গল্পের সপ্তদশ তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
জগা বলল, “তখন থেকে জুতো-জুতো করে চেঁচিয়ে মরছে দ্যাখো! কেমন চোর তুমি যে জুতো খুলে চুরি করতে ঢোকো? চুরি তো আর পুজো আচ্চা নয় যে জুতো খুলতে হবে!”
“তু দো দিনক ছোকরা, তু কুছু জানিস না। হামারা নাগরা জুতির এইসান আওয়াজ হয় কি মুর্দা ভি উঠকে বৈঠেগা, তাই লিয়ে জুতি খুলকে ঢুকতে হয়।”
“তা আমন বিটকেল জুতো পরোই বা কেন?”
“অ্যায়সা নাগরা জুতি কাঁহা মিলবে রে? তুদের মতো জুতি থোড়াই আছে। হামারা মুলক লালগোপালগঞ্জকা সীতারাম চামরিকা আপনা হাথে বনায়া গয়া চিজ। নিচে চালিশ গো বুলাকি হ্যায়, উস জুতি বিশ-পঁচিশ সালমে ভি কুছ নেহি হোগা।”
জগা খিঁচিয়ে উঠে বলল, “তবে জুতো নিয়েই থাকো, আমি চললাম। বাড়ির লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে এল বলে।”
রামপ্রসাদ খুব দুঃখের গলায় বলল, “জুতির তু কী জানিস রে জগুয়া ! তু তো নাঙ্গা পায়ে ঘুরে বেড়াস।
কথাবার্তার মধ্যেই বাইরে একটা শোরগোল শোনা গেল। কারা যেন চেঁচাচ্ছে। কে একজন হেকে বলল, “খবৰ্দার, পালাতে যেন না পারে। বল্লম দিয়ে গেঁথে ফেলবি, বাড়ি ঘিরে ফেল এক্ষুনি “।
জগা আর রামপ্রসাদ দুজনে জানালার কাছে পৌঁছে চোখের পলকে জানালা গলে বাইরে পড়ল। তারপর আমবাগানের ভেতর দিয়ে ছুটতে লাগল দুজনে।
“এ জগুয়া, কাঁহা যাচ্ছিস রে?”
“আর কোন চুলোয় যাব! নিজের বাড়ি যাচ্ছি।”
“হাঁ হাঁ, তো হামাকে ভি লিয়ে যাবি তো !”
জগা তেতো গলায় বলে, “তা আসতে হয় এসো, তবে তা বলে সেখানে জামাই-আদর পাবে না কিন্তু ” ।
“ভাত খেলাবি তো !”
“এত রাতে ভাত কোথায় পাব ? চিড়ে আর গুড় দিতে পারি।”
“থোড়া দুধ মিলবে নাই ?”
“এঃ, দুধ ! তোমার বায়নাক্কা তো কম নয় ?”
রামপ্রসাদ ভারি বিরক্ত হয়ে বলে, “তু তো একদম ছোটমোটা চোর আছিস রে জগুয়া। হামার বাড়িতে যাবি, দেখবি ছোঠো ভেস, তিনগো গাই, চার বকরি, সবসুদ্ধ আছে।”
“ছোট চোর বলে কি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছ নাকি? বেশ তাহলে আমার বাড়ি গিয়ে তোমার কাজ নেই। তুমি রাস্তা দ্যাখো।”
“গুসসা হল নাকি রে তুহার? আরে ঠিক আছে, তুকে হামি আইস চোরি শিখিয়ে দিব যে তু ভি ভেইস গাই সব কিনতে পারবি।
জগা ঘরে এসে একটা কুপি জ্বালল। তারপর দুজনে বসল চুরির জিনিসপত্র দেখতে।
পাঞ্জাবির সোনার বোতামটা খুলে হাতে একটু নাচিয়ে নিয়ে জগা খুশির গলায় বলল, “ভরিখানেক হবে, কী বলো রামপ্রসাদদাদা?”
