বেতনা তাই গেছে, কপোতাক্ষয় তবু পানি আছে, তবে কিনা ভাটার সময় শুখার কালে হাড়পাঁজরা দেখা যায় কপোতাক্ষরও, শুধু চর পড়তেছে।
বাবা শুনছিলেন, বিস্ময় প্রকাশ করলেন, এমন হতে পারে, নদী শুকোয়?
হ্যাঁ, পানির অভাব খুব, নদী ধুধু বালি।
কী সব্বোনাশ, মরে গেল অতবড় নদী?
‘জে’, বলে মাথা নামায় সিকান্দার আলি।
কেন এমন হল?
বিড়বিড় করে সিকান্দার, হিন্দুরা শুধু দেশ ছাড়তেছে, ভিটেমাটি বাগান পড়ে থাকতেছে, লোভী মানষে দখল করে নেচ্ছে, লোভে হিন্দুদের তাড়াচ্ছে, কিন্তু এডা যেমন সত্যি, তেমন সত্যি তারা দেশ ছেড়েই বা আসতেছে কেন কও দেখি চাচি, ওডা তাদেরও দেশ, যদি হিন্দু মোছলমান দুজনেই না থাকল একটা দেশে, গাঙে পানি থাকে? খেরেস্তান মধুকবির কপোতাক্ষ কবিতাটা মনে মনে শুধু আওড়াতি হয় চাচি, গাঙের পানি তো সবাইরে লিয়ে হয়, দেশডার পরাণ শুকোয় যাচ্ছে।
মা কেঁদে উঠল, একী কথা শুনাতে এলে!
কত শুনবা চাচি, সুনাই নদী জানতে তো, সে গাঙ ধূ ধূ করে, পানির বংশ নাই, একটার পর একটা নদীর পতন হচ্ছে মিলিটারি পতনের মতন, দেশশূন্য হয়ে যাচ্ছে, হিন্দুরা সবাই চলি এলি বড়দল, কপোতাক্ষ, ঢাকা, বরিশাল মরুভূমি হয়ে পড়বে।
বাবার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে বুকের উপর এসে শুকিয়ে যাচ্ছিল। বাবা কীরকম অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন সিকান্দারের দিকে। একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। অনেকটা সময় কাটিয়ে সিকান্দার উঠল। তখনও মা বাবা নিশ্চুপ।
বাইরে বেরিয়ে আমি সিকান্দারের কাঁধে হাত দিলাম, আপনি কার ছেলে?
সিকান্দার হাসল, ধীরে ধীরে বলল, রোশোনারা বিবি আমার ধর্ম মা।
নিজের মা নয়?
না, আঞ্জুমান বিবির ছেলে তিনডে, দু’জন ঢাকায় থাকে, একজন কানাডা, রোশোনারার ছেলে মেয়ে নাই, আমি তারে আম্মা ডেকিছিলাম।
তাহলে আপনি এজাহার, মোজাহারের কেউ নন?
না, আম্মা মরণের সময় কলকাতায় এসে আপনের বাবারে দেখি যেতি বলেছিলেন, তাঁর খবরডা নিতি বলেছিলেন, খুব কষ্ট পেয়ে মরেছেন তিনি, তার রূপের কিছুই আর ছেল না, যেন পোকায় কেটে দিয়েছিল তাঁরে।
এতদিনে সময় হল আপনার?
বিষণ্ণ সিকান্দার হাসল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগল আগামীকাল ভোরে সে যাবে গোবরডাঙ্গা। একটা বিয়েবাড়ি আছে। বড়দলের বিনোদ বিশ্বাস থাকে গোবরডাঙ্গা, এই তো গেল সালে চলে এসেছে। তার মেয়ের বিয়ের বরপণ আটকে গেছে নাকি। ওপার থেকে টাকা এনেছে সিকান্দার বিনোদের জমি বেঁচে দিয়ে। এক কাপড়ে চলে এসেছিল তো। বিয়েটা হয়ে গেলে সে বিনোদদের নিয়েই ও দেশে ফিরবে। ভয়ে, অভিমানে দেশ ছেড়ে এসেছে বিনোদ বিশ্বাস, অজিত কুণ্ডু, প্রণবানন্দ মল্লিকরা। সবাই আছে গোবরডাঙ্গায়। এত বছর ওপারে থেকে শেষ বয়সে চলে আসবে কেন? তাদের বুঝিয়ে ফেরত নিয়ে যাবে সিকান্দার।
প্রাণের ভয় তো আছে। আমি বললাম, দাঙ্গায় মরতে চায় কে?
