হাত ঘড়ি—-এস ইলিয়াস বাবর

রিহানের এরকম চেহারা আর কখনো দেখিনি। আমাদের বন্ধুত্বের বয়স প্রায় এক যুগেরও বেশি। ওর ভাবনা বিলাস, জীবন যাপন, রুটিন ওয়ার্ক সবই আমার জানা। বলা চলে বন্ধুত্বের খাতিরে তার একান্ত অলিগলিতেও আমার অবাধ বিচরণ। সেও আমাকে চিনে অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে জানি। বিশ্বাস আর বন্ধুত্বের দাবীতে আমরা কত কিছুই করেছি! থমথমে পুকুরে ঢেউ খেলানোর জন্য ঢিল ছুঁড়ে দিলাম-
-কিরে রিহান, মন খারাপ নাকি?
কোন উত্তর আসেনি। আমিও নিশ্চিত ছিলাম এরকম অবস্থায় কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারে না। বাধ্য হয়ে যদি দেয়ই তা মনগড়া। মনপূত না হওয়ার জন্যে। মুখ ভার, আবারো তাগদা দিলাম কি রে? নড়েচড়ে বসে রিহান। বাম হাতটাই উঁচু করে দেখায়। বাম হাততো বাম হাতই।৮ এতে দেখানোর কি আছে? উঁচু করার কি বা আছে, নির্বাচন করলে তো ডান হাতই দেখায়!
-কি রিহান, কিছু করতে হলে বল?
-না।
-তাহলে?
-এই তো হাত দেখালাম না?
এবার আমার ভেতরও কি এক আচ্ছান্নতা বোধ জেগে উঠলো। নিরীক্ষণের দৃষ্টিতে তার বাম হাত ধরলাম। মাথা আমারও ঘুরে যাওয়ার উপক্রম।
-তোর হাতঘড়ি কোথায়?
-হারিয়ে গেছে।
-কি!

 
আমার সন্দেহের পর্দা উড়িয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসে। হাতঘড়িটা আজ কতদিন ধরে ব্যবহার করছে সে! ব্যবহারের নমুনা তার বামহাতে এখনো ছায়া হয়ে লেগে আছে। এ ঘড়ির কথা সে ভুলবে কিভাবে? এতে জড়িয়ে আছে তার স্মৃতিকথার অফুরন্ত ভান্ডার, যে স্মৃতি তাকে হাসায়, তাকে ডুবায়ে…।
এসএসসি পাস করার অপার স্বপ্নের রোশনীতে আমাদের গা ভাসানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। রিহান আর আমি আগেই ঠিক করেছি- রেজাল্ট যাই হোক, শহরের কলেজেই পড়বো। রেজাল্ট খারাপ হয়নি। শহরের ভালো কলেজেও আমাদের নিরাশ করেনি। দুই বাল্য বন্ধুর তখন থেকেই মেসের জীবন শুরু। আমি কিছুটা সদাসিদে হলেও রিহান একেবারে ডিজুস বয়। আধুনিক, সৌখিন যন্ত্রের ব্যবহার সে খুব আয়ত্ত্ব করলেও ওসবে আমি দূরের মানুষ। মেসের বড়ভাইয়েরা এ সুযোগে ‘গেঁয়ো’ তকমাটা ভালভাবেই লাগিয়ে দেয় আমার কাঁধে রিহানও অনুযোগের সুরে বলে, এটা শীলকূল না চট্টগ্রাম..।
কলেজ-বাসা, এতেই আমাদের বিচরণ। নতুনতের প্রতি সহজাত আর্কষণ থাকলেও নতুন প্রবলভাবে দখল দিতে পারেনি। মেসের বড় ভাইদের ধমক মাটির সাথে মিশে না দিলেও পড়ার টেবিলে বসতে সাহায্য করতো ।
তবে হেড ফোন লাগিয়ে রিহানের মাথা দুলিয়ে পড়ার কায়দা দেখে বুঝতে কষ্ট হতো, সে কি পড়ছে, না স্টেজ শো করছে। তবুও বাহিরে জ্যাম, নাগরিক দূষণের চেয়ে মেসকেই আমাদের নিরাপদ মনে হতো। তিনতলা বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় আমাদের বসবাস। নিচে দোকান, জমিদারের পারিবারিক ব্যবসা। উপর তলা খালি। এমনিতেই ব্যাচেলর ভাড়া দেয়ার উপর কড়া আপত্তি থাকে জমিদারদের। সেখানে আমাদের বড় ভাইয়েরা কিভাবে এত চমৎকার বাসা পেয়েছিল তাতেই লেগে যায় মানসিক দ্বন্দ্ব। কিন্তু তৃতীয় তলার পুরোটায় যখন খালি তখন আবিষ্কার হতে দেরি হল না আমাদের জমিদারের অক্ষমতা। বাইরে অবশ্য সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে ‘ভাড়া দেওয়া হইবে’। প্রতিনিয়ত ছাদে উঠি দুপুরে গোসলের পরে বিকেলের অবসরে । ছাদে বসে এক আধটু কথাও হয় মুঠোফোনে। বন্ধ বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠলে, চারপাশের গুচ্ছ গুচ্ছ গাছপালা দেখলে মনে শান্তি আসে। বিশুদ্ধ হাওয়া লাগে, বিষন্নতা দূর হয়। গ্রামের কথা মনে পড়ে। রোজ দু’তিন বার ছাদে উঠি আমরা দু’জন। কখনো কাপড় শুকাতে দেয়ার ছলে, কখনো বা শহর দেখার লোভে। পড়ালেখার চাপ বেড়ে যাওয়ায় ছাদে তেমন উঠা হয় না আমার শত ব্যস্ত—তা রিহানের ছাদে উঠা বন্ধ করতে পারেনি। অন্য একটা কারণও আছে অবশ্য। আমি বরং এ ব্যাপারে নিশ্চিতই ছিলাম। বিষয়টা আছ করিনি তা নয়। সম্ভাব্য বিপদের কথা বলেও রিহানকে আশাহত করতে পারিনি। আমাদের মেস বিল্ডিংয়ের বিপরীত দিকেরটা জমিদারের। বিকেলে মোলায়েম রোদে জমিদারের নিন্ম মাধ্যমিকে পড়া কণ্যা মুক্তা। রিহান মুক্তা পারস্পরিক মানবিক লেনদেন বিরাট একটা ব্যালেন্স দাঁড়ায় সময়ান্তে। আমার দায়িত্ব যাতে বড় ভাইয়েরা বিষয়টা টের না পায়। রিহান মুুক্তার হৃদয় ঘঠিত ব্যাপারটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও দু’জন বাইরে একান্ত সময় কাটানোর মতো সময় পায়নি। একে তো জমিদারের তীক্ষè নজর, তার উপর বড়ভাইদের নৈতিক তাগিদ। তবে চুরি যাদের ধর্ম পাহারা দিয়ে রুখে তাদের কে? আমরাও পারিনি। রিহান মুক্তার বহু প্রতিক্ষিত অভিসার শেষে ফিরে আসার পর থেকেই রিহানের বামহাতে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে হাতঘড়ি। মুক্তার দেয়া প্রেম নিদর্শন।

