অনেক অনেক বছর হলো আদম আলাইহিস সালাম বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। তাঁর স্ত্রী হাওয়াও আর বেঁচে নেই। তাঁদের মৃত্যুর পর শত শত বছরের ব্যবধানে অনেক বেড়ে গিয়েছিল তাঁদের বংশধারা। এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য নারী পুরুষ আদম সন্তান। ইরাকসহ বর্তমান আরব দেশগুলিই ছিল তাঁদের বসবাসের এলাকা।
আদম (আঃ) এর মৃত্যুর পর দীর্ঘ দিন তাঁর সন্তানেরা ইসলামের পথেই চলে। চলে আল্লাহর পথে। মেনে চলে আল্লাহর বিধান। অনুসরন করে আল্লাহর নবী আদমের পদাংক। তাঁদের মাঝে জন্ম নেয় অনেক ইসলামী নেতা ও আলেম। তাঁরাও তাঁদেরকে সৎ পথে পরিচালিত করার চেষ্টা সাধনা করে যান। এরি মধ্যে হজরত ইদ্রিস (আঃ) ও অতীত হয়ে যান। কিন্তু কালক্রমে আদম সন্তানরা আদম আলাইহিস সালামের শিক্ষা ভুলে যান। ভুলে যান ইদ্রিস আলাইহিস সালামের উপদেশ। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যায় তাঁরা। ইসলামের পথ থেকে তাঁরা সড়ে পড়ে দূরে। বাঁকা পথে চলতে শুরু করে তাঁরা। বিপথে এগিয়ে যায় অনেক দূর।
ফলে তাঁরা শয়তানের অনুসারী হয়ে যায়। পরিনত হয় আত্নার দাসে। তাঁরা অহংকারি হয়ে পড়ে। দুনিয়ার জীবনটাকেই বড় করে দেখতে শুরু করে। এখানকার লাভ ক্ষতিকেই তাঁরা আসল লাভ ক্ষতি মনে করে। শুধু তাই নয়। বরং সব চাইতে বড় অপরাধটিও তাঁরা করে বসে। সেটা হল শিরক। তাঁরা শিরকে নিমজ্জিত হয়। মানে মনগড়া দেবদেবীদের তাঁরা আল্লাহর অংশীদার আর প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেয়। পূজা করার জন্যে তাঁরা মূর্তি তৈরি করে নেয়। তাঁদের কয়েকটি মূর্তির নাম বলছি।
হ্যাঁ, তাঁদের বড় মূর্তিটির নাম ছিলপ ‘অদ্দ’। এ ছিল পুরুষ দেবতা। একটি মূর্তির নাম ছিল ‘সূয়া’। এটি ছিল দেবী। একটির নাম ছিল ‘ইয়াগুস’। এটির আকৃতি ছিল সিংহের মত। একটি মূর্তি ছিল ঘোড়ার আকৃতির। এটির নাম ছিল ‘ইয়াউক’। আরো একটি বড় মূর্তি ছিলো। ঈগল আকৃতির এই মূর্তিটির নাম ছিল ‘নসর’।১ (সুরা নূহ আয়াত ২৩)
এইসব মূর্তির তাঁরা পূজা করতো। এসব অসহায় দেবদেবীকে তাঁরা আল্লাহর অংশীদার বানিয়েছিলো। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন মানুষ হয়েও তাঁরা দুবে গিয়েছিলো তাঁরা কতটা অন্ধকারে। তাঁদেরই এক উঁচু ঘরে জন্ম নেয় এক শিশু। সে বড়ো হয়ে ওঠে তাঁদেরই মাঝে। কৈশোর, তারুণ্য পার হয়ে যৌবনে এসে উপনীত হয়। তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি, যোগ্যতা, দক্ষতা দেখে সবাই ভাবে, ভবিষ্যতে সেই হবে তাঁদের নেতা। নেতৃত্বের সকল যোগ্যতাই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তাঁর মধ্যে। সে কখনো মিথ্যা বলে না। অন্যায় অপরাধে জড়িত হয় না। কারো প্রতি অবিচার করে না। উন্নত পবিত্র চরিত্রের সে অধিকারী।
ফলে সকলেরই সে প্রিয় পাত্র। তাঁর মতো বিশ্বস্ত দ্বিতীয় আর কেউ তাঁদের মধ্যে নেই। কী সেই যুবকটির নাম? নাম তাঁর নূহ। নূহ তাঁদের আশা ভরসার স্থল। তাঁদের পরিকল্পনা মতো নূহ- ই হবে তাঁদের প্রিয় নেতা। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ভিন্ন। আল্লাহ্ নূহকে নবী মনোনীত করেন। তাঁর কাছে অহী পাঠানঃ ‘‘কঠিন শাস্তি আশার আগেই তুমি তোমার জাতির লোকদেরকে সাবধান করে দাও।’’ ২ (সূরা নূহঃ আয়াত ১)