রামপ্রসাদ বোতামটা হাতে নিয়ে কুপির আলোয় একটু দেখে গম্ভীর হয়ে জিনিসটা জগার হাতে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “তু তো একদম বুরবক আছিস রে জগুয়া ?”
“কেন, বুরবকের আবার কী দেখলে?”
“উয়ো বুতাম সোনার থোড়াই আছে! উ তো গিলটি মাল।”
“অ্যাঁ !”
“উসি লিয়ে তো বলছি কি তু একদম বুরবক আছিস।”
“সুটকেসটা খুলে খানকতক জামাকাপড় পাওয়া গেল বটে, কিন্তু টাকাপয়সা ঢুঁঢুঁ।”
জগা ভারি দুঃখের গলায় বলে, “জামাইটা তো বড্ড ঠকিয়েছে আমাদের দেখছি। শুনেছিলাম জামাই বড়লোক, মেলা পয়সা ।”
রামপ্রসাদ ঝাঁটা গোঁফের ফাঁকে হেসে বলল,“হাঁ হাঁ, বড়লুক আছে তো কী আছে? চোরচোট্ট কে লিয়ে কি সুটকেসের ভেতর রুপেয়া পইসা থোড়াই রাখবে? রুপেয়া পইসা আউর কৌন জঘায় রেখেসে। হামি হলে ঠিক বাহার করে লিতাম। তু ঘরে ঘুষে কাম বিলা করে দিলি।”
জগা ফোঁস করে উঠে বলল, “যত দোষ এখন আমার না? মানিব্যাগে পচিঁশ টাকাই ছিল। রামপ্রসাদ উদাস গলায় “উ তু লিয়ে লে। পঁচিশ রুপেয়া সে হামারা কী হোবে! তু ছোটামোটা চোর আছিস, তু হি লিয়ে লে।”
এ-কথায় ভারি অপমান বোধ করল জগা । বলল, “আমি ছোট চোর? আর তুমি কোন বড় চোরটা শুনি? আহা, আমাকে চুরি শেখাতে এলেন! নিজে তো নাগরা জুতোটা পর্যন্ত খুঁজে পেলে না!”
রামপ্রসাদ একটা শ্বাস ছেড়ে উঠে পড়ল। গাঁয়ের মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবিটা খুলে নিংড়ে নিয়ে গাটা একটু মুছে নিয়ে বলল, “তু আভি আরাম কর। হামি চললাম দুসরা শিকার চূড়তে।”
জগা অবাক হয়ে বলে, “বেরোচ্ছ! বাঃ চিড়ে গুড় খাবে না?”
“চুড়া গুড় দিয়ে কী হোবে রে জগুয়া? চুড়া গুড় বসে বসে খেলে কি কামাই হোবে?”
জগা টপ করে উঠে বলল, “কোথায় যাবে রামপ্রসাদদাদা, আমাকেও সঙ্গে নিয়ে চলো।”
“তু তো কাম বিলা করে দিবি।”
“না, না, যা বলবে তাই শুনবো দেখো, মা-কালীর দিব্যি।”
“তবে শুনে লে। জবান বন্ধ রাখবি আর কোই খতরা হোলে মগজ ঠাণ্ডা রাখবি। হামি যৌন বলবে তাই করবি”।
“ঠিক আছে দাদা, তাই সই। এ যা রোজগার হল আজ তা একেবারে যাচ্ছেতাই। চলো যদি একটা দাঁও মারা যায়।”
ঝড় থেমে গেছে। বৃষ্টিটাও প্রায় ধরে এল। এখন টিপ টপ করে পড়ছে। জলকাদার রাস্তায় রামপ্রসাদ আর জগা পাশাপাশি হাঁটছে।
“কোন বাড়ি যাবে গো রামপ্রসাদদাদা ?”
