আমার বাবা মুকুন্দ পালের বয়স এখন নব্বই-এর কাছাকাছি বোধহয়। আজ থেকে পঞ্চাশ বছরেরও আগে স্বাধীনতা-দেশভাগের ক’বছর বাদে এই পালমশাই তাঁর স্ত্রী কন্যা ও বাবা মাকে নিয়ে এই বাসাবাড়িতে মাথা গুঁজেছিলেন। আমি তখন মায়ের কোলে। আমার এখন মনে হয় আমি যেন অনাথ বিশ্বাস বাই-লেনেই জন্মেছি। অনাথ বিশ্বাস বাই-লেন ছাড়া আমার আর তো কোন স্মৃতি নেই। আমার ছোটবেলা বলতে এই আধো অন্ধকার দু’কামরার ফ্ল্যাট বাড়ি, কুড়ি বাইশজন মানুষ তার ভিতরে ঠেসে গেছে। কত মানুষ এসে থেকে গেছে এখানে। এখন আর কেউ তেমন আসে না।
অনেক মানুষের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল বাগবাজারের এই বাসাবাড়ি। মুকুন্দদা, মুকুন্দকা, মুকুন্দ জেঠা, মুকুন্দ মেসো, মুকুন্দ পিসে, শুধু মুকুন্দ পাল –একজনেরই ছিল কত নাম। এই বয়সেও বেশ হাঁটাচলার দড়। কখনও এই মাস ছয় আগেও, একা একা মেয়ের বাড়ি আগরপাড়া চলে গিয়েছিলেন শ্যামবাজার অবধি হেঁটে উসুমপুরের মিনিবাস ধরে। তারপর থেকে আমার বউ রীনা চোখে চোখে রাখে তাঁকে। বাবা বেরনোর সময় পকেট দেখে নেয়, টাকাপয়সা কতটা নিয়েছেন তিনি, জামাকাপড় লক্ষ করে। রীনা জানে মুকুন্দ পাল মশাই খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন, ময়লা ধুতি, ময়লা পাঞ্জাবি পরে তিনি অনাথ বিশ্বাস বাই-লেনের বাইরে যাবেন না কোথাও। এত বয়সেও ধবধবে ধুতি, ধবধবে পাঞ্জাবি পরতে পারলেই তাঁর মুখে হাসি। তখন মেয়ের বাড়ি কিংবা সুহৃদবরেষু বড়শালা গোবিন্দ রায়ের বাড়ি যাওয়া যেতে পারে। দুই ভাই-এর কেউ বেঁচে নেই। কথায়, আলাপে আমার দুই কাকা তাঁর ভিতরে ছায়া ফেলে। পালমশাই চা খেতে খেতে বলেন, শোন বউমা, মুরারি, মুরলী, কী করত ছোটবেলায়।
রাত্রে রীনা আমায় বলে, বাবা খুব অদ্ভুত।
কেন কী হল?
ছেলেবেলার কথা বলতে আরম্ভ করলে, আর থামেন না।
কেউই থামে না, ওরকম হয় এই বয়সে।
এত বছর বয়স হল, সব মনে আছে?
থাকতেই পারে।
আমার বাবা আটাত্তরে চলে গেলেন, তিনি তো শেষ ক’বছর কিছুই মনে রাখতে পারতেন না, খাওয়ার পরও ভুলে যেতেন।
বাবার শরীরের গঠন খুব ভাল।
ইস আমাদের যখন এমন বয়স হবে, মাকে দেখছ কেমন জবুথবু হয়ে যাচ্ছেন।
দেখেছি। মার সাধ ছিল বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ার পর একবার তাঁর বাপের বাড়ি দেখে আসবে। যাওয়া হয়নি। মা কপোতাক্ষর কথা বলতে বলতে এখন প্রায় ফুরিয়ে গেছে। একই কথা কত বলা যায়। কে শুনবে? রীনাও যে কতবার শুনেছে কপোতাক্ষ নদীর জলে দূরগামী লঞ্চের ভোঁ। রীনা বলে, মা এমনভাবে বলতে পারেন, যেন সত্যিই দেখা যায়, শোনা যায় সব।
আমি বললাম, আমরা যদি কোথাও যেতে পারি এই বাই-লেন ছেড়ে, তবে আমরা এই বাই-লেনের কথা বলব ওইরকম বুড়ো হয়ে গেলে।
রীনা বলল, ওই বয়স পর্যন্ত পৌঁছতেই পারব না কেউ!
আমি অনাথ বিশ্বাস বাই-লেন ছেড়ে কোথাও একটা যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। মনে হচ্ছিল, নিজের কিছু একটা থাকা দরকার। আমার ছেলে এবার ক্লাশ টেন, পরের বার মাধ্যমিক, তারপর ধাঁই ধাঁই করে করে বড় হয়ে যাবে। ওর পায়ের তলায় কোন মাটি থাকবে না যদি এই ফ্ল্যাটে রেখে যাই ওকে। বাড়িওয়ালার বহুদিনের সাধ আমরা ছেড়ে যাই এই গৃহ। এখন শহরে বহুতলের রমরমা, ভেঙ্গেচুরে আকাশ পর্যন্ত উঠে যাবে ফ্ল্যাট বাড়ি। টেনান্সি বিল চালু হয়ে গেলে বাড়িওয়ালা তার অধিকার বুঝে নেবে। এক এক সময় মনে হয় চৌধুরীবাবুরই বা কী দোষ? বাড়িটা তো তাঁদের, আমাদের নয়। আমরা কেন এত বছরেও অন্য কোথাও চলে যেতে পারিনি।
হারানো নদীর স্রোত-৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।