আল্লাহ্ নূহের কাছে তাঁর দ্বীন নাযীল করেন। দ্বীন মানে জীবন যাপনের ব্যবস্থা। আল্লাহর দ্বীনের নাম ‘ইসলাম’। আল্লাহর দ্বীন অনুযায়ী জীবন যাপন না করলে যে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, নিজ জাতিকে সে ব্যাপারে সতরক করার জন্যে আল্লাহ্ নূহ –কে নির্দেশ প্রদান করেন।
নূহ তাঁর জাতির লোকদের বললেন- ‘‘হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব করো। তাঁর হুকুম মেনে চলো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা কেবল তাকেই ভয় করো। আর আমার কথা মেনে চলো। আমার আনুগত্য করো। যদি তাই না করো, আমার ভয় হচ্ছে, তবে তোমাদের উপর একদিন কথি শাস্তি এসে পড়বে। আমি কিন্তু তোমাদের স্পষ্ট ভাষায় সাবধান করে দিচ্ছি।’’
নূহ তাঁদের আর বলেনঃ ‘‘আমি তোমাদের যেভাবে চলতে বলছি, তোমরা যদি সেভাবে চলো, তবে আল্লাহ্ তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। আর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের বাঁচিয়ে রাখবেন। নইলে কিন্তু আগেই ধ্বংস হয়ে যাবে।’’ (সূরা নুহঃ আয়াত ২৪-২৫)
নূহের এই কল্যাণময় হিতাকাঙ্ক্ষী আহবানের জবাবে তাঁর জাতির নেতারা বললোঃ তুমি কেমন করে হলে আল্লাহর রাসুল? তুমি তো আমাদেরই মতো একজন মানুষ।৩ (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ২৭)
সাধারন মানুষের উপর কিন্তু নূহের ছিলো দারুন প্রভাব। তাঁরা জাতির স্বার্থপর নেতাদের চাইতে নূহ-কেই বেসি ভালোবাসতো। নেতারা যখন দেখলো জনগন তো নূহের কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়ছে। তাঁর সাথী হয়ে যাচ্ছে। তাঁদের সমস্ত কায়েমি স্বার্থ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তখন তাঁরা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যে কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। তাঁরা জনগণকে বলেঃ
‘‘দেখো নূহের কাণ্ড, সে তো তোমাদের মতই একজন মানুষ মাত্র। কিন্তু সে নিজেকে আল্লাহর রাসুল বলে দাবী করছে। আসলে ওসব কিছু নয়। সে এভাবে দেশের প্রধান নেতা এবং করতা হতে চায়। কোন মানুষ যে আল্লাহর রাসুল হতে পারে, এমন কথা তো বাপদাদার কালেও শুনি নি। আল্লাহ্ যদি আমাদের মাঝে কোন রাসুল পাঠাতেনই তবে নিশ্চয়ই কোন ফেরেশতা পাঠাতেন। তোমরা ওর কথায় কান দিও না। ওকে আসলে জীনে পেয়েছে।’’ ৪ (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৩-২৫)
এভাবে বৈষয়িক স্বার্থের ধারক এই নেতারা জনগণকে বিভ্রান্ত করে দিলো। তাঁরা নূহের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলো। নূহ দিন রাত তাঁদের সত্য পথে আসার জন্যে ডাকতে থাকেন বুঝাতে থাকেন। নূহ তাঁদের আল্লাহর পথে আনবার জন্যে যে কী আপ্রান চেষ্টা করেছেন, তা আমরা নূহ (আঃ) এর কথা থেকেই জানতে পারি। তিনি মহান আল্লাহর কাছে তাঁর কাজের রিপোর্ট দিতে গিয়ে বলেনঃ
‘‘হে আমার প্রভূ, আমি আমার জাতির লোকদের দিনরাত ডেকেছি তোমার দিকে। কিন্তু আমার আহবানে তাঁদের এড়িয়ে চলার মাত্রা বেড়েই চলেছে। আমি যখনই তাঁদের ডেকেছি তোমার ক্ষমার দিকে, তাঁরা তাঁদের কানে আঙুল ঢেসে দিয়েছে। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দিয়েছে। এসব অসদাচরনে তাঁরা অনেক বাড়াবাড়ি করে চলেছে। তাঁরা সীমাহীন অহংকারে ডুবে পড়েছে। পরে আমি তাঁদের উঁচু গলায় ডেকেছি। প্রকাশে দাওয়াত দিয়েছি। গোপনে গোপনেও বুঝিয়েছি। আমি তাঁদের বলেছি, তোমরা তোমাদের মালিকের কাছে ক্ষমা চাও। তিনি বড় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্যে পানি বর্ষণ করবেন। ধনমাল আর সন্তান দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের জন্যে বাগবাগিচা সৃষ্টি করে দেবেন। নদী-নালা প্রবাহিত করে দেবেন।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ৫-১২)
নূহ তাঁদের বুঝালেন, কেন তোমরা আল্লাহর পথে আসবে না? তিনি তাঁদের বললেনঃ
“দেখনা, আল্লাহ্ কিভাবে স্তরে স্তরে সাতটি আকাশ বানিয়েছেন? চাঁদকে বানিয়েছেন আলো আর সূর্যকে প্রদীপ? আল্লাহই তো তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আবার তিনি এই মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেবেন। তারপর তোমাদের বের করবেন এই মাটি থেকেই। আল্লাহই তো পৃথিবীটাকে তোমাদের জন্যে সমতল করে বিছিয়ে দিয়েছেন, যাতে করে তোমরা উন্মুক্ত পথ ঘাট দিয়ে চলাচল করতে পার।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ১৫-২০) এত করে বুঝাবার পরেও তাঁরা নূহের কথা শুনলনা। তাঁরা নিজেদের গোঁড়ামি আর অহংকারে অটল রইল। তাঁরা নূহকে বললোঃ
আমরা কেমন করে তোমার প্রতি ঈমান আনি? তোমার অনুসারী যে কয়জন হয়েছে, ওরা তো সব ছোট লোক। আমরা তোমাদেরকে আমাদের চাইতে বেশী মর্যাদাবান মনে করি না। বরং আমরা তোমাদের মিথ্যাবাদীই মনে করি।৫ (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ২৭)
তারা আর বললোঃ “আমরাতো তোমাকে দেখছি স্পষ্ট মিথ্যাবাদী।” ৬ (সূরা আল আরাফঃ আয়াত ৬০)
নূহ তাদের আবারো বুঝালেন, “হে আমার জাতির ভাইয়েরা, আমি মোটেও বিপথে চলছি না। আমি তো বিশ্বজগতের মালিকের বানীবাহক। আমি তো কেবল আমার প্রভূর বানীই তোমাদের কাছে পৌছে দিচ্ছি। আমি তো কেবল তোমাদেরই কল্যাণই চাই। আমি আল্লাহর পক্ষ এমন সব জিনিস জানি, যা তোমরা জানো না। হে আমার দেশবাসী, তোমরা একটু ভেবে দেখো, আমি যদি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া সুস্পষ্ট প্রমানের উপর থাকি আর তিনি যদি আমাকে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহও দান করে থাকেন, কিন্তু তোমরা যদি তা না দেখতে পেলে, তবে আমার কি করবার আছে? তোমরা মেনে নিতে না চাইলে আমি তো আর তোমাদের উপর তা চাপিয়ে দিতে পারিনা। হে আমার ভাইয়েরা, আমি যে দিন রাত তোমাদের আল্লাহর পথে ডাকছি, তার বিনিময়ে তো আমি তোমাদের কাছে কিছুই চাই না। আমি তো কেবল আল্লাহর কাছে এর বিনিময় চাই। এতেও কি তোমরা বুঝতে পারছোনা যে, তোমাদের ডাকার এ কাজে আমার কোন স্বার্থ নেই?” ৭ (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬১-৬২, সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ২৮-২৯)
