চেষ্টা করে না। এভাবে কিছুক্ষণ প্রত্যহ সে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর হুট করে উঠে পড়ে মিরপুরের কোনো বাসে।
মিরপুর,
অনেক বেলা। সে কোথায় যাবে?
একদিন তারও যাওয়ার জায়গা ছিল। একটা রাস্তা ছিল ব্যক্তিগত, হেমন্তের বিকেলে ঝিম মেরে থাকা শিউলি তলার নিচ দিয়ে হৃদয় বরাবর। তার ওপাশে নিঝুম হিজল বাগান, কালো পানি বুকে নিয়ে নিঃশব্দে বয়ে চলে। কখনো কখনো খালের খাড়িতে ধাক্কা খেতে খেতে ভেসে যায় দুয়েকটা হিজল ফুল। সেসব নৈসর্গিক আলোছায়ারা যুবকটির সাথে প্রতারণা করেছিল, একদিন সে দেখে এক অনাহূত বৈরী বাতাসে ভেসে গেছে পথঘাট, অন্ধকার হিজলের তলা- তাই তো পকেটে এত অভিমান নিয়ে চুপচাপ শহর দেখে সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেনি। মেধা এবং টাকা কোনোটাই তার পরিমিত ছিল না। বিএ পাস করে চলে আসে ঢাকায়, যেমন অনেকেই আসে প্যান্টের পকেটে কাঁচা মফস্বল পুরে নিয়ে। যুবকের সুখস্মৃতি বলতে ওই সবেধন একটা হিজলগাছ আর তুমুল নিঃশব্দ নিয়ে বয়ে চলা কাকচোখ খালের পানি। আপাদমস্তক মনে রাখার মতো কোনো পুরুষালি বিশেষণ চিহ্ন যুবকটির নেই।
মিরপুরের বাসে বসে পচতে থাকে সে। তুমুল হট্টগোলে বোঝা যায় বাস আর সামনে যাবে না। মিছিলের সমন্বিত কণ্ঠস্বর গিলে খাচ্ছে শহরের বোবা আর্তনাদ, কিছুই শোনা যায় না। একটু দূরে বিকট আওয়াজে শব্দ সর্বস্ব ককটেল ফাটে, তাতে যাদের জীবন সুখের ডালিতে ভরা, যাদের ঘরে আছে রোমান্সের খোলা জানালা- কেবল তারাই ছোটাছুটি করে এ দিক সে দিক- মূল্যবান জীবন পকেটে নিয়ে। আলোকময় আগামীর জন্য কিছু উঠতি যুবক একটা গাড়িতে আলোকসজ্জা জ্বালিয়ে দেয়। লেলিহান জিহ্বা দাউ দাউ করে ওপরের দিকে উঠে যায়, সুদিন আর কত দূর সেটি দেখতে।
নির্বিকার যুবক, যার পকেটে মফস্বল ঠাসা; সে কোনোমতে দাঁড়িয়ে যায় একটা দোকানের কোনায়। তুমুল শব্দ নিয়ে ফেনিল গাঙের ঢেউয়ের মতো করে দোকান সমগ্রর শাটার নামতে নামতে তার দিকে এগিয়ে আসে। যুবকটি নিজের শরীর গলিয়ে দেয় এমনি এক শাটারের নিচে। ভেতরে অন্ধকার। তীব্র দিনের আলো থেকে অকস্মাৎ অন্ধকারে চোখ মানিয়ে নিতে সময় নিচ্ছিল, নেপথ্যে শোনা যায় পুলিশের বাঁশি, থেকে থেকে বুলেটের আওয়াজ আর বেসুরো পুলিশি গালাগাল। অন্ধকার আরেকটু সয়ে গেলে যুবকটি দেখে সুমসাম নৈঃশব্দ্য নিয়ে প্রবল বেগে বুকের ছাতি ওঠানামা করছে এমন আরো দুটো ছেলে তার গা লাগোয়া হয়ে দাঁড়িয়ে।
তাদের একজন বলে-
-একদম শব্দ করবেন না। আপনি শব্দ করলে আমাদের নাম হয়তো কাল সকালে পত্রিকায় দেখবেন। পুলিশের সাথে এনকাউন্টারে আমরা মরে গেছি।
যুবক শব্দ করে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
এরই মধ্যে চার জোড়া বুটের আওয়াজ যেন কলিজার ২ সে.মি কাছে দিয়ে চলে গেল।
একফালি ক্ষীণকায় আলোর রেখা ছেলে দু’টির ওপর এসে পড়ে।