 
বিপদের রেশ সবার ঘাড়ে। শেষ পর্যন্ত বাসা ছাড়তে হলো জমিদারের হুংকারে। কানকথা হয়ে জমিদারের স্পর্ধায় দারুণভাবে আঘাত হেনেছে এ খবর। কি ভাড়াটিয়া হয়ে জমিদারের মেয়ের সাথে প্রেম। খড়কের হিংস্র থাবায় রিহান অপরাধী। সহযোগী হিসেবে মেসের সবাই। কান কাটা গেছে অজুহাত ছাড়া বাসা ছাড়লেও রিহানের বামহাত ছেড়ে যায়নি মুক্তার দেয়া হাতঘড়ি। কতটা দিন কেটে গেল…। মুক্তার বিয়ে হয়ে গেল বড়ঘরের ছেলের সাথে। বাসা যেমন বাঁচানো যায়নি। তেমনি ঠেকাতে পারিনি মুক্তার বিয়ে। রিহান আমি এখনো ছাত্রত্বের মূলা ধরে আছি। বিয়ের কথা ভাবাও পাপ! বন্ধুমহলে ঠাট্টার সীমা নেই। তবুও রিহান দূঢ়চিত্ত। সে ঘড়িটা রাখবেই। তাতে বিরহের বেদনা কমে। ছায়া থাকে মুক্তার। প্রেমের সে স্বর্গীয় অনুভূতি শরীর হয়ে ছুঁয়ে যায় মন। মুক্তার দেয়া ঘড়িটা হারিয়ে গেল। পাঁচ বছরেরও অধিক সময় যে ছিল অবিচ্ছেদ্য, সে আজ নেই। অভাবে-অসুখে সুখের পরশে যাকে বদলাতে পারেনি রিহান, আজ সে নিজেই দূরে সরে গেল! মুক্তার বয়স কম, হয়তো সেও ভাবে বুঝতে পারেনি সম্পর্কের সমীকরণ। এহাত ঘড়িটা খানিক বিতৃষ্ণা দূর করেছিল রিহানের। তার চোখে জল। যে অশ্র“ বিষাদের, হারানোর মহাকাব্যিক অথচ বাকহীন ভাষা…।
-রিহান চল, বাসায় যাবো।
-না রে, জিসান তুই যা।
আমি আর কোথায় যাবো? বিষন্ন বন্ধু মানে তো বন্ধুত্বে বিষন্নতা নয়। আমার মনে পড়ে সেদিনও রিহানকে বলেছিলাম আধুনিক যুগের কেউ ওসব ঘড়ি-টড়ি পরে নাকি? আজ বুঝতে পারি,
-পারে।
প্রেমের দান অনেক বড়,
প্রিয়াহারা প্রেমিকের কাছে।

দুঃখিত!