এভাবে আল্লাহর মহান ধৈর্যশীল নবী হজরত নূহ (আঃ) কয়েক শত বছর পর্যন্ত তাদের আল্লাহর পথে ডাকেন। তাদের সত্য পথে আনার অবিরাম চেষ্টা করেন। ধ্বংস ও শাস্তির হাত থেকে তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা তাঁর এই মহৎ কাজের জবাব দেয় তিরস্কার, বিরোধিতা আর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। তাদের সমস্ত বিরোধিতা আর ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় হাজার বছর ধরে তিনি পরম ধৈর্যের সাথে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যান। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তাদের বুঝাবার চেষ্টা করেন।
কিন্তু তাঁর হাজারো মর্মস্পর্শী আবেদন নিবেদনের পর তারা তাঁর কথা শুনলো না। আল্লাহর দ্বীন কবুল করলো না তারা। স্বার্থপর নেতারা জনগণকে বলে দিলোঃ “তোমরা কিছুতেই নূহের কথায় ফেসে যাবে না। তাঁর কথায় কোন অবস্থাতেই তোমরা দেব দেবীদের ত্যাগ করতে পারবেনা। ত্যাগ করতে পারবেনা ‘অদ্দ’ আর ‘শুয়া’ কে। ইয়াগুস, ইয়াউক আর নসরকেও পরিত্যাগ করতে পারবে না। এভাবে তারা অধিকাংশ জনগণকে সম্পূর্ণ বিপথগামী করে দিলো।” ৮ (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ২৩-২৪)
শুধু কি তাই? বরং তারা এর চাইতেও বড় ষড়যন্ত্র করলো। কি সেই ষড়যন্ত্র? তাহলো, তারা আল্লাহর নবী নূহ (আঃ) –কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলো। কুরআনের ভাষায়- ‘ওয়া মাকারু মাকরান কুব্বারা’ – তারা এক বিরাট ষড়যন্ত্র পাকালো। ৯ (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ২২) তারা নূহ (আঃ) কে অহংকারী ভাষায় শাসিয়ে দিলোঃ “নূহ, তুমি যদি বিরত না হও, তবে বলে দিচ্ছি, তুমি হতভাগ্যদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”১০ (সূরা ২৬ শুয়ারা” আয়াত ১১৬)
শুধু তাই নয়, তারা নূহ (আঃ) কে ধমকের সুরে আরো বললোঃ
“তুমি তো এতদিন আমাদের সাথে বড় বেশী বিবাদ করেছ। শুনো, তুমি যে আমাদের ধমক দিচ্ছিলে, তোমার কথা না শুনলে আমাদের উপর বিরাট শাস্তি নেমে আসবে, কোথায় সেই শাস্তি? তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তবে শাস্তিটা নিয়ে এসে দেখাও।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩২)
নূহ (আঃ) বললেন, দেখো তোমাদের শাস্তি দেয়া তো আমার কাজ নয়। সেটা আল্লাহর কাজ। তিনি চাইলে তোমাদের শাস্তি দেবেন। আর তিনি শাস্তি দিতে চাইলে টা তোমরা কিছুতেই আটকাতে পারবেনা। শুধু তাই নয়, তখন যদি আমিও তোমাদের কোন উপকার করতে চাই, করতে পারবোনা। আল্লাহর ফায়সালা পরিবর্তন করার সাধ্য কারো নাই।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৩-৩৪)
এবার মহান আল্লাহ্ অহীর মাধ্যমে তাঁর প্রিয় দাস নূহকে জানিয়ে দিলেন, “হে নূহ, তোমার জাতির যে কয়জন লোক ঈমান এনেছে, তাদের পর এখন আর কেউ ঈমান আনবে না। সুতরাং তুমি তাদের কার্যকলাপে দুঃখিত হইও না।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৬)