রক্ত! একটা ছেলের ঊরুসন্ধি ভেসে যাচ্ছে লাল রক্তে। কিন্তু ছেলেটা অমন নির্লিপ্ত হাসছে কেন? এমন ঠাণ্ডা দু’টি চোখ পৃথিবীতে কোনো দিন কেউ দেখেছে কি না সেটাই ভাবতে থাকে ঝোলা শার্টের পকেটে একটা না-খাওয়া সিগারেট নিয়ে, যুবকটি।
কিছুক্ষণের মধ্যে চেনা-জানা পরিচিত শব্দগুলো ফিরে এলে সবাই রাস্তায় নেমে যায়। কিছুক্ষণের বিরতিতে পূর্ণোদ্যমে শহর আবার প্রস্তুত হয়ে ওঠে। যুবকটি বেরিয়ে পড়ে, সে আজকে হেঁটে হেঁটে নিরুদ্দেশ হবে বলে ঠিক করে নেয়। তার এই রাস্তায় যেহেতু কোনো হিজলগাছ নেই সেহেতু উলম্ব অট্টালিকার আনুভূমিক ছায়াকে অনুসরণ করে তার নিরুদ্দেশের পথটি সে বের করে নেয়।
সে হাঁটতে থাকে।
কিন্তু সেয়ানা ছায়াগুলো তাকে পালাতে দেয়নি, শেষ বিকেলে পথটি এসে শেষ হয় তার সস্তার মেসবাড়ির গলির মুখে।
অনেক রাত অব্দি তার চোখে ঘুম নেই। ঘুমেরা কোথায় যায়?
সুজাতার প্রশস্ত পিঠের ভাঁজ ধরে নেমে যায় ত্রিকোণ উপত্যকায়। সুজাতা যে পথে গেছে যুবকটি সে পথটার মানচিত্র ঘিলুর মধ্যে এঁকে নিয়েছিল। আজ সেই পথটার কথা মনে পড়ে তার। একদিন সুজাতার চোখে অমাবস্যা নামিয়েছিল সে, কেউ জানে না। তার সুগভীর নাভির ভেতরে গরম নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে কসম খেয়েছিল, আনারের সোনালি দানা মুখে নিয়ে গোঙাতে গোঙাতে কথা দিয়েছিল ফিরে দাঁড়ানোর। যুবকটি পরিযায়ী সুজাতার স্মৃতি ডলতে ডলতে নিঃশেষ করতে চাইছিল। সমস্ত বেকার প্রেমিকের প্রতিনিধি হয়ে সে কেবল একটাই কথা বলতে চেয়েছিল যে, মেয়েদের আঁচলের তলায় দিনে দিনে বড় হয় সতিনের ছেলের মতো একটা অর্থনৈতিক শুয়োপোকা। খুব যন্ত্রণা দেয়। কিন্তু এসবের বাইরেও যেন কিছু আছে। যারা ঘুষ খায়, গম খায়, রাস্তাঘাট খায়, আর যারা সব ফেলে শুধু গুলি খায়- তারা এক হতে পারে না। সুজাতার ভরাট স্তনের তলায় যে আদিম কালো তিলটা আছে তার থেকে মধুরতম কমনীয়তা কি গুলি খাওয়া কিশোর ছেলেটির চোখে সে দেখেনি? অনেক রাত অব্দি সুজাতার স্তনবৃন্তের পরিবর্তিত হয়ে সীসার বুলেট হয়ে যাওয়া এই ক্রমিক সুরিয়েল স্বপ্নটা অনেকবার দেখে ফেলেছে সে, অদ্ভুতভাবে কখনো কখনো সে সেই বুলেটটা শিশুর মতো করে চুষেছে। ভয় পায়নি।
চোখের কোনায় লেগে থাকা পরাগের মতো সেই গুলিবিদ্ধ নির্বিকার হাসিটা খুব সুন্দর লাগছে তার। যুবকটি ঘুমিয়ে পড়ে।
তুমুল আনন্দ হইহুল্লোড়ের শব্দের মধ্য দিয়ে ঘুম ভাঙে তার।
