গল্পের অষ্টদশ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
বহুকাল এমন খাবার খায়নি দুজনে। সরে ভরা ঘন দুধ, মর্তমান কলা, বাতাসা আর চিড়ে যে কী অমৃত তা বলে শেষ করা যায় না। শীতলালক্ষ্মী একেবারে মুক্তহস্ত হয়ে খাওয়াচ্ছেন। ফলে দুজনেরই দেদার খেয়ে পেট একেবারে টাই টাই হয়ে গেল।
শীতলালক্ষ্মী দুঃখ করে বললেন, আহা রে বাছারা, কতকাল বুঝি পেট ভরে খাসনি, তা কেমন চোর তোরা যে ভরাপেট খাওয়া জোটে না?
জগা করুণ গলায় বলে, ঠাকুমা, আমি খুবই ছিচকে আর ছোটোখাটো চোর, দিন চলে না।
শীতলালক্ষ্মী রামপ্রসাদের দিকে চেয়ে বললেন, আর তুই! তুই কেমন চোর রে বাবা?
রামপ্রসাদ খুবই লজ্জার সঙ্গে মাথা নামিয়ে বলল, হামি তো বড়া চোর আছি বুড়িমা। হামার ঘর মে ছোটো ভেস, তিনগো গাই, চার বকরি, সবকুছ আছে।
তা বাবা, তোরা বড় চোর আর ছোটো চোর দুটিতে মিলে আমার একটা কাজ উদ্ধার করে দিবি?
হাঁ হাঁ, কিউ নেহি? বোলেন বুড়িমা, যে কাজ বলবেন করিয়ে দিব।
জগা বলল, আজ্ঞে শক্ত কাজ হলে আমি কি আর পেরে উঠব ঠাকুমা? ফলার খেয়ে যে নিজেকেই টেনে দাঁড় করাতে পারছি না!
একগাল হেসে শীতলালক্ষ্মী বললেন, ওরে, তোদের দেখছি মরা পেট। এটুকু আর কী খেলি বাছা? আমার দাদাশ্বশুর আস্ত পাঁটার মাংস খেয়ে উঠে আস্ত কাঁটাল দিয়ে দু’সের দুধের ক্ষীর খেতেন। তবে তাঁর ঢেঁকুর উঠত। আর কী ঢেঁকুরই উঠত বাপ, যেন বাঘ-সিংহী ডেকে উঠল। আমার শ্বশুরমশাইয়ের কথা শুনবি? আস্ত একথালা বিশসের কাতলা মাছের লেজ থেকে মুড়ো অবধি সাপটে খেতেন। তার পর এক হাঁড়ি দই আর পঞ্চাশটা রাজভোগ তাঁকে কতবার খেতে দেখেছি।
রামপ্রসাদ হাতজোড় করে বলল, উ সব দেওতা আছেন। হামি লোগ ছোটামোটা আদমি আছে বুড়িমা। যদি আউর খিলাবেন তো হামার দম নিকলে যাবে।
জগাও করুণ গলায় বলল, আজ আর নয় ঠাকুমা। অর্ধেকটা বাকি থাক, কাল আবার হবে খন।
আচ্ছা বাবারা, তোদের আর খেতে হবে না, তা বলি বাছারা, আমার একটা ছোটাে কাজ করে দিবি?
আজ্ঞে বলে ফেলুন।
কাজ খুব সোজা, তোদের গাও ঘামাতে হবে না। সরলার বাড়ি চিনিস তো !
ঘাড় নেড়ে সোৎসাহে জগা বলল, খুব চিনি, খুব চিনি। ব্যস, তাহলে তো অর্ধেক কাজ হয়েই গেল।
পুরো কাজটা কী ঠাকুমা।
ওরে সে খুব সোজা কাজ। তার বালিশের পাশে একটা কাঠের বাক্স থাকে। ঘুম না ভাঙিয়ে বাক্সটা আমাকে এনে দিবি বাপ?
জগা বেশ জোরেই হোঃ হোঃ করে হাসল। তারপর বলল, কার ঘুম ভাঙাবো ঠাকুমা? তিনি তো কবেই পটল তুলেছেন।
ওমা ! বলিস কি? সরলা মরেছে কবে?