আল্লাহর বিচক্ষন বান্দাহ ও নবী হজরত নূহ (আ) এটাকে তাঁর অবাধ্য ও চরম অধপতিত জাতির উপর অচিরেই আল্লাহর আজাব আসবার সবুজ সংকেত মনে করলে। তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন, “আমার প্রভূ, তুমি এই কাফিরগুলির একজনকেও বাঁচিয়ে রেখো না। তুমি যদি তাদের ছেড়ে দাও, তাহলে তারা তোমার বান্দাদেরকে বিপথগামী করে ছাড়বে। আর তাদের ঔরসের প্রজন্মও দূরাচারী আর কাফিরই হবে। হে প্রভূ, তুমি আমাকে আর আমার বাবা মাকে মাফ করে দাও। আর সেসব নারী পুরুষকেও মাফ করে দাও, যারা মুমিন হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ২৬-২৮)
নূহ আরও বললেন, “প্রভূ, এই লোকগুলির মোকাবেলায় তুমি আমাকে সাহায্য করো। ওরা আমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে। আমাকে অস্বীকার করছে। এখন আমার আর তাদের মাঝে তুমি চুড়ান্ত ফায়সালা করে দাও। তবে আমাকে আর আমার সাথী মুমিনদের তোমার পাকড়াও থেকে বাঁচাও। ১১ (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৬, সূরা ২৬ শুয়ারা” আয়াত ১১৭-১১৮)
আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এবার চুড়ান্ত একটা ফায়সালা হয়ে যাবে। কী সেই ফায়সালা? ফায়সালাটা হলো, আল্লাহ্ নূহের জাতির এই দুষ্ট লোকগুলিকে ধ্বংস করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এটাই আল্লাহর নিয়ম। কোন জাতি বিপথগামী হলে, আল্লাহ্ তাদের সত্য পথ দেখানোর জন্যে নবী বা সংশোধনকারী পাঠান। নবীরা তাদের সত্য পথে আনার জন্যে সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালান। অসৎ লোকদের সাংঘাতিক বিরোধিতাড় মূখেও তাঁরা জনগণকে সংশোধন করবার চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যান। কিন্তু তাদের সকল চেস্টার পরও যখন আল্লাহ্ বাস্তবে দেখে নেন যে, এই লোকগুলি আর সত্য পথে আসবে না। তখন তিনি তাদের ধ্বংস করে দেন। নূহ (আঃ) এর জাতির বাস্তব অবস্থাও তাই ছিলো। আল্লাহর নবী নূহ (আঃ) হাজার বছর ধরে তাদের আল্লাহর পথে আনার চেষ্টা করেন। দিনরাত তিনি তাদের বুঝান। গোপনে গোপনে বুঝান। জনসভা, আলোচনা সভা করে বুঝান। তারা শুনতে চায় না, তবু তিনি জোড় গলায় তাদের ডেকে ডেকে বুঝান। তাঁকে দেখলে তারা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে নিত। তিনি কথা বলতে গেলে তারা কানে আঙ্গুল চেপে ধরত। হাজারো রকমের তিরস্কার তারা তাঁকে নিয়ে করতো। বলত এতো ম্যাজেসিয়ান। কিন্তু তিনি তাদের সত্য পথে আনার অবিরাম চেষ্টা সাধনা চালিয়েই যান। কিছু যুবক অবশ্য ঈমান আনে। কিন্তু জাতির সর্দার নেতারা পরবর্তী সময়ে জনগনের আল্লাহর পথে আসার সকল পথ বন্ধ করে দেয়। তখন তারা সবাই আল্লাহর চরম বিরোধী হয়ে যায়। তাদের সত্য পথে আসার আর কোন সম্ভাবনাই আর বাকী থাকে না। এমনকি তারা আল্লাহর নবীকে হত্যা করার পর্যন্ত ষড়যন্ত্র করে। অবশেষে আলাহ তাদের পৃথিবী থেকে ধ্বংস করার ফায়সালা করেন। তিনি নূহ (আ)-কে নির্দেশ দেন, “নূহ, আমার তদারকীতে তুমি একটি নৌযান তৈরি করো।”১২ (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৭)
আল্লাহ্ নূহ (আ)-কে আর বলে দিলেন, “চুলা ফেটে যখন পানি উঠবে, তখন তুমি নৌযানের মধ্যে সব রকমের জীবজন্তু এক জোড়া এক জোড়া করে উঠাবে। তবে তাদের উঠাবেনা যাদের ব্যাপারে আমি ফায়সালা দিয়ে দিয়েছি, যে তারা ডুবে মরবে।”১৩ (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৭)