সমগ্র মেসবাড়ি যেন খুশিতে মজেছে। সকাল হলেই ভোট। এই বিশাল মেসবাড়িটির মালিক স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মকর্তার, কর্মকর্তায় তো! এত রাতে আনন্দের উপলক্ষ তালাশে সে মুখটা গলিয়ে মাথাটা জানালায় ঠেসে ধরে বাইরে দেখতে চায়। দেখে, বারান্দাজুড়ে ফেনিল উৎসবে ভরে যাচ্ছে সিলমারা ভোটের ব্যালট। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে ওকে কেউ ডাকেনি কেন তাই ভাবছিল। পাগল বলে কী? পাগলের ভোটাধিকার নেই বলেই হয়তো! এই উৎসব সারা রাত ধরে চলেছিল। দুয়েকটা বাঁশঝাড় পেরিয়ে আর একটা প্রকাণ্ড শস্য ফুল আর গন্ধে ভরা ক্ষেতটার ওপর দিয়ে দৃষ্টি প্রবাহিত করলে এই রকম একটা আলোকময় উৎসব দেখেছিল সে, সুজাতাদের বাড়ি। দিগন্তে ঝাঁপিয়ে পড়া গহিন অন্ধকারে একখণ্ড দ্যুতিময় স্বর্গীয় বিন্দুর মতো জ্বলে থাকা সুজাতাদের বাড়িতে টানা দু’রাত বেজেছিল শানাইয়ের রেকর্ড। ম ম গন্ধে ভরা শস্যফুলের বাতাসে ভর করে সেই সুর যুবকটির শোয়ার ঘরের জানালায় অবিরাম ছুঁয়ে দিয়েছিল, শীত নেমে এলে পরিযায়ী পাখিরা যেমন বসন্ত গোলার্ধ খোঁজে!
যেকোনো উৎসব যুবকটি ভয় পায়। রাতভর পালাক্রম সিল মারা যন্ত্রণায় কাতর সকালটি কোনো রকম উঠে দাঁড়িয়েছিল। সূর্য উঠেছিল, পাখি ডেকেছিল। তারপর হই হই শব্দে মিছিল হলো। সকালে যুবকটি বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে থাকা কিছু মলিন উদ্বৃত্ত বিবিধ প্রতীক আঁকা অনেক কাগজ থেকে একটি কুড়িয়ে নিলো, কিছুটা অজান্তেই।
ঝোলা শার্টটা শরীরে গলিয়ে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। দুই পাশের দোকানপাট কিছুটা নীরব নৈঃশব্দ্য নিয়ে বন্ধ। উৎসবের দিন বলে। লক্ষ করার মতো বিষয় হলো সুন্দরী মেয়েগুলো আজ রাস্তায় নেই। ঝোলা শার্টের পকেটে গত দিনের বাসি সিগারেটটা বের করে আর তরতাজা ব্যালটটি ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। স্থানবদল মাত্র।
একটা যাত্রী ছাউনি দেখে বসে পড়ে, কিছুটা ঝুঁকে দুই কনুই দুই হাঁটুর ওপর ভর রেখে ন্যুব্জ হয়ে, দেশের মতো। বাঁ হাতে সিগারেট, ধোঁয়া ছাড়লে বোঝা যায় আজ বাতাস ভীষণ নিরুদ্বেগ, এলোমেলো কুণ্ডলি পাকিয়ে তার উষ্কখুষ্ক চুলের ভেতর দিয়ে ধোঁয়ারা বেয়ে বেয়ে চলে যায়, পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টি ধোয়া বনের ফাঁকে ফাঁকে মেঘ যেমন করে ঢুকে পড়ে। শিরদাঁড়া বাঁকা করে বসাতে তার দৃষ্টি তির্যকভাবে শুধু সামনে হেঁটে যাওয়া পাগুলোর দিকেই নিবদ্ধ।
মানুষের পায়েরও ভাষা আছে, পা দেখতে দেখতে তার মনে হয়। একেকটা পায়ের একেক ভাষা, একেক সৌন্দর্য এবং নিশ্চয় একেক গতি। পায়ের গতিও একধরনের ভাষা। অথবা সে চিন্তা করতে থাকে, পায়ের চেহারায় যেন সময়ের চেহারা। তাকিয়ে থাকলে কিছু পা দেখা যায় সন্ত্রস্ত, এরা ভীতু। কিছু পায়ে দেখা যায় কালো বুট, আঁটোসাঁটো লম্বা মোজা- এগুলো পুলিশ। এদের পায়ের সাথে কখনো কখনো বন্দুকের নলটিও দেখা যায়, পায়ের সাথে সমান্তরাল। তাদের ভাষা আবার ঠাণ্ডা। মৃত্যুর মতো।
কিছু পা দেখলেই যুবকটির মনে পড়ে কাক চোখ পানিতে ভেসে যাওয়া একজোড়া হিজল ফুল। অঘ্রানের বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে বলে সেই ব্যক্তিগত পথটা- যেটা শিউলিতলার নিচ দিয়ে সোজা হিজলের গাছের নিচে শেষ হতো, সেটা শুকনো খটখটে, নিষ্প্রাণ হয়ে রয়।