তা হল অনেক দিন।
ওমা! ছুড়ি তো এই সেদিনও এক্কাদোক্কা খেলত জামতলায়। একরত্তি বয়স।
জগা মাথা নেড়ে বলে, একরত্তিই বটে, তা একশ পুরে তার ওপর আর চার-পাঁচ বছর ধরুন।
শীতলালক্ষ্মীর গালে হাত। চোখ বড় বড় করে বললেন, বলিস কি রে মুখপোড়া ! সে যে আমার চেয়েও দশ-বারো বছরের ছোটো
তা হতে পারে হতে বাধা কিসের?
হতে পারে মানে? সরলার যদি একশ চার হয় তাহলে আমার কত হচ্ছে?
জগা বলে, তা হবে একশ পনেরো-ষোলো। কিছু বেশিও হতে পারে।
ওরে বাপ রে ; এত বয়স হয়ে গেল নাকি রে আমার! তা কেউ তো বয়সের কথাটা আমাকে বলেনি এতদিন। সরলা যে মরেছে সেও তো টের পেলুম না। হ্যাঁ রে বানিয়ে বলছিস না তো!
জগা এক গাল হেসে বলে, না ঠাকুমা, বানিয়ে বলব কেন? দু-চার বছর এদিক ওদিক হতে পারে, তবে মোটামুটি হিসেবটায় খুব গণ্ডগোল পাবেন না। সরলা ঠাকুমা বেঁচে থাকতে তো ও বাড়িতে কম ঘুরঘুর করিনি। রাতবিরেতে গেলে সরলা ঠাকুমা ঘরের ভেতর থেকে কথাবার্তাও বলতেন। তখনই বলেছিলেন, তাঁর তখন একশ চার চলছে। তাও ধরুন চার পাঁচ বছর তো হয়েই গেল। বেঁচে থাকলে সরলা ঠাকুমার বয়স একশ দশটশই হত।
শীতলালক্ষ্মী তাড়াতাড়ি দুহাতে কান চাপা দিয়ে বললেন, রক্ষে কর, বয়সের হিসেব আর শুনতে চাই না। ফস করে আবার চার-পাঁচ বছর বেড়ে যাবে। যা ছিল তাই থাক।
থাকল ঠাকুমা, তা কিসের বাক্সের খোঁজ করছিলেন যেন?
সরলার বাড়িতে একখানা কাঠের বাক্স আছে রে বাপ। সে যক্ষীবুড়ির মতো আগলে রাখে। ওই বাক্সখানা যদি এনে দিস বাপ, তবে বুড়ো বয়সে একটু সুখে মরতে পারি।
বাক্সে কী আছে গো ঠাকুমা যে সুখে একেবারে ভেসে যাবেন!
ধনরত্ব নয় রে বাবা, সেদিকে টুটু বাক্সের মধ্যে আছে সাতটা কড়ি আর সাতটা তামার পয়সা।
রামপ্রসাদ আর জগা পরস্পরের দিকে তাকাল। তারপর রামপ্রসাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, উ বাক্সো তো গায়েব হয়ে গেছে ঠাকুমা।
অ্যাঁ ! গায়েব হয়ে গেছে মানে ! গায়েবটা করল কে
রামপ্রসাদ উদাস গলায় বলল, ক্যা মালুম! উসি বাক্স লিয়েই তো হামি মুলুক থেকে এতো পরেসান হয়ে আসলাম। কিন্তু ঐ বাড়ির মধ্যে ছোটো গুণ্ডা লোক ঘুসে বৈসে আছে। আজ হামাকে পাকড়েছিল। দুচার ঘুসস ভি মারল। তো বুড়ি মা, ওই সাতটো কড়ি আর সাতটো পইসার বেপারটা কী আছে বলুন তো!</div>
শীতলালক্ষ্মী খুবই ভাবিত হয়ে পড়ে বললেন, সে বাছা বলে আর কী লাভ?
জগা বলল, ওই বাক্সটা নিয়ে খুব কথা হচ্ছে গো ঠাকুমা। কোন হাতি ঘোড়া হবে বাক্সটা দিয়ে?
শীতলালক্ষ্মী দুঃখের গলায় বললেন, হত তো অনেক কিছুই রে বাপ। কিন্তু আর তো কিছু হওয়ার নয়।
বাক্সের রহস্যটা কী ঠাকুমা ?
সে আছে বাছা। ভেঙে বলা যাবে না ।
কেন ঠাকুমা? অসুবিধে কী?
শীতলালক্ষ্মী মুখখানা তোম্বা করে বললেন, আমিই কি তার সবটা জানি রে বাছা? তবে শুনেছি, সাতপয়সার হাট নামে একটা গ্রাম আছে। সেখানে সাতকড়ি নামে একটা লোক থাকে।
তারপর ?
আমি ঐটুকু জানি। বাকিটুকু ওই সাতকড়ি জানে।
মাথা নেড়ে রামপ্রসাদ বলল, সমঝমে আসছে না বুড়িমা।
জগা বলল, আমিও বুঝতে পারছি না। সাতপয়সার হাট নামে কোনও গ্রামের নাম জন্মেও শুনিনি।
শীতলালক্ষ্মী বলল, ওরে আছে, আছে। সে যে মস্ত ডাকাতের গাঁ ছিল।
সে কবে ছিল কে জানে। আপনি তো আর আজকের লোক নন। কত যেন বয়স বেরোলো আপনার হিসেবে! দেড়শো নাকি ঠাকুমা?
ওরে বলিসনি, বলিসনি! শুনলে হৃৎকম্প হয়। আমার কথাটা ভাল করে শোন। বাক্সখানা কিন্তু সরলার নয়।
তবে কার?
সরলা দুটো চোরকে লাগিয়ে নিতাই পালের বাড়ি থেকে চুরি করিয়ে আনিয়েছিল।
নিতাই পাল?
হ্যাঁ রে বাবা, নিতাই পাল। কিন্তু ও জিনিস নিতাই পালেরও নয়। তবে কার? শোনা যায়, নিতাই পাল ওটা কোন কাপালিকের কাছ থেকে চুরি করে এনেছিল।
ও বাবা ! একটা বাক্সের জন্য এত?
হ্যাঁ রে বাবা, ও বাক্স বড় সামান্য নয়।
তাহলে এখন কী করব ঠাকুমা?
বাক্সটা কে চুরি করল এটুকু খুঁজে দেখবি বাবা?
জগা মাথা চুলকে বলল, সাতপয়সার হাট আর সাতকড়ি যখন জানা গেছে তখন বাক্সটা না হলেও চলবে। রহস্য তো ভেদ হয়েই গেছে।
শীতলালক্ষ্মী বললেন, না রে না, ওই বাক্স না নিয়ে গেলে সাতকড়ি যে রা কাড়বে না।
আহা, সাতটা কড়ি আর তামার পয়সা জোগাড় করা তো আর শক্ত নয়। কাঠের বাক্সও মেলা পাওয়া যাবে।
তোর বুদ্ধির বলিহারি যাই বাপু। এই বুদ্ধি নিয়ে চুরি করে বেড়াস! এই জন্যই তোর কিছু হয় না। ওই কড়ি আর পয়সা আর পাঁচটা কড়ি আর পয়সার মতো তো নয়। ওর মধ্যে অনেক কারিকুরি আছে। তেমন চোখ নাহলে ধরতে পারবি না।
ভোর না হতেই সুজনের বাড়িতে মেলা লোক এসে হাজির। নগেন দারোগা, গদাই নস্কর, পবনকুমার, মহেন্দ্রচন্দ্র দেবরায়, শহিদলাল, নয়ন হাতি, বজ্র সেন এবং রামহরিও, সকলেই বেশ উদ্বিগ্ন।
নগেন বললেন, “আগেই বলেছিলুম আপনাকে, বাড়িতে পাহারা বসিয়ে দিই, তা হলে আর বিপদটা হত না। তা লোকগুলোর চেহারার একটা বিবরণ দিতে পারেন কি?”
সুজনের মাথায় ব্যান্ডেজ, শরীরও দুর্বল। মৃদু হেসে বললেন, “না, তাদের মুখ ঢাকা ছিল। ভাল করে কিছু বোঝবার আগেই মাথায় কী দিয়ে যেন মারল। আর কিছু মনে নেই।”
“কী কী নিয়ে গেছে ভাল করে খুঁজে দেখেছেন?”
“এখন ততটা জোর পাচ্ছি না গায়ে। তবে আমার বাড়িতে দামি জিনিস তেমন কিছু থাকে না। একটা ঘড়ি পাচ্ছি না মনে হচ্ছে।”
“আলমারিটা নাকি ভাঙা ছি ?”
“হ্যাঁ, তাও ছিল। তবে বেশি কিছু নেয়নি।”