আল্লাহর নবী নূহ (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে তৈরি করতে লাগলেন এক বিশাল নৌযান। জাতির অসৎ নেতারা যখন সেখান দিয়ে যাতায়াত করতো, তারা নৌযান তৈরি নিয়েও নূহের প্রতি বিদ্রুপ করতো। তারা তাঁকে তিরস্কার করতো।”১৪ (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৮) আসলে তাদের আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি ঈমানই ছিলো না। তারপর কি হলো? তারপর একদিন নৌযান তৈরি শেষ হলো। নূহ (আঃ) আল্লাহর নির্দেশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর? এরপর একদিন হঠাৎ দেখা গেলো চুলা ফেটে মাটির নিচ থেকে অনর্গল পানি বেরুতে লাগলো। নূহ (আঃ) বুঝতে পারলেন আল্লাহর নির্দেশ এসে গেছে। নূহ ঈমানদারদের ডেকে বললেন, তোমরা জলদি করে নৌযানে ওঠে পড়ো। তিনি তারাতারি করে সমস্ত ঈমানদার লোকদের নৌযানে তুলে দিলেন। সব রকমের জীব জন্তু একেক জোড়া তুলে নিলেন। দুজন ছাড়া তাঁর পরিবারের সকলকে তুলে নিলেন।
কে সেই দু’জন? এদের একজন নূহ (আঃ) এর স্ত্রী। এই মহিলা কিন্তু বাপদাদার জাহেলি ধর্ম অনুসারীদের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে আল্লাহও তাঁকে প্লাবনের পানিতে ডুবিয়ে মারলেন। আরেক জন কে? আরেকজন হলো স্বয়ং নূহ (আঃ) এর হতভাগ্য পুত্র। সেও ঈমান আনে নি। নির্দেশমতো সবাই যখন নৌযানে উঠে গেল, তখন কি হলো? দেখতে দেখতে তখন ঘটে গেল এক অবাক কাণ্ড। চারিদিকে যমিন ফেটে সৃষ্টি হলো অসংখ্য ঝর্ণাধারা। প্লাবনের বেগে মাটির নিচে থেকে উঠতে শুরু করলো পানি আর পানি। সাথে সাথে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। নিচে থেকেও উঠছে পানি। উপর থেকেও পড়ছে পানি। চারিদিকে পানি আর পানি। পানির উপরে ভাসতে শুরু করলো নৌযান। নূহ (আঃ) দোয়া করলেনঃ
“আল্লাহর নামে শুরু হচ্ছে এর চলা আর আলাহর নামেই থামবে এ নৌযান। আমার প্রভূ অবশ্যি অতিশয় ক্ষমাশীল দয়াময়।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৪১)
অদূরেই নূহের কাফির পুত্রটি দাঁড়িয়ে ছিলো। নূহ দেখলেন, পাহারের মতো উঁচু হয়ে এক বিরাট ঢেউ এগিয়ে আসছে। তিনি চিৎকার করে ছেলেকে ডেকে বললেন, এখনো সময় আছে ঈমান এনে আমাদের সাথী হয়ে যা। কাফিরদের সাথী হইসনে। এক্ষুনি ডুবে মরবি।”
অসৎ ছেলেটি বললোঃ “আমি পাহাড়ে উঠে যাবো, পানি আমাকে কিছুই করতে পারবেনা।” নূহ (আঃ) বললেন- একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া আজ কেঊ রক্ষা পাবে না।” এরি মধ্যে এক বিরাট ঢেঊ এসে ছেলেকে তলিয়ে নিয়ে গেলো।১৫ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪২-৪৩)
আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, নবীর পথে না চলার পরিনতি কতো ভয়াবহ। ঈমানের পথে না এলে নবীর ছেলে হলেও আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। নবীর স্ত্রী হলেও মুক্তি পাওয়া যায়না। দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির একমাত্র পথ হলও ঈমানের পথ, নবী দেখানো পথ। এরপর ঘটনা কি হলো? এরপর পানিতে সমস্ত কিছু ভেসে গেলো। বড় বড় পাহাড় পানির মধ্যে তলিয়ে গেলো। দিন যায়, রাত আসে। মাস যায়, মাস আসে। আকাশ আর পাতালের পানিতে পৃথিবী তলিয়েই চলেছে। নূহ (আঃ) এর নৌযানের মানুষ আর প্রাণীগুলো ছাড়া সমস্ত জীবজন্তু মরে শেষ। একটি মানুষও আর বেঁচে নেই। সব দুষ্ট লোক আর আল্লাহর নবীর শত্রুরা ধ্বংস হয়ে শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ্ তায়ালা এভাবে তাঁর প্রিয় নবী নুহ (আঃ) ও তাঁর সাথীদেরকে রক্ষা করলেন যালিমদের অত্যাচার ষড়যন্ত্র থেকে। তাই তিনি নূহ (আঃ)- কে নির্দেশ দিলেন এই ভাষায় শোকর আদায় করতেঃ
“শোকর সেই মহান আল্লাহর, যিনি যালিমদের হাত থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন।” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৮)
সেই সাথে আল্লাহ্ নূহ (আ)-কে এই দোয়া করতেও নির্দেশ দিলেনঃ
“প্রভূ, আমাকে বরকতপূর্ণ স্থানে অবতরন করাও, আর তুমিইতো সর্বোত্তম স্থানে অবতরন করিয়ে থাকো।” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৯)
অবশেষে আলাহ একদিন হুকুম দিলেনঃ “হে পৃথিবী সমস্ত পানি গিলে ফেলো, হে আকাশ বর্ষণ বন্ধ করো।’’১৬ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪৪)
মহান আল্লাহর নির্দেশে আকাশ পানি বর্ষণ বন্ধ করলো। পৃথিবী তাকে ডুবিয়ে রাখা সমস্ত পানি চুষে খেয়ে ফেললো। তারপর কি হলো? তারপর নূহ (আঃ) এর নৌযানটি জুদি১৭ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪৪) পাহাড়ের চুড়ায় এসে ঠেকলো। জুদি পাহাড় কোথায় জানেন? আর্মেনিয়া থেকে কুর্দিস্তান পর্যন্ত রয়েছে এক দীর্ঘ পর্বতমালা। এই পর্বতমালারই একটি নাম হলো জুদি পর্বত। এটি কুর্দিস্তান অঞ্চলে ইবনে উমর দ্বীপের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। মুসলমানরা হজরত উমর (রাঃ) এর খিলাফত আমলে যখন ইরাক ও আল জাজিরা বিজয় করেন, তখন মুসলিম সৈনিকদের অনেকেই জুদি পাহাড়ের উপর নূহ (আঃ) এর নৌযান দেখতে পান।
নৌযান জুদি পর্বতে ঠেকার পর কি হলো? এবার আল্লাহ্ নির্দেশ দিলেনঃ “হে নূহ, নেমে পড়ো। নেমে আসো পৃথিবীতে। এখন থেকে তোমার প্রতি আর তোমার সংগী সাথীদের প্রতি আমার নিকট হইতে রইলো শান্তি আর প্রাচুর্য।”১৮ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪৮)
তাঁরা নেমে আসেন পৃথিবীতে। সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন আল্লাহর অনুগত দাস হিসেবে। এভাবেই আল্লাহ্ সৎ লোকদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে দেন পৃথিবীর বুকে।
সবশেষে কয়েকটি খবর জানিয়ে দিচ্ছি
১। কুরআনে নূহ (আঃ) এর নাম উচ্চারিত হয়েছে তিতাল্লিশ বার।
২। যে সব সুরায় নূহের কথা ও কাহিনী উল্লেখ হয়েছে। সেগুলো হলোঃ আলে ইমরান, আনয়াম, নিসা,আরাফ, তাওবা, ইউনুস, হুদ, ইবরাহীম, বনি ইসরাইল, মরিয়ম, আম্বিয়া, হজ্জ, মুমিনুন, ফুরকান, শুয়ারা, আন কাবুত, আহযাব, সাফফাত, সোয়াদ, মুমিন, শুরা, কাফ, যারিয়াত, নাজম, কামার, তাহরীম, নূহ।
৩। নূহ (আঃ) এর কাহিনী বিস্তারিত জানা যাবে সূরা আরাফ, হুদ, মুমিনুন, শোয়ারা এবং নূহে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।