যুবকটি আরো কুঁজো হয়ে বসে, হাতের কনুই দুটো আরো ভালোভাবে থাইয়ের ওপর বসিয়ে নিরীক্ষণ করতে থাকে আরো কিছু পা, আরো মনোযোগ নিয়ে। সেসব আসা-যাওয়া পায়ের মধ্যে দেখা যায় ঢোলা পাজামা, খড়ম। দেখা যায় চপ্পলের সাথে রঙিন হাওয়াই। এসব পায়ের দিকে তাকালে রফিকদের মতো, আসাদ বা নুর হোসেনদের মুখের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এসব পা’ময় সময়গুলো গড়িয়ে গড়িয়ে কখন যে পশ্চিম আকাশে হেলান দিয়েছে জানা যায়নি। এসব দেখতে দেখতে পকেটের ব্যালট হাতে উঠে আসে। সাপে কাটা রোগীর বিষ যেমন উঠে আসে মাথার দিকে। কাগজটি আপন মনে ভাঁজ করতে করতে ছোটবেলার খাতার পাতা ছিঁড়ে বানানো উড়োজাহাজ, নৌকা- এসবের কথা মনে পড়ে। ভাঁজ হয়ে থাকা নিজের নিপাট জীবনটার কথাও মনে আসে। মনে আসে ঝলসানো হলুদ শস্যক্ষেতের মাঝখানে দাঁড়ানো পিতার হাসিমুখ, চিরকালীন সৎ হেডমাস্টারের টেকো চেহারা। তার আরো মনে পড়তে থাকে এ মাসে তার হাতে কোনো টিউশনি নেই। হাতের কাগজটা ভাঁজ করতে করতে তার মনে পড়ে শাটারের নিচে গুলিমাখা হাসিমুখ, মার্সিডিজের লোগো, মনে পড়ে জাতীয় পতাকার রক্তিম বৃত্ত।
এরই মাঝে সে টের পায় মগজের দক্ষিণ দিগন্ত থেকে একটা মিছিল আসছে। তারা হাসিমুখ। পুলিশ কাঁদছে। সে জানে কেন! একটু পরেই সুজাতার স্তনবৃন্তের মতো বুলেটরা চুমু খেতে পারে হৃদয়ের শরীর। তবুও যুবকটি পালায় না। সে ঝিম বসে বসে কাগজের শিল্পে মেতে থাকে নির্বিকার। একটা মিছিল চলে যায় সেসব পা নিয়ে, যা এতক্ষণ সে ভেবেছিল।
কিন্তু পৃথিবীতে এখনো বুলেট বানানো হয় কেবল কিছু সাহসী বুকের জন্য। জড় নীরস বুলেটগুলোকে বুক পেতে অভিবাদন যারা জানায় তারা পৃথিবীর সব মিছিলেই থাকে। মিছিল পুষ্পের পরাগের মতো ছড়িয়ে পড়লে দেখা যায় কালো পিচের গায়ে রূঢ় লালের তরল। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা যুবকের বিক্ষিপ্ত ছড়ানো হাত-পাগুলো মনে হয় মানচিত্রের ভেতর খাড়া নেমে যাওয়া পদ্মা ব্রহ্মপুত্র আর মেঘনার শরীর। তার পানির রঙ লাল। লাল রঙ শরীর থেকে নেমে যেভাবে ছড়িয়েছে সেটা মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক সঙ্গমস্থল সাগরের শরীর আর মেঘনার মোহনা।
তার পাশে কাগজের বানানো নৌকা কাত হয়ে রয়।
এই হেমন্তে যার নাইওর নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল পশ্চিমের দেশে, সুজাতার দিগন্ত বাড়িতে।
কিন্তু পুলিশের নথিতে এই আস্ত মানচিত্রটার পরিচয় লেখা হয় ‘অজ্ঞাত যুবক’।
সে গোনার চেষ্টা করে না। এভাবে কিছুক্ষণ প্রত্যহ সে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর হুট করে উঠে পড়ে মিরপুরের কোনো বাসে।
মিরপুর,
অনেক বেলা। সে কোথায় যাবে?
একদিন তারও যাওয়ার জায়গা ছিল। একটা রাস্তা ছিল ব্যক্তিগত, হেমন্তের বিকেলে ঝিম মেরে থাকা শিউলি তলার নিচ দিয়ে হৃদয় বরাবর। তার ওপাশে নিঝুম হিজল বাগান, কালো পানি বুকে নিয়ে নিঃশব্দে বয়ে চলে। কখনো কখনো খালের খাড়িতে ধাক্কা খেতে খেতে ভেসে যায় দুয়েকটা হিজল ফুল। সেসব নৈসর্গিক আলোছায়ারা যুবকটির সাথে প্রতারণা করেছিল, একদিন সে দেখে এক অনাহূত বৈরী বাতাসে ভেসে গেছে পথঘাট, অন্ধকার হিজলের তলা- তাই তো পকেটে এত অভিমান নিয়ে চুপচাপ শহর দেখে সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেনি। মেধা এবং টাকা কোনোটাই তার পরিমিত ছিল না। বিএ পাস করে চলে আসে ঢাকায়, যেমন অনেকেই আসে প্যান্টের পকেটে কাঁচা মফস্বল পুরে নিয়ে। যুবকের সুখস্মৃতি বলতে ওই সবেধন একটা হিজলগাছ আর তুমুল নিঃশব্দ নিয়ে বয়ে চলা কাকচোখ খালের পানি। আপাদমস্তক মনে রাখার মতো কোনো পুরুষালি বিশেষণ চিহ্ন যুবকটির নেই।
মিরপুরের বাসে বসে পচতে থাকে সে। তুমুল হট্টগোলে বোঝা যায় বাস আর সামনে যাবে না। মিছিলের সমন্বিত কণ্ঠস্বর গিলে খাচ্ছে শহরের বোবা আর্তনাদ, কিছুই শোনা যায় না। একটু দূরে বিকট আওয়াজে শব্দ সর্বস্ব ককটেল ফাটে, তাতে যাদের জীবন সুখের ডালিতে ভরা, যাদের ঘরে আছে রোমান্সের খোলা জানালা- কেবল তারাই ছোটাছুটি করে এ দিক সে দিক- মূল্যবান জীবন পকেটে নিয়ে। আলোকময় আগামীর জন্য কিছু উঠতি যুবক একটা গাড়িতে আলোকসজ্জা জ্বালিয়ে দেয়। লেলিহান জিহ্বা দাউ দাউ করে ওপরের দিকে উঠে যায়, সুদিন আর কত দূর সেটি দেখতে।
নির্বিকার যুবক, যার পকেটে মফস্বল ঠাসা; সে কোনোমতে দাঁড়িয়ে যায় একটা দোকানের কোনায়। তুমুল শব্দ নিয়ে ফেনিল গাঙের ঢেউয়ের মতো করে দোকান সমগ্রর শাটার নামতে নামতে তার দিকে এগিয়ে আসে। যুবকটি নিজের শরীর গলিয়ে দেয় এমনি এক শাটারের নিচে। ভেতরে অন্ধকার। তীব্র দিনের আলো থেকে অকস্মাৎ অন্ধকারে চোখ মানিয়ে নিতে সময় নিচ্ছিল, নেপথ্যে শোনা যায় পুলিশের বাঁশি, থেকে থেকে বুলেটের আওয়াজ আর বেসুরো পুলিশি গালাগাল। অন্ধকার আরেকটু সয়ে গেলে যুবকটি দেখে সুমসাম নৈঃশব্দ্য নিয়ে প্রবল বেগে বুকের ছাতি ওঠানামা করছে এমন আরো দুটো ছেলে তার গা লাগোয়া হয়ে দাঁড়িয়ে।
তাদের একজন বলে-
-একদম শব্দ করবেন না। আপনি শব্দ করলে আমাদের নাম হয়তো কাল সকালে পত্রিকায় দেখবেন। পুলিশের সাথে এনকাউন্টারে আমরা মরে গেছি।
যুবক শব্দ করে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
এরই মধ্যে চার জোড়া বুটের আওয়াজ যেন কলিজার ২ সে.মি কাছে দিয়ে চলে গেল।
একফালি ক্ষীণকায় আলোর রেখা ছেলে দু’টির ওপর এসে পড়ে।
রক্ত! একটা ছেলের ঊরুসন্ধি ভেসে যাচ্ছে লাল রক্তে। কিন্তু ছেলেটা অমন নির্লিপ্ত হাসছে কেন? এমন ঠাণ্ডা দু’টি চোখ পৃথিবীতে কোনো দিন কেউ দেখেছে কি না সেটাই ভাবতে থাকে ঝোলা শার্টের পকেটে একটা না-খাওয়া সিগারেট নিয়ে, যুবকটি।
কিছুক্ষণের মধ্যে চেনা-জানা পরিচিত শব্দগুলো ফিরে এলে সবাই রাস্তায় নেমে যায়। কিছুক্ষণের বিরতিতে পূর্ণোদ্যমে শহর আবার প্রস্তুত হয়ে ওঠে। যুবকটি বেরিয়ে পড়ে, সে আজকে হেঁটে হেঁটে নিরুদ্দেশ হবে বলে ঠিক করে নেয়। তার এই রাস্তায় যেহেতু কোনো হিজলগাছ নেই সেহেতু উলম্ব অট্টালিকার আনুভূমিক ছায়াকে অনুসরণ করে তার নিরুদ্দেশের পথটি সে বের করে নেয়।
সে হাঁটতে থাকে।
কিন্তু সেয়ানা ছায়াগুলো তাকে পালাতে দেয়নি, শেষ বিকেলে পথটি এসে শেষ হয় তার সস্তার মেসবাড়ির গলির মুখে।
অনেক রাত অব্দি তার চোখে ঘুম নেই। ঘুমেরা কোথায় যায়?
সুজাতার প্রশস্ত পিঠের ভাঁজ ধরে নেমে যায় ত্রিকোণ উপত্যকায়। সুজাতা যে পথে গেছে যুবকটি সে পথটার মানচিত্র ঘিলুর মধ্যে এঁকে নিয়েছিল। আজ সেই পথটার কথা মনে পড়ে তার। একদিন সুজাতার চোখে অমাবস্যা নামিয়েছিল সে, কেউ জানে না। তার সুগভীর নাভির ভেতরে গরম নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে কসম খেয়েছিল, আনারের সোনালি দানা মুখে নিয়ে গোঙাতে গোঙাতে কথা দিয়েছিল ফিরে দাঁড়ানোর। যুবকটি পরিযায়ী সুজাতার স্মৃতি ডলতে ডলতে নিঃশেষ করতে চাইছিল। সমস্ত বেকার প্রেমিকের প্রতিনিধি হয়ে সে কেবল একটাই কথা বলতে চেয়েছিল যে, মেয়েদের আঁচলের তলায় দিনে দিনে বড় হয় সতিনের ছেলের মতো একটা অর্থনৈতিক শুয়োপোকা। খুব যন্ত্রণা দেয়। কিন্তু এসবের বাইরেও যেন কিছু আছে। যারা ঘুষ খায়, গম খায়, রাস্তাঘাট খায়, আর যারা সব ফেলে শুধু গুলি খায়- তারা এক হতে পারে না। সুজাতার ভরাট স্তনের তলায় যে আদিম কালো তিলটা আছে তার থেকে মধুরতম কমনীয়তা কি গুলি খাওয়া কিশোর ছেলেটির চোখে সে দেখেনি? অনেক রাত অব্দি সুজাতার স্তনবৃন্তের পরিবর্তিত হয়ে সীসার বুলেট হয়ে যাওয়া এই ক্রমিক সুরিয়েল স্বপ্নটা অনেকবার দেখে ফেলেছে সে, অদ্ভুতভাবে কখনো কখনো সে সেই বুলেটটা শিশুর মতো করে চুষেছে। ভয় পায়নি।
চোখের কোনায় লেগে থাকা পরাগের মতো সেই গুলিবিদ্ধ নির্বিকার হাসিটা খুব সুন্দর লাগছে তার। যুবকটি ঘুমিয়ে পড়ে।
তুমুল আনন্দ হইহুল্লোড়ের শব্দের মধ্য দিয়ে ঘুম ভাঙে তার।
সমগ্র মেসবাড়ি যেন খুশিতে মজেছে। সকাল হলেই ভোট। এই বিশাল মেসবাড়িটির মালিক স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মকর্তার, কর্মকর্তায় তো! এত রাতে আনন্দের উপলক্ষ তালাশে সে মুখটা গলিয়ে মাথাটা জানালায় ঠেসে ধরে বাইরে দেখতে চায়। দেখে, বারান্দাজুড়ে ফেনিল উৎসবে ভরে যাচ্ছে সিলমারা ভোটের ব্যালট। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে ওকে কেউ ডাকেনি কেন তাই ভাবছিল। পাগল বলে কী? পাগলের ভোটাধিকার নেই বলেই হয়তো! এই উৎসব সারা রাত ধরে চলেছিল। দুয়েকটা বাঁশঝাড় পেরিয়ে আর একটা প্রকাণ্ড শস্য ফুল আর গন্ধে ভরা ক্ষেতটার ওপর দিয়ে দৃষ্টি প্রবাহিত করলে এই রকম একটা আলোকময় উৎসব দেখেছিল সে, সুজাতাদের বাড়ি। দিগন্তে ঝাঁপিয়ে পড়া গহিন অন্ধকারে একখণ্ড দ্যুতিময় স্বর্গীয় বিন্দুর মতো জ্বলে থাকা সুজাতাদের বাড়িতে টানা দু’রাত বেজেছিল শানাইয়ের রেকর্ড। ম ম গন্ধে ভরা শস্যফুলের বাতাসে ভর করে সেই সুর যুবকটির শোয়ার ঘরের জানালায় অবিরাম ছুঁয়ে দিয়েছিল, শীত নেমে এলে পরিযায়ী পাখিরা যেমন বসন্ত গোলার্ধ খোঁজে!
যেকোনো উৎসব যুবকটি ভয় পায়। রাতভর পালাক্রম সিল মারা যন্ত্রণায় কাতর সকালটি কোনো রকম উঠে দাঁড়িয়েছিল। সূর্য উঠেছিল, পাখি ডেকেছিল। তারপর হই হই শব্দে মিছিল হলো। সকালে যুবকটি বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে থাকা কিছু মলিন উদ্বৃত্ত বিবিধ প্রতীক আঁকা অনেক কাগজ থেকে একটি কুড়িয়ে নিলো, কিছুটা অজান্তেই।
ঝোলা শার্টটা শরীরে গলিয়ে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। দুই পাশের দোকানপাট কিছুটা নীরব নৈঃশব্দ্য নিয়ে বন্ধ। উৎসবের দিন বলে। লক্ষ করার মতো বিষয় হলো সুন্দরী মেয়েগুলো আজ রাস্তায় নেই। ঝোলা শার্টের পকেটে গত দিনের বাসি সিগারেটটা বের করে আর তরতাজা ব্যালটটি ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। স্থানবদল মাত্র।
একটা যাত্রী ছাউনি দেখে বসে পড়ে, কিছুটা ঝুঁকে দুই কনুই দুই হাঁটুর ওপর ভর রেখে ন্যুব্জ হয়ে, দেশের মতো। বাঁ হাতে সিগারেট, ধোঁয়া ছাড়লে বোঝা যায় আজ বাতাস ভীষণ নিরুদ্বেগ, এলোমেলো কুণ্ডলি পাকিয়ে তার উষ্কখুষ্ক চুলের ভেতর দিয়ে ধোঁয়ারা বেয়ে বেয়ে চলে যায়, পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টি ধোয়া বনের ফাঁকে ফাঁকে মেঘ যেমন করে ঢুকে পড়ে। শিরদাঁড়া বাঁকা করে বসাতে তার দৃষ্টি তির্যকভাবে শুধু সামনে হেঁটে যাওয়া পাগুলোর দিকেই নিবদ্ধ।
মানুষের পায়েরও ভাষা আছে, পা দেখতে দেখতে তার মনে হয়। একেকটা পায়ের একেক ভাষা, একেক সৌন্দর্য এবং নিশ্চয় একেক গতি। পায়ের গতিও একধরনের ভাষা। অথবা সে চিন্তা করতে থাকে, পায়ের চেহারায় যেন সময়ের চেহারা। তাকিয়ে থাকলে কিছু পা দেখা যায় সন্ত্রস্ত, এরা ভীতু। কিছু পায়ে দেখা যায় কালো বুট, আঁটোসাঁটো লম্বা মোজা- এগুলো পুলিশ। এদের পায়ের সাথে কখনো কখনো বন্দুকের নলটিও দেখা যায়, পায়ের সাথে সমান্তরাল। তাদের ভাষা আবার ঠাণ্ডা। মৃত্যুর মতো।