“চল, ঢুঁড়ে লিব ।”
চাপা গলায় জগা বলে, “আহা আমি তো এগাঁয়েরই লোক। সব বাড়ি চেনা। কোন বাড়িতে কী কী মালকড়ি আছে তাও জানা। যে-বাড়ি চলো চোখ বুজে নিয়ে যাব।”
একটা জংলা জায়গা পেরিয়ে জমিদারবাড়ির ফটকের সামনে পড়ে জগা বলল, “এই হল জমিদার মহেন্দ্রচন্দ্রর বাড়ি…আর ওই যে হোমিওপ্যাথ বিশু দত্তর ঠেক। আর একটু এগিয়ে বাঁ ধারে যে পাকা বাড়িটা দেখবে সেটায় নয়ন হাতি থাকে—মস্ত পালোয়ান। আর ই যে…”
“তুকে বলেছি কিনা জবান বনধ রাখবি।”
“ও হ্যাঁ, তা তো ঠিক। আচ্ছা আর কথা কইব না।”
একটা মাঠকোটা পেরনোর সময়ে হঠাৎ একটা খুনখুনে সরু গলায় কে যেন বলে উঠল, “কে যায় রে বাপ, চোর নাকি?”
জগা টপ করে উবু হয়ে বসে পড়ল। সর্বনাশ! এ যে গোপেশ্বরের বুড়ি মা শীতলালক্ষ্মী !
বুড়ি ভারি মিঠে করে বলে, “চোর নাকি রে বাপ ! চোর হলে একটু ঘরে আয় বাছারা, জরুরী কাজ আছে।”
রামপ্রসাদ ফিরে তাকিয়ে জগাকে বসা দেখে চাপা গলায় বলল, “বসিয়ে আছিস কাহে রে? ভাগবি তো !”
জগা চাপা গলায় বলে, “ডাকছে যে !”
“সো হামি শুনিয়েছি। ঘরে ডেকে লিয়ে পিটাই করবে।”
“আরে না, না । বুড়ি একা একটা ঘরে থাকে।”
জানালা খুলে শীতলালক্ষ্মী দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ের গাঁটে ব্যথা হয়ে গেল বাপ। কখন থেকে একটা চোরের জন্য হাপিত্যেশ করে চেয়ে আছি। তা চোরেরও কি আজকাল আকাল পড়ল? আয় বাছারা, ঘরে আয়, ভয় নেই, লোকজন ডাকব না।”
বুড়ি দরজা খুলে লণ্ঠন হাতে দাঁড়াল। দু’জন গুটিগুটি এগোতেই এক গাল হেসে বলল, “আহা রে, ভিজে যে একসা হয়েছিস। আয়, গামছা দিচ্ছি, গা-মাথা মুছে বোস।”
হতভম্ব রামপ্রসাদ জগার দিকে চেয়ে বলে, “এ বুড়িয়া পাগলি আছে নাকি রে?”
“আরে না। চলোই না মজাটা দেখি, আমাদের রামে মারলেও মারবে, রাবণে মারলেও মারবে । যাঁহা বাহান্ন, তাঁহা তিপ্লান্ন।”
“ও বাত তো ঠিক আছে।”
ঘরে ঢুকতেই শীতলালক্ষ্মী আহ্বাদে ডগমগ হয়ে বললেন, “বাঃ বাঃ একটা চোর চেয়েছিলাম, ভগবান একেবারে একজোড়া পাঠিয়ে দিয়েছেন। তা বোস বাছারা, ঘন দুধ আছে, চিড়ে আছে, মর্তমান কলা আছে, ফেনী বাতাসা আছে, একটু ফলার করবি?”
“এ জগুয়া, ফল্লার কী চিজ আছে রে?”
“খুব ভাল জিনিস। বসে যাও।”
শীতলালক্ষ্মী দুটো আসন পেতে দিলেন মেঝেতে। তারপর দুটাে জাম বাটিতে ঘন দুধ, অনেক চিড়ে, কলা আর বাতাসা দিয়ে বললেন, “খা বাছারা, আগে পেট ভরে খা, তারপর কাজের কথা হবেখন “।
গল্পের সপ্তদশ তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।