দাঙ্গা না, ওপারে একতরফা, এপারেও তাই, এই যে আপনাদের পশ্চিম দেশে, গুজরাতে এত মোছলমানের ঘরবাড়ি পোড়তেছে, তারা কি দেশ ছাড়তেছে?
না, যাবে কোথায়?
তবে হিন্দুরাই বা ওপার থেকে আসবে কেন? ওপারে হিন্দু, এপারে মোছলমান যদি না থাকে, কারে নে কে বাস করবে? গাঙ্গের পানি কি এমনি শুকায় দাদা, পানি থাকবে না কুথাও।
বাড়ি ফিরে দেখলাম রীনা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। উদ্বিগ্ন চোখ মুখ, বলল, বাবা যেন কেমন করছেন, কী শুনিয়ে গেল সিকান্দার আলি নামে লোকটা!
বাবার গলা শুনতে পাই আমি, মাকে ডাকছেন, কী হল, ওঠো, যাবে না বড়দল?
রীনা গিয়ে বাবাকে ধরেছে, কোথায় যাবেন বাবা, কী বলছেন আপনি?
মোজাহার এজাহার লোক পাঠিয়েছিল, না গেলে কপোতাক্ষ মরে যাবে বউমা।
আপনি ব্যস্ত হবেন না, চুপ করে বসুন বাবা।
না,না, খবর দিতে হবে, ঠাকুরদাস মিত্তির, শৈলেন রায়, গোবিন্দ কুণ্ডু, বলরাম মল্লিক, সবাই রে জানানো দরকার, ওরা সব থাকে কোথায়? ডেকে নিতে এসেছিল মোজাহার এজাহারের বেটা, আমরা চলে এয়েছি বলে নদীতে জল নাই, সব্বাইরে খবর দে খোকা, ঠাকুরদাস, বারাসাত থাকে বোধহয়, হ্যাঁ রমেন থাকে বিরাটির দিকে। না, না ঠাকুরদাস মছলন্দপুর, গোবিন্দ গোবরডাঙ্গায়…। বাবা গড়গড় করে বলে যাচ্ছিলেন নানা জায়গায় থাকা নানা মানুষের নাম। এইসব মানুষ সবাই-এর আদি নিবাস বড়দল, জেলা খুলনা। এখনও বিয়ের চিঠিতে লেখা হয় পিতৃপুরুষের ঠিকানা, আদি নিবাস বড়দল, বর্তমান …। নামগুলো আমার খুব চেনা। এই সমস্ত মানুষ একদিন এই বাসাবাড়িতে কাটিয়ে গেছে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। আলো আঁধারে ছাওয়া এই দুটি ঘর, সরু প্যাসেজ, এমন কি রান্নাঘরও রাতের বেলা ভর্তি হয়ে যেত। বিছানা পড়ত সব জায়গায়। দেশহারা হয়ে গ্রামহারা হয়ে বড়দলের কত লোক কাটিয়ে গেছে এখানে। তারপর ধীরে ধীরে এক এক করে চলে গেল নিজেদের বাসা খুঁজে নিয়ে। মনে পড়তে লাগল। কেউ আর আসে না, খোঁজ নেয় না আমার মা বাবার যারা কিনা একদিন সবাইকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মাকে তো শোনাই কখনও সখনও, এই যে তোমরা বুড়ো হয়েছ, কেউ কি দেখতে আসে? গোবিন্দকাকা, শৈলেনকাকা, বলরাম পিসে –খোঁজ নেয় কেউ? গোবিন্দকাকা নাকি বিদেশ ঘুরেও এসেছে, সেই খবর লোকমুখে শুনেছি, তোমাদের জানিয়ে গেছে কখনও? কেউ মনে রাখে না। কেউ মনে রাখেনি।
বাবার কথা থামছে না, বাবা বলছেন, কী সব্বোনাশ। কপোতাক্ষ শুকোয় যাচ্ছে, বেতনা শুকোয় গেছে, সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে…কে লিখেছিল, মাইকেল, মানুষ দেশ ছাড়ছে, মানুষের ঘর পুড়ছে, নদী শুকোচ্ছে খোকা, এরপর আর কোথাও নদী থাকবে না, চিতা জ্বালালে আর নেভানো যাবে না, শুনছো। বাবা ডাকছেন মাকে।
হারানো নদীর স্রোত-৬ষ্ঠঅংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন