হিলফুল ফুযুল গঠন

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর চাচাদের সঙ্গে হারবুল ফিজার যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল চাচাদের জন্য তীর কুড়িয়ে দেওয়া। এই যুদ্ধে তাঁর চাচা জুবাইর ইবনু আবদুল মুত্তালিব ছিলেন স্বগোত্রের যুদ্ধপতাকাবাহী। জুবাইর ও তাঁর ভাইয়েরা পূর্বেও ন্যায়-অন্যায়ের বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

তাঁরা বহু স্বদেশি-বিদেশি, আত্মীয়-অনাত্মীয়কে নিজ হাতে নিহত করেছিলেন। কিন্তু কোনো যুদ্ধই তাঁদের মনে বিশেষ প্রভাব ফেলেনি; বরং এসব দৃশ্য দেখে তাঁরা আনন্দই অনুভব করতেন।

কিন্তু হারবুল ফিজারে এসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পিতৃব্য জুবাইরের মনে সেই আনন্দ আর ছিল না। যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা ও রক্তপাত দেখে তাঁর হৃদয়ের পাশবিকতা দূর হয়ে যায়। হারবুল ফিজার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার পর থেকেই তিনি অত্যাচারী, অত্যাচার ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়ার সংকল্প গ্রহণ করেন।

জুবাইরের এই চিন্তার আমূল পরিবর্তনের মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন মা আমেনার এতিম পুত্র মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। সমরক্ষেত্র ত্যাগের পর থেকেই জুবাইর এমন একটি সেবক সংঘ গঠনের চিন্তা করেন, যারা অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবে।

ফলস্বরূপ, অল্পদিনের মধ্যেই তিনি সমমনাদের নিয়ে একটি পরামর্শ সভা আহ্বান করেন। নির্ধারিত দিনে জুবাইরের আহ্বানে বনী হাশেমসহ অন্যান্য গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সমবেত হন এবং অত্যাচার, অবিচার ও অন্যায়ের প্রতিবিধান নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।

তখনকার আরব সমাজে একটি প্রচলিত রীতি ছিল—
যে-ই হোক, নিজের আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু, গোত্র বা বংশের কেউ অন্যায় করলেও, তাকে সমর্থন করতে হবে এবং তার পক্ষেই অস্ত্র ধারণ করতে হবে, যত বড় অন্যায়ই সে করুক না কেন।

আলোচ্য পরামর্শ সভায় উপস্থিত সকলে একমতে উপনীত হলেন যে, আরবে প্রচলিত সেই রীতি—যেখানে আত্মীয় বা স্বজন অন্যায় করলেও তাকে সমর্থন করতে হবে—নিতান্তই অন্যায় এবং সমাজের সর্বনাশের মূল কারণ। অতএব, এই অন্যায় ও অধর্মের মূলোৎপাটন করতেই হবে।

সুতরাং উপস্থিত সকলে নিম্নলিখিত বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেনঃ

১। আমরা দেশের অশান্তির অবসান ঘটাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
২। বিদেশি লোকদের ধন, প্রাণ ও মান-সম্ভ্রম রক্ষায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।
৩। সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র লোকদের সাহায্যে কখনো কুণ্ঠিত হব না।
৪। অত্যাচারীর অত্যাচার প্রতিহত করব এবং দেশবাসীকে অত্যাচারীর কবল থেকে রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাব।

এরপর উপস্থিত সকলে আল্লাহর নামে শপথ করে ওয়াদাবদ্ধ হলেন যে—
তারা উৎপীড়িত ও অত্যাচারিতের পক্ষ সমর্থন করবেন এবং তাদের অধিকার আদায় না করা পর্যন্ত পিছপা হবেন না। যতদিন সাগরে এক ফোঁটা পানিও অবশিষ্ট থাকবে, ততদিন এই প্রতিজ্ঞাও বলবৎ থাকবে।

এই ঐতিহাসিক অঙ্গীকারই ইতিহাসে “হিলফুল ফুযুল” নামে পরিচিত। এই প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী বেশ কিছুদিন পর্যন্ত তারা ন্যায় ও ন্যায়বিচারের কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তবে পরবর্তীকালে, বিশেষত ইসলামের আগমনের পর, অনেকেই এই প্রতিজ্ঞার বিষয়টি ভুলে যান।

কিন্তু যিনি এই ওয়াদার প্রধানতম উদ্যোক্তা ছিলেন—তিনি জীবনের কোনো মুহূর্তেই এই প্রতিজ্ঞাকে বিস্মৃত হননি। ইতিহাসে বর্ণিত আছে, বদর যুদ্ধের বন্দীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনি এই প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করেছিলেন।

একদিন হযরত খাদিজা (রাযি.) নিজের একজন লোককে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে পাঠিয়ে জানালেন যে, তিনি তাঁর সঙ্গে কিছু জরুরি বিষয়ে কথা বলতে চান।

এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর গৃহে উপস্থিত হলে তিনি তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন
“আমি আপনার সততা, সত্যনিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা ও চরিত্রের মহিমা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত। তাই আমি আপনাকে স্মরণ করেছি। আপনি যদি আমার বাণিজ্য কাফেলা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তবে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হব। এজন্য আমি আপনাকে অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ পারিশ্রমিক প্রদান করব।”

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই প্রস্তাবের তাৎক্ষণিক উত্তর না দিয়ে বললেন, তিনি তাঁর চাচা আবূ তালিবের সঙ্গে পরামর্শ করে জানাবেন। এরপর তিনি গৃহে ফিরে এসে সব বিষয় চাচাকে অবহিত করলেন।

চাচা আবূ তালিব হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। একদিকে তাঁর পরিবারে সদস্যসংখ্যা ছিল অনেক, অন্যদিকে সে বছর আরব ভূমিতে অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছিল।

এ অবস্থায় আবূ তালিব এই প্রস্তাবকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের অদৃশ্য সহযোগিতা বলে মনে করলেন। তৎকালীন সময়ে আরবের বুকে হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর বাণিজ্য কাফেলার পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া ছিল এক বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়।

ঐতিহাসিক ইবনে সা‘দ প্রমুখের মতে, তখনকার দিনে হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর বাণিজ্য সম্ভার অন্য সকল ব্যবসায়ীর সম্মিলিত বাণিজ্য সম্ভারের সমান ছিল।

সবকিছু ভেবে আবূ তালিব অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তাঁর ভাতিজাকে এই দায়িত্ব গ্রহণের অনুমতি প্রদান করলেন। কাফেলার সঙ্গে হযরত খাদিজা (রাঃ) তাঁর বিশ্বস্ত ভৃত্য মায়সারাকে পাঠালেন এবং তাকে বিশেষভাবে নির্দেশ দিলেন যেন তিনি কাফেলার পরিচালক রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে অনুসরণ করেন।

নির্ধারিত দিনে কাফেলা রওনা হয়ে গেল। কাফেলা যথারীতি সিরিয়ায় উপনীত হলো এবং অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বেশি লাভ ও কম সময়ে বাণিজ্য সম্পন্ন করে মক্কায় ফিরে এলো।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!