কিছু পা দেখলেই যুবকটির মনে পড়ে কাক চোখ পানিতে ভেসে যাওয়া একজোড়া হিজল ফুল। অঘ্রানের বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে বলে সেই ব্যক্তিগত পথটা- যেটা শিউলিতলার নিচ দিয়ে সোজা হিজলের গাছের নিচে শেষ হতো, সেটা শুকনো খটখটে, নিষ্প্রাণ হয়ে রয়।
যুবকটি আরো কুঁজো হয়ে বসে, হাতের কনুই দুটো আরো ভালোভাবে থাইয়ের ওপর বসিয়ে নিরীক্ষণ করতে থাকে আরো কিছু পা, আরো মনোযোগ নিয়ে। সেসব আসা-যাওয়া পায়ের মধ্যে দেখা যায় ঢোলা পাজামা, খড়ম। দেখা যায় চপ্পলের সাথে রঙিন হাওয়াই। এসব পায়ের দিকে তাকালে রফিকদের মতো, আসাদ বা নুর হোসেনদের মুখের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এসব পা’ময় সময়গুলো গড়িয়ে গড়িয়ে কখন যে পশ্চিম আকাশে হেলান দিয়েছে জানা যায়নি। এসব দেখতে দেখতে পকেটের ব্যালট হাতে উঠে আসে। সাপে কাটা রোগীর বিষ যেমন উঠে আসে মাথার দিকে। কাগজটি আপন মনে ভাঁজ করতে করতে ছোটবেলার খাতার পাতা ছিঁড়ে বানানো উড়োজাহাজ, নৌকা- এসবের কথা মনে পড়ে। ভাঁজ হয়ে থাকা নিজের নিপাট জীবনটার কথাও মনে আসে। মনে আসে ঝলসানো হলুদ শস্যক্ষেতের মাঝখানে দাঁড়ানো পিতার হাসিমুখ, চিরকালীন সৎ হেডমাস্টারের টেকো চেহারা। তার আরো মনে পড়তে থাকে এ মাসে তার হাতে কোনো টিউশনি নেই। হাতের কাগজটা ভাঁজ করতে করতে তার মনে পড়ে শাটারের নিচে গুলিমাখা হাসিমুখ, মার্সিডিজের লোগো, মনে পড়ে জাতীয় পতাকার রক্তিম বৃত্ত।
এরই মাঝে সে টের পায় মগজের দক্ষিণ দিগন্ত থেকে একটা মিছিল আসছে। তারা হাসিমুখ। পুলিশ কাঁদছে। সে জানে কেন! একটু পরেই সুজাতার স্তনবৃন্তের মতো বুলেটরা চুমু খেতে পারে হৃদয়ের শরীর। তবুও যুবকটি পালায় না। সে ঝিম বসে বসে কাগজের শিল্পে মেতে থাকে নির্বিকার। একটা মিছিল চলে যায় সেসব পা নিয়ে, যা এতক্ষণ সে ভেবেছিল।
কিন্তু পৃথিবীতে এখনো বুলেট বানানো হয় কেবল কিছু সাহসী বুকের জন্য। জড় নীরস বুলেটগুলোকে বুক পেতে অভিবাদন যারা জানায় তারা পৃথিবীর সব মিছিলেই থাকে। মিছিল পুষ্পের পরাগের মতো ছড়িয়ে পড়লে দেখা যায় কালো পিচের গায়ে রূঢ় লালের তরল। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা যুবকের বিক্ষিপ্ত ছড়ানো হাত-পাগুলো মনে হয় মানচিত্রের ভেতর খাড়া নেমে যাওয়া পদ্মা ব্রহ্মপুত্র আর মেঘনার শরীর। তার পানির রঙ লাল। লাল রঙ শরীর থেকে নেমে যেভাবে ছড়িয়েছে সেটা মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক সঙ্গমস্থল সাগরের শরীর আর মেঘনার মোহনা।
তার পাশে কাগজের বানানো নৌকা কাত হয়ে রয়।
এই হেমন্তে যার নাইওর নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল পশ্চিমের দেশে, সুজাতার দিগন্ত বাড়িতে।
কিন্তু পুলিশের নথিতে এই আস্ত মানচিত্রটার পরিচয় লেখা হয় ‘অজ্ঞাত যুবক’।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।