হারানো নদীর স্রোত-১ম অংশ

অনাথ বিশ্বাস বাই-লেন থেকে বেড়িয়ে বড় রাস্তায় পড়ে হাঁটাপথে গঙ্গা একটুখানি। আমাদের দু’কামরার ফ্ল্যাট থেকেই ছেলেবেলায় লঞ্চের ভোঁ শুনেছি মনে পড়ে। মনে পড়ে মা তখন নিজের বাপের বাড়ির কথা বলত, কপোতাক্ষতীরে কাটিপাড়া ছিল সেই গ্রাম। সেখানেও নাকি ঘরে শুয়ে শোনা যেত শেষ রাতে ডাকা প্রথম লঞ্চের ভোঁ। কী আশ্চর্য এক নদীর কুল থেকে আর এক নদীর কুলে এসে জীবন আছড়ে পড়ল।

আগে বাগবাজারের এইসব এলাকা ছিল খুব শান্ত। আনাজপাতির বাজার তখন ঢুকে পড়েনি অনাথ বিশ্বাস বাই-লেনের ভিতরে। ফলে দূরের ডাক বিছানায় শুয়ে কী চমৎকার শোনা যেত। মা বলত, চোখ বুজলেই মনে হত যেন কপোতাক্ষতীরে বাপের বাড়িতেই রয়েছি। এখন মা বুড়ি হয়ে গেছে। মা এখন ভুলেও উচ্চারণ করে না কপোতাক্ষ নদীকে। এখন তো গঙ্গার লঞ্চের ডাকও আর শোনা যায় না ঘর থেকে, অথচ ফেরি সার্ভিসে লঞ্চ চলাচল বেড়েছে কত। মাঝরাত্তিরে আচমকা জলপুলিশের মোটরবোটের হুইসল শুনলে বুক কেঁপে যায়। অনাথ বিশ্বাস বাই-লেনটা কেমন যেন হয়ে গেছে।

সত্যিই অনাথ বিশ্বাস বাই-লেন আর আগের মতো নেই। এক সময় ঘুম ভাঙানিয়ার দল ভোরবেলায় শোরগোল তুলত এ পাড়ায়, দূর থেকে নামকীর্তনের দল যেমন আসত খোলে চাঁটি মারতে মারতে, গলা তুলতে তুলতে, তেমনি দত্তদের ঠাকুরবাড়ির ছোট মতো বাগানের গাছ থেকে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে পড়ত কাক, টিয়ার দল। এমন চৈত্র দিনে কোকিল একটা ডেকেই যেত। আর ছিল কুবো পাখি, সমস্ত দিন কোন অদৃশ্য জায়গা থেকে গম্ভীর গলায় কুব-কুব ডাক দিয়ে অনাথ বিশ্বাস বাই-লেনের বাতাসকে ভারী করে তুলত।

এখন সেই তেরচা মতো একফালি বাগানটা আর নেই। বিষমবাহু চতুর্ভুজের সামনের দিকটা ছিল চওড়ায় খুব ছোট, ফলে বাগানের জমিতে সেই সাজানো বাগান ফ্ল্যাট বাড়িটাও উঠেছে জমির মতো বেঢপ আকারের। ক’বছর আগে আমার সাধ হয়েছিল অনাথ বিশ্বাস বাই-লেন ছেড়ে কোথাও যাব না, ভাড়াটে ফ্ল্যাটের ভবিষ্যৎ অজানা, নতুন টেনান্সি বিল কাকে সাহায্য করবে ধরা যাচ্ছে না, বরং নিজের একটা আশ্রয় যদি করা যায়। সেই ইচ্ছেয় খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম আমাদেরই বাই-লেনে গড়ে ওঠা ফ্ল্যাটগুলো কেমন, কত তার দাম। খোঁজ নিতে নিতে উঠে গিয়েছিলাম চারতলা বাড়ির ছাতে। ঠিক যেমনটি ছিল বাগান, তেমনি হয়েছে ছাত, যেন বাগানটিকেই কেউ ভাসিয়ে দিয়েছে আকাশে। বৈশাখের আগুনে পুড়ে গেছে সব গাছ, মাটি হয়ে গেছে কংক্রিট কঠিন। রোদে পুড়ে গিয়েছিল চোখমুখ, ঠাকুরবাড়ির বাগানের ছায়ার একবিন্দুও নেই কংক্রিট মাটির উপরে।

ফ্ল্যাটের দামও ছিল কম নয়। অত টাকা আমায় কে দেবে? লোন পেলেও শোধ করব কীভাবে? পাঁচরকম ভেবে এগনো হয়নি। আশায় আছি যে আধো অন্ধকার ফ্ল্যাটে সপরিবারে আমার বাবা মুকুন্দ পাল এসে উঠেছিলেন দেশভাগের পর, সেই ফ্ল্যাটই হয়ত একদিন কিনে নিতে পারব। না হলে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হবে দূরে কোথাও।

 

হারানো নদীর স্রোত-২য় অংশ পড়তে এখানে ল্কিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!